জ্বলদর্চি

কবিতা অ্যাভিনিউ /পর্ব – ২৭ /বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়

কবিতা অ্যাভিনিউ

পর্ব – ২৭

বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়


কবি শ্যামলকান্তি দাশের কবিতা বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে আগের পর্বে  পাঠক ও কবির আত্মিক বন্ধনের কথা বলেছি। চিরজীবিতেষু পাঠকের জন্যই কবির যা কিছু পরমাত্মিক সম্পদ। ব্যক্তি মানুষের মনই তাঁর সমস্ত সমস্ত অর্থের কেন্দ্রস্থল। যা দর্শনকে দেয় সিদ্ধি অতিরিক্ত প্রাপ্তি এবং ভরিয়ে দেয়  সংক্রমণের অধিক উষ্ণতায় । শিল্পের জীবন তার জনন-উৎসের সমস্ত প্রসূতি চিহ্ন নিয়ে দখল করে রসগ্রাহী মানুষের বৌদ্ধিক সত্তা। ইন্দ্রিয়জ ভোগবাদের বাইরে পরিকল্পনার বাইরে  চিরায়ত জ্ঞানের যে বন্ধনী নিজস্ব বৈভবের বিন্যাসে  সেখানে কবিতা যতদূর যাবে সুর যতদূর যাবে, শিল্প যতদূর যাবে ততদূরই ছড়িয়ে দিয়ে যাবে স্পর্শ করবার মতো অতলস্পর্শী এক অধরা জ্যোর্তিবলয়। উদাসীন উপাসক ছাড়া এই চিরায়ত বিক্ষেপণ ধারণ করার আত্মীকরন করার সক্ষমতা কারও নেই।  কোন মগ্ন শিল্পই “ যুথচারীদের শোরগোল নয়, নিঃসঙ্গের আত্মনিগ্রহ’ তাই আমরা জানি যত নির্জনেই লেখা হোক না কেন দূরে কেউ কোথাও অপেক্ষা করে আছে তার জন্য।গানের ওপারে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছেই। হ্যাঁ শুধু তারই জন্য সুরগুলি চরণ পায়, গতিশীল হয়ে ওঠে এবং যুগ পেরিয়ে সময় পেরিয়ে চলে যায় যুগান্তরের দিকে।সৃষ্টির সেই অলক্ষ্যবিন্দুতে।  

    একজন কবির সম্পদ কী ? ঘরবাড়ি? জমি জায়গা? বীমা ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স? না কি বই বিক্রির রয়্যালটি গ্রন্থস্বত্ত্ব ? এসব বস্তুজগতের মানুষের হিসেবনিকেশের বিষয়। কবি যখন পারিবারিক পরিসীমানায় আবদ্ধ তখন অল্পবিস্তর তুচ্ছাতিতুচ্ছ অঙ্ক তার দরকার হয়। তাই তিনি ব্যক্তিমানুষ হিসেবে প্রিয়জনদের দিয়ে যেতে চান কাকচক্ষু সরোবর, পতিত অনাবাদী জমি অথবা বহুমূল্য স্বর্নালঙ্কার। কিন্তু এসব তো “ টাকা মাটি মাটি টাকা”কালের নিয়মে যা একদিন বিলীন হয়ে যায় , লোপাট হয়ে যায় বা অন্যেরা কেড়ে নিতে পারে। চিরজীবিতেষু পিঁপড়েদের জন্য যে সাধনরস রেখে যান একজন কবি, একজন শিল্পী, একজন গায়ক বা অভিনেতা সেই সম্পদই শাশ্বত সম্পদ।এর মূল্য যে বোঝে সে আর্থিক হিসেবে পরিমাপ করবে না তার  জীবনের চাওয়া পাওয়া।                

        কবি শ্যামলকান্তি দাশের কবিতা সহজ কথায় গভীর দর্শনের কথা। ইন্দ্রিয়জ চেতনা অতীন্দ্রিয়ের দিকে চলে যায় নিঃশব্দে। দৃশ্যমান চিত্রাবলী পরিদৃশ্যমান জগতের সীমান্তে গিয়ে উজাড় করে দেয় নিজেকে।  গ্রাম আর শহর মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় তার অনুভবে।তাই অনায়াসে তিনি নাগরিক শব্দের পাশে গ্রামীণ কাদা মাখা  অক্ষরকে বসিয়ে দিতে পারেন।এই আশ্চর্য মিলনে অনুঘটকের দায়িত্বই শুধু তাঁর নয়।শব্দের ভেতরই তাঁর ঘর সংসার , সর্বক্ষন বসবাস।অন্তর্বাহী মীড় টেনে কবিতার ভেতর তিনি প্রতিষ্ঠা করেন প্রাণের ঐশ্বর্য। স্নায়ু নিংড়ে তুলে আনেন সজীব শব্দমালা।তাদের কবিতা হয়ে ওঠার পিছনে রয়ে যায় অবচেতনে ছায়ার মতো সঞ্চিত কিছু গতিবিন্যাস।চেতনায় উদ্ভাসিত হয় তারই উজ্জ্বল প্রভা। কোমল পর্দায় বাঁধা সেই মগ্ন উচ্চারণ পাঠকের চেতনাস্তরে সপ্রতিভ স্পর্শ রাখে । ঠিক তখনই মায়াতন্তুতে বন্দী হয়ে যায় পাঠক।কবি হাতে তুলে পাঠককে দিতে পারেন না কিছুই।শুধু দীক্ষিত করেন আশ্চর্য অলৌকিক মন্ত্রে। শব্দের রহস্য দিয়ে তৈরি করেন সেতুএবং প্রতিদিন নিজেই অতিক্রম করে যাবেন নিজস্ব পরিমণ্ডল।  আরার্গর একটি অবিস্মরণীয় পঙক্তিকে উদ্ধৃত করতে হচ্ছে এই মুহুর্তে –The world is ill arranged my heart tired…Each day I discover my limits in a different way. সীমাবদ্ধতার চিহ্নগুলিকে সনাক্ত করাই একজন শিল্পীর কাজ এবং অবশ্যই তাকে অতিক্রম করা।‘কে আছো সন্তুষ্ট, হাত তোলো’। বলেছিলেন কবি শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়।নিজের ভেতর  নিরন্তর অতৃপ্তি ছাড়া অসন্তোষ ছাড়া শিল্প কখনোই গতিশীল হতে পারে না।বস্তুতপক্ষে নিজের ভেতর ক্রমাগত জমে ওঠা অসন্তোষই নতুন ভাবনায় গতিজাড্য সঞ্চার করে।শব্দপৃথিবীর যাবতীয় সম্পদ কবির চেতনাবিশ্বের যে দরজা সেখানে প্রবেশ করার অধিকার সবার নেই, সবাই  পারবেন ও না।এই জগত পরিক্রমা করে চিন্তাভাবনার অনুসৃতিকে ধারণ করা এবং আত্মগত অনুভূতির কর্ষণে তাকে সমৃদ্ধ করবেন পাঠক।পাঠক বা শিল্পবস্তুর রসগ্রাহক যারা,  তাঁরা খুঁজে পান নতুন নতুন দিগন্ত।সমাজ ছাড়িয়ে, ব্যক্তিকে ছাড়িয়ে পাঠক ঢুকে পড়েন চেতনার মায়াজালে।অন্তরের আলোছায়ায় রহস্যমেদুর এক পরিমণ্ডলে ভিজে যেতে থাকে অন্তরাত্মা।এক অবিচ্ছিন্ন বন্ধনে বাঁধা পড়ে যায় অনুভবের সাথে,নির্বেদের সাথে।জাগতিক স্থুল হিসেব দিয়ে এই প্রাপ্তি বা অপ্রাপ্তির অঙ্কগুলির রহস্য উতঘাটন করা যাবে না কোনদিন।শ্যামলদা  যদি বলেন এরকম-

‘পদ্মের মৃণালগুলি ফাঁকা মাঠে ছড়িয়ে দিয়েছি,

দুলিয়ে দিয়েছি জলে শালুকের রেণু,

থমথমে নির্জনতা, চারদিকে কুয়াশা শিশির

তারই মধ্যে চেয়ে দ্যাখো

চিরশূন্য জীবনের শিল্প ফুটে আছে।’

পদ্মের মৃণাল ফাঁকা মাঠে ছড়িয়ে দিয়ে যান একজন শিল্পী।যেখানে শুধু কুয়াশা আর শিশিরের ঘেরাটোপ।নির্জন সেই বলয়ে কোথাও শব্দউৎসবের আলো জ্বলে ওঠে।এই আলোটির কাছেই পিঁপড়ের শর্তহীন প্রস্তাবহীন সমর্পণ।   অবিচ্ছেদ্য তন্ত্র থেকে শিল্পের সেই অমিয় রেণুগুলি কেউ সংগ্রহ করে রেখে দেয় নিজস্ব গর্তে।আত্মিক মন্থনে তা থেকেই উদ্ধার করে অমৃতের স্বাদ। বস্তুজগতের যে ধনরাশি তা উইল করে দেওয়া যায়।পাত্রে অপাত্রে যাকে খুশি দান করা যায়। ফেলে ছড়িয়ে নষ্ট করাও যায়।  কারণ তা নশ্বর। মাটি থেকে উঠে আসে আবার মাটির ভেতরই বিলীন হয়ে। কিন্তু যে চিন্তাবীজ এবং ভাবসম্পদ রচিত হয় ব্যাপ্তির বোধে,যেখানে আছে চৈতন্যদ্যুতির আয়োজন তার উত্তরাধিকার শুধু  ক্ষুদ্র পিপীলিকার। কারণ শুধু সে ই জানে এই সম্ভোগের স্বাদ।

  ‘কাগজকুচি’  থেকে আরম্ভ করে ‘আমাদের কবিজন্ম’ ‘লালরঙের স্বর্গ’, ‘ভালোবেসেছিলাম’, ‘সরল কবিতা’, ‘ ছোট শহরের হাওয়া’, ‘খড়ের মানুষ’  ‘শত্রুরা বাড়ি নেই’, ‘রাক্ষস’, ‘নির্জন চায়ের দোকান’ , ‘ভাঙা বাড়ির জানালা’ পেরিয়ে ‘বাঘ ও প্রতিভা’  জুড়ে কবিতার যে বিচ্ছুরণ আমরা দেখি,  দেখি প্রীতি ও সমবেদনার ভেতর থেকে উদ্ভাসিত শব্দের এক অনুপম কুটিরশিল্প।নিজেকে নিংড়ে সেই নির্যাস থেকে নির্মিত হয়েছে শব্দের শরীর

আমার প্রতিদিনের অপমান

দরজায় আড়ালে আমার চোখের জল

পিঠের লম্বালম্বি কালশিটে

অনেকদূর অব্দি আমার পালিয়ে যাওয়া

সব তুমি একটি একটি করে টুকে রেখেছ।(দেখা)

শূন্য রাত্রির ভেতর আমরা পড়ি সেই তারানক্ষত্র। পড়ি সেই বনমালীপুর নামের একটি দেশ।‘জলভরা আনন্দের পাশ দিয়ে’ যেখানে নৌকা ছাড়া আর কিছুই মানায় না।সেখানে দেওয়ালে মুখ চেপে প্রভাকরবাবুকে ফুঁপিয়ে কাঁদতে দেখি আমরা।তাঁর শান্ত কাদামনের ভেতর থেকে ব্যাঘ্রপ্রতিভার উন্মোচন আমাদের ভাবনাকে দুরপ্রসারী করে তোলে।ব্যক্তিমানুষের ভেতরের যে অবচ্ছায়া, যে ব্যবধান, একক মানুষের অন্তঃস্থলে বিভিন্ন সত্তার যে সমীকরণ  সেই গভীর মর্মলোকের উপর আলোকসম্পাত করে শ্যামলকান্তির কবিতা।শুধু কি ব্যক্তির খণ্ডিত জীবন? শুধু কি ব্যক্তির প্রলম্বিত ব্যবধান? ব্যক্তি ও নিসর্গের আত্মকথনের ভেতর থেকে দূরত্বমোচনের নিরন্তর প্রয়াসই তাঁর কবিতার প্রাণবস্তু।প্রকৃতির ভেতর জড়বস্তুর ভেতর এমনকি দৃশ্যাতীত কল্পনার ভেতর প্রাণের প্রবাহকে লিপিবদ্ধ করেন তিনি-  

পাহাড়ের ওপার থেকে মা ডাকছে।

একশো দুশো বছরের পুরনো খনখনে ডাক।

কান্নার ভিতর গলে গেল।

হুড়মুড় করে শৈলচুড়া গড়িয়ে পড়ল।( ছোট বরফ বড় বরফ)      

কবি শ্যামলকান্তি দাশের কবিতার এই সজীব উচ্চারণ কবিতার চারপাশে গড়ে তোলে অপরিহার্য আবহ। তাঁর বাচনিক কৌশল স্পর্শ করে আমাদের চেতনার রন্ধ্রপথ।আমরা দেখি শব্দের ভেতর থেকে কী অনায়াসে তিনি তুলে আনেন কবিতার যৌনশরীর

তুমি আমাকে শরীর লিখতে বললে- লিখলাম

কাগজ দেহমন্দিরের আকার নিল।

জল লিখতে বললে-দু’চার ফোঁটা লিখলাম।

পদ্মপাতায় টলটল করতে লাগল দিবাবসানের হাসি( যখন লিখেছিলাম)

জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇


জ্বলদর্চি তিরিশ পেরিয়ে... 
পদ্মপাতার উপর এই হাসি যেহেতু অস্থায়ী তাই এত সুন্দর।যা স্বল্পকালীন এবং প্রতিমুহূর্তে যেখানে হারানোর ভয়, অপ্রাপ্তির ভয় তাকেই আঁকড়ে থাকতে চায় মানুষ। রূপকথা যাকে আপাত অলীক মনে হয় আজকের  বস্তু পৃথিবীতে,এই মায়া সাম্রাজ্যের শিহরণ কিন্তু বেঁচে থাকে আমাদের মনে,আমাদের সত্তার গভীরে।তাই রূপকথার রাস্তা ধরে  বাড়ি ফিরতে হয় সকলকেই।সেখানে রাক্ষসের সাথে কথা হয়, দস্যুর সাথে কথা হয়। তখন মনে হয় এই রহস্যজগতের ভেতর লুকিয়ে আছে আমাদের প্রতিদিনের ঘাম লাগা জীবন-

রাক্ষসের সঙ্গে কথা হয়।দস্যুর সঙ্গে

কথা হয়। এমন কী  সংসারে ব্রাহ্মণীর সঙ্গেও।

একবার দুবার অন্ধকারে চোখাচোখি।

শুধু তোমার সঙ্গেই কোন কথা হয় না। কথা বলতে গেলে

কেবলই পিছলে যাও। বিদ্যুৎ ঝলসে ওঠে।(রাজকন্যা)

এই রাজকন্যা আমাদের রূপকথার জগত আলো করে। বিদ্যুৎ ঝলসে ওঠে। বিদ্যুতের আলো নিভে গেলে যখন আমরা এসে দাঁড়াই সেই পরিচিত নারীটির কাছে

রাজকন্যা, বুক ঢিপঢিপ করে আমার। আমি অপলকে

তোমার অপূর্ব ভেঙে যাওয়া দেখতে থাকি। ( রাজকন্যা) ( ক্রমশ)

Post a Comment

1 Comments