জ্বলদর্চি

পৌষ উৎসব ও পার্বণ ও মেলা /অমর সাহা

পৌষ উৎসব ও পার্বণ ও মেলা

অমর সাহা


পৌষ সংক্রান্তির পৌষ-পার্বণ বাঙালির অন্যতম শস্য উৎসব ৷ এই উৎসব বাঙালির ফসল সঞ্চয়ের পরিপূর্ণতার পার্বণ ৷ বাংলার পার্বণের উৎসব ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের পোঙ্গল উৎসবের সঙ্গে তুলনীয় ৷ সারা বছর অক্লান্ত পরিশ্রমের পর গ্রামীণ সমাজ সম্পদের দেবী লক্ষ্মীকে আঁকড়ে ধরে রাখতে ঘরে ঘরে লক্ষ্মীপুজো করে ৷ বাংলার বৃহৎ অংশে এই উৎসব হলেও জঙ্গলমহলেই এর গুরুত্ব বেশি ৷ সূর্য ওইদিন ধনুরাশি থেকে মকররাশিতে গমন করে ৷ তাই মকর পৌষ সংক্রান্তিকে লোকে মকর সংক্রান্তি বলে ৷ পৌষ পার্বণের অন্যতম অংশ পিঠে পায়েসের উৎসব ৷ ওইদিন সকাল সকাল নদীতে বা পুকুরে স্নান সেরে এসে নতুন পোশাক পরার নিয়ম আছে ৷ এরা নতুন পোশাক পরার পর সর্বপ্রথম চিড়ে আর নারকেল খায় ৷ মকর সংক্রান্তির দিন মকরের প্রাধান্য ৷ আতপচাল, গুড়, কলা, লাল আলু, শাক আলু, নারকেল কুচি, দুধ, আদাবাটা, মধু, ঘি প্রভৃতির পরিমাণ মত মিশ্রণে মকর তৈরি করা হয়৷

     পয়লা মাঘ এলাকার ঘরে ঘরে এইখ্যান উৎসবে মানুষ মেতে উঠে ৷ ছোটো বড় সমস্ত কৃষকের খামারে লক্ষ্মীপুজো হয় ৷ লক্ষ্মীপুজোর সময় মাঠ থেকে তুলে আনা শেষ তিন বা পাঁচ বা সাত গাছা ধানের আঁটি লক্ষ্মীর ঘটের সামনে রাখা হয় ৷ এই লক্ষ্মীপুজোকে খামার পুজো বলে ৷ অগ্রহায়ণ ও পৌষ মাসের বৃৃৃহস্পতিবার মেয়েরা লক্ষ্মীপুজো করলেও এইখ্যান পুজো ব্রাহ্মণরা করে ৷ ওইদিন ঘরদোর, উঠোন সব জায়গাতে গোবর দিয়ে বা জল দিয়ে পরিষ্কার করে আলপনা দেওয়া হয় ৷ পুজোর পর শেয়াল বা লক্ষ্মী পেঁচা ডাকলে পুজোর সব উপকরণ ধানের গোলায় তুলে দেওয়া হয় ৷ পুজোর স্থান চট বা ঝুড়ি দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয় ৷ এর কারণ পরদিন যাতে কাক বা চিল শকুন ওই স্থান দেখতে না পায় ৷ কাক বা চিল দেখলে অমঙ্গল ৷ পুজোর পরের দিন বিশ্রাম ৷ অনেকেই পরের দিনকে খোলা বিশ্রাম বলে ৷ ওইদিন খামারে যাওয়া নিষেধ ৷ টাকা পয়সা লেনদেন করাও নিষেধ৷

     মকর সংক্রান্তির আগের দিন বাউনিব্রত পালন করা হয় ৷ ওইদিন ঘরের শিকল, সের, ধামা, কুলো, ঢেঁকি, চালের হাঁড়ি, মুড়ির টিন ইত্যাদি পুরনো খড় দিয়ে বাঁধা হয় ৷ মকর সংক্রান্তির দিন বাড়ির সকলের বড় যে সে এসে বাঁধন খুলে দেন ৷ এই ঘটনার প্রেক্ষাপটে যে আর্থ-সামাজিক ক্রিয়া কাজ করে তা হল বাউনি ব্রতের মাধ্যমে ঘরের লক্ষ্মীকে বেঁধে রাখা ৷ পৌষ মাস ধনসম্পদের মাস ৷ সারা বছর যাতে সুখে কাটে তার ব্যবস্থা করা হয় বাউনি ব্রত পালনের মধ্য দিয়ে৷

     লক্ষ্মী বড় চঞ্চলা ৷ পুরনো খড় দিয়ে বাউনি ব্রতে সবকিছু বাঁধা হয় বলে এলাকার মানুষের বিশ্বাস সারা বছর কৃষি সম্পদ পরিপূর্ণ থাকবে ৷ বাউনি বাঁধার সময় বলা হয় 'এসো পৌষ যেও না' ৷ ধনদেবী লক্ষ্মীকে কীভাবে ঘরের মধ্যে ঘিরে রাখা যায় তার জন্য এলাকার মানুষ সাড়ম্বরে লক্ষ্মীপুজো করে ৷ লক্ষ্মীপুজোর দিন বৃহস্পতিবারকে লক্ষ্মীবারও বলে ৷ ওইদিন কোনোরকম পোড়া খাওয়া নিষেধ ৷ কাপড় চোপড় কাচাও মানা ৷ ধার বাকি চলে না ৷ ঘর থেকে চাল ধান দেয় না ৷ কৃৃৃষক লাঙল করে না ৷ ওইদিন ঘরে মাছ মাংসও বা ডিম রান্না হয় না ৷ লক্ষ্মীকে তুষ্ট করার জন্য ঘরদোর পরিস্কার করা হয় ৷ লোকজীবনের বিশ্বাস দুই তিন ভাই থাকলে বাবা মা জীবিতকালে সংসার একান্নবর্তী না হলে লক্ষ্মী ভাগ করে না ৷ অর্থাৎ একাধিক ভাইয়ের বাড়িতে লক্ষ্মীপুজো ভিন্নভাবে হয় না৷

টুসু উৎসব
     জঙ্গলমহলের এই অঞ্চলটিতে টুসু পরব খুবই জনপ্রিয় ৷ টুসু কৃৃৃষিক্ষেত্রের উর্বরাশক্তির বৃৃৃৃদ্ধিকারিনী শস্যদেবী ৷ টুসু শব্দটির উদ্ভব সম্পর্কে নানান মত প্রচলিত ৷
এক— পুষ্যা নক্ষত্রযুক্ত পৌষমাস ৷ পুষ্যা নক্ষত্রের আর এক নাম তুষা ৷ তুষু>টুসু ৷মূর্ধন্যভবনের ফলে দন্তধ্বনির মূর্ধন্যধ্বনিতে পরিবর্তিত ৷
দুই— টুসু নামটির উদ্ভব উষা বা ওষাব্রত থেকে ৷ ওড়িশার পাহাড়ি অঞ্চলের হিন্দু ভুঁইয়ারা এখনও এই উষা বা ওষাব্রত পালন করে ৷ ময়ুরভঞ্জ জেলার কথ্যভাষার উচ্চারণে তা টুসুতে পরিণত ৷
তিন— সাধারন জনমত টুসু দ্রাবিড় অস্ট্রিক ভাষাবর্গের কোল, মুন্ডা, ওরাও, ভূমিজ, সাঁওতাল, কুড়মি প্রভৃতি সম্প্রদায়ের উপাস্য দেবী এবং প্রাচীন বাংলার তুষ তুষলি ব্রতই ব্রতই টুসুতে পরিণত হয়েছে ৷
চার— টুসু শব্দটি ধানের খোসা বা তুষ থেকে জাত ৷ তুষ মৃত ধানের প্রতীক হলেও এর মধ্যে গুপ্ত থাকে জীবন ৷ তাই তুষকে কেন্দ্র করে উৎসব তাই টুসু। 

     ঝাড়খণ্ডী উপভাষার অন্তর্গত জঙ্গলমহলের এই এলাকাটিতে টুসু উৎসব ধরিত্রীর কল্যাণী ও সুন্দরী সুশ্রী রূপের পুনর্জীবন কামনার অভিব্যক্ত ৷ অতীতে টুসুর কোনো মূর্তি ছিল না ৷ বাঁশের তৈরি ডালাতে বালি দিয়ে ছোলা, ধান প্রভৃতি শস্যদানা রেখে সেগুলিকে অঙ্কুরিত শস্যের পালি বা ডালা যাকে জাওয়া বলে তাকেই টুসু বলে পুজো করা হতো ৷ পরবর্তীকালে হিন্দু দেবদেবীর মত টুসুও লৌকিক দেবী রূপে মূর্তি লাভ করে ৷ অগ্রহায়ণ মাসের সংক্রান্তিতে টুসুর বন্দনা শুরু হয় আর টুসুকে বিদায় জানানো হয় পৌষ সংক্রান্তির দিন ৷ টুসুকে বন্দনা করে মূলত নারীরাই ৷ ঠাকুমা দিদিমা কাকিমা সঙ্গে মেয়ে বউরা ৷ টুসু পুজো বাগদি, বাউরি, কামার, কুড়মি, ভুইঞা পাড়াতে শুধু নয়, এখানে ব্রাহ্মণ কায়স্ত পাড়াতেও হয়। 

জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇


জ্বলদর্চি তিরিশ পেরিয়ে... 
     শালবনী ব্লকের দেউড়ি গ্রামে তুষ কুঁড়ো দিয়ে টুসু বানানো হয় ৷ বর্তমানে টুসু উৎসবে আধুনিক বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে মহিলারা টুসু পুজোর সময় সুর করে টুসু গান করে ৷ টুসু গানের ভেতর মেয়েরা নিজেদের সুখ দুঃখের কথাই ব্যক্ত করে ৷ পৌষ সংক্রান্তির আগের দিন টুসুকে বাউনি ব্রতের সময় পিঠে খাওয়ানোর জন্য উপকরণ হিসেবে পিঠে দেওয়া হয় ৷ শস্য উৎপাদনের জন্য উর্বরাশক্তি হিসেবে গোবরকুণ্ডলীকে রাখা হয় ৷ মাটির সরা পৃথিবীর প্রতীক আর ধান হল শস্যের পুনর্জন্মের জন্য টুসু বন্ধ্যা ধরিত্রীর, উর্বরাশক্তির বন্দনা অনুষ্ঠান ৷ টুসু ধরিত্রীর মৃত শস্যের পুনর্জন্মের প্রজনন শক্তি ৷ বিবাহিত মেয়েরা তাই টুসুব্রত বেশি করে ৷ ড. বিনয় মাহাতোর মতে, "টুসু উৎসব আদিম মানুষের মৃৃৃত শস্যের পুনর্জীবন কামনা একটি জীবনধর্মী, সৃষ্টিধর্মী অভিনব লোকউৎসব৷ (মাহাত, বিনয়, 'লোকায়ত ঝাড়খণ্ড', ১৯৮৪, পৃষ্ঠা-২৯৩)

     শস্য ও সন্তান কামনায় উদ্ভিদের দেবতাকে তুষ্ট করার জন্য জাদুক্রিয়া মেশানো এই ধরনের আচার অনুষ্ঠান সবচেয়ে বেশি প্রচলিত ছিল সিরিয়া, ব্যবিলন, ইজিপ্তে ৷ ইজিপ্তের শস্যদেবী আইসিস আমাদের টুসুদেবীর সঙ্গে তুল্য টেসবু বা টুসুবু দেবতার উৎসবের সঙ্গে টুসু উৎসবের মিল আছে ৷ আবার গ্রিসের আদিম মানুষ বিশ্বাস করে এডোনিসের দয়াতে মৃৃৃত্যুর পরও শস্য পুনর্জীবন লাভ করে ৷ শস্য ও সন্তান কামনায় গ্রিসের 'গার্ডেন অব এডোনিস' নামে যে অনুষ্ঠানটি পালন করা হয় তার সঙ্গে এই এলাকাটির করম ও টুসু উৎসবের সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায় ৷ ব্যবিলনের শস্যদেবতা টাইমুজ-এর সঙ্গে টুসুর মিল আছে। 

টুসু গীত
১. সোনাঝুরি ফুলের বাগানে
ফুল তুলিব বাঁধব মালা
পরাব টুসুর গলে ৷

২. বড় বনে লতাপাতা
ছোট বনে তালপাতা
কোন বনে হারালে টুসু
সোনায় বাঁধা লাল ছাতা
টুসু ধনকে জলে দিব না
আমাদের গান করে স্বাদ মেটে না
টুসু ধনকে জলে দিব না ৷

৩. হে ভগবান হে ভগবাণ
আমায় একটি পুত্র দাও
রোজগার খাওয়া যেমন তেমন গ
মুখে যেমন অগ্নি পায় ৷

৪. আমদের পাড়া বসতে যাবি
বসতে দিব পিঁড়া গ
জল গামছা দিব গ
সঙ্গে চিড়া ভাজা গ

৫. বারে বারে বারণ করি
শালগাছে চট মার না
ফরেস্টবাবু ধরলে
নিয়ে যাবে জেলখানা
আসতে যাতে শালবনি থানা
আমি ভয় করি না
------------
লেখক মেদিনীপুর কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক। 

Post a Comment

0 Comments