জ্বলদর্চি

বিস্মৃতপ্রায় কবি কিরণশঙ্কর সেনগুপ্ত /নির্মল বর্মন‌

বিস্মৃতপ্রায় কবি কিরণশঙ্কর সেনগুপ্ত
নির্মল বর্মন‌

কবি কিরণশঙ্কর সেনগুপ্ত চল্লিশের দশকের  আলোড়ন সৃষ্টিকারী প্রতিনিধিস্থানীয় কবি ছিলেন। 'শত্রু' ও 'দৃষ্টান্ত' নামক দুটি কবিতা ১৯৩৬ সালে বুদ্ধদেব বসুর "কবিতা" পত্রিকায় প্রকাশের মাধ্যমে তার আত্মপ্রকাশ ঘটে। ১৯৩৬ সালে "পরিচয়" ও "সোনার বাংলা" পত্রিকাতে প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। ঢাকা থেকে প্রকাশিত কবি কিরণশংকর সেনগুপ্তর প্রথম কাব্যগ্রন্থ "স্বপ্নকামনা" প্রকাশিত হয়, যার ভূমিকায় কলম ধরেছিলেন কবি জীবনানন্দ দাশ।

জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇



২রা  ফেব্রুয়ারি ১৯১৮ সালে অধুনা বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরে কবি প্রথম পৃথিবীর আলো দেখেন। ১লা মে ১৯৯৮ কবি কিরণশংকর সেনগুপ্ত পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারে পাড়ি জমান। ইংরেজি সাহিত্যের কৃতি ছাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে এম.এ পাস করে প্রিয়নাথ স্কুলে কিছুদিন শিক্ষকতাকে পেশা হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন !পরবর্তীকালে নারায়ণগঞ্জে কাকার ব্যবসায় যুক্ত হয়েছিলেন । কবি ঢাকা কলেজে বি.এ পড়ার সময় ঢাকা হলের পত্রিকা "শতদল"১৯৩৮ সালে সম্পাদক হিসাবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৩৯ -১৯৪১ অবধি ঢাকা থেকে প্রকাশিত স্বনামধন্য মাসিক সাহিত্য পত্র 'শান্তি' র সহ-সম্পাদক পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন । বন্ধু সোমেন চন্দের আহ্বানে ১৯৩৮ সালে সদ্য প্রতিষ্ঠিত ঢাকা প্রগতি লেখক সংঘে যোগ দেন। পরবর্তীকালে আজীবন সদস্য ছিলেন । প্রগতি লেখক সংঘের উদ্যোগে ঢাকা জেলাতেই "সোভিয়েত সুহৃদ সমিতি " গড়ে উঠেছিল , কবি যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন। সোভিয়েতের আক্রান্তদের ফটো সমিতির ছবি, শতাধিক পোস্টারের এক অভিনব আধুনিক প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিলেন । এই প্রদর্শনী কর্মশালার 'শহিদুল্লাহ 'সাহেব উদ্বোধন করেছিলেন। কবি কিরণশঙ্কর সেনগুপ্ত জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত "সাহিত্যচিন্তা" পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন ( ১৯৪৩-৪৪)। পার্টির সভ্য ও সাংস্কৃতিক ফান্ডের গুরুদায়িত্ব যত্ন সহকারে পালন করেছিলেন ।পশ্চিমবঙ্গে এসে সরকারের পুনর্বাসন দপ্তরে চাকরি করেছিলেন , সালটা সম্ভবত ১৯৫০-৫১।
অভিন্ন হৃদয় বন্ধু সোমেন চন্দ স্মৃতি রক্ষার্থে পশ্চিমবঙ্গে  বাংলা একাডেমি থেকে সোমেন চন্দ স্মৃতি পুরস্কার প্রদানের সুব্যবস্থা করেছিলেন । ১৯৭৫ এ কবিতার জন্য 'কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত' পুরস্কার ও 'নির্বাচিত কবিতা ' গ্ৰন্থের জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারের রবীন্দ্র পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন। কবি কিরণশংকর সেনগুপ্ত দেশ-বিদেশের ইংরেজি কবিতা অনুবাদ করেছেন । কবি নিজের কবিতাও ইংরেজি ও বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত করেছিলেন।
কবি কিরণশঙ্কর সেনগুপ্তের সৃষ্টিশীল কাব্যগ্রন্থ গুলি হল -- "স্বপ্নকামনা" - ১৯৩৮," স্বর ও অন্যান্য কবিতা"-১৯৫৩ , "দিনযাপন " ১৯৬২, ' এই এক সময়' ১৯৭৩ , 'বৃষ্টি এলে' -১৯৭৩, " রুক্ষ দিনের কবিতা" ১৯৮৩ , "মানুষ জানে" - ১৯৮৫ ও "নির্বাচিত কবিতা"- ১৯৮৯।
কবি কিরণশঙ্কর সেনগুপ্ত  মার্কসীয় দর্শনে বিশ্বাসী সমাজ সচেতন জীবনের ইতিবাচক ভাবনাকেই কবিতায় রূপ দিয়েছিলেন । সমকালীন সময় ও সমাজের জীবন যন্ত্রণা, হতাশা কবিকে আলোর পথে উত্তীর্ণ করে দিয়েছে‌।স্বার্থপরতা , নিচতা, মনের বিকার কবিতায় চান্স দেননি। এমনকি কবি প্রেমের কবিতায় বর্তমান ঘুণধরা জীবনের পরিবর্তনশীলতার জলন্ত ছবি ও ছক কবিতায় নির্মাণ করেছেন। কবি সেনগুপ্তের কবিতার ছবি সামগ্রিক জীবনের রূপকে উন্মুক্তরূপে মেলে ধরে। কবির কবিতায় রোমান্টিকতার পরিচয় রয়েছে তা আসলে স্বপ্ন মধুর স্পর্শের ইতিকথা। প্রত্যক্ষ রাজনীতি না করলেও রাজনীতি ও কবিতাকে তিনি একত্রিত করতে পেরেছিলেন কবিতার মাধ্যমে।
কবি কিরণ শঙ্কর সেনগুপ্তের প্রথম কাব্যগ্রন্থ "স্বপ্নকামনা " গুরুত্বপূর্ণ একটি কবিতা 'হে ললিতা , ফেরাও  নয়নে', যা ১৩৪৫ এ আশ্বিন মাসে কবিতা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল! প্রেমের রোমান্টিক ভাবনার কবিতা হিসাবে স্মরণীয় প্রচেষ্টা তীব্র কামনায় আবদ্ধ এই কবিতাটি শুরু ভাবেই--
"হে ললিতা, ফেরাও নয়ন !
যদি শুভ্র শ্রীদেহের স্বাদ
আর নৈশ আশ্লেষ - শয়ন
মুক্তিস্নান এনেছে জীবনে,
দূরে থাক লোক --পরিবার"।
কবি কিরণশঙ্কর তাঁর প্রেম কামনার মোক্ষধামে পৌঁছানোর চেষ্টা করেছেন--
"উতরোল নিবিড় রজনী।
খেলো রক্ত লাজ  - আবরণ,
লজ্জা - অপমান শঙ্কা ছাড়ো !
শোনো মোর রমণীর ধ্বনি,
আগে রাখো মানুষের মন"!
কবি "স্বপ্নকামনা" কাব্যগ্রন্থের ভূমিকায়  সুরোরিয়ালিষ্ট কবি জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন--
"বিষয়বস্তু অত্যন্ত মর্মান্তিক নিতান্তই দৈহিক কামনা ; কিন্তু মানুষের এই আদিম আবেগকেও আগুনের সঙ্গে তুলনা করতে পারা যায় কিংবা জলের সঙ্গে অথবা আকাশের সঙ্গেও-----"!
প্রথম কাব্যগ্রন্থের হাজার বছর আগে কবিতার সঙ্গে জীবনানন্দের "বনলতা সেন" কবিতার ছায়া পরিষ্কার ভাবে ফুটে উঠেছে---
"হাজার বছর আগে সেই সব মৃত নর - নারী
ম্যমি হয়ে বালু হয়ে আজ শুধু পিরামিডে স্থির,
বহুদিন পরে তারা কাল রাতে মৃতদেহ ছাড়ি
আমার চোখের পরে নানারূপে করেছিল ভিড়"।
কবি কিরণশঙ্কর সেনগুপ্ত'র "স্বর ও অন্যান্য কবিতা"য় প্রেমের কবিতার মালা যেমন আছে, তেমনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমি, নিঃসর্গ রূপের উদ্ভাসে 'প্রথম গ্রীষ্ম ' কবিতাটি জনসমাজে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল--
"দিগন্ত প্রসারী ক্ষেত তীব্র রৌদ্রালোকে ধু ধু করে।
ছায়া নেই দগ্ধ মাটি , ভ্রুকুটি কুটির নভোনীল।
স্তম্ভিত গরুর দল, বজ্রাহত শূন্যে উড়ে চিল,
শুষ্ক মাঠ থেকে ধূলি উড়ে উড়ে মিশেছে অন্তরে"।
কবি সেনগুপ্তের "দিনযাপন" কাব্যে  জীবন সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে কর্মময়তার মধ্যে জীবনের স্বাদ উপলব্ধি করতে চেয়েছেন , এই স্বাদ ও শান্তির আবহে মোহিতলালের প্রভাব পরিলক্ষিত---
"কি তবে  আমার কাজ ঃ  অবিরাম উত্থান পতনে
বিদীর্ণ কল্পান্ত কাঁপে , মধ্যবিত্ত ছা - পোষা মানুষ
আরো অনেকের মতো আমিও ছুটেছি প্রাণপণে
নারী ,স্বর্ণ ,গান নয় , লুপ্তপ্রায় স্বস্তির সন্ধানে
পথে মাঠে তেপান্তরে ; পথকষ্টে প্রায় দীর্ণপ্রাণ;
তবুও দুর্মর আশা মুহূর্তেই আনে চঞ্চলতা
বিধ্বস্ত প্রাণের পাত্রে,---- বারং বার তীব্র আত্মদান
করার সংকল্প নিয়ে ফিরে আসি";
ভারতের অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবাংলায় ১৯৬৮ থেকে ১৯৭২ নৈরাজ্যের বাতাবরণ সৃষ্টি হয়েছিল সেই ক্লান্তিকর দিনগুলির কথা স্মরণে ও মননে রেখে "লোকটা" কাব্যগ্রন্থের "প্রতিদিন সারাক্ষণ" কবিতায় সুস্পষ্ট উচ্চারণ করেছেন---
"আমি শান্ত হতে ভদ্র থাকতে চেয়েছি সারাজীবন,
অথচ আড়াল থেকে কারা বারবার ধাক্কা দিচ্ছে,
অমানুষিক প্ররোচনায়
আমাকে ভীষণ ক্রোধের কুন্ডে ঠেলে দিতে চাইছে"।
বিস্মৃতপ্রায় কবি কিরণশংকর সেনগুপ্ত র সমকালীন সময় ও সমাজের রূপ , হতাশ, অভিমান  ও সংকল্পকে পাথেয় করে সৃষ্টি করলেন "বৃষ্টি এলে" কাব্যগ্রন্থ । মার্কসীয় নেতা লেলিনকে নিয়ে "তাঁর মুখে আলো নেই" কবিতায় লিখলেন--
"ঝলমল করছে নটার মতো
রাতের চৌরঙ্গী
শুধু যিনি অন্ধকার তাড়িয়ে
আলো জ্বেলে ছিলেন এক মাঘের শীতে
তাঁর মুখে আলো নেই"।
কবি সেনগুপ্ত ' তাঁর কবিতায় ছন্দবোধ ও আঙ্গিক নির্মাণে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। তাঁর কবিতা ছায়ায় বলবার ভঙ্গি , ভাষার প্রবাহমানতা, সৃষ্টির ক্ষমতা, ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধা ও সৃষ্টিশীলতাকে মেলে ধরার প্রয়াস আমরা তাঁর কবিতাগুলোর মধ্যে দেখতে পাই।  এজন্যই তাঁর কবিতাগুলি অন্যান্য কবিতার থেকে স্বাতন্ত্র্য চিহ্নিত। এই সৃষ্টিধর্মিতার অনন্য সাধারণ দৃষ্টান্ত -- "স্বদেশ " কবিতা থেকে কয়েকটি পঙক্তির উজ্জ্বল উদ্ধার----
"এই ভালো , এই দেশ ;  মায়ের শিশু স্মিত  হাসি,
প্রৌঢ়ের  বিগত স্মৃতি,  যুবকের নিভৃত উদ্যম
মাটি ও মাঠের কাজে,- পণ্য কুটিরের অধিবাসী
সুখে দুখে দ্বন্দ্বে গড়া ; এখানে প্রশান্তি নিরুপম
সামান্য সংসার ঘিরে, --  অগ্নিহোত্রী মানুষেরা খাঁটি
স্বদেশকে খুঁজে খুঁজে এইখানে পেয়েছিল মাটি"।

Post a Comment

0 Comments