জ্বলদর্চি

যেতে যেতে পথে -৫৯/রোশেনারা খান

যেতে যেতে পথে
রোশেনারা খান

পর্ব ৫৯

এখানে এসে  প্রথম যে মাড়োয়াড়ি বাড়িতে আমার বাংলা কবিতা ইংলিশে ট্রান্সলেট করে শুনিয়েছিল ওর নাম অভীক। বউয়ের নাম সুমনা। অভীক ডাক্তার, সুমনা স্কুল শিক্ষিকা। পেশা যাই হোক না কেন, অভিক তিথি-নক্ষত্র মেনে খুবই ভক্তিভর শুদ্ধাচারে পুজো করে। মনে হয় শিকড় থেকে বহুদূরে থাকে বলে নিজেদের সংস্কৃতি    ধর্ম, থেকে দূরে সরে যাওয়ার ভয়ে ধর্মকে আরো জোর করে ধরে আছে। অভিকের বাড়িতে সাজানো গুছনো পুজোরঘর আছে। আর এক সুমনা আমাদের মেদিনীপুরের মেয়ে, একই স্কুলে ওরা পরেছে, তবে তখন একে অপরকে চিনত না। ও বাবলির থেকে অনেক বড়। শেফিল্ডে থাকে, ওর গৃহ প্রবেশের অনুষ্ঠানে যাওয়া হয়নি। মৌসুমি, স্মিতা, সুতপা, প্রায় সবার বাড়ি যাওয়া হয়ে গেছে। মৌসুমি  বর্ধমানের মেয়ে। ও শুধু বড় ডাক্তারই নয়, অপূর্ব সুন্দরী এবং রন্ধন পটীয়সী। একা বিশ তিরিশ জনের রান্না অনায়াসে করতে পারে। স্মিতার স্বামীর গানের গলা দারুণ! দেবশীষ  সুজাতা  দুজনেই ডাক্তার। প্রথম দিনের পার্টীতে দেবাশীষই প্রথম আমাকে কবিতা শোনাতে বলেছিল। ওর মা রমাদির দুইছেলে। আর একছেলে মুম্বাইয়ে থাকেন। স্বামী চলে যাওয়ার পর রমাদি বছরের ছ’মাস মুম্বাইয়ে বড় ছেলের কাছে, ছ’মাস নটিংহামে ছোট ছেলের কাছে থাকে। মিতাদিরা বাংলাদেশ থেকে এসেছেন,  ওনারা খ্রিষ্টান। দুইমের বিয়ে দিয়ে সাহেব জামাই করেছে এক মেয়ের সম্প্রতি বিয়ে হয়েছে। আমাকে যেতে বলেছিলেন, কিন্তু যাওয়া হয়নি।

জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇



     আমাদের দেশে যে সমস্ত   মেয়েরা  চাকরি করেন তাদের অনেকার প্রশ্ন, তিনি কেন বাড়ির কাজ করবেন?  অথচ বিদেশে মহিলারা বাড়িতে বসে থাকা পছন্দ করেন না।  কাজ ছোট না বড় তাও তাঁদের কাছে বিচার্য  বিষয় নয়। কাজ হলেই হল। এদেশের ও বাইরে থেকে আসা মহিলারা চাকরিও করেন, আবার ঘরও সামলান, সন্তান প্রতিপালনও করেন। কাজের ক্ষেত্রে নারী পুরুষের মধ্যেও ভেদাভেদ নেই।বারিতেও পুরুষরা কাজে সাহায্য করে থাকেন। অনেক পরিবারে মা চাকরি করেন, বাবা বাচ্চা ও সংসার সামলান। এর জন্য কোন পুরুষ হীনমন্যতায় ভোগেন না। আবার অনেক বাবা মা উপার্জন করার পরিবর্তে অধিক সন্তানের জন্ম দিয়ে থাকেন। এদের সন্তানরা যে সরকারী ভাতা পেয়ে থাকে, তাতে সন্তানদের সঙ্গে মা বাবারও খরচ চলে যায়।

      এমনি করেই দিনের শুরু আর শেষ হচ্ছে। ঋতু পরিবর্তন হচ্ছে। রোজ সকালে উঠে প্রথমে ছেলের সঙ্গে কথা বলি, তারপর বেরিয়ে পড়ি। এদেশে যখন এসেছিলাম প্রত্যেকের বাড়ির সামনের অংশটি ফুলে ফুলে ঢাকা ছিল। কত রকম কায়দা করে সে সব গাছ লাগানো হয়। বেশিরভাগ ফুল আমাদের দেশে দেখা যায় না। কিছু কিছু গাছ শীতপ্রধান এলাকায় দেখা যায়। বেশিরভাগ ফুলের নামই জানিনা। ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে নতুন নতুন ফুল ফুটতে দেখছি। ছোট্ট একরকম ফুলের নাম ‘ফুসিয়া’। এই ফুলটি তিনরঙে দেখা যায়। এই ফুলের আর একটি নাম ‘ব্যালেরিনা’। ব্যালে ড্যান্সারের মত দেখতে বলেই এই সুন্দর নামটি দেওয়া হয়েছে। ফুটপাথ ধরে হাঁটোতে কতরকম গাছ চোখে পড়ে, যদিও আমি নিচের দিকে মুখ করেই হাঁটি। একরকম উইলো গাছের ডাল পাতা সবসময় নিচের দিকে ঝুঁকে থাকে, তাই একে বল হয় কাঁদুনে উইলো(উইপিং উইলো)।

    প্রথম প্রথম কোনও দিকে না তাকিয়ে হাঁটলেও চোখে পড়ে বাস রাস্তার ধারে কতরকম গাছ, কোন কোন গাছের পাতা মেরুন। একদিন নিচের দিকে তাকিয়ে যেতে যেতেই দেখতে পেলাম একটি গাছের তলা বিছিয়ে লাল টুকটুকে চেরিফল পড়ে আছে। কৌতূহল বশে কয়েকটা কুড়িয়ে নিলাম। এভাবেই একদিন লক্ষ্য করলাম কতগুলো গাছে ছোট ছোট ফল ধরেছে। একটু বড় হতে চিনলাম ওগুলো আপেল। ছোট বড় সবরকম গাছেই আপেল ধরে রয়েছে। ছোট গাছগুলো আপেলের ভারে ফুটপাতে ঝুঁকে পড়েছে। অগাস্টের মাঝামাঝি সময় থেকে আপেল ঝরা শুরু হল। রোজ দেখি আর অবাক হই গাছের তলায় এত আপেল পড়ে থাকতে দেখে! কেউ কুড়োই না, পাড়েও না। অক্টোবর পর্যন্ত আপেল ঝরেই চলেছে। একদিন দেখি, কাউন্সিলের লোকেরা পরিষ্কার করছে। আপেল দুধরণের হয় আগে জানতাম না।রান্না করে খাওয়ার আপেলকে কিচেন আপেল বলা হয়।

     এখানে একধরণের কুমড়ো পাওয়া যায়,য়াস’ ‘বাট্টার নাট স্কোয়াশ’। গঠনটা একটু আলাদা। এর কিছু বীজ ইনডোর পাতাবাহারের টবে ছড়িয়ে দিয়েছিলাম।কয়েকদিন পর দেখি চারা বের হয়েছে। কয়েকটা চারা তুলে নিয়ে জারার ছোটবেলার বাতিল বাথটাবে মাটি ভরে তাতে পুঁতে দিয়েছিলাম। গাছগুলো দিব্যি বাড়তে শুরু করল। বেশ কয়েকবার পাতা কেটে রান্না করা হল,দারুণ স্বাদ। ইংল্যান্ডে বসে এমন টাটকা কুমড়ো শাক খাওয়া, কম কথা নয়। ফার্ম থেকে ফুলগাছের সঙ্গে খান সাহেব একটা লঙ্কার চারা এনে মাটিতে পুঁতে দিয়েছিলেন। প্রায় তিন মাসের ওপর অজস্র লঙ্কা ফলতে দেখলাম। তবে বরফ পড়তে শুরু করলে গাছটি মারা যাবে, তাই মেয়ের খুব মনখারাপ।

     এর মধ্যে আরও কয়েকটি জায়গা  বেড়াতে যাওয়া হল। ‘অলটন’ গেলাম অনলাইনে টিকিট কেটে। এখানেও পুরনো ক্যাসেল, লেক, বাগানের সঙ্গে রয়েছে বিভিন্ন ধরণের রাইড। কারপারকে গাড়ি রেখে ‘মনোরেল’এ চড়ে স্পটে গিয়ে রাইডে চড়া শুরু হল। প্রথমবার স্কাই রাইডে চড়লাম।ঝিলের জলে জল কামান নিয়ে নকল যুদ্ধ হচ্ছে। এই খেলার জন্য বিশেষ ধরণের পোশাক পরতে হয়েছে। শরীর গরম করার ব্যবস্থাও রয়েছে।
    একদিন হঠাৎ করে ‘ওয়েলস’ যাওয়া হল। গতবার গ্রেট ব্রিটেনের ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ডের কিছু কিছু অংশ দেখা হয়েছিল। বাকি ছিল ওয়েলস। ওয়েলসের ল্যানডুডনো সি বীচ আটলান্টিকেরই একটা অংশ, নাম ‘ওরম’। প্রথমে ট্রামে চড়ে পাহাড়ে ওঠা হল। কিছুটা ওঠার পর ট্রাম চেঞ্জ করতে হল। ওপরে ওঠার সময় নীচে তাকিয়ে মনে হল সমুদ্র গোল করে শহরটাকে ঘিরে রেখেছে। ক্রমশ চারপাশের সুন্দর দৃশ্য দেখা যেতে লাগল। সমুদ্র, পাহাড়, সাদা ভেড়ার পাল। একটা কপার মাইনও দেখতে পেলাম। ওপরে পৌঁছে ট্রাম থেকে নেমে দেখলাম বাচ্চাদের খেলার পার্ক, কফিশপ, আরও অনেককিছু রয়েছে। আমরা সমুদ্রের দিকে এগিয়ে গেলাম। সমুদ্র অনেক নিচে, ঘাসে ঢাকা ঢালু জমির পাশে রাস্তাও রয়েছে। আর রয়েছে একটা মস্ত কবরখানা। দূরে জাহাজ দেখা যাচ্ছে। লঞ্চ ভাসছে। বেলুনে চড়ে মানুষ উড়ছে। আরও অনেককিছু আছে, কিন্তু দেখার মত মন নেই। এখানে একটি মুসলিম পরিবারের সঙ্গে দেখা হলে বয়স্ক ভদ্রলোক নিজে এসে আলাপ করলেন। ১৯৪৮ সালে উত্তরপ্রদেশ থেকে এসেছিলেন। বর্তমানে ম্যানচেস্টারের বাসিন্দা। এইরকম একটা জায়গায় এসে দেশের মানুষের সঙ্গে, দেশের ভাষায় কথা বলে খুব ভাল লাগল। কেবল কারে পাহাড় থেকে নামার কথা ভাবা হলেও ট্রামেই নামতে হল। কারণ প্রচণ্ড বাতাসের জন্য কেবল কার বন্ধ। এখানে সমুদ্রের জল আর নীল আকাশ মিলেমিশে একাকার। কাছে গিয়ে দেখলাম ঢেউয়ের সঙ্গে  উঠে আসা ঝিনুকগুলোও নীল। কয়েকটা নীল ঝিনুক কুড়িয়ে নিলাম।
      এরপর বাসে চড়লাম শহরটা ঘুরে দেখার জন্য।  প্রথমে একটি নদীর  ওপর আমাদের নিয়ে বাসটি বেশ কয়েকবার পাক খেল। এই জায়গাটির নাম ‘কনওয়ে’। এখানেই দেখলাম বিশ্বের ক্ষুদ্রতম বাড়িটি।লম্বায় ৩ মিটার, চওড়ায় ১.৮ মিটার।  ১৬০০ শতকে নির্মিত এই বাড়িটির সর্বশেষ বাসিন্দা ছিলেন এক জেলে। তিনি খুব কষ্ট করে এখানে বাস করতেন,কারণ তাঁর উচ্চতা ছিল ৬ফুট ৩ইঞ্চি। এখন এই বাড়িটি টুরিষ্টদের কাছে খুবই আকর্ষণীয়। শহরটিতে একটি ভাংগা ক্যাসেল দেখলাম । ১২০০ শতকের এই ক্যাসেলটি বহু যুদ্ধের সাক্ষী হয়ে শহরের বুকে দাঁড়িয়ে আছে। এছাড়াও  সারা শহর জুড়ে প্রচুর কাঠের মূর্তি ছড়িয়ে রয়েছে। এই মূর্তিগুলি হল বিশ্ববরেণ্য লেখক লুইস ক্যারলের লেখা ‘অ্যালিস অ্যাডভেঞ্চারস  ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড’ পড়লাম। আমরা অনেকেই ছোটবেলায় এই গল্প পড়েছি।

 ক্রমশ

Post a Comment

1 Comments