জ্বলদর্চি

ড. মণিলাল ভৌমিক (পদার্থ বিজ্ঞানী, শিউরী, তমলুক) /ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ৪০

ড. মণিলাল ভৌমিক (পদার্থ বিজ্ঞানী, শিউরী, তমলুক)

ভাস্করব্রত পতি

ড. মণিলাল ভৌমিকের জন্ম সোনার চামচ মুখে দিয়ে হয়নি। কিন্তু কর্মগুণে আজ তাঁর জীবনে অঢেল সম্পদ। বিজ্ঞান সাধনায় দেশ ছেড়ে বিদেশে থাকলেও ভুলে যাননি দেশকে। তিনি আজ আমাদের মেদিনীপুরের গর্ব। মেদিনীপুরের মানুষ রতন। এরাজ্যের গর্ব। এ দেশের গর্ব। দেশের যুবসমাজের কাছে আদর্শ তিনি। নিষ্ঠা আর অধ্যবসায় থাকলে যে কোনও সাফল্য অর্জন করা যায় - তা দেখিয়েছেন ড. মণিলাল ভৌমিক।

খালি পায়ে হেঁটে প্রতিদিন স্কুলে যেতে হত তাঁকে। আলিনান থেকে কোলা ইউনিয়ন হাইস্কুল পর্যন্ত তাঁকে যেতে হত চরম দারিদ্রের সাথে লড়াই করে। ১৯৪৭ সালে এখান থেকেই ভালো ফল করে ভর্তি হন কলকাতায় স্কটিশ চার্চ কলেজে। তিনিই আমাদের ড. মণিলাল ভৌমিক। আজ যাঁর নাম বিশ্বজোড়া। পূর্ব মেদিনীপুরের শহীদ মাতঙ্গিনী ব্লকের অখ্যাত গ্রাম শিউরীর মণিলাল ভৌমিক আজ সারা ভারতবাসীর নয়নের মণি। ১৯৩১ এর ৩০ শে মার্চ জন্ম। একসময় তাঁর বাবা স্কুল শিক্ষকের চাকরি ছেড়ে গান্ধিজীর অহিংস আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বাবার লড়াই তিনি দেখেছেন ছোট থেকেই। তেমনি মাতঙ্গিনী হাজরার কার্যকলাপও তাঁর বালক বয়সের স্মৃতিতে অমলিন। এসব নিয়েই তিনি বেড়ে উঠেছেন গ্রাম থেকে। এখন তিনি ক্যালিফোর্নিয়ার বেভারলি হিলসের বাসিন্দা। কিন্তু মেদিনীপুরের মানুষ তাঁকে ভোলেনি। তিনিও ভোলেননি মেদিনীপুরকে।
একসময় জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীর সাথে মহিষাদল ক্যাম্পে কাটিয়েছেন। তাঁর বাড়ির অদূরেই মাতঙ্গিনী হাজরার জন্মস্থান। প্রত্যন্ত গ্রামের বুক চিরে জেগে উঠেছিলেন তিনি। স্কুল জীবনের গণ্ডি কাটিয়ে স্কটিশ চার্চ কলেজে বি.এসসি. এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থ বিদ্যায় এম.এসসি. করেন। বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর নজরে এসে যান তিনি। বদলে যায় মণিলাল ভৌমিকের জগৎ। পরিবর্তন ঘটে মনিলাল ভৌমিকের কর্মক্ষেত্র।

'Resonant Electronic Energy Transfers' বিষয়ে গবেষণা শুরু করেন। তিনিই প্রথম ছাত্র হিসেবে আই.আই.টি খড়গপুর থেকে পি.এইচ.ডি. ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫৮ তে কোয়ান্টাম ফিজিক্সের Resonant Electronic Energy Transfer বিষয়ে ওপর গবেষণা করেছিলেন। ১৯৫৯ সালে পেয়ে যান Sloan Foundation Fellowship। 'নুন আনতে পান্তা ফুরায়' অবস্থা তিনি দেখেছেন নিজের চোখে। কিন্তু সেই অভাবের জগতের কালো মেঘ সরতে শুরু করে মনিলালের 'মণিকাঞ্চন'-এর ছোঁয়ায়। 

পােষ্ট ডক্টরাল করতে পাড়ি দিলেন University of California Los Angeles (UCLA)তে। ১৯৬১ সালে তিনি জেরক্স ইলেক্ট্রো অপটিক্যাল সিস্টেমস এর কোয়ান্টাম ইলেক্ট্রনিক বিভাগে একজন লেসার বিজ্ঞানী হিসেবে যোগ দেন। ১৯৬৮ সালে তিনি নরথ্রপ রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে যোগ দেন। এখানেই পরে তিনি লেসার টেকনোলজি ল্যাবরেটরির ডিরেক্টর হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। এছাড়া তিনি লং বিচের ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটিতে কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যা ও জ্যোতির্বিদ্যায় অধ্যাপক পদে নিযুক্ত হন। 
১৯৭৩ সালের মে মাসে এক্সাইমার লেসার প্রযুক্তির গবেষণার ওপর লিখিত প্রবন্ধ কলোরাডোর 'অপ্টিক্যাল সোসাইটি অফ আমেরিকা'র এক অধিবেশনে পেশ করেন। সেখানে তিনি দেখান, এই এক্সাইমার লেসারকে এতটাই ক্ষমতাসম্পন্ন ও কার্যকরী করা যেতে পারে যে তার ব্যবহারিক প্রয়োগ ঘটানো সম্ভব। চোখের দৃষ্টি সংক্রান্ত সমস্যার সমাধানে লেসিক সার্জারিতে এক্সাইমার লেসারের ব্যবহার করে ভালো ধরনের সাফল্য এসেছে পরবর্তীতে। এর ফলে তিনি আমেরিকান ফিজিক্যাল সোসাইটি ও ইনস্টিটিউট অফ ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেক্ট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ার্স এর সদস্যপদ লাভ করেন। সেইসাথে ১৯৭৩ এর মে মাসেই Optical Society of America তাঁকে ঘােষণা করে 'Successful Demonstrator of the World's First Efficient Excimer Laser' অভিধায়। ঝড়ের গতিতে ছড়িয়ে পড়তে থাকে মণিলালের নাম। অখ্যাত, অজ্ঞাত গ্রামের কালোপানা ছেলেটা হয়ে উঠলো নয়নের মনি। পেয়ে গেলেন Electrical and Electronics Engineers এবং American Physical Society র Fellowship।
আজ মনিলাল ভৌমিককে চেনেনা, এমন মানুষ নেই বললেই চলে। আজ তিনি মেদিনীপুরের গর্ব। কাজের মহিমা ও ধারাতেই তিনি উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়েছেন। তাঁর লেখা দুটি বই আজ সারা বিশ্বের বিজ্ঞানীদের কাছে বহু চর্চিত বিষয়। মণিলাল ভৌমিকের সর্বশেষ Paper টি হোলো - 'Unified Field The Universal Blueprint'। 

গত ২০১১ তে ভারত সরকার দিয়েছে 'পদ্মশ্রী' পুরস্কার। ১৯৯৫ তে খড়গপুর আই.আই.টি, দিয়েছে সাম্মানিক 'ডি.এস.সি.' সম্মান। ২০০৬ তে এশিয়াটিক সােসাইটি তাঁকে Fellow নির্বাচিত করেছে। সারা জীবনে ৫০ টিরও বেশি গবেষণাপত্র করেছেন। প্রতিটি গবেষণা বিশ্বের বিজ্ঞানী মহলে উচ্চ প্রশংসিত হয়েছে। 

মনিলাল ভৌমিকের দুটি পৃথিবী বিখ্যাত বইয়ের একটি হল -- 
'CODE NAME : GOD' : ২০০৫ সালে Crossroads Publishing এই বইটির (ISBN-0-8245-2519-1) প্রকাশ করে। Fritjof Capra তাঁর 'The Tao of Physics' গ্রন্থে মনিলাল ভৌমিকের এই বই সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, 'The Attempt to find common ground between Eastern Spiritually and Western Science is eloquently told and makes for fascinating veading'। আবার আলেকজাণ্ডার সােলঝিনেতসিন বইটি পড়ে লিখেছিলেন - "This example of a personal spiritual growth and Re evaluation of material values.... Arouses very warm feelings. God is one and there are no major differences between religions'।
আরেকটি হল -- 
'THE COSMIC DETECTIVE' : মণিলাল ভৌমিকের লিখিত এই বইটির প্রকাশক 'পেঙ্গুইন'। ২০০৯ তে (ISBN-9780-143330691) প্রকাশিত হয় International Year of Aestronomy (IYA-২০০৯) এর অফিসিয়াল বই হিসেবে। বিশ্বের সাতটি বহুল ব্যবহৃত ভাষাতে অনুদিত হয় তা। এই 'IYA-২০০৯' এর স্লোগান ছিল – 'The Universe - Yours to Discover'। বইটি তারই প্রতিচ্ছবি। Modern Cosmology বিষয়ে নানা তথ্য পরিপূর্ণ ছিল তা। CERN এর Dr. Walter Thirring এই বই সম্পর্কে মতামতে জানিয়েছেন, 'The cosmic detective reveals another of Mani Bhowmik's talents, he is an outstanding science writer to complement his demonstrated scientific insight. He has the unique ability to distill from the voluminous material the essential concepts for the general public'। একইভাবে অ্যাপোলো ১৪ এর মহাকাশচারী এডগার মিটচেল মন্তব্য করেছেন, 'Mani Bhowmik builds on recent development in science to bring us new pictures, larger views and insights about the magnificens of our universe'। মণিলাল ভৌমিকের এই বই যে রীতিমতো আলোড়ন ফেলেছিল তা বোঝা যায় International Astronomical Union এর সভাপতি ড. ক্যাথরিন ক্যাসারস্কির মন্তব্য থেকে। তিনি লিখেছেন, 'The cosmic detective is an inspirational read. Dr. Bhowmik tackles topics with impressive scope, yet delves into them with spirit rarely seen. Marrying scientifically accurate text with accessible language is no easy task, but the cosmic detective is a proof that it can be done'।

বিখ্যাত প্রবন্ধকার রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় মণিলাল ভৌমিককে নিয়ে লিখেছেন 'মণিকাঞ্চন'। মনিলাল ভৌমিকের বেশ কিছু বই বাংলায় অনুবাদ করেছেন রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়। যাঁরা বিশ্বাস করেন 'ব্রহ্ম মিথ্যা জগৎ সত্য' সেই সব অতি জাগতিক মানুষের ভাবনার জন্য অ্যালবার্ট আইনস্টাইন পরিবেশিত কিছু ‘অশন’ -- 'The fanatical atheists are like slaves who are still feeling the weight of their chains which they have thrown off after hard struggle. They are creatures who in their grudge against traditional religion as the opium of the masses'-cannot hear the music of the spheres।' এটাই বিধৃত 'ব্রম্ভ সত্য জগৎ সত্য : উপনিষদ বিজ্ঞান রবীন্দ্রনাথ' (২০১৪) বইতে। এছাড়া তাঁর অনুদিত বই হল 'বিজ্ঞানে ঈশ্বরের সংকেত' (২০১০), 'আমি নরেন: বিদেশে বিবেকানন্দ' (২০১৩), 'বিশ্ব জীবনী' (২০০৭) এবং 'হ্যালো আইনস্টাইন : চেনা নাম অচেনা গল্প' (২০১৪) নামের বইগুলি।


জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇



Post a Comment

0 Comments