জ্বলদর্চি

ড. প্রদ্যোত কুমার মাইতি (অধ্যাপক, ইতিহাস গবেষক, লেখক, প্রবন্ধকার - তমলুক, পূর্ব মেদিনীপুর)/ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ৩৯

ড. প্রদ্যোত কুমার মাইতি (অধ্যাপক, ইতিহাস গবেষক, লেখক, প্রবন্ধকার - তমলুক, পূর্ব মেদিনীপুর)

ভাস্করব্রত পতি

বয়ঃভারে ন্যুব্জ হয়েছেন। বয়স বেড়েছে। তাই বলে কখনো থমকে যায়নি তাঁর কাজ। আঞ্চলিক ইতিহাসকে তাঁর হাতের তালুতে বন্দী রেখেছেন আমৃত্যু। মেদিনীপুর জেলার আঞ্চলিক ইতিহাস ও লোকসংস্কৃতি চর্চাকারীদের কাছে তিনি প্রাণভোমরা। তিনি ড. প্রদ্যোত কুমার মাইতি। যিনি মানতেন আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চাই পারে কোনো সমাজ ও সংস্কৃতির প্রকৃত রূপরেখা জানাতে। তুলে ধরতে।

মেদিনীপুরের ইতিহাসের মূক মুখে তিনি জুগিয়েছেন ভাষা। ইতিহাস অন্বেষণের মাধ্যমেই তো ‘অবলা’ কথা, ‘অজানা’ তথ্য বলা হয়ে যায়, জানা হয়ে যায়। ইতিহাস হ’ল অতলস্পর্শী মহাসাগর। যে সাগরের কুলকিনারা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তাই ইতিহাস অন্বেষণ কখনই ‘লিমিটেড' হতে পারেনা। যতটা সম্ভব পারা যায় মহাসাগরের গভীরে ডুবে তুলে আনা যায় ইতিহাসের মণিমুক্তো। কিন্তু লেখক ড. প্রদ্যোতকুমার মাইতি তাঁর অগুনতি বইতে তমলুক তথা মেদিনীপুরের যে ইতিহাস তুলে এনেছেন, তা পরিমাপ করা সম্ভব নয়। সাগর ছেঁচে যে ‘মুক্তো’ তিনি সংগ্রহ করেছেন, তা অনবদ্য। বহুদিনের পরিশ্রমের ফল। আর তিনি তাই হয়ে উঠেছেন 'ইতিহাসের ডুবুরি’। মেদিনীপুরের মানুষ রতন।

তমলুক শহরের উপকণ্ঠে দীর্ঘদিন ধরে করেছিলেন ইতিহাস ও লোকসংস্কৃতির গবেষণা। প্রকাশিত হয়েছে অসংখ্য গবেষণাপত্র। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তাঁর লিখিত প্রবন্ধের ইয়ত্তা নেই। না, তবুও 'আহামরি ভাব' তাঁর ধাতে নেই। তেমনি নেই দেখনদারি মানসিকতা। আসলে কাজপাগল এই মানুষটার নেশা অজানা ইতিহাসকে অন্ধকারের গলি থেকে তুলে আনা। ১৯৩৬ এর ৩০ শে এপ্রিল পটাশপুরের বড়হাটতে জন্ম। ২০২১ এর ৮ ই অক্টোবর মৃত্যু হয় এই মানুষটির। কাঁথি কলেজ থেকে বি এ এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এ পাশ করে লণ্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬২ তে পি এইচ ডি করেন প্রাচ্যবিদ্যা বিশারদ এ এল ব্যাশামের অধীনে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পেয়েছেন ডিলিট খেতাব। তিনি এখন  মেদিনীপুরের গর্ব। একসময় তমলুক কলেজের অধ্যাপক ছিলেন। তখন University Grants Commission থেকে পাঁচবার গবেষণা বৃত্তি লাভ করেন। কর্মজীবন থেকে অবসরের পরেও তাঁর লেখনী থামেনি। তাঁর এই নেশার জগৎ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেননি। তাই প্রথাগতভাবে অধ্যাপনার সাথে জড়িত এই মানুষটি ইতিহাস ও লোকসংস্কৃতির নানা দিক ফুটিয়ে তুলতে কখনই কার্পণ্য দেখাননি। তমলুকে স্থাপিত 'তাম্রলিপ্ত সংগ্রহশালা ও গবেষণা কেন্দ্র'র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং কোষাধ্যক্ষ ছিলেন একসময়। 
মানুষ হিসেবে তিনি সবসময়ই শিশুর মতো কোমল এবং নরম স্বভাবের। মোমের আলোর মতো স্নিগ্ধ। যখন কথা বলেন তখন তিনি বুঝতেই দেননা শ্রোতার সঙ্গে তাঁর বয়সের পার্থক্য। আসলে তাঁর মতে, মানুষের সাথে সহজ সরলভাবে মিশতে জানলেই মানুষের সেই জীবনযাত্রার কথা ভালো করে লেখা যায়। তুলে ধরা যায় লোকসংস্কৃতি, আঞ্চলিক ইতিহাসের চাপা পড়া বিবরণ। তিনি তাই সত্যিকারের মাটির মানুষ। কাছের মানুষ। অন্য মানুষ। রতন মানুষ।

'পূর্বাদ্রী' পত্রিকার সম্পাদক ইন্দুভূষণ অধিকারীর উৎসাহ পেয়েছেন গবেষণার কাজে। ১৯৮০ সালে আলাপের পর তিনিই ১৯৮৭ তে প্রথম ছাপেন 'তাম্রলিপ্ত তমলুকের সমাজ ও সংস্কৃতি' বইটি। এই বইটি বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সাম্মানিক স্নাতকস্তরে সহায়ক পুস্তকরূপে তালিকাভুক্ত হয়েছে। একদিকে লোকসংস্কৃতি ও আঞ্চলিক ইতিহাসের পুস্তক রচনা, অন্যদিকে গতানুগতিক ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তক রচনা – দুয়েতেই সাবলীল ছিলেন এই বয়োঃবৃদ্ধ ইতিহাসপাগল মানুষটি। এছাড়া মেদিনীপুরের লোকসংস্কৃতি, মেদিনীপুর: ধর্ম উৎসব ও মেলা, প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে নারী, উৎসব ও আচার অনুষ্ঠানাদির আঙিনায় বাংলা, সমাজ সংস্কৃতির রূপরেখা, পূর্ব মেদিনীপুর জেলার স্বাধীনতা সংগ্রাম ও সংগ্রামীদের কথা, ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রেক্ষাপটে তমলুকের মানিক পীর, বিয়াল্লিশের তমলুক ও তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার, স্বাধীনতা আন্দোলনে তমলুক ও হলদিয়া মহকুমার নারী সমাজ, ঐতিহাসিক তমলুকের সমাজ ও সংস্কৃতি, মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে মুসলিম সমাজ ও জীবন, বাংলার লোকধর্ম ও উৎসব পরিচিতি, বঙ্গভঙ্গ প্রতিরোধ আন্দোলন ও অবিভক্ত মেদিনীপুর, স্বদেশ সাধক সুশীল কুমার ধাড়া (যুগ্ম সম্পাদক), শতাব্দীর আলোকে সতীশ চন্দ্র সামন্ত (যুগ্ম সম্পাদক) ইত্যাদি অসংখ্য বই তিনি লিখেছেন বিভিন্ন সময়ে। বর্গভীমা মন্দির ও তার ইতিহাস নিয়ে ড. প্রদ্যোত কুমার মাইতি দিয়েছেন নানা তথ্য। জেলার স্বাধীনতা সংগ্রামের অসংখ্য অজানা ইতিহাস আজ আমরা জানতে পারি তাঁর লেখনি পড়েই। তাঁর লেখা ইংরেজি বইগুলির মধ্যে Historical Studies in the Cult of the Goddess Manasa - A Socio- Cultural Study (Ph D. Thesis). 1966 Reprint-2001, The Goddess Bargabhima - A Study, Calcutta, 1971, Reprint, 2009, Popular Cults, Legends and Stories in Ancient Bengal, Calcutta 1971, Folk Rituals of Eastern India, New Delhi, 1988 Soem Aspects of Indian Culture, Calcutta, 1989, Human Fertility Cults and Rituals of Bengal - A Comparative Study (D.Litt. Thesis), New Delhi, 1989, History - Famed Tamluk Through the Ages, Calcutta, 2000, Quit India Movement in Bengal and Tamralipta, - Jatiya Sarkar, Calcutta, 2002, Historic and Glorious Tamralipta - A Profile, 2009, Tamralipta - Tamluk in Archaeology and History, (Jointly Ed.) 2010 The Pir Cult in Bengal - an Aspect of Hindu Muslim Religion ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। মেলা, উৎসব, ব্রত, পার্বণ, পূজা, পরব নিয়ে তিনি ডুব দিয়েছেন পুণ্যিপুকুরে। স্বধর্মের নানা উৎসবের বিবরণ, মন্দির মসজিদ ধর্মস্থানের বিবরণ তিনি দিয়েছেন সুচারুভাবে।

তাঁর প্রবন্ধ বহু গবেষকের কাছে মূল্যবান সম্পদ হয়ে রয়েছে। এ পর্যন্ত তিনি লিখেছেন ২০ টির বেশি বাংলা ভাষার বই এবং ইংরেজী ভাষায় ১০ টির বেশি বই। প্রতিটি বইতেই হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস ও সংস্কৃতির পুনরুদ্ধারের চেষ্টা প্রতীয়মান। আজও তিনি গবেষক মহলে রোল মডেল। জীবিত কালে সবসময়ই স্মিতহাস্য মুখে তিনি ছিলেন লোকপিপাসুদের কাছে অন্যতম পথপ্রদর্শক। বয়স নয়, কিছু করার মানসিকতাকে পাথেয় করেই প্রদ্যোতবাবুর কর্মনিশান উড়েছে লোক আঙিনায়।
তাঁর লেখায় প্রাগৈতিহাসিক যুগের তাম্রলিপ্ত তথা মেদিনীপুর বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। প্রাচীন তাম্রলিপ্ত কেমন ছিল এবং তা জানতে যেসব প্রত্নবস্তুর সাহায্য মিলেছে তা লিপিবদ্ধ করেছেন। তা থেকেই অনুমান করা হয়েছে যে তাম্রলিপ্ত তথা সমগ্র মেদিনীপুরের প্রাগৈতিহাসিক সভ্যতার স্রষ্টা ছিল প্রাআর্য প্রোটো অস্ট্রোলয়েড শ্রেণির কোন শাখা বা দ্রাবিড় ভাষাভাষী কোনও জাতি। একসময় তাম্রলিপ্তের অবস্থান ও সীমানা ঠিক কতটা ছিল তা নিরূপণ করেছেন নিবিড় পর্যবেক্ষণ এবং গবেষণার মাধ্যমে। আর প্রাচীন তাম্রলিপ্ত বন্দর বলতে ঠিক কোনটাকে বোঝাতো এবং সেই সঙ্গে বাণিজ্যকেন্দ্র রূপে কেমন ছিল — সেই ইতিহাস তুলে আনাও যথেষ্ট কৃতিত্বের। প্রাচীন তাম্রলিপ্তের অধিবাসী, ধর্মজীবন ও ধ্যানধারণা, সমাজবিন্যাস, সংস্কৃতি, শিল্পকলা এবং জীবনযাত্রার চিত্রকল্প চিত্রিত হয়েছে তাঁর নানা লেখায়। আজকের তমলুকে বসে প্রাচীন তমলুকের মানুষের জীবনযাত্রার খোঁজখবর দিয়েছেন অসংখ্য প্রবন্ধে। এছাড়া মধ্যযুগের তমলুকের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, অধিবাসীদের জীবনযাত্রা, তাঁদের ধর্ম, সমাজবিন্যাস, সংস্কৃতির পরিচয় বিধৃত করেছেন নানা ভাবে। ইতিহাসের ধারায় যেসব তথ্য হারিয়ে যাওয়ার মুখে,  তা নিয়েই তাঁর অনুসন্ধান। স্বাধীনতা আন্দোলনে গর্বিত তমলুকের কাহিনি লিপিবদ্ধ করেছেন সুচারুভাবে। ব্রিটিশ বিরোধী বিদ্রোহের সময়গুলিতে অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছিল আমাদের তমলুক। তমলুকের সেই অগ্নিঝরা দিনগুলির বর্ণনায় ড. প্রদ্যোতকুমার মাইতির প্রচেষ্টা প্রণিধানযোগ্য। ১৯৪২ এর ভারতছাড়ো আন্দোলনের সময় কেমন ছিল এই তমলুক এবং সেই আন্দোলন দমনে কি কি ব্যবস্থা নিয়েছিল ব্রিটিশ সরকার সেই ইতিহাস তুলে আনা তো সাচ্চা ডুবুরির কাজ। আর জীবৎকালে সেই কাজ তিনি সামলেছেন দক্ষতার সাথে।

জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇


জ্বলদর্চি তিরিশ পেরিয়ে... 

Post a Comment

0 Comments