জ্বলদর্চি

নিউটনের আপেলগাছ: প্রেক্ষাপট ও ভাগ্য/সৌমেন রায়

নিউটনের আপেলগাছ: প্রেক্ষাপট ও ভাগ্য 
                                                                                  সৌমেন রায়
                      
মহাবিজ্ঞানী নিউটন বসেছিলেন আপেল গাছের নিচে, একটি আপেল পড়লো পায়ের কাছে। আর অমনি নিউটনের মাথার ভেতর গজিয়ে উঠলো গ্রহ উপগ্রহের টানাপোড়েনের নিয়ম। গল্পটা বেশ প্রচলিত ও প্রেরণাপ্রদ। কিন্তু বিজ্ঞানের কোন আবিষ্কারের প্রেক্ষাপট এতখানি সাজানো নয়, এমনকি যেগুলি আমরা হঠাৎ আবিষ্কার বলে জানি সেগুলিও অনেকক্ষেত্রে নয়। বরং বিজ্ঞানের পথ সভ্যতার মতোই জটিল, সভ্যতার মতো রুধিরসিক্ত  না হলেও কখনো কখনো কর্দমাক্ত বটে।
                                         
  মোটামুটি ষোড়শ শতাব্দীর আগে পর্যন্ত টলেমীয় বিশ্ব ভাবনাই ছিল সর্বজনীন। অর্থাৎ সবাই মনে করত সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘুরছে। ষোড়শ শতাব্দীতে এক ধর্মযাজক, নাম তার কোপার্নিকাস (১৪৭৩-১৫৪৩ খ্রিস্টাব্দ) বললেন একটু ভিন্ন কথা। সূর্য স্থির আছে গ্রহগুলো ঘুরছে বৃত্তাকার পথে। হ্যাঁ, আমরা কোপার্নিকাসকে বিজ্ঞানী বলে জানলেও আসলে তিনি ছিলেন একজন ধর্মযাজক। আইন পড়েছেন, ডাক্তারি পড়েছেন, পেশার জন্য ধর্মযাজকতা করেছেন, কিন্তু ভালোবাসার জ্যোতির্বিদ্যার হাত কখনো ছেড়ে দেননি। তবে ধর্মযাজক হয়েও  কথাগুলো বললেন ভয়ে ভয়ে । বইটা ( On the revolution of heavenly bodies) উৎসর্গ করলেন তৃতীয় পোপ কে। কারণ  তিনি জানেন যাজক হয়ে বাইবেল বিরোধী কথা বললে কি হতে পারে। তবে এমন কথা যে তিনিই প্রথম বললেন তা কিন্তু নয়। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে অ্যারিস্টারকাস সূর্যকেন্দ্রিক বিশ্বের কথা বলেছিলেন। কিন্তু প্রবল প্রতাপান্বিত  অ্যারিস্টটল সে কথা মানেননি। তাই সেটা থেকে গিয়েছিল এক বিকল্প ভাবনা হিসাবে।এমন সব বিকল্প ভাবনার খোঁজ পাওয়া যাবে ইতিহাসের পরতে পরতে। যেগুলি সমকালে কলকে না পেলেও পরে সত্য প্রমাণিত হয়েছে। যাইহোক সব ক্ষেত্রে যা হয় এখানেও তাই হলো, সহজে গৃহীত হলো না অচলায়তন ভাঙা ভাবনা।বেশ কিছুকাল পরে ব্রুনো সে কথা প্রচার করতে গিয়ে চার্চের কোপে পড়েন, তাকে পুড়িয়ে মারা হয়(১৬০০খ্রিস্টাব্দ)। আশ্চর্যের বিষয় যখন  প্রথাগত ভাবনার বিরুদ্ধে কথা বলার জন্য পুড়িয়ে মারা হচ্ছে ইউরোপে প্রায় সমসাময়িক কালে ভারতবর্ষে সম্রাট আকবর সর্ব ধর্ম সমন্বয়ের জন্য ‘ দীন ই ইলাহী' প্রবর্তনের চেষ্টা করছেন। এটা একই সঙ্গে গর্বের ও লজ্জার। গর্ব এই কারণে ইউরোপে যখন অসহিষ্ণুতার কারণে, সত্য বলার কারনে পুড়ে মরতে হচ্ছে  তখনই আমাদের দেশে সহিষ্ণুতার উদাহরণ হিসেবে সর্বধর্ম সমন্বয়ের চেষ্টা হচ্ছে।আবার লজ্জার এই কারণে যখন ইউরোপীয় দুরন্ত কিশোর-টি সত্য অনুসন্ধানের জন্য প্রতিটি পাথর নেড়েচেড়ে দেখছে, সেজন্য মার খাচ্ছে, আবার ধুলো ছেড়ে সত্যের খোঁজ করছে, মিথ্যাকে সত্য বলে স্বীকার করে বেঁচে থাকছে আরো কিছুদিন সত্য অনুসন্ধানের জন্য ( গ্যালিলিও)  তখনো আমরা ধর্মে আটকে আছি।  প্রসঙ্গে ফিরে আসি, কোপারনিকাসের এই তথ্য কিন্তু পুরোটাই ছিল পর্যবেক্ষণ ভিত্তিক।  এর  পরে আসরে নামেন গ্যালিলিও গ্যালিলি(১৫৬৪-১৬৪২ খ্রিস্টাব্দ)।  হল্যান্ডের চশমা বিক্রেতারা দুরবীক্ষণ বানিয়েছে শুনে তিনি নিজেও আলাদা করেই বানিয়ে নিলেন। নিজের বানানো যন্ত্র  দিয়ে চোখ রাখলেন আকাশে।হল্যান্ডের লিপার্সে আর গ্যালিলিও দুজনেই প্রায়ই সমসাময়িক সময়ে দূরবীন বানিয়েছিল। তবে তাদের মধ্যে পার্থক্য হল একজন সেটা ব্যবহার করলেন খেলনা হিসেবে আর অন্যজন তা দিয়েই চেষ্টা করলেন বিশ্ব রহস্য সন্ধান করার। গ্যালিলিও দূরবীক্ষণ এ চোখ রেখে কোপারনিকাসের কথার সত্যতা বুঝতে পারলেন এবং 'ডায়লগস অন দি টলেমিক এন্ড কোপার্নিকান সিস্টেম'বইতে প্রকাশ করলেন। তার বিচার বসলো ঘটা করে।বিচারে সূর্যই পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে এই মিথ্যা শিকার করে রক্ষা পান। রক্ষা বলতে প্রাণ রক্ষা, তাকে কিছুদিন অন্তরীন রাখা হয় শাস্তি স্বরূপ। তিনি বেঁচে ছিলেন মিথ্যার সঙ্গে আপোষ করে, শুধুমাত্র আরও কিছুদিন সত্য অনুসন্ধান করবেন বলে।
            

জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇


 আরো কিছুকাল পরে কেপলার(১৫৭১-১৬৩০) তার নিজের ও টাইক্রো ব্রাহের(১৫৪৬-১৬০১) পর্যবেক্ষণ গুলি নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখলেন কোপার্নিকাসের বৃত্তাকার কক্ষপথের ধারণাটি ঠিক খাপ খাচ্ছে না। তিনি প্রস্তাব করলেন উপবৃত্তাকার কক্ষপথের। যে উপবৃত্তের একটি নাভিতে ( বৃত্তের যেমন একটি স্থির বিন্দু কেন্দ্র তেমনি উপবৃত্তের দুটি স্থির বিন্দু নাভি বা ফোকাস আছে)সূর্য। সে কক্ষপথে ঘোরার বেগ ও পর্যায়কাল সম্পর্কে দিলেন তথ্য। অবশ্যই এখানেও তিনি যে একথা একেবারে প্রথমে বললেন তা নয় একাদশ শতাব্দীতে টোলেডো র  আর্জাচেল বলেছিলেন উপবৃত্তাকার কক্ষপথের কথা।  কেপলার তার বলা কথার স্বপক্ষে পর্যবেক্ষণ ভিত্তিক ও গাণিতিক প্রমাণও দেন।  কেপলার দেখালেন যে নাভিতে সূর্যের অবস্থান তার কাছাকাছি এলে গ্রহগুলির ঘোরার বেগ বাড়ছে এবং গ্রহগুলি দূরত্ব অনুযায়ী পর্যায় কালের পরিবর্তন বোঝালেন তিনি। কিন্তু নতুন প্রশ্ন সামনে এলো আমাদের মত সাংসারিক লোকের মতো গ্রহগুলি এমন বনবন করে  পরাক্রান্ত সূর্যের চারিদিকে ঘুরছে কেন, মোহে না ভয়ে? উপবৃত্তাকার পথেই বা কেন ঘুরছে?
                                                    
   এই প্রশ্নগুলিরই সমাধান করেছিলেন নিউটন (১৬৪৩-১৭২৭), তবে তা একদিনে নয়। গিলবার্ট(১৫৪৪-১৬০৩) দেখালেন যে পৃথিবী একটি বিরাট আকারের চুম্বক। তারপর তিনি খানিক হালকাভাবে বললেন যে গ্রহগুলির ঘূর্ণন এই ধরনের চুম্বকীয় বলের কারণে ।সে ধারণা অনেকে বিশ্বাসও করত। সেটা ভুল হলেও মানবিক সম্পর্কের মতো স্পর্শ ছাড়াও বল যে কাজ করতে পারে সেটার কথা সবাই ভাবতে শুরু করল। জিওভানি  বরেলি একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বললেন(১৬৬৬)। বললেন ঘুরে চলা গ্রহদের কেন্দ্রাতিগ ( centrifugal) বলকে প্রশমিত করতে নিশ্চয়ই একটি পাল্টা বল কাজ করছে। কেন্দ্রাতিক বল হল বৃত্ত পথে  বস্তুর ওপর বাইরের দিকে ক্রিয়াশীল বল। কেন্দ্রতিগ বলকে প্রশমিত করছে যে বল তার নাম দিলেন অভিকর্ষ বল। কেপলারের দ্বিতীয় সূত্রটি ধরে বোঝা যায় গ্রহরা সূর্যের যত কাছে আসে বেগ তত বাড়ে অর্থাৎ কেন্দ্রাতিগ বল আর তাকে প্রশমিত করতে অভিকর্ষ বল বাড়ে।  অর্থাৎ এই অভিকর্ষ বল দূরত্বের কোন একটা ঘাতের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্কে আবদ্ধ। অনেকেই ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে শুরু করলেন।
                                                    
  আলো সোজা পথে যায় না তরঙ্গের মতো ঢেউ তুলে তুলে অগ্রসর হয় সে নিয়ে তর্কাতর্কি হয়েছে বহু কাল। আলোড়ন সৃষ্টিকারী তরঙ্গ তত্ত্বের জনক বলে আমরা যাকে জানি সেই হাইগেন্স(১৬২৯-১৬৯৫) একটা কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করলেন। গ্যালিলিও দেখিয়েছিলেন পেন্ডুলাম দিয়ে সময়ের নিখুত হিসাব রাখা সম্ভব। সেই পেন্ডুলাম নিয়ে কাজ করতে গিয়ে হাইগেন্স কেন্দ্রতিগ বলের সূত্র প্রণয়ন করলেন। দেখালেন ওই বলটি ব্যাসার্ধের সমানুপাতি এবং পর্যায় কালের বর্গের ব্যস্ত অনুপাতে পরিবর্তিত হয় ।আবার কেপলারের সূত্র অনুযায়ী পর্যায় কালের বর্গ ব্যাসার্ধের ঘনফলের সমানুপাতিক। এই দুটি বিষয় নিয়ে বোঝা যাচ্ছিল যে  বলটি যেহেতু অভিকর্ষ বলের সমান তাই অভিকর্ষ বলটিও হওয়া উচিত ব্যাসার্ধের বর্গের ব্যস্তানুপাতিক। হুক এবং অন্যান্য কিছু বিজ্ঞানী এমন একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছেও যান। কিন্তু সমস্যা থেকে যায় উপবৃত্তাকার কক্ষপথের ব্যাখ্যা নিয়ে ।এ ব্যাপারে হুক নিউটনকে একটা চিঠিও লেখেন। কিন্তু নিউটন কোন উত্তর দেননি। সমস্যাটি সমাধান অবশ্য করলেন নিউটনই। তার প্রিন্সিপিয়া গ্রন্থে(১৬৮৬) মহাকর্ষ সূত্রের পূর্ণাঙ্গ রূপ তুলে ধরলেন, ব্যাখ্যা করলেন উপবৃত্তীয় গতিপথের। প্রকৃতপক্ষে নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র থেকে যেমন কেপলার এর সূত্রে উপনীত হওয়া যায়, তেমনি কেপলার এর সূত্র থেকে উপনীত হওয়া যায় মহাকর্ষ সূত্রে। প্রিন্সিপিয়া প্রকাশের পর হুক দাবি করেন যে মূল ধারণাটি তার। শুরু হয় জ্ঞান তাপস বিজ্ঞানীদের মধ্যে কাদা ছোড়াছুড়ি।তীব্র বাকবিতণ্ডা হয় দুজনের মধ্যে। পরে বিভিন্ন নথি থেকে অবশ্য জানা যায় হুকের চিঠির অনেক আগেই তিনি সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন। বহু বছর এই ব্যাপারে হিরন্ময় নীরবতা পালন করেছেন অজ্ঞাত কারণে। নিউটনের চরিত্র অনেক ক্ষেত্রেই ছিল এইরকম রহস্যময়।
                               
  সুতরাং দেখাই যাচ্ছে যদি কোপার্নিকাস থেকেও ধরা হয় তাহলেও দুইশত বছর ধরে বহু মানুষের প্রচেষ্টার ফল মহাকর্ষ সূত্র। যে ফল একটি সংহত রূপ ধারণ করে নিউটনের মত গণিত নিপুন, সাহসী বিজ্ঞানীর হাত ধরে। এখানে আপেল গাছের ভূমিকা কতটা তা পাঠকই বিচার করবেন। গল্প সত্যি হোক বা মিথ্যা আপেল গাছটির ভাগ্য ভাবুন! কত আপেল গাছ তো জন্মায়, কার কপালে জোটে নিউটনের সমান খ্যাতি! ঈর্ষা না করে আমরা বরং ফিরে আসি আমাদের বিষয়ে।  এই সমস্ত গণনাতে নিউটন ব্যবহার করেন মেথড অফ ফ্লাক্সিওন। যেটা আমাদের এখনকার ক্যালকুলাস। আশ্চর্যের ব্যাপার এইরকম ধারণা যে তিনিই প্রথম ব্যবহার করছেন তাও কিন্তু নয়। বহু প্রাচীন সময় থেকে প্রায় একই ধরনের ধারণা ব্যবহার করেছেন ইউ ডক্সাস(৪০০-৩ ৫৫বি সি), আর্কিমিডিস(২৮৭-২ ১২বি সি), গ্যালিলিও (১৫৬৪-১৫৪২) ফার্মা(১৬০৭-১৬৬৫) সহ অনেকেই নিজেদের মতো করে। তবে এই বিদ্যাটিও সংহত রূপ ধারণ করে নিউটনের হাত ধরে। আধুনিক যে রূপটি আমরা ব্যবহার করি তার আবিষ্কর্তা অবশ্য লিবনিজ(১৬৪৬-১৭১৬)।  প্রকৃত আবিষ্কর্তা কে নিউটন না লীবনিজ সেই নিয়ে আরেক প্রস্থ বাগবিতণ্ডা, কাদা ছোড়াছুড়ি।আশ্চর্য, বারবার দেখছি কোন ধারনাই টুপ করে উপর  থেকে ঝরে পড়েনি। দীর্ঘকাল অপরিশীলিত ভাবে, হালকা ভাবে ব্যবহারের পর সংহত রূপ ধারণ করেছে কোনো একজনের হাতে।
                              
  নিউটনের এই আবিষ্কার কিন্তু নাড়িয়ে দিয়েছিল চার্চের ভিত। সবাই অবাক হয়ে প্রত্যক্ষ করেছিল সৌরজগৎ চলেছে প্রাকৃতিক নিয়মে, অদৃশ্য ঈশ্বরের অঙ্গুলি হেলনে নয়। পরিবর্তনশীল গতির সঙ্গে গতিশীল পৃথিবীর যে চিত্রটি তিনি আঁকলেন তা অনড়, নিরঙ্কুশ কর্তৃত্বের প্রতি অশ্রদ্ধা জাগালো। সমাজেও সেই সময় ঘটছিল একই রকম ব্যাপার। সামন্ততান্ত্রিক অনড় কাঠামোটি ভেঙে পড়ছিল ধীরে ধীরে। এমন যে যুগান্তকারী নিয়ম পরে দেখা গেল সে নিয়মেও খুঁত।

 আইনস্টাইন(১৮৭৯-১৯৫৫) দেখালেন গ্রহগুলির গতিপথ আসলে গ্রহগুলির ভারে দুমড়ে যাওয়া শূন্যস্থান( General theory of relativity,১৯১৫)। সে অবশ্য অনেক পরের কথা ও জটিল কথা। কি জানি ভবিষ্যতে হয়তো জানা যাবে আইনস্টাইনের নিয়মেও খুঁত। প্রকৃতি হোক বা মানুষ, সৃষ্টিতে খুঁত বোধ হয় অনিবার্য। খুঁত হয়তো আরো সুন্দর করে তুলে সৃষ্টিকে।কবির কথা কারো মনে পড়তেই পারে, 
                    
 'ঘরটা একটু অগোছালো থাক, উঠোনে একটু ধুলো।'

Post a Comment

1 Comments

  1. সংক্ষিপ্ত পরিসরে মহাজাগতিক সত্যানুসন্ধানের বিষয়গুলি খুব সুন্দরভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। জটিল বিষয়গুলি সহজ ভাবে ব্যাখ্যা করা নিশ্চয় দরকার কিন্তু সরলীকরণের রাস্তায় যদি বিষয়টি হালকা হয়ে যায় সেটি ঠিক নয়। আপেল গাছের উপমা টেনে এনে এই বিষয়টির ওপর লেখক জোর দিয়েছেন।

    ReplyDelete