জ্বলদর্চি

যেতে যেতে পথে-৬৪/রোশেনারা খান

যেতে যেতে পথে

রোশেনারা খান

পর্ব ৬৪

আজ খান সাহেব বেশ ভাল মুডে আছেন। সকালে একা হাঁটতে বেরিয়েছিলেন। দুপুরে একা চুল কেটে এলেন। ওর ও কী বাড়িতে বন্দি থাকতে ভাল লাগে? দেখা যাক কতদিন সুস্থ থাকেন? সকাল থেকে ব্যস্ততার মধ্যে কেটেছে। কমলেশ নন্দকে   ‘ঝরা বকুলের মালা’ ছড়া সংকলনটি করতে দিয়ে গেছলাম। আমি বলাতে শিল্পী মানব বন্দ্যোপাধ্যায়, আমাদের মানবদা খুশি হয়ে আমি যেমনটি স্কেচ করেছিলাম ,তেমনই প্রচ্ছদটি এঁকে দিয়েছিলেন। আজ কমলেশ ফোন করে জানাল বই রেডি। ‘আমি নারী’ প্রবন্ধের বইটির কাজ চলছে, বই মেলায় প্রকাশিত হবে। এমনটাই প্রকাশক জানিয়েছেন।

     আজ স্কুটারটা একজনকে বিক্রি করে দেওয়া হল। কি হবে আর? পড়ে থেকে লোহা হয়ে যাবে। বাইকটা পাপুকে এমনিই দিয়ে দিয়েছি। গাড়ি আর একটা সাইকেল রয়েছে। কত কি বিলিয়ে দিলাম, বিক্রি করে দিলাম। আরও কতকি দিয়ে দিতে হবে। তবে গাড়িটা দেবনা ভেবে রেখেছি। ভাবলেই যে তা  ঘটবে, এমন নিশ্চয়তা কোথায়?  কতও কিই তো ভেবে ছিলাম। তার কিছুই তো হয়ে উঠল না।  

    আমার ছড়ার বইটির কোথায় মোড়ক উন্মোচন করব? তা নিয়ে নয়ন পত্রিকার সম্পাদকের সঙ্গে আলোচনা করলাম। দীপা ফোনে ডেকেছিল, বড়দিন উপলক্ষ্যে। যেতে ভাল লাগছে না। নিজের বাড়িতে  নিজের মত থাকতে ভাল লাগে। লোকের ওই একই বিষয়ে আলোচনা শুনতে ভাল লাগে না। কোনও কোনও বিষয়ে সহমত হতে পারি না। আমি এক উজান পথের পথিক। মেদিনীপুর লি্টিল ম্যাগাজিন মেলায় সঞ্জীব দত্ত বইটির উদ্বোধন করলেন। 

 কয়েক দিন হল সময় ২০১৫ তে পা রেখেছে। এখন আর পৌষ সংক্রান্তিতে পিঠেপুলির ঝামেলা নেই। ১লা জানুয়ারি থেকে শরীরটা খুবই খারাপ। তিনের কাছাকাছি জ্বর। চিন্তা ওনাকে নিয়ে, আমাকে সুস্থ থাকতেই হবে। আমার কিছু হলে ওনাকে কে দেখবে? ৫/৬ দিন ভোগার পর আজ অনেকটাই সুস্থ বোধ করছি।


জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇



    আগামিকাল ওনাকে নিয়ে কলকাতা যাব। ডাক্তার কী বলেন দেখি। তাঁর নির্দেশ মতই সবকিছু মেনে চলছি। খাওয়া নিয়েই বেশি সমস্যা। প্রোটিন ছাড়া খাবার ওনার খেতে কষ্ট হয়। তার ওপর তেলমশলা ছাড়া রান্না, তবুও উনি মুখবুজে খেয়ে নেন। আমার খুব কষ্ট লাগে। তাই সবার জন্য একই রান্না করি। সবাই বলতে আমি আর আমার ছোট বোনের মেয়ে রানী। রানী প্রথম বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক  পাশ করার পর মেদিনীপুরে রাজা নরেন্দ্রলাল খান মহিলা কলেজে বাংলা নিয়ে ভর্তি হয়েছে। ওর এবং আমার ভবিষ্যতের কথা ভেবেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তবে ওর মামাদের থেকেও চাপ ছিল। আমাকে বলা হয়েছিল, বড় খরচগুলো ওরাই দেবে।কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি।

     এবার দুদিন ধরে সরস্বতী পুজো। আজ সারদা কল্যাণ ভাণ্ডারের পুজোতে দিদিরা ডেকেছেন, আমি আর নন্দিনী গেছলাম খিচুড়ি খেতে,  খান সাহেবের জন্যও দিয়েছিলেন। আজ ২৫ জানুয়ারিও সরস্বতী পুজো। সকালে বাজারে গিয়ে মাছ পাইনি। তাই ডিমের ঝোল করলাম। আজ নটিংহাম থেকে সুপ্রীতিদি ফোন করেছিলেন। এখানকার ২/৩ জনকে বাদ দিলে ওখানে অনেক বেশি সহমর্মিতা, আন্তরিকতা পেয়েছি।

    আজ ২৬ জানুয়ারি, প্রজাতন্ত্র দিবস। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক অবামা এসেছেন। ওসব আর দেখতে ইচ্ছে করে না। দেখিও না। এখনও সরস্বতী পুজোর বক্স বাজছে, কানের পর্দা ফেটে যাওয়ার জোগাড়।

কি যে লিখব ভেবে পাচ্ছি না। যা লিখতে চাইনা, সেগুলোই মনে আসছে। মানুষটা অসুস্থ হয়ে পড়াতে সব আমার ওপর এসে পড়েছে। এত দিক সামলে লেখায় মন বসানো খুব কঠিন। কিন্তু হাল ছেড়ে দিলে চলবে কি করে? তাই এসবের মধ্যেই একটু সময় পেলেই খাতা পেন  নিয়ে বসছি। সবসময় মনে হচ্ছে কে যেন আমার পেছন পেছন ঘুরছে।

    ভোরের বেলা হঠাৎ খান সাহেব অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। নার্সিংহোমে ভর্তি করব বলে তৈরি হয়েও গেছলাম। ইংল্যান্ড যাওয়ার আগে গাড়িটা ভাইয়ের শ্বশুরবাড়িতে রেখে গেছলাম। ভাইয়ের শ্বশুর মশাই গাড়ি নিয়ে আসেন। উনি বলেন, এসব টেনশনে হচ্ছে। সব চিন্তা মন থেকে ঝেড়ে ফেলুন। আমি জানি উনি ওনার ভাইদের আচরণ ও কথায় উনি খুব কষ্ট পেয়েছেন।তা থেকেই এই অবস্থা। ওরা ক্ষমারও অযোগ্য।এখন মোটামুটি ঠিক আছেন। 

    আজ ওনাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছলাম। আগের থেকে রিপোর্ট অনেক ভাল। ক্রিয়েটিনিন কমেছে, হিমোগ্লোবিন বেড়েছে। ডাক্তার খুব খুশি, বললেন এভাবেই কিডনির সমস্যাটিকে থামিয়া রাখতে হবে। ডাক্তারের কথা শুনে শত দুঃখেও ভাল লাগছে। কিন্তু মেদিনীপুরে একটা  ওষুধ পাওয়া যাচ্ছে না। ডাক্তারকে মেসেজ করতে উনি ওষুধ বদলে দিয়েছেন।

     এই সমস্যা জর্জরিত জীবনে চারিদিকে কি ঘটে চলেছে, তার খবর কে রাখে? কী করে আমি এর থেকে বেরিয়ে আসব? মনকে  নানাভাবে অন্য কিছুতে ভোলানোর চেষ্টা করছি।

     ছড়ার বইটির এককপি বানু মাসিকে পাঠিয়েছিলাম। আজ দেখা হতে বললেন, বেবি, তোমার বইটি পড়েছি আর কেঁদেছি। উনি আমার ব্যথা বুঝবেন, এটাই তো স্বাভাবিক। যদিও আমার জীবনে স্বাভাবিক কিছু ঘটছে না। তবে যাই ঘোটুক সব গ্রহন করার  জন্য মনকে ধিরে ধিরে তৈরি করছি। যদিও জানি কাজটা খুব্ব কঠিন, তবুও আমাকে পারতেই হবে। হার আমি মানব না। এজন্য সবসময় নিজেকে কাজে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করি। ওখানেও কিছু করার না থাকলে উল বুনতাম। জারার জন্য অনেকগুলো সোয়েটার বানিয়ে ছিলাম। দেশে এসেও সেই কাজ শুরু করলাম।

      একালের রক্তকরবি থেকে আমার ‘আমি নারী’ বইটি বই মেলায় প্রকাশিত হয়েছে(২০১৫)। অনামি লেখক, তবুও বই বিক্রি হচ্ছে বলে শুনছি। যাঁদের বইয়ের কপি পাঠিয়েছি, তারা হলেন, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অরুনাভ বসু, ভাইবউ মৌসুমি ,আজহারউদ্দীন খান, অধ্যাপক রিনা পাল, এবং ‘সারদা কল্যাণ ভাণ্ডার’ এর দিদিদের  পাঠালাম। রীনাদি পড়ে জানালের, খুব সুন্দর ঝরঝরে বাংলায় লেখা, বিষয়গুলিও ভাল। সারদা কল্যাণ ভাণ্ডারের প্রাক্তন অধ্যাপক রেখাদি, তপতীদি বললেন, খুব সুন্দর বই হয়েছে। তুমি রিভিউর জন্য পাঠাছ না কেন? বাসবীকে প্রকাশক নিজেই এক কপি পাঠিয়েছেন। অরুনাভ বাবু  বললেন, বই খুবই ভাল হয়েছে, তবে আনেকগুলি বিষয় রয়েছে বইটিতে। আপনি যদি একটি বিষয়ের ওপর আর একটি বই করেন, তাহলে সেটি একাডেমিক হবে। স্টুডেন্টদের কাজে লাগবে।  পরামর্শটি আমার ভাল লাগল। আবার লেখা শুরু করলাম মুসলিম মেয়েদের নিয়ে। তাদের  জীবনযাত্রা, তাদের শোষণ পীড়ন বঞ্চনার ইতিহাস, কিভাবে যুগযুগ ধরে, ধরমের নামে, নারীর কোমল মন ও কিছু অসহায়তার সুযোগ নেওয়া  হচ্ছে। এছাড়াও তালাক,খোরপোষ,নারীর শিক্ষা, অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা , পোশাক, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি, ইত্যাদি।

    এসব লেখা তখন হাতে লিখতে হয়েছে। কি যে ঝামেলার ছিল তা বলার নয়। তখন অবশ্য এই পদ্ধতিতেই লেখা পাঠানো হত, যাকে পাণ্ডুলিপি বলা হয়। লেখার পর সেগুলি রিভাইজ দেওয়ার জন্য কুরিয়ারে  অরুণাভ বাবুর কাছে পাঠাই। উনি কোথাও আমার লেখায় কলম  চালাননি। কোথাও কোথাও বলেছেন, এই জায়গাটা এরকম হলে কেমন হত? এর বেশি কিছু নয়। এই লেখার পাশাপাশি অন্য লেখা, অন্য  কাজও করতে হচ্ছে। সংসারের কাজ তো আছেই।

      মাঝে মাঝে মনে একটা প্রশ্ন উঁকি দেয়, বিশ্বাস কী? মানুষের প্রতি বিশ্বাস আর ঈশ্বরে বিশ্বাস তো এক নয়। তবুও মনের শান্তির জন্য অনেক যুক্তিহীন বিষয়ও বিশ্বাস করতে ভাল লাগে। অথচ নিজের বিশ্বাসের জায়গা থেকে এসব মানতে পারি না। পারলে হয়ত মনের অনেক কষ্ট লাঘব হত। যে কষ্ট আমাকে তিল তিল করে শেষ করে দিচ্ছে। 

                                  ক্রমশ

Post a Comment

0 Comments