জ্বলদর্চি

মহাভারতের কর্ণ - এক বিতর্কিত চরিত্র/নবম পর্ব /দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

মহাভারতের কর্ণ - এক বিতর্কিত চরিত্র                           নবম পর্ব    
দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী                                                                 

কর্ণ কৃতজ্ঞচিত্তে শ্রীকৃষ্ণকে বললেন "লোকে তোমাকে ঈশ্বরের অবতার বলে, পৃথিবীর ভার হরণ করার জন্য তোমার আগমন। তবে আমার কাছে সর্বাপেক্ষা যা আনন্দের তা হল তোমার অন্তরের যথার্থ পরিচয় লাভ করলাম। আমার জন্ম রহস্য প্রকাশ করে তুমি যে আমার কি উপকার করলে সে কথা আমি ভাষায় ব্যক্ত করতে পারব না। তুমি যে কেবল উৎপীড়িতের বা বঞ্চিতের মুক্তিদাতা নও তুমি আমার জীবনেরও দুঃসহ যন্ত্রণার মুক্তি দিয়েছ। এরপরে আমার মৃত্যু হলেও আমার কোনো দুঃখ থাকবে না। তবে তোমার কাছে আমার একান্ত অনুরোধ জীবনে যেমন আমার জন্ম পরিচয় সকলের কাছে অজ্ঞাত থেকেছে আমার মৃত্যুর পরেও যাতে এই অজ্ঞাতকুলশীল ব্যক্তির মরদেহ লোকচক্ষুর অগোচরে কোন নির্জন স্থানে নিয়ে যেয়ে সৎকার করা হয় - সেই আবেদন তোমার কাছে করলাম। আমার সেই আবেদন তুমি আশাকরি পূরণ করবে। এরপরে আশা করি তুমি আমাকে বিদায় দিবে। 
কর্ণের শেষ ইচ্ছা জ্ঞাত হয়ে বাসুদেব বললেন "তাই হবে ভাই, তোমার মরদেহ আমি এমন এক নির্জন জনহীন স্থানে নিয়ে যেয়ে বিসর্জন দেবো যে স্থান এই দ্বাপর যুগ শেষ হওয়ার পরে কলিযুগেও এক মহান তীর্থে পরিণত হবে। আর বিদায় তোমাকে আমি এই ক্ষণে দিচ্ছি, তবে তোমার স্থান আমার হৃদয়ে চিরকাল জাগ্রত থাকবে, সেখান থেকে তোমায় আমি কোনদিন বিদায় জানাতে পারবো না"। 

বাসুদেবের এই কথা বলার পরে কর্ণ নিজের রথে আরোহন পূর্বক গমন করার পরে বাসুদেব নির্নিমেষ নয়নে দৃষ্টিপাত করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে পাণ্ডব শিবিরের উদ্দেশ্যে উপপ্লব্য নগরে গমন করলেন।
এদিকে বাসুদেব হস্তিনাপুরে বিদুরের গৃহ থেকে পিতৃষ্বসা কুন্তীর কাছে বিদায় নিয়ে আসার পরে পথিমধ্যে কর্ণের সাথে যে নিভৃতে আলোচনা হয়েছে বিদুরের মুখে এই সংবাদে উৎকণ্ঠিত হলেন পান্ডব জননী কুন্তী। তিনি ভাবলেন বাসুদেব নিশ্চিত তাকে সম্পূর্ণ সংবাদ জ্ঞাত করবেন। কিন্তু তিনদিন অতিক্রান্ত হওয়ার পরেও বাসুদেব তাঁর কাছে এসে কোন সংবাদ না দেওয়ায় তিনি উৎকণ্ঠা দমন করতে না পেরে একদিন প্রত্যুষে অবগুণ্ঠনবতী হয়ে যমুনার উদ্দেশ্যে একাকী যাত্রা করলেন। তিনি যে পান্ডব জননী যাচ্ছেন সেই সংবাদ গোপন রেখে কর্ণের সাথে সাক্ষাতের অভিপ্রায়ে তিনি গমন করলেন, উদ্দেশ্য একটাই আসন্ন মহাযুদ্ধের পূর্বে কর্ণের নিকট তার জন্ম রহস্য উন্মোচন করা যাতে এই যুদ্ধে তাঁর কোন পুত্রের কোন ক্ষতি না হয়। কুন্তী জানেন কর্ণ সূর্য বন্দনাকালীন তার কাছে পরিচিত বা অপরিচিত যে কেউ যা পাওয়ার আশা করে প্রার্থনা করে সে তা পূরণ করে।         
স্নান সমাপন করে যথারীতি সূর্য বর্ণনা করতে করতে দিবা দ্বিতীয় প্রহর আগত। সূর্যবন্দনার শেষে কর্ণ  লক্ষ্য করলেন তীরে এক অবগুন্ঠনবতী মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি ভাবলেন এই নির্জন নদীতীরে মহিলা কিভাবে এলেন, দেখে মনে হয় কোন অভিজাত গৃহের মহিলা অথচ যতদূর দৃষ্টি যায় নিকটে বা দূরে কোথাও কোনো শিবিকা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। তাহলে তিনি কিভাবে এখানে এলেন? বিস্ময়াচিত্তে আভূমি নত হয়ে তিনি প্রশ্ন করলেন "দেবী আপনি কে, কি উদ্দেশ্যে আমার নিকটে আপনার আগমন - এই প্রশ্ন কি করতে পারি? আমি জননী রাধা ও সুত অথিরথের সন্তান কর্ণ"। 


অবগুণ্ঠন উন্মোচন করে কুন্তী বললেন "বৎস তুমি রাধেয় নও, কৌন্তেয়। তুমি পান্ডব জননী কুন্তীর জ্যেষ্ঠপুত্র"। কুন্তীকে দেখে ও তাঁর কথায় কর্ণ ততোধিক বিস্মিত ও আশ্চর্যান্বিত হয়ে বললেন "দেবী আজ এই সময়ে আপনি আমার জন্ম পরিচয় দিতে এত উৎসাহী হয়ে এই নির্জন নদীতীরে এসেছেন কি তার কারণ"? 
কর্ণের এই কথা শুনে পান্ডব জননী বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বললেন "বৎস, আজ তোমাকে বলতে দ্বিধা নেই অল্প বয়সের অজ্ঞতা, অপরিনামদর্শিতা এবং কৌতুহলের ফলে, ক্ষণিকের চাপল্যে তোমাকে আমি গর্ভে ধারণ করেছিলাম। তোমার জন্মের পরে লোকলজ্জা ও সমাজে নিন্দিত হওয়ার ভয়ে তোমাকে একটি পেটিকায় ভরে নদী জলে বিসর্জন দিয়েছিলাম। একথা অবশ্যই স্বীকার্য যে সুত অধিরথ ও তার স্ত্রী রাধা তোমাকে নদী জল থেকে নিয়ে গিয়ে একটি শিশুর প্রতি পিতা মাতার যা কর্তব্য তার সবকিছুই তারা করেছেন। কিন্তু তোমার জন্মদাত্রী মা এই পান্ডব জননী কুন্তী। এখন তুমি নিজের পিতৃ-মাতৃ পরিচয়ে পাণ্ডু পুত্রদের গ্রহণ করে রাজ্য সুখ ভোগ কর - এই আমার প্রার্থনা। তুমি ধর্মতত্ত্বজ্ঞ, আশা করি আমার এই প্রার্থনা তুমি পূরণ করবে"।                
কুন্তীর কথা শোনার পরে কর্ণের মস্তিষ্কের শিরা সমূহের সমস্ত রক্তবিন্দু মুখমন্ডলকে আরক্তিম করে তুলল। তিনি নিস্পৃহ কন্ঠে উত্তর দিলেন "আপনি ধর্মের কথা উচ্চারণ করে ধর্মশাস্ত্রকে পীড়িত করলেন। শাস্ত্রের কথা যদি বললেন তাহলে জন্মের পরেই নবজাতককে বিসর্জন দেওয়ার রীতি কি কোথাও উল্লেখিত আছে? আপনি কেবলমাত্র গর্ভে ধারণ করেছিলেন বলেই জন্মদাত্রীর দাবি করতে পারেন না কিন্তু জননীর দাবি করতে পারেন না, সে দাবি একমাত্র সুত অধিরথের ভার্যা রাধা করতে পারেন। সুত অধিরথ ও রাধা আমাকে জন্মের পরেই পিতৃমাতৃস্নেহে নিজ পুত্র জ্ঞানে সমস্ত কর্তব্য পালন করেছেন। আমি এতখানি পাষণ্ড বা নরাধম নই যে সামান্য সিংহাসনের লোভে তাঁদের বৃদ্ধ বয়সে তাঁদের প্রতি সন্তানের দায়িত্ব বিসর্জন দিতে পারবো? আপনি তো জন্মের পরেই পুত্রের প্রতি স্নেহ মায়া মমতা ত্যাগ করে তাকে বিসর্জন দিতে চেয়েছিলেন, অথচ নদী জল থেকে তুলে নিয়ে যেয়ে আমার পালক পিতা মাতা সত্যিকারের জনক-জননীর কর্তব্য পালন করেছেন। আপনি আজ আমাকে বলছেন পান্ডবদের জ্যেষ্ঠভ্রাতা হিসেবে সিংহাসনে আরোহণ করতে কিন্তু ক্ষত্রিয় কুলে জন্ম গ্রহণ করে ক্ষত্রকুলের কোন শিক্ষা-দীক্ষাই তো আপনি আমাকে দান করেন নি। উপরন্তু দূর্যোধন আমাকে কৈশোর কাল থেকে বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করে একজন রাজার সমস্ত সম্মান বা অধিকার দিতে কুণ্ঠিত হননি। আমার শস্ত্র বলে নির্ভর করে তিনি এই মহারণে প্রবৃত্ত হয়েছেন। এমতাবস্তায় তাকে ত্যাগ করে কেবলমাত্র সিংহাসনের লোভে আমি যদি পান্ডব পক্ষে যোগদান করি সে ক্ষেত্রে কি আমি ধর্ম ধর্মপথে থাকার অধিকার পাবো? সমস্ত ক্ষত্রিয় সমাজ কি আমি ধিকৃত হবো না? আকৈশোর আমার স্বপ্ন অর্জুনের সাথে সমরে লিপ্ত হয়ে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করব, সেই যুদ্ধ থেকে বিরত হয়ে, প্রাণ ভয়ে ভীত হয়ে নিজের বিবেক, ধর্ম, সম্মান, বিসর্জন দিয়ে আমি বাঁচতে চাই না। আজন্ম আমি যেমন অজ্ঞাতকুলশীল হয়ে থেকেছি আমাকে সেখানেই থাকতে দিন"। 
হতাশা ও লজ্জা জড়িত করুণ কন্ঠে কুন্তী চোখের জল সংবরণ করে বললেন "বৎস, তোমার সূর্যবন্দনার পরে কোনো প্রার্থীর প্রার্থনা তো তুমি অপূর্ণ রাখো না, আমি সেক্ষেত্রে তোমার কাছে আমার ভিক্ষা চেয়েছিলাম"। তাঁর কথা শুনে কর্ণ বললেন "গর্ভধারিণী ও জন্মদাত্রী হয়ে আপনি পুত্রের কাছে ভিক্ষা প্রার্থনা কেন করবেন? আপনার তো আদেশ করার অধিকার ছিল কিন্তু সেটা আপনি নিজের হাতে রুদ্ধ করেছেন। আপনি আমার প্রাণ রক্ষার্থে যতখানি না উদগ্রীব তার থেকেও বেশি উদগ্রীব ধনঞ্জয়ের জীবনের জন্য। কিন্তু আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি এতদিন যেমন পঞ্চপুত্রের জননী ছিলেন, অর্জুন ও আমার দ্বৈরথ যুদ্ধে একজন পরাজিত ও নিহত হলেও, যুদ্ধশেষে আপনি সেখানেই থাকবেন। যুদ্ধে আমি অর্জুন ছাড়া অপর কোনো পান্ডবকে বধ করবো না একথা আমি নিশ্চিত করে আপনাকে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি"।   
কুন্তী বললেন "পুত্র, তোমার প্রতিটি বক্তব্য সত্য একথা আমি স্বীকার করছি। আমি অপরাধিনী, এর অধিক আশা করার যোগ্যতা আমার নেই। তুমি আমাকে যে আশ্বাস আজ দিলে তা আমার আশার অতীত। তবে যাবার পূর্বে তোমাকে বলে যাই ইহজীবনে আর কোনদিন দেখা হবে কিনা তার স্থিরতা নেই, তবে অবসরকালীন কোন এক সময় যদি চিন্তা করে দেখো নিজের কৈশোর জীবনের কোনো এক অসতর্ক মুহূর্তে কোন নীতি বহির্ভূত কার্য করে থাকলে সে কথা স্মরণ করে এই হতভাগিনী জননীকে ক্ষমা করতে পারবে"। এই কথা বলে অশ্রুসজল চোখে নত মস্তকে, অধোবদনে ধীর পদক্ষেপে কর্ণের কাছ থেকে কুন্তী বিদায় নিলেন। 
                                                  ………….পরবর্তী সংখ্যায় দেখুন


জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇



Post a Comment

0 Comments