জ্বলদর্চি

একমুঠো ভিয়েতনাম /প্রথম পর্ব/স্বপন কুমার দাস

একমুঠো ভিয়েতনাম 
প্রথম পর্ব
                    
স্বপন কুমার দাস
                           

আমার নাতি নোটোর গরমের ছুটি  পড়েছে টানা দেড় মাস। ছুটি মানেই ওর বেড়াতে যাওয়ার বায়না।এবার ও দেশে যাবে না। মাত্র তিন মাস আগে ও দেশ থেকে ফিরেছে। সুতরাং অন্য কোথাও, অন্য কোনখানে। সিঙ্গাপুরের কাছেপিঠে যে কোন দেশে ওর আপত্তি নাই।
কোভিডের আগে আমরা সপরিবারে ইন্দোনেশিয়ার বালি ঘুরে এসেছি। তাই এবার ভিয়েতনাম যাওয়াই স্থির হলো। কাছাকাছির মধ্যে বেড়াতে যাওয়ার জন্য নিঃসন্দেহে ভিয়েতনামের কোন বিকল্প হয় না।
ভিয়েতনামের রাজধানী হ্যানয়ে থেকে ঐ দেশের কিছু কিছু দ্রষ্টব্য জায়গাগুলি দেখার পরিকল্পনা করলো আমার বৌমা। এ ব্যাপারে ও খুব সিদ্ধহস্ত। ভিয়েতনামের অন্যতম শ্রেষ্ঠ  আকর্ষণ হা লং বে, পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের অন্যতম। অদৃষ্টপূর্ব সেই উপসাগরের বুকে এক দিন এক রাত্রি থাকার সিদ্ধান্তে আমার শরীরে যেন কাঁটা দিয়ে উঠলো।
দিনস্থির হলো জুলাই-এর ১৫ তারিখ। সেই মতো ফ্লাইটের টিকিট কেটে তড়িঘড়ি হোটেল এবং ক্রুজ-এর কেবিন বুক করলো আমার ছেলে ও বৌমা।
এবার শুধু সময়ের অপেক্ষা।প্রতীক্ষার প্রহর গোনা।  
সময় থেমে থাকে না। দ্রুত পায়ে এগিয়ে এলো সেই দিন। সেই শুভ মুহূর্ত। ভোর রাতে এলার্মের শব্দে ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হলো তোড়জোড়। প্রাতঃকৃত্য ইত্যাদি শেষ করে, গোছানো সুটকেসগুলি নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম সিঙ্গাপুরের বিশ্ববিখ্যাত চাঙ্গি ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে।
ভোর রাতের নির্জন পথ বেয়ে আমাদের যান  মাত্র ২০ মিনিটেই আমাদের পৌঁছে দিল চাঙ্গি এয়ারপোর্টে। নিয়মের ঘেরাটোপ ধাপে ধাপে পেরিয়ে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের একটি পেল্লাই হ্যানয়গামী বিমানে আমরা সওয়ার হয়ে বসলাম। নির্ধারিত সময় ঠিক সকাল ৯ টা ৫৫ মিনিটে আকাশে উড়লো আমাদের বিমান। মাত্র ৩ ঘন্টা ৩০ মিনিটের পথ পাড়ি দিয়ে ভিয়েতনামের হ্যানয় আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছালাম আমরা পাঁচটি প্রাণি।                                                            

ভিয়েতনামে আমি এই প্রথম বার। সুতরাং কুতূহলী মন ছুটেছে অদেখাকে দেখার অত্যুগ্র আকাঙ্ক্ষায়। মনের মধ্যে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হচ্ছে ছোটোবেলায় লোকের মুখে মুখে ফেরা সেই স্লোগান, “তোমার নাম আমার নাম, ভিয়েতনাম ভিয়েতনাম”l সেই ভিয়েতনামের মাটিতে আজ আমি দাঁড়িয়ে। 

কালবিলম্ব না করে  লাগেজ নিয়ে আমরা বেরিয়ে এলাম এয়ারপোর্টের বাইরে। গেটের পাশের কারেন্সি এক্সচেঞ্জ কাউন্টার থেকে সিঙ্গাপুর ডলার ভাঙিয়ে ভিয়েতনামি ডং সংগ্রহ করে নিল আমার ছেলে। বৌমা ইত্যবসরে একটি গাড়ি ডেকেই রেখেছিল। হঠাৎ সেটি এসে দাঁড়ালো আমাদের সামনেই। বুঝলাম, এটিই আমাদের বাহন।

কিন্তু একি !  গাড়ির ড্রাইভার কেন উল্টো দিকে বসা ? শুধু কি তাই ? গাড়ির দরজাও খুললো উল্টোদিকে। অর্থাৎ গাড়ির বামে নয়, ডাইনে।
লাগেজ পত্র উঠিয়ে আমরা গাড়িতে চড়ে বসার সঙ্গে সঙ্গেই ড্রইভার অটোমেটেড দরজা বন্ধ করে দিয়েই ইঞ্জিন স্টার্ট দিল। তারপর গাড়ি হুহু করে চলতে শুরু করলো। কিন্তু এখানেও সেই উল্টো কাণ্ড। গাড়ি ছুটলো রাস্তার ডানদিক ধরেই। অর্থাৎ এদেশে  সবটাই উল্টো। আমার কিছু বলার আগেই আমার ছেলে বললো, “এ দেশে রাইট হ্যাণ্ড ড্রাইভ”। অর্থাৎ গাড়ি রাস্তার ডান দিক দিয়ে চলে।

হ্যানয় এয়ার পোর্টে আরও একটি অদ্ভুত জিনিস চোখে পড়লো আমার। সেটি হলো, দ্বিচক্রযানে সস্তায় যাত্রী পরিবহন ব্যবস্থা। ভাড়া বাইক বা স্কুটিতে যাতায়াতের সুবর্ণ সুযোগ আছে এখানে। 

 সাবেকি রিক্সার বেশ চল আছে এখানে। তবে সেখানেও স্বাতন্ত্র্য। রিক্সাগুলির প্যাসেঞ্জার বসে সামনের সীটে আর চালকের সীট পিছনে। অর্থাৎ সেই উল্টো।
এয়ারপোর্ট রোড ধরে আমরা চলেছি হ্যানয়ের বিখ্যাত শেরেটন হোটেলের উদ্দেশ্যে । প্রশস্ত রাস্তা। ঝাঁ চকচকে। 

রাস্তার দু’ধারে খেজুর গাছের সারি। বেশ দৃষ্টিনন্দন। যেন কোন শিল্পীর তুলিতে আঁকা নিখুঁৎ ছবি। মাঠ-ঘাট, চাষ-বাস, পুকুর-ডোবা, নদী-নালা, কী নাই এ দেশে ? সেই চেনা চেনা ছবি। স্বদেশী স্বদেশী গন্ধ।
মাত্র আধ ঘণ্টার মধ্যেই আমরা হোটেল শেরেটনের মেন গেটে এসে হাজির হলাম। গাড়ির হর্ণের আওয়াজ শুনে চার জন ইউনিফর্ম পরা হোটেল বয় শশব্যস্তে দৌড়ে এলো। গাড়ি থেকে লাগেজপত্র নামিয়ে আমাদের  নিয়ে চললো হোটেলের মেইন গেটের উদ্দেশ্যে।


বিশাল বহুতল হোটেল। স্বমহিমায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। উঠোনে সুসজ্জিত বাগানে নাম না জানা হাজার ফুলের মেলা। চোখ সরানো মুশকিল। তারই বুক চিরে এক ফালি সুন্দর বাঁধানো রাস্তা ধরে আমরা হোটেলের রিসেপশন কাউন্টারে এসে হাজির হলাম। সেখানে প্রাথমিক কাজ শেষ করার পর লিফ্টে চড়িয়ে আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো সতেরা তলার রিসেপশন হলে। আপ্যায়নের রাজকীয় ব্যবস্থা আছে সেখানে। বিভিন্ন রকম ড্রিঙ্কস থেকে শুরু করে, চা, কফি, স্ন্যাক্স ইত্যাদি কী নাই সেখানে?
আপ্যায়নের পর আমাদের নিয়ে আসা হলো হোটেলের নয় তলায়। এখানেই পাশাপাশি দু’টি সুইট আমাদের জন্য বরাদ্দকৃত। সুন্দর সাজানো গুছানো লিভিং রুমে কাঁচের টেবিলের উপর পুষ্পস্তবকের সঙ্গে ট্রে ভর্তি পাকা আম, কলা, লেবু আর লিচু দিয়ে সাজানো। একটু অভিনব।
সব্বাই ফ্রেশ হয়েই নিচের তলায় গেলাম লাঞ্চ করতে। খাদ্যতালিকাতে কোন ভারতীয় খাদ্যের চিহ্নমাত্র ছিল না। অবশ্য না থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ভাত ছিল। যদিও সাধারণ ভাত নয়, স্টিকি রাইস। সামুদ্রিক মাছ ও ছিল। মাংসের মধ্যে ছিল চিকেন, পোর্ক আর মাটনের আইটেম। ভিয়েতনামের স্পেশাল স্যুপ তো ছিলই। এ ছাড়াও সিদ্ধ শাকের আইটেমটা ও ছিল নজর কাড়া। অয়েস্টারের টেস্টি স্যুপ ও ছিল। ছিল, রান্না করা পদ্মবীজের একটি সুস্বাদু আইটেম ও। আমরা প্রত্যেকে নিজের নিজের পছন্দের খাবার খেয়ে ফিরে এলাম নিজেদের ঘরে। তারপর সন্ধ্যে পর্যন্ত টানা ঘুম। 
হঠাৎ কলিং বেলের শব্দে ঘুম ভাঙলো আমার। ছেলে, বৌমা আর নাতি এসে হাজির। চা পর্বের ডাক। সুতরাং কালবিলম্ব না করেই সবাই গেলাম সতেরো তলার টি-কাউন্টারে। চা, কফি আর স্ন্যাক্স এর বিপুল আয়োজন আছে সেখানে। যে যার মতো চা, কফি আর স্ন্যাক্স খেয়ে ফিরে এলাম নিজেদের ঘরে।

সিদ্ধান্ত হলো, আমার ছেলের সঙ্গে আমরা দু’জন আজ উইকএন্ড নাইট মার্কেটে যাবো। বৌমা আর নাতি হোটেলেই থাকবে। যেমন কথা, তেমন কাজ। রাত্রি ঠিক আটটায় একটা গাড়ি নিয়ে আমরা রওনা দিলাম হ্যানয় নাইট মার্কেটের উদ্দেশ্যে।                                                           ক্রমশ….



জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇




Post a Comment

0 Comments