জ্বলদর্চি

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা-৫৮/প্রীতম সেনগুপ্ত

পর্ব ৫৮

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা

প্রীতম সেনগুপ্ত

 দক্ষিণেশ্বরে সুবোধের প্রথম শ্রীরামকৃষ্ণ-দর্শনের বর্ণনা দিয়েছেন বিশিষ্ট ব্রিটিশ-আমেরিকান সাহিত্যিক ক্রিস্টোফার ইশারউড তাঁর ‘Ramakrishna and his disciples’ গ্রন্থে এইরকম --“When Subodh was eighteen, his father gave him a book in which some of Ramakrishna's teachings had been recorded. This made Subodh eager to know Ramakrishna himself, and he visited Dakshineswar at first opportunity. Ramakrishna had already met Subodh's parents and he welcomed Subodh warmly. Holding the boy's hand, he meditated for a few minutes and then told him, ‘You will attain the goal; Mother says so.” দ্বিতীয় দর্শনের বর্ণনাটিও দিয়েছেন ইশারউড। সেটি বেশ আকর্ষণীয় ও এইরকম -- “During their second meeting, Ramakrishna wrote something with his finger on Subodh's tongue, saying, ‘Awake, Mother, awake!’ Then he told Subodh to meditate. Subodh felt his whole body trembling and a current rushing up his spinal column to the brain. Ramakrishna was surprised at the boy's power of concentration. Subodh explained that he had meditated regularly at home on the gods and goddesses his mothet had described to him.” শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে দ্বিতীয় দর্শনের পর ঘটল অদ্ভুত ঘটনা। এরও বর্ণনা দিয়েছেন ইশারউড --“After this meeting with Ramakrishna, Subodh began to see a strange light between his own eyebrows. His mother cautioned him never to speak about this to anyone else, for fear of some supernatural consequences. But Subodh answered, ‘What harm could it do me, mother? It's not the light I want, but That from which it comes.”
 শ্রীরামকৃষ্ণদেবের কাছে ঈশ্বরদর্শন ও প্রার্থনা বিষয়ে কীরকম উপদেশ লাভ করেছিলেন সেই বিষয়ে পরবর্তীকালে জনৈক ভক্তিমতী শিষ্যাকে ৬.১২.১৯১৬ তারিখের এক পত্রে লিখেছিলেন, “একবার আমি শ্রীশ্রীঠাকুরকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম, ‘কত পুস্তক পড়িয়াছি ও কত লোকের নিকট গল্প শুনিয়াছি; ঠাকুর-দেবতা দেখিতে পাওয়া যায় কি না?’ তিনি বলিলেন, ‘যেমন দুইজনে একসঙ্গে বসে গল্প করে, বেড়াইয়া বেড়ায়, এইরকম দেখিতে পায়। তবে ঠিক ঠিক অন্তরের সহিত ডাকিতে হয়। ঠাকুরকে কাঁদাকাটি করিয়া ডাকিতে হয়; তাঁর কাছে আবদার করিতে হয় -- যেমন ছোট ছেলেমেয়ে মার কাছে কাঁদাকাটি করিয়া কোন জিনিসপত্র চায়, সেইরকম ডাকিতে হইবে। মন হইতে অন্য পাঁচরকম বাসনা-কামনা সমস্তই তাড়াইতে হইবে -- ‘শুধু আমার মা আছেন, আমি আছি’।” আবার অন্যান্য বিষয়ে ঠাকুরের উপদেশ সম্বন্ধে একটি পত্রে ( ২২.২.১৯২৮ ) তিনি লিখেছেন -- “ঠাকুর বলিতেন, ‘যাহাদের ধর্ম-সম্বন্ধে কিছু হইবার, এখানকার হাবভাব তাহাদের সমস্তই ভাল লাগিবে।’ আমি ঠাকুরের কাছে ঐসমস্ত কথা শুনিয়াছি। ... ঠাকুর আরও বলিতেন, ‘যার হেথায় আছে, তার সেথাও আছে; যার হেথায় নাই, তার সেথায়ও নাই’।” (শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তমালিকা, ২য় ভাগ, স্বামী গম্ভীরানন্দ প্রণীত )
 শ্রীরামকৃষ্ণ সন্নিধানে আসার পর পড়াশোনায় আগ্রহ হারালেন সুবোধ। শ্রীরামকৃষ্ণ-সঙ্গে অতিবাহিত করতে পছন্দ করতেন। ধ্যান, প্রার্থনা ও ঈশ্বরের নাম জপ ছিল তাঁর প্রিয়। কোনও কোনও দিন দক্ষিণেশ্বর থেকে বাড়ি ফিরতে দেরি হত, গৃহশিক্ষক অপেক্ষা করে থাকতেন তাঁর জন্য। একদিন গৃহশিক্ষক বললেন, “তুমি পড়াশোনায় বড্ড বেশি অবহেলা করছ। সময়ানুবর্তিতা মেনে না চললে তোমার পিতার কাছে অভিযোগ করব।” সুবোধ এর উত্তরে বলেন, “আমার পিতা কি করবেন? তিনি তো পড়াশোনা করছেন না, করছি আমি। আমি যদি মনে করি লেখাপড়া করব না, তাহলে কেউই আমায় জোর করে পড়াশোনা করাতে পারবে না। তবে আপনি অনুগ্রহপূর্বক যেমন আসছেন তেমন আসুন। আমি আমার সময় ও মনযোগ অনুযায়ী অবশ্যই পড়াশোনা করব।” গৃহশিক্ষক সুবোধের কথায় বিস্মিত হলেন এবং কর্তব্যবোধের প্রেরণায় গোটা বিষয়টি সুবোধের পিতা কৃষ্ণদাসকে জানালেন। স্বভাবতই উদ্বিগ্ন পিতা বললেন, “এটা অত্যন্ত চিন্তার বিষয়। তবে ওঁর উপর বেশি চাপ সৃষ্টি না করাই ভালো। আমি লক্ষ্য করেছি ও যখন পড়ে তখন মনযোগ সহকারেই পড়ে।”
 কথামৃতকার শ্রীমর সঙ্গে ১৮৮৫ সালের ৩১ অগাস্ট শ্রীরামকৃষ্ণদেবের সাক্ষাৎকালে ঠাকুর শ্রীমকে বললেন, “অন্য একদিন দুটি ছেলে এখানে এসেছিল। এঁদের মধ্যে একজন সুবোধ, সে শঙ্কর ঘোষের প্রপৌত্র। অন্যজন ক্ষীরোদ, ওঁর প্রতিবেশী। চমৎকার ছেলে দুটি। আমি ওঁদের বলে দিয়েছি যে আমার শরীর ভালো নয়, তাই তোমার নির্দেশ অনুযায়ী চলতে। ওঁদের দিকে একটু নজর দিও।” বাড়ি ফিরে তিনি সুবোধকে তাঁর গৃহে আসবার আমন্ত্রণ জানিয়ে পত্র পাঠালেন। কিন্তু সুবোধ তাঁর কাছে গেলেন না এই ভেবে যে, একজন গৃহীর কাছ থেকে আধ্যাত্মিক নির্দেশ লাভ করা অর্থহীন। কিছুদিন পর সুবোধ আবার দক্ষিণেশ্বর গেলেন। ঠাকুর দুই তরুণ ভক্ত শরত ও শশীর সঙ্গে তাঁর পরিচয় করিয়ে দিলেন। পরস্পরের সঙ্গে মেলামেশা করার নির্দেশ দিলেন যাতে তাঁরা পরস্পরকে ভালোভাবে চিনতে ও জানতে পারে। সুবোধ তাঁদের বললেন, “আমি তোমাদের বাড়ি যাব, কিন্তু তোমরা আমার বাড়ি এস না -- কারণ এর ফলে আমার পিতা উন্মাদপ্রায় হয়ে উঠবেন।” এইসব তরুণ ভক্তদের পিতামাতারা যাতে নিজ সন্তানকে নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত না হয়ে পড়েন সেই বিষয়ে সর্বদাই যত্নবান থাকতেন ঠাকুর। সুবোধের খোলাখুলি কথাবার্তা ও স্বাভাবিক বোধবুদ্ধিতে খুশি হলেন। সেই সময় ঠাকুর গলায় কর্কট রোগে আক্রান্ত। রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পাওয়ায় তিনি বেশি কথা বলতে পারছিলেন না। শশী ও শরতকে বললেন সুবোধের সঙ্গে নরেন্দ্রর পরিচয় করিয়ে দিতে, যাঁকে তিনি এই তরুণদের নেতা নির্বাচিত করেছিলেন!

জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇


জ্বলদর্চি তিরিশ পেরিয়ে... 
 কিছুদিন পর ঠাকুর সুবোধকে জিজ্ঞেস করলেন, “মহেন্দ্র'র ( মহেন্দ্র অর্থাৎ শ্রীম ) বাড়ি তোর বাড়ির কাছেই। তুই তাঁর কাছে যাস না কেন?” সুবোধ উত্তর দিলেন, “তিনি সংসার ত্যাগ করতে পারেন নি, সুতরাং আমায় কীভাবে ঈশ্বরের বিষয়ে উপদেশ দেবেন?” একথা শুনে ঠাকুর প্রবল হাস্যমুখর হয়ে উঠলেন। বললেন, “ওরে রাখাল, শুনেছিস শালা খোকা কী বলছে?” তবে সুবোধের ত্যাগ প্রবণতায় খুশি হলেন। কিন্তু বললেন, “ও তোকে নিজের কথা বলবে না, আমার কাছে যা শুনেছে শিখেছে সেইসবই বলবে। ওঁর কাছে যেতে কোনও দ্বিধা করিস না।”

Post a Comment

0 Comments