জ্বলদর্চি

বিস্মৃতপ্রায় কবি সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত /নির্মল বর্মন

বিস্মৃতপ্রায় কবি সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত
নির্মল বর্মন

"শোনো !
গলা ঝেড়ে পরিষ্কার করেই বলছি শোনো
পিঁপড়েও প্রতিশোধ নেয়, মৃত্যুর পরেও তার কালো মুন্ডু
মানুষের জ্যান্ত মাংসে আটকে থাকে , খুব সহজে"---!
        (কার্যকারণ -- সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত)
কবি সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত উপরি উদ্ধৃত কবিতায় যন্ত্রনা থাকা সত্ত্বেও হতাশ হননি। প্রতিশোধ আজ না হয়, কাল অবশ্যই যে কেউ নিতে পারে তাই এসব নিয়ে কবির ভাবনার সময় কোথায় ? ৫ই মে ১৯৩৫ সালে অধুনা বাংলাদেশের ঢাকা শহরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন কবি সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত ! কবি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশুতোষ কলেজ থেকে বিজ্ঞানে সাম্মানিক স্নাতক লাভ করার পর , সাহিত্যে  এম.এ পাস করেন বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বিশ শতকের পঞ্চাশের দশকের মহান ব্যক্তিত্ববাদী কবি সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত ভেষজ প্রতিষ্ঠানে আঞ্চলিক অধিকর্তা ছিলেন। "বিভাব" পত্রিকার সম্পাদনা করেছিলেন । সেই সঙ্গে "কৃত্তিবাস" ও "কবিপত্র" পত্রিকা ও সম্পাদনা করেছিলেন। "কৃত্তিবাস" পত্রিকার নিয়মিত লেখকও তিনি। অবসর গ্রহণের পর তিনি "পাক্ষিক বসুমতি" সম্পাদনা করেছিলেন কিছুকাল। কবিতা , ভ্রমণ কাহিনী ও প্রবন্ধ নিয়মিত লিখতেন। ১৯৯৮ সালে "কফি হাউসের সিঁড়ি" র  জন্য রবীন্দ্র পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন। ২০০৭ সালে পান সাহিত্য একাডেমি । ১৯৭৮ এর জাতীয় কবি হিসাবে খ্যাতি লাভ করেন। ৬ই মার্চ ২০১১পৃথিবীর মায়া কাটিয়েছেন।


জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇



কবি সমরেন্দ্র সেনগুপ্তর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ গুলি হল ''যে কোনো নিঃশ্বাসে"( ১৯৬২ ), "চারিদিকে পৃথিবী " (১৯৬৬ ) , "ধ্যানে ব্যবধান"(১৯৭৪), , "ভিন্ন যতি চিহ্ন" (১৯৮০) , "শ্রেষ্ঠ কবিতা " (১৯৮৪ ) , "আজন্ম জন্মেজয় ",(১৯৮৬), " কান্না বারুদ" (১৯৮৯), "আছ মানুষ"( ১৯৯২ ), 'একবচ্চন বহু বচ্চন" (১৯৯৩),  "ভাষা দেশ " (১৯৯৫ ), "খোলা কলমের পাশে" ( ১৯৯৬ ),"কফি হাউসের সিঁড়ি"(১৯৯৬),"নির্বাচিত কবিতা"(১৯৯৯),'কালনেমি',(১৯৯৯), "ছবির শব্দ" (১৯৯৯), " দুই নগরী"( ২০০১),  " একা, এই বর্ষবিপন্ন দেশে"(২০০২) ইত্যাদি।
কবি সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত জগত ও জীবনের নানান জটিল সমস্যা কে কবি তার দীর্ঘ কবিতার আঙ্গিকে উপস্থাপনা করেছেন,এ প্রসঙ্গে কবি নিজেরই মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য--"ঠিক সে সময় আমার সতীর্থরা কেউ দীর্ঘ কবিতা রচনা করতেন না। কবিতাগুলির উৎস ছিল সংবাদপত্র । প্রতিদিন যেসব মানবিক ও দানবিক ঘটনা আমাদের গোচরে আসে তারই কিছু কিছু ধরে রাখা"! বিশ শতকের ষাটের দশকে মার্টিন লুথার কিং কালো ,সাদাকে মেলাবার প্রয়াস, কবি হৃদয় কে নাড়া দিয়েছিল , "রাজা" কবিতায় তাই তিনি লিখেছেন--
"কেননা তুমি সাদা আর কালো এই দুই মূল বর্ণ"
কবি সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত মানবতার মুক্তি কামনা করেছেন কেবলমাত্র মেলাতে চেয়েছিলেন মানুষের পণ্য নিঃশ্বাসের সঙ্গে একই পৃথিবীর নাগরিকতায় মানুষের বিশ্বাস মেলানোতে তিনি দায়বদ্ধ ছিলেন।। কবি মানুষের জীবনের অন্ধকার দিকগুলির অবসান ঘটিয়েছেন লক্ষ্যকে সামনে রেখে আসার বাণী জনগণের সামনে তুলে ধরেছে, "এসো আরো একবার চেষ্টা করি" কবিতায়---

"রাত্রি শব্দটিকে লিখে তৎক্ষণাৎ কেটে দিই।
জ্যোৎস্না লিখবে , জনতাকে নক্ষত্র চেনাবো
ভেবেই প্রথম শব্দটা লিখেছিলাম । এই
বোবা স্বাধীনতার স্বদেশে এখন কেউই আজ স্পষ্ট জেগে নেই।
শুধু টেলিপ্রিন্টারের   গম্ভীর গুঞ্জনে বোঝা যায়, কাছে
দুঃসংবাদ - দুঃখী এক মেধাবী মেশিন জেগে আছে "!

কবি সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত "রাত্রি" থেকে 'সূর্য'র কাছে পৌঁছানোর কাব্যিক ব্যবস্থা করেছেন --
"এখনই 'রাত্রি' কেটে 'সূর্য' শব্দটি আমি স্পষ্ট লিখতে চাই 
যেন জবাকুসুমশঙ্কাসের আগেই স্বদেশ জেগে ওঠে, চাই
প্রত্যেককে দেখুক চেয়ে মানচিত্র ভরে উঠেছে আবার
জনগণমন  মুক্ত স্বাধীনতায়"।
কবি সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত দেশপ্রেমের মন্ত্র মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে সামনের সারিতে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন---
"প্রেম ভালো, তার আগে ভালো দেশপ্রেম, রমণী শেখার আগে
মানুষতো চিরকাল জননীকেই প্রথম শিখেছে"!
কবি সমরেন্দ্র সেনগুপ্তের কবিতায় স্বদেশচেতনার স্বাক্ষর স্বর্ণাক্ষরে খচিত রয়েছে---
"আমার ধুতি নাও, তোমার পাগড়ি দাও মুকুট করে পরি।
আজ ধর্ম মানে ভারতবর্ষ, যার সূর্য মাটি অন্নজলে
দেবতারাও বেঁচে থাকেন, বেঁচে আছেন নানা নানক গুরু এবং হরি"।
কবি "চিত্র" কবিতায় আশাবাদের সুরে প্রভাতের ভৈরবী সংগীত পরিবেশন করেছেন----
"পাখির ভৈরবী কন্ঠে শুভ্রশান্ত ভোর ফিরে এল;
সূর্যের প্রতাপ নামে যেদিকে তাকাই এলোমেলো"।

আধুনিক কবি ও ভেষজ প্রতিষ্ঠানের আঞ্চলিক অধিকর্তা সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত'র  "সন্তদাস" কবিতায় শঙ্কর, রামানুজ প্রভৃতি দার্শনিকদের জীবন ভাবনাকে কবি নস্যাৎ করে সম্পূর্ণ নিজস্ব ভাবনায় ভাবিত হয়ে আত্মশ্লাঘা প্রকাশ করেছেন---+
"খুব বেশিদিন নেই
হরি দিন তো প্রায় চলেই গিয়েছে,
এবারের এ সন্তদাসকে একাকী থাকতে দাও
হাসতে কাঁদতে দাও
নিজস্ব মৃত্যুর মতবাদে"।

কবি সমরেন্দ্র সেনগুপ্তর "উত্তরভাষণ" কবিতায় কিভাবে একটি চিঠি দীর্ঘদিনের বিবাদ মিটিয়ে ইতিহাস রচনা করে ইতিহাসও সৃষ্টি করে তার সুদৃঢ় পরিচয় ধাপে ধাপে ফুটে উঠেছে---+
"মায়া নামে এককালে আমার প্রেমিকা ছিল; তাকে
মাঝে মধ্যে বেশ আদর-টাদরও করতাম ,তখন তার শরীরের
ডগমগ মাংসপেশী থেকে গান উঠত । অথচ একদিন
কথা নেই বার্তা নেই , তার সঙ্গে ভীষণ বিবাদ হল;
তার নারীচিহ্নগুলি , চিৎকারে বলল 'আমাদের প্রত্যেকেরই ভিন্ন ভিন্ন ভাষা
তবে কেন একই চশমায় আমাদের পড়তে চাইছ"?
কবির  'কার্যকারণ' কবিতায় প্রতিশোধলিপ্সু মানব জীবনের চালচিত্র চমৎকার ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন---
"ছিঃ এভাবে কি পথ আগলে রাত দাঁড়ায়!
তুমি তো কুকুর নও, এক টুকরো সাময়িক মাংসের লোভে
যাকে তাকে যখন তখন কামড়াবে"!

কবি তার  কবিতায় সমকাল সচেতন পারিপার্শ্বিক জীবন , অন্যায় ,দুর্নীতি সবকিছু যত্ন সহকারে উপলব্ধি করেছেন এবং তার "একা, এই বর্ষাবিষণ্ণ দেশ " কবিতায় ক্ষুব্ধ হয়ে লিখেছেন---
"এক সময় দ্রুত বড় হয়ে উঠতে চাইতাম ----ভাবতাম"
হঠাৎ করে কিভাবে বড় হওয়া যায়? কিভাবে আরো বড় হওয়া যাবে , সবিশেষ দামী মহাশয় , বিশ শতকে শেষের দিকে কবি তাই পরিষ্কারভাবে লিখেছেন।----
"আর এখন এ - দেশ কার
হাঁস- মুরগি খাবার চোরের, নাকি ক্রিকেট টাকার"।

কবি সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত এইসব তত্ত্ব তালাশ দেখে ভবিষ্যৎবাণী করেছেন---
"হিমালয় - শেখা যে বরফ নামতে নামতে জলকণা
হয়ে ভারত বেরিয়ে সাগরের সুনীলে পৌঁছায় , সে কি বুঝছে না
এই জলে কত ধু ধু অধীনতা
কত শ্মশান নিংড়ানো গঙ্গা উপস্থিত আছে"!

তাই শেষ বেলায় কবি সেনগুপ্ত আবার স্বদেশজননীর  কাছে আত্মসমর্পণ করতে চয়---
"তাই আমি আকাশ দেখাতে গিয়ে
আর কখনোই পুনর্বিবেচনা করব না পূর্ণিমা।
'পূর্ণিমা' শব্দটি বড় সুন্দর, কেননা সেখানে আজও এক
'মা 'মিশে রয়েছে"।

কবি সমরেন্দ্র  সেনগুপ্ত'র  জন্ম বাংলাদেশের ঢাকা শহরে তাই স্বদেশ ঢাকাকে হারিয়ে নস্টালজিক হয়ে উঠবেন তো বটেই, সেই সঙ্গে স্বদেশ চরণের প্রতি তীব্র আকর্ষণ কবি হৃদয়ে চিরকাল গেঁথে ছিল। তাঁর বিভিন্ন কবিতায় সহজ সরল চিত্রাত্মক বিবরণধর্মিতা--পাঠককে আপ্লুত করেছে ।কবি সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত সব সময় মানুষের আত্মিক অবনমন, মূল্যবোধ হীনতা থেকে মানুষকে অমৃতের সন্ধান দিতে সর্বদা বদ্ধপরিকর ছিলেন।

Post a Comment

3 Comments

  1. খুব সুন্দর অনেক অজানা তথ্যর সঙ্গে পরিচিত হলাম । কলম সচল থাকুক ।

    ReplyDelete
  2. অসাধারণ লেখা। বিস্মৃত প্রায় কবি সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত সম্পর্কে অনেক তথ্য জানলাম। ধন্যবাদ জানাই ড. নির্মল বর্মন মহাশয়কে এভাবে এত ভালো বিষয় লেখনীর মাধ্যমে আমরা জানতে পেরেছি। অনেক কিছু আরো জানবো আশায় আছি।

    ReplyDelete
  3. অনেক কিছু জানলাম

    ReplyDelete