জ্বলদর্চি

ওলাবিবির পূজা /ভাস্করব্রত পতি

পশ্চিমবঙ্গের লৌকিক উৎসব, পর্ব -- ৫৮

ওলাবিবির পূজা

ভাস্করব্রত পতি 

"কোথায় মা ওলাবিবি, বেউলা রাঁড়ীর মেয়ে" - জ্ঞানদাসের 'লীলাবতী'।
চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষের প্রথম সোমবার পালিত হয় ওলাইচণ্ডীর ব্রত। অশ্বত্থ ও বট গাছ যেখানে একসাথে থাকে সেখানে গাছের তলায় এই পূজা করা হয়। মূলতঃ ওলাউঠা এবং অন্যান্য রোগজ্বালার হাত থেকে বাঁচতে এই ব্রতটি পালন করা হয়। হিন্দু প্রধান অঞ্চলে শনি মঙ্গলবার নিরামিষ নৈবেদ্য দেওয়া হয়। আর যেখানে মুসলিম ফকিররা পরিচালনা করেন সেখানে ওলাইচণ্ডীর বদলে ওলাবিবি বা বিবিমা নামে পূজিতা হন। ওলাবিবি এবং ওলাইচণ্ডী একই দেবী ও অভিন্ন । ওলাবিবির মতোই ওড়িশার যোগিনীদেবী এবং দক্ষিণ ভারতের মারাম্মা এবং আনকাম্মা কলেরা তথা ওলাউঠা রোগের দেবী হিসেবে পূজিতা হন। এই ওলাবিবি হলেন ওলার তথা ওলাউঠার অধীষ্ঠাত্রী দেবী। কলেরা বা ওলাউঠা Vibrio cholerae নামের একটি ব্যাকটেরিয়া ঘটিত রোগ। এটি ক্ষুদ্রান্ত্রে সংক্রমন করে। কলেরার প্রধান উপসর্গ হল ঘনঘন চাল ধোয়া জলের মত পাতলা পায়খানা হওয়া। ১৯ শ শতকে এতদঞ্চলে কলেরার প্রাধান্য বেড়ে যাওয়ায় প্রচুর মানুষের মৃত্যু হয়। তখন এই রোগের হাত থেকে বাঁচতে ওলাবিবির পূজা শুরু হয়। পরবর্তীতে কলেরা রোগ নির্মূলীকরণের ফলে ওলাবিবির পূজার্চনার বহর কমে যায়। যদিও এখনও এই লৌকিক উৎসবটি মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের দ্বারা টিকে আছে।
'ওলা' অর্থে ভেদ বা তরলমলনিঃসরণ বা পেটনামা বোঝায়। হিন্দিতে 'উলার' এবং গুজরাটীতে 'উলাহ' বলে। অবতরণ বা অবরোহণ বা নামা অর্থেও 'ওলা' বোঝায়।
ওলা + উঠা > ওলাউঠা ( গুজরাটীতে 'উলাহ' অর্থে বমি)
'ওলাউঠা' অর্থে তরল মলনিঃসরণের ও বমনের রোগবিশেষ বোঝায়। অর্থাৎ ভেদবমি বা বিসূচিকা। মালদহে পরিচিত 'নামাতোলা' নামে এবং দুই ২৪ পরগণা জেলায় 'বাজারভাব' নামেও পরিচিত।

ওলাবিবি মুসলিম উপাস্যদেবী হলেও হিন্দুরাও ওলাবিবিকে সম্মান জানায়। তমলুক এলাকায় প্রতিটি গ্রামে আছে ওলাবিবির থান। এখানে দেবীমূর্তি নেই। তিনটি করে উঁচু উঁচু অর্ধগোলক পরপর থাকে। আগে মাটির তৈরি ছিল। এখন সিমেন্টের। লাল রঙের দেখতে। 'ওলাউঠা বিবি' থেকে ওলাবিবি। গ্রামে শয়ালপূজার সময় শীতলাপূজা হয়। তখন প্রথমেই ওলাবিবির পূজা হয়। পদুমবসানে গ্রামীণ হরিমন্দিরের গায়েই আছে ওলাবিবির থান। সেখানে পূজা করেন ব্রাহ্মণ। কিন্তু ওলাবিবির সিন্নি বানান স্থানীয় মুসলিম পরিবার। এজন্য তাঁরা নতুন মাটির সরাতে সুগন্ধি সরু চাল, চিনি, বাতাসা, কিসমিস, কাজু ফুটিয়ে পায়েস বা ক্ষীর তৈরি করেন। একেই বলে 'সিন্নি'। এজন্য নতুন করে উনুন খোঁড়েন ঐ মুসলিম পরিবারের কেউ। আর জ্বালানি হিসেবে এক ধরনের শুকনো পাতা ব্যবহার করা হয়। সাধারণত শুকনো তালপাতা সংগ্রহ করা হয় উনুনের জ্বালানি হিসেবে। এক্ষেত্রে অন্য কোনও জ্বালানি উনুনে দেওয়া হয়না। ঐ সিন্নি তিনি পৌঁছে দেন ওলাবিবির থানে। সেখানে ব্রাম্ভণ তা সকলকে পরিবেশন করেন পূজার পর। আর পূজার সময় ওলাবিবির থানে টাঙানো হয় চাঁদোয়া। ধুপ, ধুনা, প্রদীপ জ্বেলে চাঁদমালা পরিয়ে মন্ত্রপাঠ করা হয়। হিন্দু মহিলারা সিঁদুরের প্যাকেট, বাতাসা আর ধূপ দিয়ে পূজা দেন। সেই সিঁদুর ঢালা হয় ওলাবিবির থানে। অনেক যায়গায় ছলন দেওয়ার চল রয়েছে। শীতলা অষ্টমীর দিন তমলুকের মানিকতলায় মানিক পীরের থানে সেবাইতরা ওলাবিবির জন্য পায়েস ভোগ করেন। সেই পায়েস জাতিধর্ম নির্বিশেষে সবাই খান। এই সেবাইতরা কিন্তু সকলেই মুসলিম ধর্মাবলম্বী। তাই বলা যায় হিন্দু মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের কাছে নমস্য দেবী হয়ে উঠেছেন এই ওলাবিবি। নিম্নবর্গীয় হাঁড়ি বা ডোমদের ওলাবিবির পূজায় নানাবিধ বলি দেওয়ার চল আছে।
ওলাবিবির পূজায় 'মাঙন' রীতিও রয়েছে। যা কিনা প্রাচীন কালের Food gathering এর দৃষ্টান্ত। এ প্রসঙ্গে ড. গোপেন্দ্রকৃষ্ণ বসু লিখেছেন, "এই পূজায় কয়েকটি অবশ্য পালনীয় প্রথা বা লোকায়ত বিধান আছে। তার মধ্যে 'মাঙন' করা ও ‘ছলন' দেওয়া। অঞ্চলের মোড়ল বা প্রধান ব্যক্তি গলায় বদিরমালা (একটি খড়ের হার) পরে বা দাঁতে একটি তৃণ ধারণ করে পল্লীর বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে এই পূজার জন্যে অর্থ, চাল, ফল-মূল ইত্যাদি সংগ্রহ করেন, এটাই ‘মাঙন’ প্রথা। কোন কোন পল্লীর লোক এই পূজার ওলাবিবির ক্ষুদ্রাকৃতি মূর্তি গড়ে দেবীর থানে রেখে দেন। ওইরূপ ক্ষুদ্র মূর্তিকে ‘ছলন’ বা ‘সলন' বলা হয়। ভক্তদের কেউ কেউ কলেরা রোগের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাবার জন্যে বা অন্য কোন বাসনায় সিদ্ধ হবার ইচ্ছায় দেবীর থানের জানলায় বা থানের সংলগ্ন কোন গাছের ডালের দড়ি সহযোগে একটা ঢিল ঝুলিয়ে রাখে, একে ‘ঢিল-বাঁধা’ মানত বলে।"

প্রাচীন ভারতীয় হিন্দুসমাজে ‘সপ্তমাতৃকা' দেবীদের আরাধনা করা হ'ত। সেই সাতদেবীর মূর্তিরও সন্ধান মেলে কোনও কোনও স্থানে। তাঁরা হলেন ব্রাহ্মণী, ইন্দ্ৰাণী, বৈষ্ণবী, চামুণ্ডা, কৌমারী, মাহেশ্বরী এবং বারাহী। চামুণ্ডাকে কোথাও নারসিংহী বলা হয়ে থাকে। কারো কারো মতে, মাতৃকাগণ আসলে অষ্টমাতৃকা এবং তাঁরা সংখ্যায় আটজন। এই মাতৃকারা নেপালে অষ্টমাতৃকা এবং দক্ষিণ ভারতে সপ্তমাতৃকা নামে পূজিতা হন। দক্ষিণ ভারতের কয়েকটি গ্রামে সাতজন বনদেবীর বোন একাসনে পূজিতা হন। গোপেন্দ্রকৃষ্ণ বসুর মতে, “সপ্ত কালিংগেস এবং মীনাক্ষী ও তাঁর ছয় ভগ্নী উক্ত সাতদেবী ভগ্নীর অনুরূপ। তবে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার সাতবিবি এবং মীনাক্ষী ভগ্নীদের পূজাচারে বেশ মিল দেখা যায়।’
সাতবিবি দু ধরনের হন। হিন্দুপ্রধান অঞ্চলে সাতবিবির আকৃতি লক্ষ্মী সরস্বতীর মতো দেখতে। আর মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় দেবীর বেশভূষা মুসলিম মহিলাদের মতো হয়। এই সাতবিবিদের একবিবি হল 'ওলাবিবি'। সাতবিবির সাতবোনের মধ্যে ওলাবিবির প্রাধান্য এবং গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। গ্রামেগঞ্জে একসময় কলেরা বা ওলাউঠার খুব প্রভাব ছিল। সেই রোগ থেকে মুক্তি পেতে এই দেবীর উপাসনা করে মানুষজন। ওলাবিবির সাতবোনেরা হলেন — ওলাবিবি, ঝোলাবিবি, ঝেটুনেবিবি, আসানবিবি, চাঁদবিবি, আজগৈবিবি এবং বাহড়বিবি। গোপেন্দ্রকৃষ্ণ বসু লিখেছেন— "দক্ষিণ ভারতের গ্রাম্যদেবী সপ্তকানিংগেস এবং মীনাক্ষী ও তাঁর ছয় ভগ্নীর কয়েকটি দিক হইতে উক্ত সাতবিবির মিল দেখা যায়। কোনো রোগের প্রাদুর্ভাবকালে দক্ষিণ ভারতের কুঙালোর অঞ্চলে এই সাতদেবীর বিশেষভাবে পূজা দেওয়া হয়।" 

সাতবহুনী দেবী তথা সাতবোনের যে নামগুলি আমরা পাই, তা হল — শাঁখাসিনি, চন্দ্রাসিনি, খাঁদারানি, চম্বারী, অন্বন্তরী, ধন্বন্তরী এবং বাশুলি । এই সাতবোন বিভিন্ন জায়গায় পৃথক পৃথকভাবে গ্রামের মানুষের হাতে পূজা পেয়ে থাকেন। গ্রামের মানুষ তাঁদের গেঁও ছড়ায় সেই সাতটি বোনকে ডাকে এভাবেই — 
“নদীর ধারে সুরগুজা ফুল ফুটে লালে লাল 
হিলতে আয়রে দুলতে আয়রে 
সাতবহিন সাত ফুলে আয়।"

শুধু সাতবহুনীর সাতবোন আছে — তা নয়। অন্যান্য অনেক দেবী আছেন, তাঁদেরও সাতবোনের সন্ধান মেলে। যদিও পাঁচবহনা এবং আটবহনার কথাও মেলে। বীরভূমের মহম্মদপুর থানার খয়রাকুঁড়ি গ্রামে বাণেশ্বরীদেবীর সাতবোন — দুধেশ্বরী, খগেশ্বরী, নন্দীশ্বরী, মাঘেশ্বরী, কেচুরেশ্বরী, বাণেশ্বরী এবং শংখেশ্বরী। তবে এঁরা ‘সাতবহুনী' দেবী নয়। শীতলারও সাতবোনের নাম মেলে। তাঁরা হলেন— শীতলা, ফুলমতী, কালী, সাম্য, বিগিম, কঙ্কালী এবং যোগীন। বর্ধমানের জামুড়িয়া থানার জোবা গ্রামে রয়েছে সাতকালী। বীরভূমের মনসাদেবী 'শাওডালি'-র সাতবোন রয়েছে। তাঁরা হলেন— চিন্তামণি, বসন্তকুমারী, ওলাইচণ্ডী, শীতলা, শাঁওডালি, কমলা এবং মড়কচণ্ডী। সবংয়ের খড়াই গ্রামের সপ্তমাতৃকা হল — চামুণ্ডা, ইন্দ্ৰাণী, ব্রহ্মাণী, বৈষ্ণবী, কুমারী, বরাহী এবং মহেশ্বরী। গ্রামের ব্রাহ্মণরা এঁদের পূজা করেন। সকল গ্রামবাসীই এঁদের পূজা করার সুযোগ পান। কথিত আছে, বর্গিরা নাকি এই মূর্তির তলায় খোঁড়াখুঁড়ি করে কোনও ধনরত্ন না পেয়ে রেগে এই সাতদেবীর মূর্তির নাক কান কেটে দিয়েছিল। তবে বাঁকুড়ার আটবাইচণ্ডী গ্রামের লোকেদের কাছে সাতবোন হল — শীতলা, মনসা, চণ্ডী, বাশুলি, রঙ্গিনী, শঙ্খিনী এবং চমকিনী। কোথাও আবার সাতবোন হল — বাশুলি, জামনালা, চণ্ডী, বিলাসিনী, রঙ্গিনী, চমকিনী এবং সনকিনী। ঝাড়গ্রামের সাঁকরাইলের বনপুরা গ্রামের মানুষের কাছে সাতবোন হলেন — দিয়ালীবুড়ি, কুবড়িয়া বুড়ি, কেঁদিয়া বুড়ি, গোনিয়া বুড়ি, শাঁকারী বুড়ি, সাতভাউনী এবং দুয়ারসিনী। 

আরো একটি কাহিনী শোনা যায় কোথাও কোথাও। একসময় অসুরদের অত্যাচারে মুণ্ডা জাতি সন্ত্রস্ত হয়ে সিংরোঙার শরণাপন্ন হয়। সিংবোঙা নানাভাবে অসুরদের শায়েস্তা করার চেষ্টা করেন এবং অবশেষে কৌশলে তাঁদের লোহাগলানো চুল্লিতে পাঠিয়ে ভস্মীভূত করেন। এরপর অসুরদের কাতর ক্রন্দনে বিগলিত হয়ে সিংবোঙা বলেন যে, এরপর থেকে তাঁরাও বোঙা হয়ে যাবে। কিন্তু সিংবোঙাকে ওঁরা কিছুতেই ছাড়তে চাইল না। ফলে, চুলের মুঠি ধরে সিংবোঙা ওঁদের ছুঁড়ে ফেললেন পাহাড় বনে, নদী নালায় এদিক ওদিক। এর ফলে বিভিন্ন দেবতার উদ্ভব। যে পাহাড়ে পড়ল, তার নাম হল বুরু বোঙা। এমনিভাবে ইকির বোঙা (জলদেবী), নাগে বোঙা (টাঁড়দেবী), দেশোয়ালী বোঙা (বনদেবী), চান্দো ইকির বোঙা (ঝরনাদেবী) এবং চাণ্ডী বোঙা (বনের অধিষ্ঠাত্রী কর্ত্রী) প্রভৃতি বন পাহাড় ঝরনাধারার দেবী হয়ে গেল।

গোপেন্দ্রকৃষ্ণ বসু এই সাতবিবির কাহিনি শুনিয়েছেন এভাবে — ব্যাধির বীজ ভরা কুঁজ নিয়ে সাতবিবি আসমান থেকে সোজা বাদশার শয়নকক্ষে উপস্থিত হলেন, তখন গভীর রাত। বিবিরা বাদশার উদ্দেশ্যে বললেন—
শুন বাদশা গুণমণি ঘুমে দেছ মন।
শিয়রে মা সাতবিবি ডাকে হওরে চেতন।। 
হাজোত যদি না দিবে, ভালে ভাল।
কাল তোমার সহরে দিব মড়া জাঙ্গাল।।
সকালবেলায় দরবারে বাদশা সকলকে গতরাতের কথা জানালেন। তিনি ভয় পেয়েছেন বিবিদের দেখে, তাঁদের হাজোত দেবেন মনস্থ করেছেন। কিন্তু উজীর নাজীর বাধা দিলেন। অশরীরী অবস্থায় সাতবিবি সেখানেই ছিলেন, তাঁরা ক্রুদ্ধ হয়ে মারণমন্ত্র ছাড়লেন—
দাওনা কারকুন যে যেখানে ছিল।
দেখতে দেখতে সকলের প্রাণ উড়ে গেল।।
ঠিক ওইসময় উজীরের সাতপুত্রও রক্ত বমি করে প্রাণ হারাল। বাদশা আর স্থির থাকতে পারলেন না, ভয়ে ভক্তিতে সাতবিবির কৃপা প্রার্থনা করলেন।
তখন সাতবিবি জাহির করলেন—
বাইশের বন্দ ঘর, তার চার হাত কোঠা।
দেখিতে সুন্দর হবে, বিজলীর ছটা।। 
মউরের পুচ্ছ দিয়ে চাল ছাওইবে। 
তবে ত আমার হাতে নিস্তার পাইবে।। 
বাদশা উজীর সকলে সাতবিবিদের আরাধ্য বলে স্বীকার করলেন। তখন বিবিরা -
আল্লা রসুল বলে যখন দস্ত ফিরায় গায় 
উজীরের সাতপুত্র বাহান বকশিস পায়।।


জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇




Post a Comment

1 Comments

  1. কত অজানাকে জানলাম। দাসপুর থানায় নির্ভয়পুরে পটিকারদের ওলাবিবি আছে।

    ReplyDelete