জ্বলদর্চি

ড. সূর্যেন্দুবিকাশ কর মহাপাত্র (পদার্থ বিজ্ঞানী, সাউটিয়া, দাঁতন, পশ্চিম মেদিনীপুর)/ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ৪৪

ড. সূর্যেন্দুবিকাশ কর মহাপাত্র (পদার্থ বিজ্ঞানী, সাউটিয়া, দাঁতন, পশ্চিম মেদিনীপুর)

ভাস্করব্রত পতি

বাবা কিশোরীরঞ্জন ছিলেন অবিভক্ত মোহনপুরের (১৯২০) প্রথম গ্র্যাজুয়েট। আর মা ছিলেন হিরন্ময়ী দেবী। পশ্চিম মেদিনীপুরের দাঁতনের সাউটিয়া গ্রামে ১৯২৪ এর ১ সেপ্টেম্বর জন্ম মেদিনীপুরের কৃতি সন্তান ড. সূর্যেন্দুবিকাশ কর মহাপাত্রের। সারা জীবন ধরে যে কাজ তিনি করেছেন তাতে উজ্জ্বল হয়েছে মেদিনীপুরের মাটি। গর্বিত হয়েছে মেদিনীপুরের জনসাধারণ। 

দাঁতন হাই স্কুলের পর মেদিনীপুর কলেজে বিজ্ঞান নিয়ে ইন্টারমিডিয়েট পড়েন। সেখানে বি.এসসি.ও পড়েন। এ সময় তাঁর বাবা কিশােরীরঞ্জন মারা যান। সূর্যেন্দুবিকাশ কর মহাপাত্র ছিলেন লক্ষ্যে অবিচল। তবুও কালক্রমে পরিচয় হয় বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর সাথে। প্রবল ইচ্ছা ছিল ডাক্তারী পড়ার। কিন্তু সেই লক্ষ্য পরিবর্তিত হয় অবশেষে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যাতে এম.এসসি.তে ভর্তি হন। লক্ষ্যণীয় বিষয় যে, ঐ ভর্তির আবেদনপত্রে সত্যেন্দ্রনাথ বসু নিজেই লিখে দিয়েছিলেন ‘অ্যাডমিট' কথাটি!

ছােট থেকেই লেখালেখির সাথে যুক্ত থাকতে ভালােবাসতেন। প্রচুর বইপত্র পড়তেন। কবিতা লিখতেন। কিন্তু মূল পছন্দ ছিল বিজ্ঞান বিষয়ক লেখালেখি। একদিকে পারিবারিক কারণে জমিদারী-দেখাশুনা, অন্যদিকে জনপ্রিয় বিজ্ঞান বিষয়ক লেখালেখির মাধ্যমে জীবনের চলার পথে নতুন বাঁক তৈরি হয়ে যায়। ১৯৪৮ সালে 'জ্ঞান ও বিজ্ঞান' পত্রিকায় (অক্টোবর সংখ্যা) সূর্যেন্দুবিকাশ কর মহাপাত্র প্রথম লেখা প্রকাশিত হয়। এরপর আরও বেশ কয়েকটি লেখা পরপর ছাপানাে হয় তাঁর। সে সময় এই পত্রিকার যাবতীয় বিষয় নজর রাখতেন বিজ্ঞানী গােপালচন্দ্র ভট্টাচার্য। তিনিই সূর্যের লেখায় মােহিত হয়ে চিঠি লিখে গ্রাম থেকে ডেকে এনে যােগাযােগ করিয়ে দেন সত্যেন্দ্রনাথ বসুর সাথে।
এদিকে এম.এসসি. এর রেজাল্ট বের হওয়ার দিনই আরেক প্রখ্যাত বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার অধীনে 'সাইক্লোট্রন' প্রকল্পে কাজ শুরু করে দেন। এমনকি পিএইচ.ডি.র জন্য 'মাসস্পেকট্রোমিটার' যন্ত্র বানিয়ে (১৯৫৫) তা নিউক্লিও পদার্থ বিজ্ঞান গবেষণায় ব্যবহার করেন। পেয়ে যান ডক্টরেট ডিগ্রি। মূলতঃ তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল ভর বর্ণালীবিদ্যা এবং আইসােটোপ পৃথকীকরণ। তিনি একাধিক আয়নিক পরমাণু সমষ্টির সংমিশ্রনের বিশ্লেষণের জন্য তড়িৎচুম্বকীয় পদ্ধতিতে এমন এক বিশেষ ধরনের ভর বর্ণালি যন্ত্র গঠন করেছিলেন, যা প্রচলিত যন্ত্রের তুলনায় অনেক বেশি কার্যকর হয়েছিল। তাঁর আবিষ্কৃত এই যন্ত্র আলােড়ন ফেলে দেয় বিজ্ঞানীমহলে। 

নিউক্লিও বিজ্ঞানীদের কাছে সমাদৃত হয় তাঁর তৈরি নানা রকমের আয়ন উৎস। তিনি যখন শুরু করেন আইসোটোপ পৃথক করার কাজ, তখন ভারতে কেউই এই বিষয়ে গবেষণা শুরুই করেনি। কানাডার বিজ্ঞানী এইচ ই ডাকওয়ার্থ, যিনি ছিলেন মাসস্পেকট্রোস্কোপিস্ট তিনি ১৯৬০ সালে ভারতে এসেছিলেন। সূর্যেন্দুবিকাশের কাজের ভূয়সী প্রশংসা করে কানাডাতে কাজ করার আমন্ত্রণ জানান। ১৯৬২ তে রেনে বার্নাস 'আইসোটোপ সেপারেটর আন্তর্জাতিক সম্মেলন'এ ফ্রান্সের ওরস গবেষনাগারে যাওয়ার আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন। সেসময় ইউরোপীয় বেশ কিছু গবেষণাগারে তিনি যান। নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডামে ইনস্টিটিউট অফ অ্যাটমিক অ্যাণ্ড মলিকিউলার ফিজিক্সের ডিরেক্টর কিস্তেমেকার, এহাল্ড, নেলসনদের সঙ্গে দেখা করেন। ১৯৭০ নাগাদ তাঁরই পরিচালনায় সাহা ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্স-এ আইসােটোপ পৃথকীকরণ যন্ত্র স্থাপিত হয়। ১৯৮৬ তে এখান থেকে অবসর নেন।

বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদের সাথে আজীবন জড়িয়ে ছিলেন তিনি। এটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু। ১৯৮১ ৮২ তে দুবার সভাপতি ছিলেন এই পরিষদের। প্রচুর বই লিখেছেন। সম্মানও পেয়েছেন বহু। মিলেছিল 'প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ স্কলার। প্রথমবারের 'জ্ঞান ও বিজ্ঞান' পুরস্কার তাঁকে দিয়েছিল বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ (১৯৯৫)। অসংখ্য বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ তাঁর কলম থেকে প্রকাশিত হয়েছে। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে 'নরসিংহ দাস পুরস্কার' পেয়েছেন ১৯৮৫ তে। মাস স্পেকট্রোমিটার যন্ত্রের সফল রূপায়নের জন্য পেয়েছিলেন 'মোয়াট স্বর্ণপদক'। এছাড়া 'সৃষ্টির পথ' গ্রন্থের জন্য ১৯৯৯ তে পেয়েছেন রবীন্দ্র পুরস্কার। 

সূর্যেন্দুবিকাশ করমহাপাত্র বিজ্ঞানী হিসেবে আজ মেদিনীপুরের গর্ব। গত ২০০৭ এর ২৩ মার্চ ৮২ বছর বয়সে  মৃত্যু হয়েছে এই মহান বিজ্ঞানীর। অসংখ্য বই এবং প্রবন্ধ সম্পদ হিসেবে রেখে গিয়েছেন তিনি। যাঁরা বিজ্ঞানকে ভালােবাসে, তাঁদের কাছে এই লেখা অমূল্য সম্পদ। যুক্ত ছিলেন 'সায়েন্স অ্যান্ড কালচার' ম্যাগাজিনের সাথে। তিনি নানা সময়ে লিখেছেন - 'সৃষ্টির পথ', 'কণাত্বরণ', 'মহাবিশ্বের কথা', 'পরমানু থেকে বোমা ও বিদ্যুৎ', 'পদার্থ বিকিরণ রহস্য', 'মেঘনাদ সাহা জীবন ও সাধনা', 'ভরের বর্ণালি', 'প্রগতি পরিবেশ পরিণাম' ইত্যাদি গ্রন্থগুলি। 
এতো কাজের মধ্যেও তিনি নিজের গ্রাম সাউটিয়াকে ভোলেননি। ১৯৪৩ সালে এখানে বাবার স্মৃতিতে স্থাপন করেন 'কিশোরীরঞ্জন স্মৃতি পাঠাগার'। এই গ্রামেই তাঁর উদ্যোগে ১৯৮২ তে শুরু হয় সাউটিয়া গ্রামীন বিজ্ঞান মেলা। বিজ্ঞানের নানা বিষয় প্রদর্শিত হোতো এখানে। ২০০৯ থেকে এই মেলা বন্ধ। এই গ্রামেই সাউটিয়া হাইস্কুল, সাউটিয়া হাসপাতাল গড়ে তোলার পেছনে তাঁর অবদান যথেষ্ট। ড. সন্তোষ কুমার ঘোড়াই লিখেছেন – “বিজ্ঞানী সূর্যেন্দুবিকাশ করমহাপাত্রের জীবন ও কর্মকে স্মরণে আনলে সবার স্বাভিমান জাগ্রত হবে। বিশেষ করে মেদিনীপুরবাসীর'।



জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇



Post a Comment

2 Comments

  1. বিশদে জানলাম।

    ReplyDelete
  2. এই সময়ের বিজ্ঞানীদের নিয়ে এরকম আলোচনা আরও দরকার।

    ReplyDelete