জ্বলদর্চি

যেতে যেতে পথে-৫৮/রোশেনারা খান

যেতে যেতে পথে

রোশেনারা খান

পর্ব ৫৮

ডার্বিশায়ারে খুব সুন্দর সুন্দর বেড়ানোর জায়গা আছে। একদিন ‘ডাবডেল’ নামে একটি জায়গা গেলাম। পাহাড় নদী আর জঙ্গলের সমন্বয়ে অপূর্ব সব মনভোলানো দৃশ্য দেখে কিছু সময়ের জন্য মনে হল যেন অন্য এক পৃথিবীতে এসে পড়েছি। তির তির করে ১২/১৩ ফিটের অগভীর একটি নদী বয়ে চলেছে। নদীর বুকে মা’হাঁস ছানাপোনা নিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে। নদীর একদিকে নেড়া পাহাড়, আর একদিকে পাহাড়কে ঢেকে রেখেছে সবুজ জঙ্গল। নদীটি এঁকেবেঁকে জঙ্গলের ভিতরে হারিয়ে গেছে। একহাঁটুরও কম জলের ওপর পাথর খণ্ড ফেলে তার ওপর দিয়ে লোকজন নদীর এপার ওপার যাতায়াত করছে। এই পথ ধরে অনেকেই পাহাড়ে উঠছেন। বাচ্চারা জলে নেমে খেলা করছে। যেখানে জল বেশি সেখানে কয়েকজন তরুণী বিকিনি পরে নেমে পড়েছে। অন্যদের অনুসরণ করে আমরাও পাহাড়ে উঠতে শুরু করলাম। কিছুটা ওঠার পর খান সাহেব বসে পড়ে বললেন,আমি  আর পারবনা। অগত্যা মেয়ে থেকে গেল বাপির কাছে, আমি দীপ আর জারা এগিয়ে চললাম। ওপরে ঝোপ ঝাড়ে ভরা কিছুটা সমতল ও তার ওপর ছোট্ট  একটা ঢিপি। এখান থেকে রাস্তা নিচে নেমে গেছে, নিচে নামার আর সাহস হলনা,  আমরা আবার ফেরার পথ ধরলাম। কিন্তু এত মানুষ নিচে কেন নামছে? জানার কৌতূহল নিবারণের জন্য একজনকে জিজ্ঞেস করে জানলাম, নিচে একটি কুয়ো আছে। কোনো একসময়ে নিচের ওই গ্রামে একবার  প্লেগ মহামারির আকার ধারণ করেছিল। তখন এই কুয়োর জল পান করে সবাই সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন। সেই কুয়ো দেখার জন্যই মানুষ চলেছে।
চ্যটসওয়ার্থ এ বাবা মেয়ে।

     আমরা এখান থেকেই ফেরার জন্য নামতে শুরু করলাম। সঙ্গে খাবার ও  কফি ছিল। নদীর ধারে বসে খাবার খেয়ে আমরা আরও কিছু দেখার জন্য এদিক ওদিক হাঁটতে লাগলাম। জারা হাতের ম্যাপে চোখ রেখে নানুর সঙ্গে হেঁটে চলছে। একদল লোক মাংস ও অন্যান্য রান্নার জিনিস নিয়ে পাহাড়ের দিকে চলেছে। পিকনিক হবে নিশ্চয়। কয়েকদিন আগে ইদ গেছে, তার সেলিব্রেশনও হতে পারে। এদেশে দেখার জিনিসের শেষ নেই। একদিন অনলাইনে টিকিট কেটে আমাদের   চ্যাটসওয়ারথ(Chatsworth)  যাওয়া হল। দীপ জারাকে ছোটদের খেলার জায়গায় নিয়ে গেল। আমরা তিনজন হাঁটতে শুরু করলাম। এক জায়গায় মুদ্রা দিয়ে তৈরি পাশাপাশি দুটি চেয়ার দেখতে পেয়ে এগিয়ে গেলাম। একটা চেয়ারে উনি বসলেন আর আমি পিছনে দাঁড়িয়ে ছবি তুললাম। একটু এগিয়ে গ্রিন হাউসের ভিতরে ঢুকে দেখলাম টেম্পারেচারের ব্যাল্যান্স রেখে গ্রীষ্মপ্রধান দেশের নানা রকম গাছ লাগানো হয়েছে। গুলঞ্চ, পেঁপে, কলা, বেদানা ইত্যাদি গাছ রয়েছে। এখানে এতকিছু  দেখার জিনিস রয়েছে যে একদিনে তা কোনও ভাবে দেখা সম্ভব  নয়। যেটুকু দেখি তা সবিস্তারে লিখলে একটা করে প্রবন্ধ হবে। এখানে ছোট বড় কত রকম জলাশয়। জলাশয়ের বুকে ফোয়ারা মন জুড়িয়ে দিচ্ছে। এছাড়াও রয়েছে ক্যাসেল, গিফটশপ, রেস্টুরেন্ট, পাহাড়, ঝর্ণা, কত রকম গাছ, ফুল পাখি, মাছ। এক যায়গায় যন্তর-মন্তরের মত একটা গোলকধাঁধা রয়েছে। কিছুটা ভিতরে ঢুকে  পথ হারানোর ভয়ে বেরিয়ে এলাম।  আজ আমি যেন আমি নই, আমার শৈশব  কৈশোর ছুটে বেড়াচ্ছে। প্রসস্থ সবুজ মাঠে কতরকম খেলার জিনিস ছড়ানো রয়েছে। কোথাও পাহাড়ের গা বেয়ে সিঁড়ি উঠে গেছে, মনে হচ্ছে যেন আকাশ থেকে নেমে  এসেছে। কোথাও পাহাড়ের জল পাহাড় থেকে গড়িয়ে নেমে ধাপে ধাপে গড়িয়ে নিচে নেমে স্রোত হয়ে বয়ে চলেছে। এসব ছাড়াও কিচেন গার্ডেনে বিনস, কপি, শিম,  ইত্যাদি কত রকমের সবজি ফলে আছে, দেখে মন ভরে গেল।

জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇



       গোটা  অগাস্ট মাস এখানের স্কুলে সামার ভ্যাকেসন চলে। ঐসময়  নটিংহামের সিটি সেন্টারে নকল সি বিচ বানান হয় বাচ্চাদের খেলাধুলা করার জন্য। প্রচুর বালি ফেলা হয়। বালিতে ঘর বানানোর জন্য ছোট ছোট বালতি, বেলচা রয়েছে। জলে ভাসমান  বেলুনে প্রবেশ করে অনেক বাচ্চা ভাসছে, বেশিরভাগ ছেলে-মেয়ে ভেতরে ঢুকে কান্নাকাটি করলেও জারা খুব মজা পাচ্ছিল। জাহাজের মত দেখতে নাগরদোলাও রয়েছে, ফোয়ারা রয়েছে। বাচ্চারা যে যার মত  জলে, না হলে বালিতে কেলছে। সঙ্গে বড়রাও রয়েছেন।

    একদিন সিটিসেন্টারে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে দীপ বলল, এটা লেস মার্কেট,  কোনো এক সময় বাড়ির পুরুষরা দীর্ঘ সময়ের জন্য যুদ্ধে গেলে মহিলারা হাতে লেস বুনে এই মার্কেটে বিক্রি করে সংসার চালাতেন। সেই থেকেই এই মার্কেটের নাম লেস মার্কেট। এখনও ২/১ টি পরিবার রয়েছে যারা লেস তৈরি করে। কার্ললুইসের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দীপ জানাল, এখানে কোনও সেলসম্যান নেই,  যারা  কাজ করেন এখানে, তাঁরা প্রত্যেকেই কার্ললুইসের মালিক বা অংশীদার।
       জুতোর শেল্ফ ও আরও কিছু কেনার জন্য একদিন বিশ্বখ্যাত শয্যা বিপণি ‘আইকিয়া’ গেছলাম। এই কোম্পানির মালিক প্রথম জীবনে একজন ছুতোর ছিলেন। আজ তাঁর জিনিস সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। আইকিয়ার ভিতরে ঢুকে আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে থাকলাম! কি নেই এখানে? সংসারের প্রয়োজনীয় সমস্ত রকম জিনিস রয়েছে। এক একটা রুম এক এক রকমভাবে সাজিয়ে রাখা আছে। বাচ্চাদের ভাল লাগার জন্য মজার মজার খেলার ব্যবস্থা রয়েছে। এদেশে সব কাজের জন্য সবসময় মিস্ত্রী বা মেকানিক পাওয়া যায় না। গেলেও তার হাজিরার  মুল্য  অনেক। তাই ছবি ও  নির্দেশিকা দেখে ছোটখাটো জিনিস বাড়িতে নিজেদের  ফিট  করে নিতে হয়। এখানে একটা ছেলে পুতুল দেখে খুব কিনতে ইচ্ছে করছিল। মেয়েরাই মায়ের কাছে পুতুল কেনার জন্য আবদার করে। সেখানে মা হয়ে কী করে মেয়েকে পুতুল কিনে দিতে বলব? তাই লজ্জায় বলিনি। বাড়িতে এসে পুতুলের কথা বলতে, বাবলি একদিন গিয়ে আইকিয়া থেকে আমার পছন্দের পুতুলটি কিনে দিয়েছে। আমি ওর নাম রেখেছি ‘ফুল’। এখানে সময় কাটাতে নাতনি জারার জন্য বেশ কয়েকটা সোয়েটার বানিয়েছি। ফুলকেও বানিয়ে দিলাম।

      দেশের কোনও খোঁজখবর রাখছি না। দেশের কথা মনে করতে গেলে অনেক কিছুই মনে পড়ে যায়, তাই ভুলে থাকারই চেষ্টা করি। যদিও চেষ্টা করেও কিছু লাভ হয় বলে বলে মনে হয় না। যা হওয়ার সেটায় হবে। মাঝে মাঝে  ভাবি, যাক না জীবন যেদিকে যেতে চায়। আমি শুধু একটুখানি শান্তি চাই। তাই ওরা এদিক সেদিক যেদিকে নিয়ে যায় চলে যায়। এভাবেই একদিন ‘জংশন ২৬ ফ্যাক্টরি আউটলেট’ গেলাম হ্যান্ডব্যাগ আর স্যান্ডেল কিনতে। ফ্যাক্টরি থেকে সরাসরি বিক্রি হয় বলে এখানে সব জিনিসের দাম কিছুটা কম। ৩০ পাউণ্ড (প্রায় ৩০০০ টাকা) দিয়ে একজোড়া স্যান্ডেল নিলাম আর ২৫ পাউণ্ড দিয়ে একটি ব্যাগ নিলাম।  

    আগের বার বলেছিলাম নটিংহামে পুরনো জিনিস বিক্রির হাটের কথা। এবারেও একদিন নিনাদির সঙ্গে ওই হাটে গেছলাম। ওখানেই সুপ্রীতিদিদের বাড়ি। ওঁকেও সঙ্গে নিলাম। টুকটাক শপিং করে সুপ্রিতীদির বাড়ি গেলাম। ওনার স্বামীর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন। ওখানেই লাঞ্চ করার পর অনেক গল্প হল। বিকেলে বাড়ি ফিরলাম। সুপ্রিতীদিকে বেশ সরল মনের মানুষ বলেই মনে হয়। নিনাদি খুবই ব্যাক্তিত্বময়ী ও বেশ সুন্দরী। কলকাতার বনেদী পরিবারের মেয়ে, স্বামী এখানকার জিপি ছিলেন, নিজেও ডাক্তার। এখানে থাকা কালেই একদিন সুপ্রীতিদি ফোন করে জানালেন, নিনাদির জামাইবাবু মারা গেছেন। মানে বাসবি নন্দী্র স্বামী মারা গেছেন। শুনে নিনাদিকে ফোন করে দেখা করতে গেলাম। আমাদের দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা, মানে অব্যবস্থা নিয়ে অনেক কথা হল। দুই বোনের একটা ছবি দেখিয়ে কোনটা কে? জিজ্ঞেস করলেন। চেনা মুশকিল ছিল, তবুও আমি ঠিক চিনেছিলাম।

     ভৌমিকদা ও সুজাতাদির বাড়ির পার্টিতে গেলাম একদিন। ডার্বিতে বিশাল  বাড়ি ওনাদের। ততোধিক বড় ফল-ফুলের বাগান। একটি মাত্র মেয়ে, মেয়েটি  সম্পূর্ণ স্বাভাবিক নয়। তবে ভৌমিকদা খুব আমুদে মানুষ। কী কাজ করতেন জানা হয়নি। সুজাতাদি নার্স ছিলেন। উনি নিনাদির প্রসঙ্গে বলছিলেন, কী ব্যক্তিত্ব! স্কারট আর কালো’শু পরে গট গট করে হাঁটতেন, বুকে ভয় ধরে যেত। যাইহোক  সুজাতাদিদের বাগানটা দারুণ। ঘাসে ঢাকা মস্ত লন, সামনেই একটা কিচেন আপেলের গাছ, প্রচুর আপেল ধরে আছে। নাগালের মধ্যেই অনেক অ্যাপেল। ওন্যদের দেখে আমিও হাত বাড়িয়ে কয়েটা আপেল পাড়লাম।লন ঘিরে প্রচুর গাছ রয়েছে। লনের মাঝখানে একটা বেশ বড় প্লাম গাছে প্রচুর পাকাপাকা প্লাম ধরে  আছে। অনেকেই পাড়ার চেষ্টা করলেন, কিন্তু ২/৪ টির বেশি পাড়তে পারনেন না। হতাশ হয়ে ক্যারাম খেলতে চলে গেলেন। আমরা, মহিলারা একটা লগি জোগাড় করে কয়েকটা মাত্র পাড়তে পারলাম।

                                          ক্রমশ

Post a Comment

0 Comments