জ্বলদর্চি

যেতে যেতে পথে-৬০/রোশেনারা খান

যেতে যেতে পথে

রোশেনারা খান

পর্ব ৬০

হ্যাঁ, অ্যালিস নামে একটি ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে লেখা কাহিনী আমরা পড়েছি। এখনকার ছেলেমেয়েরা পড়ে কিনা জানা নেই। এখন তো ছেলেমেয়েরা হ্যারি পটারে  মুগ্ধ। তাছাড়া ওরা গল্পের বই পড়েনা বললেই হয়। সে যাইহোক, অ্যালিস চরিত্রটি ঘিরে কিছু রহস্য রয়েছে। অ্যালিস ১৮৬১ সালে তার পরিবারের সঙ্গে এখানে  বেড়াতে এসেছিল। তখন ওর বয়স ছিল মাত্র ৮ বছর। লেখক এই পরিবারের বন্ধু ছিলেন।তিনিও এঁদের সঙ্গে ল্যানডুডনো বেড়াতে এসেছিলেন। শোনা যায় লেখক  এই অ্যালিসকে ভেবেই কাহিনীটি রচনা করেছিলেন। আবার এটাও শোনা যায়,  লেখক কোনদিন অ্যালিসকে দেখেন নি। এটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক চরিত্র। আমরা শহর পরিক্রমার সময় যে কাঠের তৈরি খরগোশের মূর্তিটি দেখেছিলাম, অ্যালিস ওকে খুঁজতে খুঁজতে একটি গর্তে পড়ে গিয়ে পৌঁছে যায় ওয়ান্ডারল্যান্ডে। তারপর ঘটতে  থাকে নানারমক মজার ঘটনা।

    কনওয়েতে আমাদের হোটেল বুক করা ছিল, সন্ধ্যায় আমরা সেই হোটেলে ফিরলাম, নাম ‘প্রিমিয়ার নি’। শহরের বাইরে মনোরম পরিবেশে বাংলো ডিজাইনের দোতলা হোটেল। জানালার পর্দা সরাতেই দেখি, সবুজ ঢালু মাঠে একদল সিগাল ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাসে চড়ে যখন শহরটা ঘুরে দেখছিলাম তখনই একটি রেস্টুরেন্ট চোখে পড়েছিল, নাম ‘বেঙ্গলি ডায়নাস্টি’। তখনই সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেওয়া  হয়েছিল এখানেই  ডিনারের অর্ডার দেওয়া হবে। রাতে ‘বেঙ্গলি ডায়নাস্টি’ থেকেই খাবার  এল। সেই খাবারে বাঙালির গন্ধও নেই। থাকবে কি করে? এখানে  বাঙ্গালি থাকলে, তবেই না! শাড়িপরা মহিলা ২/১ জন চোখে পড়লেও তাঁরা বাঙালি ছিলেন না। কি আর করা যাবে? ওই খাবারই খেতে হল।


জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇


     সকালে জানলায় চোখ রাখতে দেখি, সন্ধ্যার ছবিটা সম্পূর্ণ বদলে গেছে। সিগাল দেখতে পেলাম না। কতকগুলো ঘোড়া তাদের সন্তানসন্ততিদের নিয়ে মাঠে চরছে। আরও একবার  শহরটা ঘুরে দেখে দুপুরে নটিংহাম ফেরার জন্য রওনা হলাম। শুধু ঝিনুক নয়, আরও অনেক কিছু ঝুলি ভরে নিয়ে ফিরিছি, যা চোখে দেখা যায় না।

    দেশে কত কী ঘটে চলেছে, কিছু খবর রাখছি না। তবে কিছু খবর তো কানে এসেই যায়। মেজ দেওরের একমাত্র ছেলে মুকুল খুব অসুস্থ, কি হয়েছে সঠিকভাবে এখনো জানা যায় নি। কলকাতার এক ডাক্তার বলেছেন, কিডনি ড্যামেজ হতে পারে। তাই এখানে কোনো টেস্ট না করে জাহাঙ্গির ব্যাঙ্গালুরু নিয়ে গেছে। এদিকে পাপুর ইউরিনে ইনফেকশন হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। ডাক্তার নার্সিংহোমে ভর্তি হতে বলেছে। তবে মুকুলকে নিয়ে বেশি চিন্তায় আছি। ছোট ননদও মেদিনীপুরে থাকে। ওকে ফোন করে জানলাম বায়েপ্সি রিপোর্ট এখনো আসেনি, রিপোর্ট দেখে ডাক্তার চিকিৎসা শুরু করবেন। কি যে হচ্ছে জানিনা। আমাদের পরিবারের সময় খুব খারাপ চলছে।

    একদিন লেসটার গেলাম। এই শহরের একটি বিশেষত্ব হল, এখানে প্রচুর  ইণ্ডিয়ান  বাস করেন। বিশেষ করে গুজরাটি পাঞ্জাবি, সাদা চামড়ার মানুষ খুব কম চোখে পড়ছে। বেশি চোখে পড়ছে পাকড়িধারি মানুষ। এখানে মসজিদ মন্দির সবই রয়েছে। কিন্তু মসজিদের কোনো মিনার নেই। হিন্দু মন্দিরের ও আমাদের দেশের মন্দিরের মত চূড়া নেই। যে রেস্টুরেন্টে বসে লাঞ্চ করছিলাম, তার জানালা দিয়ে তাকাতে একটা পারকে গান্ধীজীর মূর্তি দেখতে পেলাম।

     রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে আমরা যখন ফুটপাত ধরে হাঁটছি, মনে হচ্ছে যেন দেশের কোনো বাজারে ঘুরছি। দুপাশে সারিবদ্ধভাবে ইণ্ডিয়ানদের দোকান, এখানে   ইণ্ডিয়ান মহিলাদের প্রয়োজনীয় সমস্ত কিছু রয়েছে। অনেকে বিয়ের বাজার করছেন।  কী নেই? বেনারসি, ল্যাহেঙ্গা, কস্মেটিক্স জুয়েলারি, ইত্যাদি সবই রয়েছে। এছাড়াও নানাধরনের শাড়ি, চুড়িদার, সালোয়ার কামিজ, চুড়ি, টিপ, আলতা, সিন্দুর নানা রকম শেরওয়ানি পাগড়ি ইত্যাদি প্রচুর জিনিস রয়েছে।  

    আর দুদিন পরেই  কালিপুজো, তাই এলাকাটি লাইট ও ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে। কিন্তু দিনের আলোয় সেভাবে বোঝা  যাচ্ছে না। তবে দেখা যাচ্ছে। এখানে দুর্গা পুজোও হয় বেশ আড়ম্বরের সঙ্গে। আশপাশের শহরগুলো থেকে বাঙ্গালিরা যোগ দিতে আসেন। প্রবাসে থেকেও নিজেদের পরম্পরা নিজেদের মত করেই ধরে রাখার চেষ্টা করে চলেছেন।

   এদেশের কালচার বা ঐতিহ্যের মত বাঙালি্রাও তাদের পারিবারিক বন্ধনটা  অনেকটাই আলগা করে ফেলেছেন। তাই পুস্পদির মত মাকে একই শহরে বাসকরেও ছেলের সঙ্গে না থেকে আলাদা বাড়িতে থেকে দায়িত্ব কর্তব্য পালন করতে হয়। এটা উদাহরণ মাত্র। দেশে বিদেশে এমন অনেক মা একাকীত্বকে সঙ্গি করে জীবন কাটাচ্ছেন। অপর দিকে পাকিস্তানি ও অবাঙ্গালি ব্যবসায়ী পরিবারগুলি বেশ বড়। তাঁরা সবাই একসঙ্গে বাস করেন, ব্রিটিশ কালচার অনুসরণ করেন নি।

     আবার ব্রিটিশ জামাইরা দেখছি বাঙালি শ্বশুর শাশুড়ির প্রতি বেশ কেয়ারফুল। রান্নায় শাশুড়িকে সাহায্য করা, গেস্টদের আপ্যায়ন করা, খাবার পরিবেশন করা ইত্যাদি সমস্ত রকম প্রয়োজনে পাশে থাকে। অনেকের ব্যক্তিগত সমস্যা থাকলেও বিশেষ আমল দেন না। অল্পে কাতর হয়ে পড়েন না। এ শিক্ষা অবশ্য এদেশের। সাধারণত এরা কেউই অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে বাঁচতে চান না। এটা একটা খুব ভাল দিক।

      ব্রিটিশরা যত বৃদ্ধ বা  অপারগ হন না কেন, কারো সাহায্য করতে আসা পছন্দ করেন না। এঁরা সমস্ত রকম প্রতিবন্ধকতাকে উপেক্ষা করে জীবনকে উপভোগ করতে জানেন। এঁদের সারমেয় প্রীতি দেখার মত। এঁরা একাধিক কুকুর সঙ্গে নিয়ে হাঁটতে বের হন। কিন্তু রাস্তা নোংরা করেন না, কুকুর মলত্যাগ করলে পকেট থেকে পলিথিন বের করে সেই মল তুলে নিয়ে ফুটপাতের ধারে নির্দিষ্ট বিনে গিয়ে ফেলেন। তাই এখানকার শহরগুলো এত পরিচ্ছন্ন ও সুন্দর।
ল্যানডুডনোত প্রাচিন দূর্গ

       বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিলেত অনেকটাই বদলেছে. ২০০৮ আর ২০১৪ সালের মধ্যে কিছুটা হলেও পার্থক্য দেখছি, অনুভবও করছি। গ্রেট ব্রিটেনের থেকে স্কটল্যান্ড বিচ্ছিন্ন হতে হতে থেকে গেছে। এতদিন এদেশের বৃদ্ধ নাগরিকরা যে সমস্ত সরকারি  সুযোগসুবিধা পাচ্ছিলেন, তা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। এর প্রতিবাদ জানাতে তাঁরা লন্ডনের পথে নেমে  বিক্ষোভ দেখানোয় অনেককে অ্যারেস্ট করা হয়েছিল। গতবারে এসে ধারণা হয়েছিল, এদেশে খেয়ে পরে বেঁচে থাকাটা কোন সমস্যা নয়। এবার এসে অনেক্ কিছু জেনে বুঝে আগের ধারণা বদলে গেছে। এখান যারা সরকারি দানে জীবনধারণ করেন, তা তাঁরা সবাই ইচ্ছে করে করেন  তা কিন্তু নয়। এখানেও বেকারত্ব রয়েছে। সরকার চাকরি দিতে পারেন না বলেই ভাতা দিতে  বাধ্য হন। আমরা জানি এদেশের শিশুরা চিকিৎসা শিক্ষা ইত্যাদি সমস্ত ক্ষেত্রেই অনুদান পেয়ে থাকে। এটাও সম্পূর্ণ সত্যি নয়। আড়াই লক্ষ শিশু স্যাত স্যেতে ঘরে  বাস করে। দেড় লক্ষ শিশুর বাড়িতে ঘর গরম করার ব্যবস্থা নেই। এটা ২০১৪ সালের খবর। ২০০৭ সালে মায়ের অত্যাচারে বেবি পি নামে একটি শিশু মারা যায়। মা এবং আরও দুজনের জেল হয়। বেবি পির শরীরে ৬০টি আঘাতের চিহ্ন ছিল। সমাজকর্মীরা বেবি পিকে এমন অবস্থায় দেখেছিলেন যে ওঁরা বুঝতে পেরেছিলেন ও মারা যাবে। তবুও ওঁরা বেবি পিকে মায়ের কাছ থেকে সরিয়ে নেননি। এই নিয়ে খুব সমালোচনা হয়েছিল, তার পরেই পুরো ব্যবস্থাটিকে ঢেলে সাজানো হয়। তারপর থেকে বছরে চারগুন শিশুকে  পারিবারিক অত্যাচারের কারণে সরিয়ে নেওয়া হয়। ২০১১-২০১২ সালে ১০,০১৯ জন শিশুকে কেয়ার হোমে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। সেইসময়(২০১৪) ইংল্যান্ডে ৬৫,০০০ শিশুকে কেয়ার হোমে রাখা হয়ে ছিল। এখানে থেকে যেটুকু জেনেছি, এদেশের কেয়ার হোমগুলির সঙ্গে আমাদের দেশের হোমগুলির বিশেষ পার্থক্য আছে বলে মনে হয়না।  ভাইবোন একই হোমে থাকার সুযোগ পায় না। দুজনকে দুজায়গায় রাখা হয়। কে কোথায় আছে, ওরা জানতে পারেনা। এরা সেই সব পরিবারের ছেলেমেয়ে যারা সরকারি ভাতা অধিক পরিমানে পাওয়ার লোভে অধিক সন্তানের জন্ম দেয়। ১৬ থেকে ১৮ বছর বয়সের মধ্যে এরা হোম থেকে ছাড়া পায়। এদের অধিকাংশেরই থাকার জায়গা বা কাজ কিছুই থাকে না। খুব কম ছেলেমেয়ে স্কুলের পড়া শেষ করতে পারে। এদেশে প্রায় ৫০% ছাত্রছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয় পৌঁছায়। কেয়ার হোমের বাচ্চারা মাত্র ১২% বিশ্ববিদ্যালয় পৌঁছায়। এদেশের জেলবন্দি অপরাধিদের  চার ভাগের একভাগ অপরাধি কোন না কোন সময় কেয়ার হোমে ছিল।  শুধু তাই নয়, এদেশের অর্ধেক দেহোপজীবিনী কেয়ার হোমে বড় হয়েছে। প্রতি চারজনের একজন হোম ছাড়ার আগেই গর্ভবতী হয়ে যায়।

নীল সমুদ্র

      এই তথ্য ও পরিসংখ্যান ওদেশে বসে নেট ছাড়াও বিভিন্নভাবে উদ্ধার করেছি। এই প্রসঙ্গে ওখানে এক ভদ্রলোক বলেছিলেন, এদেশটাও ভিতরে ভিতরে  ফোঁপরা হয়ে যাচ্ছে।তাই খরচ কমানোর জন্য নতুন নতুন নিয়ম চালু করছে। ভদ্রলোক বেশ কয়েকদশক এদেশে বাস করছেন। তবুও মন বসেনি এখানে।  কলকাতার প্রতি ভীষণ টান। একদিন বলেছিলেন, আমি কলকাতায় মরতে চাই।  কলকাতার বন্ধু-বান্ধব, আড্ডা, ভীষণ মিস করি। আর এক ভদ্রমহিলা বহু বছর দেশ ছেড়েছেন। একেবারে সাদামাটা চেহারা ও পোশাক। ঠিক যেন পাশের বাড়ির  মাসিমা, কাকিমা মনে হবে। একমাত্র সন্তানকে শিশু কালেই হারিয়েছেন। পৃথিবীর বহু দেশ ঘুরে বেড়িয়েছে্ন। এখন দেশে ফিরতে চান। বললেন, কিছু না হোক, কাজের  মেয়ে তো পাওয়া যাবে।

                                         ক্রমশ

Post a Comment

1 Comments