জ্বলদর্চি

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা-৫৭/প্রীতম সেনগুপ্ত

পর্ব ৫৭
শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা

প্রীতম সেনগুপ্ত

 স্বামী সুবোধানন্দ

প্রকৃত ধর্ম সর্বদাই সরলতার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে সম্পর্কযুক্ত। হিসেবি, কৌশলী মানুষ পার্থিব স্তরে সাফল্য লাভ করতে পারে, কিন্তু আধ্যাত্মিকতায় কখনওই নয়।
 আধ্যাত্মিক সত্য উপলব্ধি করতে হলে প্রয়োজন শিশুর মতো ঈশ্বরবিশ্বাসী হওয়া, তাত্ত্বিক বা দার্শনিক হওয়া নয়। তত্ত্ব বা দর্শন ঈশ্বরের ধারণা অনাবশ্যক জটিল বা দুরূহ করে তোলে। সুবোধ ছিলেন এমনই এক ঈশ্বরবিশ্বাসী সরল দিব্যভাবসম্পন্ন শিশু। শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁকে বলতেন ‘খোকা’, সমগ্র জীবন খোকার সারল্য নিয়েই তিনি অতিবাহিত করেন। হয়ে ওঠেন দিব্য মানুষ। 
 ১৮৬৭ সালের ৮ নভেম্বর কলকাতার ২৩ নং শঙ্কর ঘোষ লেনে জন্মগ্রহণ করেন সুবোধচন্দ্র ঘোষ। তাঁর পিতা কৃষ্ণদাস ঘোষ ও মাতা নয়নতারা দেবী ধর্মপ্রাণ হিন্দু ছিলেন। ঠনঠনিয়ায় সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দিরটি ছিল ( অধুনা ঠনঠনিয়া কালীবাড়ি নামে পরিচিত ) তাঁদের পারিবারিক। ১৮৫২ সালে কলকাতায় প্রথম পদার্পণ করেন শ্রীরামকৃষ্ণ। এই মন্দিরের নিকটবর্তী স্থানেই সেইসময় তিনি থাকতেন। ফলে প্রায়ই মন্দিরে মায়ের দর্শন করতেন। চিরাচরিত হিন্দু ধর্মের মানুষ হয়েও ধর্মীয় সামাজিক প্রতিষ্ঠান ব্রাহ্ম সমাজের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল কৃষ্ণদাসের। তাঁর সন্তানদের সঙ্গে করে নিয়ে ব্রাহ্ম সমাজে যেতেনও। সেখান থেকে তাঁদের জন্য ধর্মীয় পুস্তকাদিও কিনতেন। সন্ধ্যায় সুবোধের মমতাময়ী জননী ভাগবত, রামায়ণ কিংবা মহাভারত থেকে নানা কাহিনি শোনাতেন সন্তানদের। এইসব কাহিনি শ্রবণের ফলে বাল্যকাল থেকেই সুবোধের মধ্যে ধর্মপ্রবণতা লক্ষ্য করা গিয়েছিল। পরবর্তীকালে সেই কথা স্মরণ করে সুবোধ বলেছিলেন, “অল্প বয়স থেকে পবিত্র মানুষদের জীবনকথা পাঠ করতাম, লক্ষ্য করতাম তাঁদের জীবনে রূপান্তর ঘটেছে কীভাবে।”

 বালক সুবোধ সাঁতার জানতেন না বলে নৌকায় চাপতে ভয় পেতেন। ভয় পেতেন অন্ধকার, তাই পিতামহীর কাছে শয়ন করতেন। তাঁকে নিয়ে এমন এক পূর্বাভাস ছিল যে তিনি গৃহে থাকবেন না, পরিভ্রমণরত সন্ন্যাসী হয়ে একাকী বিচরণ করবেন। অন্ধকারের ভয় জয় করতে তাই সর্বদা সচেষ্ট থাকতেন। এক অন্ধকারাচ্ছন্ন সন্ধ্যায় সুবোধ ও তাঁর পরিবারের অন্যান্য শিশুরা শয়নকক্ষে কোলাহল করতে করতে ক্রীড়ারত ছিল। এমন সময় সুবোধ জননী কম্বল মুড়ি দিয়ে সেই ঘরে প্রবেশ করলেন তাদের ভীতি প্রদর্শনার্থে। সকলে ভয়ে চিৎকার করে উঠলে তিনি কম্বলটি খুলে ফেলেন। বালক সুবোধ যখন দেখলেন যাকে দেখে তাঁরা এতক্ষণ ভয় পাচ্ছিলেন তিনি আদতে তাঁর জননী, সেই ক্ষণ থেকে অন্ধকারের ভয় তাঁর মন থেকে চিরতরে মুছে গেল।

 বাল্যকাল থেকেই সুবোধ ছিলেন শান্ত, সরল ও সুমিষ্ট স্বভাবের। সঙ্গে সঙ্গে স্পষ্টভাষী। অ্যালবার্ট কলেজিয়েট স্কুলে তাঁকে ভর্তি করা হয়। মেধাবী ছাত্র ছিলেন, অসম্ভব ভালো ছিলেন গণিতে। ক্লাসে এই বিষয়টিতে সবচেয়ে বেশি নম্বর পেতেন। সপ্তম শ্রেণিতে হেয়ার স্কুলে ভর্তি হন। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় তাঁর পিতা স্থির করেন সুবোধকে বিবাহ দেবেন। সুবোধের পরিবার ছিল ধনী এবং সেই সময় কৈশোরে বিবাহের প্রথা চালু ছিল। যাই হোক বিবাহের কথা শুনে সুবোধ পিতৃদেবকে বললেন, “দয়া করে আমায় বিবাহের জন্য জোরজার করবেন না।” উত্তরে পিতা বললেন, “কেন? তুমি ভালো পড়াশোনা করছ, পরীক্ষায় ভালো ফল করছ। আমরা এক অভিজাত পরিবারের কন্যার সঙ্গে তোমার বিবাহ স্থির করেছি।” সুবোধ পিতার এই কথা শুনে বললেন, “আপনি যদি আমায় জোর করেন তাহলে আমি আপনার আদেশ পালন করব। কিন্তু বিবাহান্তে গৃহ পরিত্যাগ করব। সাংসারিক জীবন আমার জন্য নয়। অনুগ্রহ করে আমায় বিড়ম্বনায় ফেলবেন না।” 

পিতৃদেব জানালেন, “ঠিক আছে এই নিয়ে আমরা এখন আর কথা বলব না।” এদিকে এই ঘটনায় সুবোধ বুঝে নিলেন যদি তিনি পরীক্ষায় ভালো ফল করেন, ভালো নম্বর পান তাহলে পিতৃদেব তাঁর বিবাহদানে সচেষ্ট হবেন। ফলতঃ পড়াশোনায় কঠোর পরিশ্রমে বিরত হলেন এবং ঈশ্বরে কাছে একান্তভাবে প্রার্থনা করলেন যাতে পরীক্ষার ফলে খুব খারাপ নম্বর পান। সেটা হলও। শিক্ষকরা অষ্টম শ্রেণিতে তাঁকে আরও এক বছর থেকে যেতে বললে সুবোধ বিদ্যাসাগরের স্কুলে ভর্তি হলেন। এই স্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন কথামৃতকার শ্রীম। 
 পরীক্ষায় খারাপ ফলের কারণে সুবোধের পিতাও ওঁর বিবাহের বিষয়ে উৎসাহ হারিয়ে ফেললেন। ১৮৮৫ সালের কোনও এক সময়ে সুবোধের পিতা কৃষ্ণদাস তাঁকে শ্রীরামকৃষ্ণদেব সম্পর্কে অবহিত করেন। শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে কেশবচন্দ্র সেনের সাক্ষাতের কথাও বলেন। ব্রাহ্ম পত্রিকাসমূহে ইতিমধ্যে সুবোধ শ্রীরামকৃষ্ণদেব সম্পর্কে কিছু লেখাও পড়েছিলেন।
 একদিন কৃষ্ণদাস সুবোধকে একটি বই উপহার দিলেন। বইটি হল -- শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের উক্তি। ১৮৮৪ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রকাশিত এই বইটির সঙ্কলক ছিলেন সুরেশচন্দ্র দত্ত। বইটি পাঠ করে অসম্ভব মুগ্ধ হলেন সুবোধ। শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে সাক্ষাতের বাসনা জাগল তাঁর অন্তরে। পিতাকে এই বাসনার কথা নিবেদন করলে তিনি কোনও ছুটির দিনে সপরিবারে শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে যাবেন এমন প্রতিশ্রুতি দিলেন।
 গুপ্ত ঐশ্বর্যের সন্ধান পেলে কোনও মানুষের পক্ষেই সেটি প্রত্যক্ষ না করা পর্যন্ত ধৈর্য বজায় রাখা সম্ভব হয় না। একই অবস্থা হয়েছিল সুবোধেরও। ছুটির দিন পর্যন্ত তাঁর পক্ষে অপেক্ষা করাটা কঠিন হয়ে পড়ল। তাই ১৮৮৫ সালের অগাস্ট মাসের এক সকালে বন্ধু ক্ষীরোদ চন্দ্র মিত্রকে সঙ্গে নিয়ে দক্ষিণেশ্বর অভিমুখে রওনা দিলেন। কিন্তু দক্ষিণেশ্বরের অবস্থান বিষয়ে তাঁদের কোনও ধারণা ছিল না। এটি কলকাতার উত্তরে গঙ্গার ধারে এইটুকুই জানা ছিল। কিছু পথ অতিক্রমের পর পথ হারিয়ে ফেললেন তাঁরা। সুবোধ খুবই উৎকণ্ঠায় পড়ে গেলেন, কারণ গুরুজনেরা তাঁকে এইভাবে যাওয়ার অনুমতি দেন নি। অন্যদিকে ক্ষীরোদ ধীরতা বজায় রাখেন এবং সুবোধকে শান্ত থাকার পরামর্শ দেন। এইভাবে একসময় তাঁরা আড়িয়াদহ পৌঁছলেন, সেখানে এক ব্যক্তি তাঁদের দক্ষিণেশ্বর যাওয়ার কম দূরত্বের রাস্তাটি বাতলে দেন। যেটি ছিল ধানক্ষেতের মধ্য দিয়ে। অবশেষ তাঁরা একসময় দক্ষিণেশ্বরে এসে পৌঁছলেন। বস্তুতপক্ষে শ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্ঘের রূপকার ছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণদেব স্বয়ং। তিনিই তৈরি করেছিলেন তাঁর সৈনিকদের। সুবোধ ছিলেন সেরকমই এক সৈনিক, যিনি ছিলেন অবতারের লীলা পার্ষদ। তাই দক্ষিণেশ্বরে শ্রীরামকৃষ্ণদেবের দর্শনে সুবোধের প্রথম আগমন সঙ্ঘের ইতিহাসে অতি তাৎপর্যপূর্ণ একটি ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে।

পেজে লাইক দিন👇
জ্বলদর্চি তিরিশ পেরিয়ে... 

Post a Comment

0 Comments