জ্বলদর্চি

মহাভারতের কর্ণ - এক বিতর্কিত চরিত্র -৬/দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

মহাভারতের কর্ণ - এক বিতর্কিত চরিত্র                                               
দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী                                                 ষষ্ঠ পর্ব                        

দ্রৌপদীর প্রতি কর্ণের অন্তরের জ্বালা যে কি পরিমাণ তাঁকে অহরহ দগ্ধ করত তা তিনি হস্তিনাপুরে দ্যূতসভায় সর্বসমক্ষে বাক্যবিন্যাসে প্রদর্শন করেছিলেন। দ্রৌপদীর প্রতি ক্রোধ তাঁর শুরু হয়েছিল স্বয়ম্বরসভায় যেদিন ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন। দ্রৌপদীর প্রত্যাখ্যানের জ্বালা আজও তিনি ভুলতে পারেননি। সেই প্রতিহিংসার স্পৃহায় তাঁকে দ্যূতসভায় অমানুষের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল। সেদিন যেন তিনি তাঁর শৌর্য-বীর্য দানশীলতার কথা, মার্জিত রুচি ও ব্যবহারের কথা ভুলে গেছলেন। দ্রৌপদীর ও অর্জুনের প্রতি বিদ্বেষ সেদিন তিনি অমার্জিত বাক্যের কষাঘাতে মিটিয়েছিলেন। কৃষ্ণাও ভাবতে পারেননি এ কি সত্যিই সেই দীপ্তকান্তি পুরুষের - যার অভিজাত্যপূর্ণ ব্যবহার, বিনম্র বাক্য, শৌর্যের খ্যাতি বা অকৃপণ দানের কাহিনী সমগ্র ভারতবর্ষে পরিব্যাপ্ত - তাঁর মুখনিঃসৃত এই অমার্জিত কদর্য ভাষা! দ্যূতসভায় তিনি দ্রৌপদীকে 'দাসী, বেশ্যা' বলেছিলেন। দ্রৌপদীকে বিবস্ত্রা করার চেষ্টার পাশবিক উল্লাসে তিনিও শরিক হয়েছিলেন। দুঃশাসনকে বলেছিলেন 'যাজ্ঞসেনীকে একবস্ত্রে সভায় আসতে হয়েছে বলে তিনি দুঃখ পেয়েছেন, তাকে সেই বস্ত্র ভার থেকে মুক্তি দাও' -  এ কিসের ইঙ্গিত? 
বহুদিনের মর্মবেদনা যা তিনি কাউকে বলতে পারেননি তারই বহিঃপ্রকাশ। যুধিষ্ঠির ও পঞ্চপান্ডবকে বাক্যের শাণিত কষাঘাতে জর্জরিত করে বলেছিলেন 'ধর্মরাজ, যুধিষ্ঠির শুনেছি ন্যায়-নীতির পরাকাষ্ঠা। নিজের স্ত্রীকে দ্যূতক্রীড়ায় পণ রাখা কি ধরনের ন্যায়-নীতি? দ্রৌপদীতো তাঁর একার স্ত্রী নন, তিনি তো পঞ্চভ্রাতার স্ত্রী। সেখানেই কি তিনি পণ রাখার পূর্বে তাদের সম্মতি নিয়েছেন? যে কৃষ্ণার পঞ্চস্বামী তাঁর এই দুর্গতি! ধিক্ তাদের যারা নিজের স্ত্রীর সম্মান রক্ষা করতে জানেনা তারা আবার কিসের স্বামী, কিসের কাদের বাহুবলের আস্ফালন? যে সমস্ত রাজা মহারাজার রক্ষিতা থাকে তারাও পাশা খেলায় তাদের রক্ষিতাদের বাজি রেখে খেলেন না'। নিষ্ঠুর কৌতুক মিশ্রিত হাসি হেসে পাঞ্চালীকে তিনি বললেন "ওই নির্জীব কাপুরুষ দাসগুলোর দিকে তাকিয়ে কোন লাভ নেই, ওরা কি মানুষ, মেষপালক বললেও বুঝি তাদের অপমান করা হয়"। 
এরপরে যখন দ্রৌপদী অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের কাছে বর লাভ করে পঞ্চস্বামী ও তাঁদের সমুদয় ধনরত্ন ফেরত পেলেন তখন এই কর্ণ শ্লেষমিশ্রিত বাক্যে পুনরায় দ্রৌপদীর প্রশংসা ও অর্জুনকে ভৎর্সনা করেছিলেন। 
সেদিনের দ্যূতক্রীড়ার শেষে কর্ণ যেন মর্মবিদারী ব্যঙ্গের আঘাতে শান্তির পরিবেশ ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে বললেন "অদ্যাবধি অনেক নারীর কাহিনী শুনেছি, কিন্তু আজ এই সভাস্থলে দ্রৌপদী যে কীর্তি স্থাপন করলেন জগতে বোধ করি তার তুলনা নেই, আর হবেও না। পুরুষ ও ক্ষত্রিয়, বীর বলে যারা পরিচিত তাদের রক্ষা করতে এগিয়ে এলেন এক নারী, ধন্য তিনি। পাণ্ডবেরা বোধবুদ্ধিহীন হয়ে যে বিপদ সাগরে নিমজ্জিত হয়েছিলেন তাঁদের কুলবধূ সেখানে তাঁদের বাঁচিয়ে দিলেন"। এই সময়ে ভীম ও অর্জুন একযোগে আস্ফালন করে বললেন "যথা সময়ে তারা এই অপমানের প্রতিশোধ নিবেন"। অর্জুন এমন কথাও বললেন যে রণাঙ্গনে তিনি কর্ণকে বধ করবেন। 
এইখানে অর্জুনের এই আস্ফালন সম্বন্ধে প্রশ্ন আসছে যে সত্যই কি রণাঙ্গনে তিনি কর্ণকে বধ করতে পারতেন যদি না কৌশলে দেবরাজ ইন্দ্র কর্ণের কবচকুণ্ডল হস্তগত করতেন? যদি না পরশুরামের অভিশাপ কর্ণের উপর বর্ষিত হতো এবং ব্রাহ্মণের অভিশাপে তাঁর রথচক্র মেদিনী গ্রাস করতো? 
অর্জুনের এই উক্তি শুনে কর্ণ অর্জুনের নিকটে যেয়ে শ্লেষের সঙ্গে বললেন "পার্থ, তোমার এই শৌর্য এতক্ষন কোথায় ছিলো, যখন সভার মধ্যে পান্ডব কুলবধূ লাঞ্ছিতা হলেন? কুলবধূর সম্মান পিতা মাতার সম্মানের মত সযত্নে রক্ষা করতে হয়। এককালে আমার আশা ছিল সম্মুখ যুদ্ধে তোমাকে পরাজিত করব, কিন্তু আজ মনে হচ্ছে তোমার সঙ্গে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হওয়া আমার পক্ষে সম্মানহানিকর হবে। তোমার শস্ত্রজ্ঞানকে ধিক্! ধিক্ তোমার অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্যকে যিনি এক কাপুরুষকে সর্বশ্রেষ্ঠ ধনুর্বিদ করতে চেয়ে তোমাকে তাঁর সমস্ত বিদ্যা উজাড় করে দিয়েছিলেন। মনে হয় আজ যদি সেই অনার্য একলব্য, যাকে দ্রোণাচার্য অস্ত্রশিক্ষা দিতে রাজি হননি, সে এখানে থাকতো তাহলে সেও এই অপমানের যোগ্য উত্তর দিত"। 


জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇



কর্ণের এই স্বভাববিরুদ্ধ আচরণের অর্থ সেদিন দ্রৌপদী বুঝতে পারেননি। সেদিন কেন ভবিষ্যতেও তাঁর কাছে এই কথাগুলি দুর্জ্ঞেয়, দুর্বোধ্য ও রহস্যময় হয়েছিল। যে কর্ণ কিছুক্ষণ পূর্বে দ্রৌপদীর প্রতি অশালীন বাক্য প্রয়োগ করে নিন্দিত হয়েছিলেন। তাহলে কি দ্রৌপদীর প্রতি তাঁর মনে কোনো সহানুভূতি বা আন্তরিকতা ছিল। সে প্রশ্নের উত্তর পেতে আমাদের কর্ণের জীবনের শেষের সেদিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। 
কর্ণ কিন্তু সেদিন কোনো মিথ্যা বলেননি। বস্তুত দ্রৌপদীর কল্যাণে সেই দিন পাণ্ডবেরা চরম লাঞ্ছনার হাত থেকে পরিত্রাণ পেয়েছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয়বার যখন পাণ্ডবেরা শকুনির চালে পরাজিত হয়ে দ্বাদশ বৎসরের জন্য বনবাসে যাচ্ছেন তখন দ্রৌপদীর সেই নিরাভরণা আলুলায়িত কুন্তলে অশ্রু মোচন করতে করতে যাওয়ার দৃশ্য দেখে কর্ণ আর স্থির থাকতে না পেরে যেন বিষাক্ত মর্মভেদী শায়কে বিদ্ধ হয়েছেন - এইভাবে দুইহাত বুকে চেপে নিয়ে এসে নিজের পুরের এক অন্ধকার কক্ষে প্রবেশ করে দ্বার রুদ্ধ করে নির্জনে আত্মগোপন করেছিলেন। এ ছিল তাঁর অজান্তে অন্তরের দুঃখ নিবারণের প্রচেষ্টা। হয় তো বা তাঁর অন্তরে স্নেহের ফল্গুধারা প্রবাহিত হয়ে তাঁকে সিক্ত করে বলেছিল 'এরাই তো তোমার আপন ভ্রাতা ও ভ্রাতৃবধু'।                                            
কর্ণ যে কখনো ন্যায়ের পথ থেকে বিচ্যুত হবেন না একথা শকুনি জানতেন। কুরুক্ষেত্র মহারণ শুরু হবার পূর্বে পান্ডবদের পক্ষ নিয়ে শ্রীকৃষ্ণ যখন হস্তিনাপুর রাজপ্রাসাদে এসেছিলেন তখন দুর্যোধন দুঃশাসন ও শকুনি তিনজনে মিলে চক্রান্ত করে শ্রীকৃষ্ণকে বন্দী করার জন্য মন্ত্রণা করেছিলেন, তখন কর্ণকে সেই মন্ত্রণায় তারা আমন্ত্রণ জানান নি। দুঃশাসন বলেছিলেন অঙ্গরাজ্যের সাথে আলোচনা করার জন্য, কিন্তু শকুনি নিষেধ করে বলেছিলেন 'পূর্বাহ্নে জানতে পারলে অঙ্গরাজ এই প্রস্তাবে সম্মতি তো দেবেনই না উপরন্তু বাধা দিবেন'। এরপরে যখন শ্রীকৃষ্ণের শান্তি স্থাপনের দৌত্য ব্যর্থ হলো তখন দুর্যোধন, দুঃশাসন ও শকুনির ইচ্ছাতে কুরু সৈন্যরা বাসুদেবকে বন্দী করতে অগ্রসর হয়েছিলেন তখন সাত্যকির প্রচেষ্টায় তাদের সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়।                                
শ্রীকৃষ্ণ পাণ্ডব শিবির ফিরে যাওয়ার সময়ে অঙ্গাধিপতি কর্ণ বিষন্নচিত্তে একাকী হয়ে শ্রীকৃষ্ণের জন্য অপেক্ষমান। শ্রীকৃষ্ণ রথ থামিয়ে তাঁকে গাড় আলিঙ্গন করে রথে নিয়ে হস্তিনাপুর নগরের বাইরে চলে গেলেন। তাঁর মনে হলো কর্ণ যেন কিছু বলার জন্য অপেক্ষা করছেন, আবার তাঁর নিজেরও কিছু বলার আছে।             ইতিপূর্বে ইন্দ্রপ্রস্থে রাজসূয় যজ্ঞের সময় কর্ণের সাথে কিছু মধুর বক্যালাপ হয়েছিল শ্রীকৃষ্ণের। হস্তিনাপুর রাজসভায় দ্রৌপদীর লাঞ্ছনার হওয়ার খবর এবং দ্রৌপদীর উদ্দেশ্যে কর্ণের ব্যঙ্গাত্মক অশালীন ও অমার্জিত বাক্য প্রয়োগ যদুপতি অবগত হয়েছেন, তথাপি সে সম্বন্ধে তিনি কোনরূপ প্রসঙ্গ উত্থাপন না করে হস্তিনাপুর নগর অতিক্রম করে এক শিংশপা বৃক্ষ তলে রথ রেখে রথের সারথি দারুককে ইশারায় নিষ্ক্রান্ত হতে বলে কর্ণকে বললেন "একটি নিগূঢ় রহস্য তোমার কাছে উদঘাটন করব বলে তোমাকে এত দূরে নিয়ে এসেছি"। 
                                                  ………….পরবর্তী সংখ্যায় দেখুন

Post a Comment

0 Comments