জ্বলদর্চি

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা-৬৩/প্রীতম সেনগুপ্ত

পর্ব ৬৩

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা

প্রীতম সেনগুপ্ত

 ব্রিটিশ-আমেরিকান সাহিত্যিক ক্রিস্টোফার ইশারউড তাঁর ‘SriRamakrishna and his disciples’ গ্রন্থে লিখছেন -- “After Sarada had become Trigunatitananda, he made several pilgrimages but spent most of his time in Calcutta. During the famine of 1897 in the Dinajpur district, he organized relief work. He himself has strange eating capacities. He could live for a long time on a few pieces of fruit a day; then again he could eat enough for four or five people at a sitting. Once, when Trigunatitananda was on pilgrimage, he went into an inn accompanied by a young boy. The Swami asked the innkeeper if he would charge less for the boy's food, since he would certainly not eat as much as an adult. But the innkeeper replied curtly that everyone must pay the same price. So Trigunatitananda, to teach him a lesson, began to eat and eat and eat. At last the innkeeper appeared and told him humbly, ‘Holy Sir -- I won't charge you anything for what you have eaten, but now you must stop, because we have no more food in the house’.”

 ১৯০২ সালে স্বামী বিবেকানন্দের আকস্মিক মহাপ্রয়াণের পর স্বামী ব্রহ্মানন্দজী আমেরিকার সান ফ্রান্সিসকো কেন্দ্রের দায়িত্বভার অর্পণ করেন স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দজীর উপর। কারণ তিনি জানতেন তুরীয়ানন্দজী ভারত পরিত্যাগ করে আর সেখানে ফিরে যাবেন না। সুতরাং বছরের শেষদিকে ত্রিগুণাতীতানন্দজী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্যে জাহাজে চেপে রওনা দিলেন। তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন সেখানে গিয়ে সম্পূর্ণ নিরামিশ আহার গ্রহণ করবেন। সেখানে কোনও শাক-সবজি নাও পাওয়া যেতে পারে, এমন এক ধারণা থেকে স্থির করেছিলেন শুধুমাত্র রুটি ও জল খেয়ে থাকবেন। 

জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇



 ত্রিগুণাতীতানন্দজীর সুচারু পরিচালনায় আমেরিকায় সান ফ্রান্সিসকোতে প্রথম হিন্দু মন্দির নির্মিত হয়, মন্দির উৎসর্গের কাজটি সম্পন্ন হয় ১৯০৬ সালে। সেখানে ভয়াবহ ভূমিকম্প ও অগ্নিকাণ্ডের অব্যবহিত পূর্বে এটি নির্মিত হয়েছিল। সেইসব দুর্যোগ পেরিয়ে আজও মন্দিরটি স্বমহিমায় দণ্ডায়মান। একটি অতি মনোরম পুরনো মন্দির যার শীর্ষদেশে প্রাচ্য ধাঁচের গোল গম্বুজ।
 প্রতি বছর শান্তি আশ্রমে নির্বাচিত ভক্তগোষ্ঠীকে নিয়ে ধ্যান শিক্ষা প্রদান করতেন ত্রিগুণাতীতানন্দজী ও নিজেও সকলের সঙ্গে ধ্যানে মগ্ন হতেন।

 শ্রীরামকৃষ্ণদেবের দেহত্যাগের পর তাঁর যুবক শিষ্যেরা গৃহীভক্ত সুরেন্দ্রনাথ মিত্রের সহায়তায় দক্ষিণেশ্বরের নিকটবর্তী বরানগরে একটি ভগ্নদশাসম্পন্ন বাড়ি ভাড়া করেন। এটিই প্রথম রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের মঠ। পিতামাতার তীব্র আপত্তি থাকা সত্ত্বেও সারদা গুরুভাইদের সঙ্গে সেখানে নিত্য সাক্ষাৎ করতে যেতেন। পিতামাতার শঙ্কা ছিল সারদা বুঝি সন্ন্যাসী হয়ে যাবেন। ১৮৮৬ সালের ডিসেম্বর মাসে ক্রিসমাসের ঠিক আগে এই যুবক শিষ্যেরা স্থির করলেন গুরুভাই বাবুরামের জন্মস্থান আঁটপুরে সকলে মিলে যাবেন। আসন্ন পরিভ্রমণের পরিকল্পনাটি অতি গোপনে সারদাকে জানিয়ে দিলেন নরেন্দ্রনাথ। সারদা গৃহ পরিত্যাগ করে সকলের সঙ্গে আঁটপুরে গিয়ে পৌঁছলেন। ক্রিসমাসের রাতে অগ্নি সাক্ষী রেখে এই যুবক ভক্তেরা ত্যাগের মন্ত্রে দীক্ষিত হওয়ার প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করলেন। এই ঘটনায় রামকৃষ্ণ ভাবান্দোলনের ইতিহাসে আঁটপুর এক তাৎপর্যমণ্ডিত স্থানে পরিণত হল। শ্রীরামকৃষ্ণ যে ত্যাগের আগুন এই যুবকদের মধ্যে প্রজ্জ্বলিত করেছিলেন তা সার্থক রূপ পেল। তাঁরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলেন যে আর গৃহে ফিরে যাবেন না।

 আঁটপুরে এক দুর্ঘটনার কবলে পড়েন সারদা ও ভাগ্যক্রমে রক্ষা পান। সাঁতার জানতেন না, পুকুরে স্নান করতে গিয়ে সিঁড়িতে পা পিছলে গভীর জলে পড়ে যান। সঙ্গে সঙ্গে গুরুভাই নিরঞ্জন ( স্বামী নিরঞ্জনানন্দ ) পুকুরে নেমে উদ্ধার করেন সারদাকে। আরেকদিন এই ত্যাগী ভক্তরা হর-গৌরী উৎসবের আয়োজন করেন। সারদা শিব এবং গঙ্গাধরকে গৌরীরূপে সজ্জিত করা হয়। প্রকৃতপক্ষে এই এই ত্যাগী যুবকেরা তাঁদের গুরুর কাছে শিখেছিলেন যে কীভাবে অধ্যাত্ম জীবন উপভোগ্য করে তোলা যায়।

 এক সপ্তাহ আঁটপুরে অতিবাহিত করার পর সকলে ফিরে আসেন বরানগর মঠে। সারদা বাড়িতে ফিরে যাওয়ার তুলনায় মঠে থেকে যাওয়াই শ্রেয় মনে করেন। ১৮৮৭ সালের জানুয়ারি মাসে সারদা ও অন্যান্য গুরুভাইয়েরা শ্রীরামকৃষ্ণের আলোকচিত্রের সামনে বিরজা হোম সম্পন্ন করে সন্ন্যাসের ব্রতে দীক্ষিত হন। সারদার সন্ন্যাস নাম দেন স্বামী বিবেকানন্দ স্বয়ং -- স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দ। পরবর্তী সময়ে এই নাম নিয়েই আবার ব্যঙ্গ করতেন স্বামীজী। বলতেন এত লম্বা নামটা সংক্ষেপ করতে। যার ফলস্বরূপ স্বামীজী ‘ত্রিগুণাতীত’ বলে তাঁকে সম্বোধন করতেন।

 বরানগর মঠে কঠোর সাধনার দিনগুলিতে ত্রিগুণাতীতানন্দজীর একবার ইচ্ছা হল মধ্যরাতে শ্মশানে গমন করে তান্ত্রিক ক্রিয়া সম্পন্ন করবেন। তিনি জানতেন বিবেকানন্দ এই ব্যাপারে অনুমতি দেবেন না। সুতরাং এক রাতে সকলে ঘুমিয়ে পড়ার পর অতি নীরবে ও সতর্কতার সঙ্গে শ্মশানাভিমুখে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলেন। এমন সময় একটি ঘটনায় যুগপৎ বিস্মিত ও হতাশ হলেন। তিনি শুনলেন ব্রহ্মানন্দজী তাঁর উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলছেন, “ওরে সারদা, যাস নি, যাস নি।” সে শব্দে সকলেরই নিদ্রাভঙ্গ হল। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য ব্রহ্মানন্দজী, সুবোধানন্দজী ও ত্রিগুণাতীতানন্দজী একশয্যায় নিদ্রিত ছিলেন। নিদ্রাভঙ্গের পর সকলে দেখলেন সারদা মহারাজ ঘরের ভিতর প্রবেশ করছেন। ব্রহ্মানন্দজীকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, স্বপ্নে ঠাকুর ওইভাবে ত্রিগুণাতীতানন্দজীকে নিষেধ করতে বলেছিলেন। স্বভাবতই ত্রিগুণাতীতানন্দজীর তন্ত্রসাধনার সেখানেই ইতি হল।
 বরানগর মঠে আরেকটি ঘটনা ঘটেছিল যার থেকে তাপস ত্রিগুণাতীতের পরিচয় মেলে। এই বিষয়ে গম্ভীরানন্দজী ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তমালিকা‘ গ্রন্থে লিখছেন --“বরাহনগরে একসময়ে ত্রিগুণাতীত মহারাজ একবার একটি ছোট ঘরে দরজা বন্ধ করিয়া এরূপ জপধ্যান আরম্ভ করিলেন যে, আহারনিদ্রাও ভুলিয়া গেলেন। সুতরাং অপর সকলে তাঁহাকে সাধ্যসাধনা করিতে লাগিলেন, এমন কি জোর করিয়াও ধরিয়া আনিতে চাহিলেন; কিন্তু কিছুতেই কিছু হইল না। অবশেষে তিনি বলিলেন যে, মহাপুরুষ শিবানন্দজী যদি আহারের সময় তাঁহাকে স্পর্শ করিয়া থাকেন, তবে উহাই তাঁহার জপের সদৃশ হইবে এবং ঐভাবে তিনি অন্নগ্রহণ করবেন। অগত্যা তাহাই হইল।”


Post a Comment

0 Comments