জ্বলদর্চি

মেদিনীপুরের কৃষিবিজ্ঞানী ড. রামচন্দ্র মণ্ডল-এর বর্ণময় জীবনের উত্থান-পতনের রোমহর্ষক কাহিনী)উপপর্ব — ০৬ /পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

বিজ্ঞানের অন্তরালে বিজ্ঞানী — ৭১
এগ্রিকালচারাল রেটুনিং

(মেদিনীপুরের কৃষিবিজ্ঞানী ড. রামচন্দ্র মণ্ডল-এর বর্ণময় জীবনের উত্থান-পতনের রোমহর্ষক কাহিনী)

উপপর্ব — ০৬

পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা


'ব্যাটা, হিন্দুর ছেলে হয়ে মুসলমানি ভাষা শিখবি! কয়েকটা নম্বর বেশি পাওয়ার লোভে। আমি তোকে সংস্কৃত পড়াবো। টিপস শিখিয়ে দেবো। যাতে উর্দুর থেকে অনেক বেশি নম্বর পাবি' — এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে শিষ্যের মুখের'পর কটমট চেয়ে রইলেন পণ্ডিত মশাই। বহু কষ্টে তাঁর রাগ সংবরণ করা কঠিন প্রতিপন্ন হচ্ছে এমনই অসহায় দশা। 

পণ্ডিত মশাইয়ের কথা শুনে হতচকিত শিষ্য। ক্ষণিক বাকশূন্য। মস্তক ঈষৎ সম্মুখে ঝুঁকে রয়েছে। দৃষ্টি মাটিতে নিক্ষিপ্ত। মৌনতা সম্মতির লক্ষণ ভেবে নিশ্চিন্ত পণ্ডিত মশাই শ্রী রামচন্দ্র ভট্টাচার্য। সংস্কৃতের প্রাজ্ঞ ব্যক্তি। পার্বতীপুর পতিতপাবনী হাইস্কুলে সংস্কৃত সাহিত্যের শিক্ষক। আদি দেবনাগরী ভাষায় তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য। প্রভূত জ্ঞান। এ হেন রাসভারী পণ্ডিত মশাইয়ের নেকনজরে পড়ল রাম। কথায় আছে – লোভে পাপ। পাপে মৃত্যু। বেশি নম্বরের লোভে পরভাষা শিক্ষালাভ পরচর্চার সামিল। মাস্টার মশাইয়ের চোখে– তা মৃত্যুর নামান্তর! ঠিক যেমনটা ঘটেছিল মাইকেল মধুসূদন দত্তের বেলায়। ঘটনা কী?

সেসময় বিদ্যালয়ে এক আজব নিয়ম চালু ছিল। এ পোড়ারমুখো বঙ্গদেশে বাঙালি অধ্যুষিত বিদ্যালয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্য সংস্কৃত আর মুসলিম ছাত্রদের জন্য উর্দু ভাষা সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত ছিল। এ পর্যন্ত সব ঠিকঠাক চলছিল। গোল বাধল ব্যতিক্রমী এক নিয়ম নিয়ে। নিয়মটি কী? কোনও হিন্দু শিক্ষার্থী স্কুলে সংস্কৃত ভাষা চর্চার বদলে উর্দু পড়লে পরীক্ষায় দশ নম্বর অতিরিক্ত পাবে। অতিরিক্ত দশ নম্বর ফাউ-এর লোভে পড়ে রীতিমত উর্দু সাহিত্য শেখায় আগ্রহী হয়ে পড়ল অনেক হিন্দু বিদ্যার্থী। এদের মধ্যে একজন ছিল মেধাবী রাম। আগাগোড়া সোৎসাহে উর্দু বর্ণমালা আলিফ, বে, তে, সে, জিম, কে, হে, ড়ে ইত্যাদি বর্ণ মুখস্থ শুরু করল সে। তড়িৎ বেগে এ হেন খবর পৌঁছল সংস্কৃত সাহিত্যের পণ্ডিত শ্রী রামচন্দ্র বাবুর কানে।‌ আকর্ণ তিনি রেগে লাল। তারপর সে কী হুলস্থুল কাণ্ড! আদি দেবনাগরী ভাষা ছেড়ে উর্দু! ছো! ছাত্রের স্থুল ভাবনা চিন্তাকে মেনে নিতে অপারগ পণ্ডিত মশাই। মুখোমুখি রামকে দেখে হাতের ঝোল মুখে মেটালেন তিনি। ধমকে সমঝে কড়া জবাব ফিরিয়ে দিতে পিছপা হলেন না। শুধু তিরস্কার করেই ক্ষান্ত নয়, ছাত্রের মাথায় অকৃত্রিম আশির্বাদের হাত রাখলেন তিনি।‌ অভয় দিলেন সংস্কৃত সাহিত্য শিক্ষায় প্রভুত মার্কস রপ্ত করার কৌশল শেখানোর খুঁটিনাটি পন্থা। কী সেই উপায়?

জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇


জ্বলদর্চি তিরিশ পেরিয়ে... 
সংস্কৃত ব্যাকরণের ছন্দ খানিকটা বীজগণিতের সূত্রের মতো। ব্যাকরণ কৌমুদীর শব্দ ও ধাতু প্রত্যয়ে বর্তমান-অতীত-ভবিষ্যৎ একবচন দ্বিবচন বহুবচন আর উত্তম মধ্যম প্রথম পুরুষ সম্পর্কিত ছন্দগুলি বেজায় সহজ। পরিষ্কার বীজগণিতের সূত্রের মতো  ছন্দগুলি আওড়াতে এবং স্মরণে রাখতে পারলে দেবনাগরী ভাষা তখন জলভাত। এটাই নাকি সংস্কৃত ভাষায় জ্ঞানার্জনের যথার্থ উপায়! ব্যাস, এতেই হবে সিদ্ধিলাভ। যাকে বলে কিস্তিমাত। পণ্ডিত মশাইয়ের নির্দেশে এ হেন উপায় অবলম্বন করে পরীক্ষায় ৯০ - ৯৫ নম্বর পেত রাম। আসলে গুরু মশাইয়ের আন্তরিকতা ও সঠিক নির্দেশ পেলে শিষ্যের শেখার আগ্রহ দ্বিগুণ বেড়ে যায়– মনে মনে টের পেল রাম।


বাসা বদল :

পার্বতীপুরের তৎকালীন জমিদারের গোমস্তা শ্রী প্রাণকৃষ্ণ দাস। সারাক্ষণ জমিদারির হিসেব নিকেষ নিয়ে ব্যস্ত। ক্ষীণ শরীর। হাড়-পাঁজরা বেরোনো একটেরে হাভাতে চেহারা। ঘন ঘন বিড়ি আর চা পানের অভ্যাস। পেটে খিদে-টিদে নেই। দুপুরের আহারে এক বাটি মুড়িই যথেষ্ট। মাঝে মধ্যে কাশিতে ধুঁকছেন। কাশির চোটে তাঁর প্রাণ ওষ্ঠাগত প্রায়। দুই হাঁটুর মধ্যে মাথা গুঁজে ধুঁকতে ধুঁকতে খাতাপত্রের কাজও চলে সমান তালে। বিড়ির ধোঁয়ায় কালো বর্ণ ধারণ করেছে কণ্ঠনালীর ঝিল্লিগুলো। কণ্ঠনালীর পর্দা একেবারে নিস্তেজ। তাই অনবরত ধুকপুকানি কাশি।

তাঁর ছোট ছোট দুটি ছেলে। বাড়িময় বাচ্চা দুটোর দস্যিপনার বিরাম নেই। তাদের দুজনকে সামলাতে বাড়ির লোকজনের সে কী লেজেগোবরে অবস্থা! লেখাপড়া নেই; সারাদিন শুধু খেলা আর খেলা! তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে দুজনের দৌরাত্ম্যি। এ হেন শিশু দুটিকে পড়ানোর মস্ত বড় দায়িত্ব পড়ল কিশোর রামের উপর। তার বদলে থাকা খাওয়ার বন্দোবস্ত পাকা। পার্বতীপুর পতিতপাবনী হাইস্কুলের সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার অব্যহতি পর অনন্তদার বাসা ছেড়ে প্রাণকৃষ্ণ বাবুর বাড়িতে গিয়ে উঠল সে। পড়ানোর পাশাপাশি নিজের পড়াশুনার ব্যস্ততা। সারাদিন স্কুলের ক্লাসে চলে লেখাপড়া। ধৈর্য্য ধরে শিক্ষক মশাইদের পাঠ শোনা। অবসর সময়ে ঢুঁ মারা স্কুলের লাইব্রেরীতে। 
       
একদিন পাঠাগারে একটা ঘটনা ঘটল। এ বই ও বই সে বই ঘাঁটতে ঘাঁটতে রামের হাতে এসে পড়ল একখানি পুস্তিকা। 'চা পান নাকি বিষ পান'। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের লেখা। বিশ্ব বিখ্যাত বিজ্ঞানী। ভারতে রসায়ন বিদ্যার জনক। শ্রদ্ধেয় বৈজ্ঞানিকের লেখা পুস্তকটি গোগ্রাসে গিলে ফেলল রাম। পড়ার শেষে আমূল বদলে গেল মান্ধাতা আমলের তার ধ্যান ধারণা। শীত ঘুম ভেঙে জেগে উঠল বিবেক। সে উপলব্ধি করল – চা পান আসলে বিষ পান কেন? ঘন ঘন চা পানের ভীষণ অপকারিতা কী? তবে হ্যাঁ, অল্প বিস্তর চায়ে চুমুক দেওয়ার অভ্যেসে সামান্য উপকারী প্রভাব আছে বৈকি! মাত্রাতিরিক্ত চা পান স্বাস্থ্যের পক্ষে অবশ্যই ক্ষতিকর। কথায় আছে না, অতিরিক্ত পরিমাণে কোনও জিনিস সেবন একদম হিতকর না। কারণ, চায়ের ক্বাথ (Decoction) বেশি মাত্রায় শরীরে ঢুকলে খিদে থাকে না। ঘুম কমে যায়। মাথায় রোগ হয়। মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। আরও কত কী লেখা আছে বইতে; তার ইয়ত্তা নেই! বইখানি পড়ে আর চা পান হেতু বাড়ি মালিক প্রাণকৃষ্ণ বাবুর ভগ্ন শরীরের বেজায় খারাপ অবস্থা উপলব্ধি করে সেদিনই রাম স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছয় — 
'চা পান বর্জনই জীবনের মূলমন্ত্র হোক।'
        
বার্ধক্যের বারানসিতে পৌঁছে আজকে তাঁর স্পষ্ট মনে পড়ে— 'সে সময় থেকে দৃঢ়ভাবে থাকতে পেরেছিলাম বলেই খিদে ও ঘুমের অভাব আমার শরীর ও মননকে সারা জীবন অবসন্ন বা ক্লান্তি অনুভব করতে পারেনি। তাই আমার মনে হয় দেহ মনের ক্লান্তি দূর করতে হলে চা পান, ধূমপান, সুরাপান ইত্যাদি বাজে অভ্যাসে দেহ মন্দিরকে কলুষিত না করে জীবন যাপন করতে পারলে টেনশন কমে যায়। মানুষ দীর্ঘায়ু হওয়ার আশা রাখে।'

স্কুলে যাতায়াতের পথে প্রায়শই একটা জিনিষ তার নজরে পড়ে। স্কুলের পাশেই গড়ে উঠেছে 'ভারত সেবাশ্রম সংঘ'। হিন্দু ধর্ম আর হিন্দু শাস্ত্রের প্রতীক। স্কুল স্টুডেন্টদের রামায়ণ, মহাভারত ও গীতার অমর বাণী অধ্যয়ন এবং আদর্শ জীবন যাপনের পীঠস্থান এই সংঘ। অনেক বিদ্যার্থী সংঘের আশ্রমিক। সংঘের অধ্যক্ষ স্বামী সচ্চিদানন্দজী মহারাজ। তিনি ইন্দ্রিয় সংযমের মূলমন্ত্র দীক্ষা প্রদান করেন। ছাত্র জীবন থেকে চরিত্র গঠনের সঠিক শিক্ষা দেন। আশ্রমবাসী ছাত্রদলকে কঠোর অনুশাসন মেনে চলার সুপরামর্শ দেন তিনি। আশ্রমিক বিদ্যার্থীদের দলে ভীড়ে গেল রাম। পেল আশ্রমের সান্নিধ্য। রামায়ণ-মহাভারতের আদর্শ জীবন কাহিনী এবং গীতার কয়েকটি অধ্যায়ের পবিত্র শ্লোক মুখস্থ করে শ্রীকৃষ্ণ-এর বাণী হৃদয়ঙ্গম হল তার। ছাত্র জীবনের শুরুতে এমন সংঘের সংস্পর্শে এসে তার ষোলআনা লাভ হল। এক স্বচ্ছ চারিত্রিক জীবন গঠনের বুনিয়াদ শক্ত পোক্ত করায় দারুণ সাহায্য করল সংঘ। ইতিমধ্যে পার্বতীপুর পতিতপাবনী হাইস্কুল একটি ধর্মশাস্ত্র পরীক্ষার আয়োজন করে। সে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে রাম। মিলে যায় প্রথম পুরস্কার। প্রশংসিত হয় সে।

আরও একটি ঘটনা স্কুলে চরিত্র গঠনের সহায়ক হয়ে উঠেছিল। স্কুলে ছিল ব্রতচারীর দল। সে দলে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য প্রকাশের অনুকূল। ব্রতচারীর কিংবদন্তি পুরুষ শ্রদ্ধেয় গুরুসদয় দত্ত-এর উপদেশাবলী যথাযথ মেনে চলার প্রয়াসে তার চরিত্র মজবুত হয়ে উঠেছিল। প্রণম্য গুরুসদয় দত্ত-এর খাদহীন বিখ্যাত উক্তি —
'চল কোদাল চালাই / ভুলে মানের বালাই / হবে শরীর ঝালাই।' কিংবা
'কোঁচা ঝুলাইয়া চলিব না / ভুলেও ভুঁড়ি বাড়াইব না।'


মোড় :

–এই ছেলেটিকে স্কুল ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে হল।
–কেন?
–কোন থাকার জায়গা না থাকায় ওকে চলে যেতে হচ্ছে — কথা হচ্ছিল অঙ্কের মাস্টার মশাই সীতানাথ বাবুর সঙ্গে ধনাঢ্য জনৈক ভদ্রলোকের। ভদ্রলোক খানপুর গ্রামের বাসিন্দা। নাম শ্রী গুণসিন্ধু মান্না। তিনি তাঁর ছেলের ভর্তির ব্যাপারে স্কুলে কথা বলতে এসেছিলেন। যখন মাঝবয়সী দুজন মানুষের কথা হচ্ছিল, ঠিক সেসময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয় রাম। প্রিয় ছাত্রকে লক্ষ্য করে সীতানাথ বাবু বলছিলেন মনখারাপ করা কথা। রামের মুখ তখন শুকিয়ে কাঠ। কথা বলবার মতো অবস্থায় সে নেই। সে চায়নি স্কুল ছেড়ে চলে যেতে। কিন্তু উপায় কী? না-চাইলেও যেতে তাকে হবেই। 
         
প্রাণকৃষ্ণ বাবুর বাড়িতে হাজার একটা অসুবিধা। রামের নিজের পড়াশুনার বারোটা বাজছিল। লেখাপড়ায় মন বসছিল না। রেজাল্ট খারাপের আশঙ্কা মাথার উপর বাঁদর নাচ নাচছিল। এদিকে, স্কুলের পাশাপাশি থাকা-খাওয়ার ভালো জায়গাও ব্রাত্য। অগত্যা তার কী করণীয়? সবদিক ভালো বিবেচনা করে ঠিক করল— বাড়ি ফিরে যাবে সে। বাড়ির অদূরে কলাগাছিয়া হাইস্কুলে ভর্তি হবে। তা হলে বাড়ি থেকে যাতায়াতে সুবিধা হবে। সাত পাঁচ চিন্তা ভাবনা করে কলাগাছিয়া স্কুলে ভর্তির পরীক্ষায় বসল। রেজাল্ট বের হতে দেখা গেল, ভর্তির পরীক্ষায় সে মনোনিত হয়েছে। কলাগাছিয়ায় সত্বর ভর্তির জন্য চাই আগের স্কুলের ট্রান্সফার সার্টিফিকেট। সার্টিফিকেট আনতে তাকে যেতে হবে সূদূর পার্বতীপুর। যেদিন সে সার্টিফিকেট আনতে গেল পুরাতন স্কুল, সেদিনই দেখা হয়ে গেল গুণসিন্ধু বাবুর সঙ্গে। 

সীতানাথ বাবুর মন বেজায় খারাপ! কৃতী ছাত্র স্কুল ছেড়ে চলে যাবে। তাঁর এ কষ্ট স্বাভাবিক! কেমনে বেঁধে রাখবেন রামকে? কীভাবে দূর করবেন তার অর্থনৈতিক দূরাবস্থা! একবার শেষ চেষ্টা করে দেখলেন মাস্টার মশাই। গুণসিন্ধু বাবুকে চেপে ধরে বললেন :
–ওর থাকার একটা ব্যবস্থা করলে ভালো হয়। 

এককথায় রাজি গুণসিন্ধু বাবু। সেদিনই রামকে নিজের বাড়িতে ডেকে নিয়ে যেতে উদ্যত হলেন তিনি। কথায় আছে — রাখে হরি মারে কে? মূহুর্তের মধ্যে স্কুল ছেড়ে যাওয়ার দুশ্চিন্তা বাতিল হল মন থেকে। হাঁফ ছেড়ে বাঁচল রাম। এবার নিজেকে অনেকটা হালকা প্রতিপন্ন লাগছে তার। 

সময়টা ১৯৪৯ সাল। দেশ স্বাধীন হয়েছে সবে দুবছর হল। সেবার স্বাধীন বাংলাদেশে দ্বিতীয় প্রবেশিকা পরীক্ষা শুরু হব হব করছে। রামের প্রিপারেশন যথেষ্ট ভালো। মাস্টার মশাইরা দারুণ আশাবাদী। পরীক্ষায় ভালো ফল করবে রাম। পরীক্ষার রেজাল্ট বের হতে দেখা গেল ফলাফল আশানুরূপ। তার সাফল্যে স্কুলের মুখ উজ্জ্বল।‌ সবাই বেশ খুশি। প্রবেশিকা পরীক্ষা পাশ করে রামের পরবর্তী লক্ষ্য কলেজে অ্যাডমিশন। তার পাখির চোখ বিজ্ঞান বিভাগ। কাছে পিঠে কলেজ বলতে কাঁথি প্রভাত কুমার কলেজ। বাড়ি থেকে ঘুর পথে তিরিশ মাইল খানিক পথ। দক্ষিণে। এ হেন কলেজের বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়ে গেল রাম। থাকা খাওয়া কাঁথির রামকৃষ্ণ মিশনে। মাসিক কুড়ি কিলো চাল আর সামান্য কিছু অর্থের বিনিময়ে। চাল আনার খুব হ্যাপা! তখনকার দিনে রসুলপুর-কাঁথি রুটে বাস চলে বটে, তবে প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল বাসের সংখ্যা। অধিকাংশ সময় কাঁধে কিংবা মাথায় তুলে হেঁটে হেঁটে বয়ে নিয়ে যেতে হত চালের বস্তা। রসুলপুর ঘাট পর্যন্ত বাবা প্রহ্লাদবাবু চালটা পৌঁছে দিয়ে যান। তারপর বাকি পথ রামের হেফাজতে। মিশনের আশ্রমমুখী পরিবেশ স্কুল লাইফ থেকে তার চেনা জানা। ভালো লাগে আশ্রমের নিষ্ঠা, সময়বর্তিতা আর কর্তব্যপরায়ণতা। ভক্তিযোগ ও কর্মযোগ – এই দুটো উপলব্ধি ও উপভোগের নেশা তাকে খুব টানে। কাঁথি আশ্রমের অধ্যক্ষ স্বামী অন্নদানন্দজী মহারাজ। প্রৌঢ়। অত্যন্ত স্নেহপ্রবণ। একবার আশ্রমে মহারাজের ভীষণ কোপে পড়তে হয়েছিল স্বভাবে শান্ত রামকে। ব্যাপারটা কী? কী ঘটেছিল সেদিন? 
 ‌       
ঘন শীতের ভোর। বাইরে কনকনে ঠাণ্ডা। আঁধারের তন্দ্রা তখনও কাটেনি। ঘুম থেকে উঠে পড়েছে রাম। আশ্রমের ঠাকুরঘরের বাসন মাজার কাজ এবং অন্যান্য কাজ সব সারা। কাঁথির আশ্রমে এসে অব্দি তার খুব ঠাণ্ডা লেগেছে। হঠাৎ হঠাৎ কাশির উদ্রেক হয়। কাশির চোটে আস্ত হৃৎপিণ্ডটা যেন বাইরে বেরিয়ে আসতে চায়। একদিনের ঘটনা। ভোরের কাজ সেরে পড়তে বসেছে সে। পড়ার তালে তাল মিলিয়ে শুরু হয়েছে কাশি। ঠাণ্ডায় কাশতে কাশতে কখন যে তার গলার স্নায়ু গেল ছিঁড়ে! গলা দিয়ে উঠে এল চাপ চাপ কফ। কফের সঙ্গে কাঁচা রক্ত। সে রক্ত গিয়ে পড়ল জীবনবিদ্যা বইয়ের পাতায়। পাতায় রক্তের আভা দেখে ভয় পেল রাম। কী জানি কী রোগ দানা বাঁধছে শরীরে! এদিকে আশ্রমে রটে গেল খবর— রামের যক্ষ্মা হয়েছে। খুব ছোঁয়াচে। আশ্রমিক ছাত্রের দল বেজায় ভীত, সন্ত্রস্ত। এ হেন ভুয়ো খবরের সংবাদ দাতা আবাসিক একজন সিনিয়র দাদা। বি. এ. পাঠরত অর্ধেন্দুদা। অর্ধেন্দুদার মারফত যক্ষ্মার নালিশ পৌঁছে গেল সরাসরি রামকৃষ্ণ মিশন কর্তৃপক্ষের দরবারে। আশ্রম কর্তৃপক্ষ ঘটনার সত্যাসত্য যাচাই করল না। নিয়ে ফেলল বেফাঁস সিদ্ধান্ত। চিকিৎসার জন্য বাঁকুড়ায় যক্ষ্মা হাসপাতালে ভর্তির নিদান দিলেন তাঁরা। কোনোমতে আশ্রমে থাকা চলবে না। অগত্যা যেতে হল বাঁকুড়া।

হাসপাতালে শুরু হল হাবিজাবি পরীক্ষা নিরীক্ষা। একগাদা টেস্ট। মেডিকেল টেস্টের শেষে রিপোর্ট এল। রিপোর্টে দেখা গেল যক্ষ্মার ন্যূনতম জার্ম নেই। সব রিপোর্ট ওকে। জার্ম ধরা পড়ল না ঠিকই। তবে‌ ডাক্তার বাবুর প্রেসক্রিপশনে কলম চলল অল্প বিস্তর। ডাক্তারের কড়া নির্দেশ। আপাতত দুই বোতল ওয়াটার-বারির কম্পাউন্ড (Waterbury's Compound) গেলা আর বিশ্রামের নিদান দিয়ে এ দৃশ্যের যবনিকা পড়ল। ব্যাস, চুকে গেল তার কলেজের পাঠ। অধরা রইল উচ্চ শিক্ষার স্বপ্ন। আবারও একধাপ পিছিয়ে গেল জীবন যুদ্ধে। বঞ্চিত হল শিক্ষার আলোকে নিজেকে রাঙিয়ে তোলার আপ্রাণ প্রয়াস। ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এল। ঘরে এসে তার অনন্ত বিশ্রাম আর নতুন ভোরের দিন গোনা ভিন্ন দ্বিতীয় কাজ নেই! (ক্রমশ...)

তথ্য সূত্র :
• প্রণম্য বৈজ্ঞানিক ড. রামচন্দ্র মণ্ডল মহাশয়
• শ্রী সুদর্শন সেন বিশিষ্ট শিক্ষক ও আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক
• 'মনীষী ড. রামচন্দ্র মণ্ডল' – সম্পাদনা শ্রী জয়দেব মাইতি ও শ্রী সুব্রতকুমার মাঝি


Post a Comment

0 Comments