জ্বলদর্চি

সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত // ঈশিতা ভাদুড়ী

স্মৃতি ডট কম ১৩
সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত // ঈশিতা ভাদুড়ী 


কবে ঝড় দামাল/ নীলের বিখ্যাত শূন্য করেছিল নীল আরো,/ কবে মেঘ বর্ষামুখর/ চলে গেল অন্য কোনো অনুবাদ-অযোগ্য আকাশে.../ এইসব যতিচিহ্নহীন ব্যকরণে/ বেড়ে উঠেছে যে গাছ/ খনিজ পাহাড় চেনে তাকে কতটুকু/ অথবা সুবর্ণরেখা?/ শীতের অলস কলকাতা চেনে সেই গাছটিকে/ আর কার্নিশে শালিখ-সকালও/ সে গাছ কেমন/ জানে জলের ভাষা অথবা মেঘের অনুবাদ,/ বিষণ্ণ কিশোরীর বিষাদ/ সে কেমন দিয়েছে মুছে/ দীর্ঘ লম্বা সেই গাছটি...
যে কবিকে নিয়ে লেখা এই সব লাইন, তিনি হলেন পঞ্চাশ দশকের অন্যতম উল্লেখযোগ্য কবি সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত। সচেতনভাবে সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকম কবিতা একের পর এক নির্মাণ করেছেন। ১৯৬২তে ‘যে কোনো নিঃশ্বাসে’ গ্রন্থে যেমন লিখেছেন ‘কোন কোন বুক থেকে দুঃখ বড় শব্দ করে আর্তনাদ করে’, সেই তিনিই ১৯৭৪-এ ‘ধ্যানে ব্যবধানে’তে লিখলেন ‘সাদা শাড়ি ছাড়া ছিল তোমার মৃত্যুকে ঢাকা বারণ মল্লিকা’, আবার আশির দশকে তিনি লিখলেন ‘প্রেম ভাল, তার আগে ভাল দেশপ্রেম, রমণী শেখার আগে/ মানুষ তো চিরকাল জননীকেই প্রথম শিখেছে’। নব্বইতে লিখলেন ‘অনির্বাণ হাতকড়া আরেকটু এগিয়ে এসো/ এসো হে দাম্ভিক লোহা বর্তুল আহ্লাদ/ চামড়ার ওপরে এসে বসো’, পরবর্তীকালে ‘আমার সময় অল্প’ তে কবি লিখলেন ‘নৌকা থেকে নেমে যাবো আমি, অক্ষরপ্রকল্প/ থামিয়ে শয্যাকে ডাকবো/ বলবো, এসো, ভালো করে এসে শেষবার নিচে শোও/ আমার সময় অল্প’। এইভাবেই বিভিন্ন সময় নতুন নতুন বাঁক তাঁর কবিতায় আমরা দেখতে পাই। 
চেতনার বিভিন্ন স্তরে ছিল তাঁর বিচরণ। ইন্দ্রিয়পরতা ছাড়িয়ে অতীন্দ্রিয়তার দিকে তাঁর কবি-সত্তার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। মনন-ধর্মের অসীম ব্যাপ্তিতে তাঁর কবিতা-চর্চা। তাঁর কবিতা ভাবিত করে আমাদের। সুখ-দুঃখের নিবিড় অনুভবের মধ্যেও মননশীলতার প্রকাশ তাঁর কবিতায়। ১৯৩৫ সালে ঢাকা শহরে তাঁর জন্মগ্রহন। পরবর্তীকালে দেশভাগের কারণে তাঁকে আরও অনেকের মত কলকাতায় চলে আসতে হয়। কিন্তু তিনি কখনো বাংলাদেশকে অন্যদেশ বলে মনে করেন নি। ‘৪৭-এর সেই রক্তাক্ত দেশভাগ বালক সমরেন্দ্র সেনগুপ্তকে এমনই আকুল করেছিল, সেই বেদনা এবং দেশপ্রেম তিনি সারাজীবন বহন করে বেড়িয়েছেন। তাঁর কবি-মানসের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছিল তার বীজ। এবং আমরা তার প্রকাশ তাঁর বিভিন্ন কবিতায় দেখেছি। তাঁর সঙ্গে বাংলাদেশ ভ্রমণে তাঁর বিপুল জনপ্রিয়তা টের পেয়েছি। সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত মানুষ হিসেবে অনেক বড় মাপের ছিলেন। খুব সবুজ ছিলেন। নবীন প্রবীন সকল কবি লেখকের সঙ্গেই ছিল তাঁর যোগাযোগ। বলতে দ্বিধা নেই, আমরা যারা কোনো গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত নই, নির্বিবাদে সমরেন্দ্রদা তাঁদের সংগে যুক্ত ছিলেন। তিনি তরুণ কবিদের বন্ধু ছিলেন, মোটেই পক্ষপাতদুষ্ট ছিলেন না।
সচেতনভাবে সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকম কবিতা একের পর এক নির্মাণ করেছেন। ১৯৬২তে ‘যে কোনো নিঃশ্বাসে’ গ্রন্থে যেমন লিখেছেন ‘কোন কোন বুক থেকে দুঃখ বড় শব্দ করে আর্তনাদ করে’, সেই তিনিই ১৯৭৪-এ ‘ধ্যানে ব্যবধানে’তে লিখলেন ‘সাদা শাড়ি ছাড়া ছিল তোমার মৃত্যুকে ঢাকা বারণ মল্লিকা’, আবার আশির দশকে তিনি লিখলেন ‘প্রেম ভাল, তার আগে ভাল দেশপ্রেম, রমণী শেখার আগে/ মানুষ তো চিরকাল জননীকেই প্রথম শিখেছে’। নব্বইতে লিখলেন ‘অনির্বাণ হাতকড়া আরেকটু এগিয়ে এসো/ এসো হে দাম্ভিক লোহা বর্তুল আহ্লাদ/ চামড়ার ওপরে এসে বসো’, পরবর্তীকালে ‘আমার সময় অল্প’ তে কবি লিখলেন ‘নৌকা থেকে নেমে যাবো আমি, অক্ষরপ্রকল্প/ থামিয়ে শয্যাকে ডাকবো/ বলবো, এসো, ভালো করে এসে শেষবার নিচে শোও/ আমার সময় অল্প’। এইভাবেই বিভিন্ন সময় নতুন নতুন বাঁক তাঁর কবিতায় আমরা দেখতে পাই। 

একসময়ে আকাশবাণীর জন্য তিনি একাধিক গান রচনা করেছিলেন। সেই সব গানে ঞ্জানপ্রকাশ ঘোষ, ভি বালসারা, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের মত সুরকাররা সুর দিয়েছেন। ‘অঙ্গে অঙ্গে জলতরঙ্গে/ শ্রাবন বাজায় কে/ বলো শ্রাবন বাজায় কে/ আমার আঁখি দুষ্টু পাখি/ খাঁচায় ভরে কে’ – মৃনাল চক্রবর্তীর সুরে এই গান যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়েছিল একসময়। অথচ গীতিকার সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত আজ সম্পুর্ণই বিস্মৃত।

অনুবাদক হিসেবেও তাঁর ভুমিকা যথেষ্ট উল্লেখযোগ্য ছিল। ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট ও সাহিত্য আকাদেমির সঙ্গে তিনি কাজ করেছেন অনুবাদক হিসেবে। কবি, গদ্যকার, গীতিকার এবং অনুবাদক সমরেন্দ্র সেনগুপ্তর পাশাপাশি সম্পাদক সমরেন্দ্র সেনগুপ্তও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি বিভিন্ন সময় কৃত্তিবাস, পাক্ষিক বসুমতি ইত্যাদি সম্পাদনার কাজ করে থাকলেও তাঁর সম্পাদনায় ‘বিভাব’ পত্রিকাটি বাংলা সাহিত্য-ক্ষেত্রে দায়িত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, বিষয়ের অভিনবত্বে, রচনার গুরুত্বে ও সর্বোপরি সম্পাদনার কুশলতায় ‘বিভাব’-এর অনবদ্যতা অনস্বীকার্য। জীবনানন্দ দাশ শতবর্ষ সংখ্যা, দিলীপ কুমার গুপ্ত, কমল কুমার মজুমদার, সৈয়দ মুজতবা আলী ইত্যাদি – এই সব বিশেষ সংখ্যাগুলি অমূল্য রয়ে যাবে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে।
তিনি সাহিত্য আকাদেমী পুরস্কার, রবীন্দ্র পুরস্কার পেয়েছেন। এছাড়া জসীমুদ্দিন পুরস্কার, বিষ্ণু দে পুরস্কার এবং অন্যান্য আরও অনেক পুরস্কারও পেয়েছেন। ১৯৭৮-এ আকাশবাণী থেকে জাতীয় কবির সম্মান পেয়েছিলেন। ১৯৮৬তে রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে আমেরিকাতে কবিতা পড়তে যান, নিউ অরলিয়েন্স-এর মেয়র তাঁকে আন্তর্জাতিক নাগরিকের সম্মানে ভূষিত করেন। 
আজ সমরেন্দ্রদা নেই, আর কেউ কলকাতা থেকে পাটনাতে আমাকে ফোন করে বলবেন না “এই ছেমড়ি, এক্ষুনি দু’তিনটে কবিতা পাঠা’ বিভাব-এর জন্যে”। আর কেউ ইলিশ মাছ খাওয়ার জন্য আবদার করবেন না। মানুষ সমরেন্দ্রদার অনেক স্মৃতি।

পেজে লাইক দিন👇

জ্বলদর্চি তিরিশ পেরিয়ে... 

Post a Comment

0 Comments