মটগোদার ধর্মরাজ ও শনিমেলার ইতিহাস /সূর্যকান্ত মাহাতো

জঙ্গলমহলের জীবন ও প্রকৃতি

পর্ব - ৬১

মটগোদার ধর্মরাজ ও শনিমেলার ইতিহাস

সূর্যকান্ত মাহাতো


সচরাচর যেকোন মেলার নামকরণ যেখানে অনুষ্ঠিত হচ্ছে, সেই স্থানের নাম অনুসারেই হয়। যেমন 'বিষ্ণুপুর মেলা', 'মুকুটমনিপুর মেলা', 'পরকুল মেলা' ইত্যাদি। নয় তো যে অনুষ্ঠান উপলক্ষে মেলা বসে, সেই অনুষ্ঠান অনুযায়ীও মেলার নামকরণ হয়। যেমন 'মকর মেলা', 'দুর্গা পূজার মেলা', 'দোল মেলা' ইত্যাদি। কিন্তু তাই বলে সপ্তাহের একটি বিশেষ বারের 'নাম' থেকেও যে মেলার নামকরণ হয় এটা জেনে বেশ অবাক হলাম। একজনকে অদম্য কৌতুহল থেকে জিজ্ঞেস করলাম, "মটগোদার এই মেলার নাম 'শনিমেলা' কি স্রেফ শনিবার থেকেই এসেছে? নাকি 'শনি' দেবতার সঙ্গে কোন সম্পর্ক আছে?"

ভদ্রলোক বললেন, "এই 'শনিমেলা' নামকরণ স্রেফ এক সাপ্তাহিক 'বারের নাম' থেকেই এসেছে। প্রতিবছর মাঘ মাসের শেষ 'শনিবার' এই মেলার শুভারম্ভ ঘটে। সেই থেকে মেলার নামকরণ 'শনিমেলা'। আর এটা কোনভাবেই 'শনি' দেবতা বা 'শনি' ঠাকুরের মেলা নয়। (পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি/বিনয় ঘোষ, প্রথম খন্ড, পৃষ্ঠা- ৩৮০) এখানকার 'গ্রামদেবতা' 'ধর্মরাজ' ঠাকুরের পূজা উপলক্ষ্যে এই মেলা বসে। এই মেলার আরো একটি বিশেষত্ব হল, এই মেলার সময়কাল।"

"সময়কাল! সে তো  জঙ্গলমহলের আর পাঁচটা ধর্ম পূজার মতোই। অন্যান্য স্থানে বছরের যে সময়টা ধর্মরাজের পূজা অনুষ্ঠিত হয় সেটাই মূলত বৈশাখী পূর্ণিমা থেকে শ্রাবণ মাস পর্যন্ত। এখানে ব্যতিক্রম কোথায়?"

"ব্যতিক্রম আছে। মটগোদার ধর্মরাজের পূজা ঘটা করে অনুষ্ঠিত হয় শীতকালের মাঘ মাসে। অন্যান্য স্থানের সঙ্গে শীত ও গ্রীষ্মের ব্যবধান।"

"মটগোদার এই 'ধর্মরাজ' দেবতা ও 'শনিমেলা'-র কোন ঐতিহাসিক পটভূমি কিছু আছে কি?"

"অবশ্যই আছে। আজকের এই মটগোদা, শ্যামসুন্দরপুর, ফুলকুশমা, সিমলাপাল, রায়পুর সহ বাঁকুড়ার দক্ষিণ অংশের নাম আগে ছিল 'রাজাগ্রাম'।"


জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇



"বাব্বা! এই এলাকা আগে 'রাজাগ্রাম' নামে পরিচিত ছিল! তাহলে এখানে একজন রাজাও ছিলেন নিশ্চয়?"

"ঠিক বলেছ। একজন সামন্ত রাজা ছিলেন বটে। তবে কোন এক বিশেষ কারণে তিনি নাকি সপরিবারে আগুনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন। এই 'রাজাগ্রাম' তারপর রাজশূণ্য হয়ে পড়েছিল। চোর, ডাকাত ও বন্য জন্তুতে ভরে উঠেছিল এই এলাকা। ঠিক এই সময় উড়িষ্যার একজন মানুষ নাম 'নকুড়তুঙ্গ' এই 'রাজাগ্রাম' পরবর্তী কালে অধিকার করেন।"

"এই নকুড়তুঙ্গের সঙ্গে কি 'তুঙ্গদেও' এর কোন সম্পর্ক আছে? শুনেছি 'তুঙ্গদেও' জগন্নাথদেবের কৃপা লাভে একসময় পুরীর রাজা হয়েছিলেন।"

"ঠিক শুনেছো। এখানকার 'নকুড়তুঙ্গ' ওই রাজ পরিবারেরই বংশধর ছিলেন। 'তুঙ্গদেও' ছিলেন নকুড়তুঙ্গের প্রপিতামহ। শোনা যায়, 'তুঙ্গদেও' জগন্নাথ দর্শনে এসে তার কৃপায় পুরীর রাজা হন। আগে তিনি 'গণ্ডকী' নদীর তীরে বাস করতেন। আবার এটাও ঠিক তার পৌত্র 'গঙ্গাধরতুঙ্গ'কে সেই জগন্নাথ দেবই নাকি স্বপ্নে জানান, গঙ্গাধরের পরে তার বংশের আর কেউ পুরীর রাজা হতে পারবে না। তবে নাম পরিবর্তন করে অন্য দেশের রাজা হতে পারবে। এই স্বপ্নাদেশের পরে 'গঙ্গাধরতুঙ্গ' তার পুত্র 'নকুড়তুঙ্গ'কে অন্য দেশে চলে যেতে বলেন। তবে তার উড়িষ্যা ত্যাগ ঠিক স্বপ্নাদেশের কারণেই নাকি অন্য কোন কারণ ছিল সেটা আর জানা যায়নি।"

"এরপরই কি 'নকুড়তুঙ্গ' এখানে এসেছিলেন?"

"হ্যাঁ। ১২৭০ শকাব্দ বা ১৩৪৮ খ্রিস্টাব্দে 'নকুড়তুঙ্গ' পুরী ত্যাগ করে বাঁকুড়ার রায়পুরের এই অঞ্চলে এসে শ্যামসুন্দরপুর এর কাছে টিকারপুরে বসবাস শুরু করেন।( পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি/ বিনয় ঘোষ, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা- ৩৮১) শুধু তাই নয়, তিনি নিজের ও এই স্থানের নামও পরিবর্তন করেন। নিজের নাম রাখলেন, 'ছত্রনারায়ণদেব'। এবং এই স্থানের নাম রাখলেন, জগন্নাথ দেবের নামে 'জগন্নাথপুর'। 'তুঙ্গভুম' নামটাও সে কারণেই।" (পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি/ ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা- ৩৮১)

"আজ সিমলাপাল ও রায়পুর সংলগ্ন এলাকায় যে উৎকল ব্রাহ্মণদের বসবাস গড়ে উঠেছে, তারাও ওই সময়ই উড়িষ্যা থেকে এসেছিলেন।"

"বল কী! এখানকার উৎকল ব্রাহ্মণরাও তার মানে একসময় উড়িষ্যা থেকে এসেছিলেন?"

"হ্যাঁ। 'নকুড়তুঙ্গদেবের' সঙ্গেই ওই সময় ২৫২ টি উৎকল ব্রাহ্মণ পরিবার এখানে এসেছিলেন।(পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি/ বিনয় ঘোষ, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা- ৩৮১) ওই ২৫২ টি পরিবারই এই অঞ্চলে প্রথম বসতি স্থাপন করেন। 'নকুড়তুঙ্গ'দেবই 'শ্রীপতি মহাপাত্র' নামে এক উৎকল ব্রাহ্মণকে 'সিমলাপাল' অঞ্চলের জমিদারি দান করেছিলেন। আর 'রায়পুর' পরগনা দিয়েছিলেন 'শিখর' রাজবংশকে।"

"'শিখরভুম' কথাটি কি তাহলে 'শিখর' রাজবংশ থেকেই এসেছে?"

"একদম। রায়পুরে এখনো শিখর রাজাদের বেশ কিছু নিদর্শন আছে। যেমন 'শিখর শায়র', 'শিখর গড়', ও মিলন সাহেব সমাধি।"

"এখানকার 'ধর্মরাজ' দেবতার প্রতিষ্ঠা কি তার হাত ধরেই?"

"না, না। সে আরো অনেক পরে। নকুড়তুঙ্গের পর ষষ্ঠ পুরুষ তথা রাজা 'লক্ষীনারায়ণ'দেবের রাজত্বকালে তার ভাই 'মুকুটনারায়ণ'দেবের সঙ্গে তার পারিবারিক বিরোধ ঘটে। এই বিরোধের ফলে রাজ্য দু'ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। 'শ্যামসুন্দরপুর' গ্রহণ করেছিলেন 'লক্ষ্মীনারায়ণ'। আর ফুলকুশমা নিলেন 'মুকুটনারায়ণ'। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সময় 'সুন্দরনারায়ণ' এবং 'দর্পনারায়ণের' নামে দুই জমিদারির পত্তনও ওই সময়েই। যদিও পরবর্তীকালে সেই দুই জমিদারিই উঠে গিয়েছিল। তবে 'বড়তুঙ্গ' আর 'ছোটতুঙ্গ' এই দুটি নাম কিছুকাল আগেও লোকমুখে শোনা যেত।"

"তাহলে 'ধর্মরাজ'দেবের প্রতিষ্ঠা মটগোদাতে কীভাবে হল?"

"'শ্যামসুন্দরপুর' এর উৎকল রাজা স্বপ্নে আদেশ পেয়েছিলেন যে, 'ধর্মরাজ' নাকি 'মটগোদা' গ্রামে মাটিচাপা হয়ে পড়ে আছেন। তাকে যেন তিনি উদ্ধার ও প্রতিষ্ঠা করেন। এবং লালগড় থেকে 'পন্ডিত' উপাধিধারী কোন এক জেলেকে এনে পূজার ব্যবস্থা করেন। তবে ব্রাহ্মণ দিয়ে নয়। (পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা- ৩৮২) এই রাজার হাত ধরেই এখানে ধর্মরাজের পূজার সূচনা ঘটে।"

"কিন্তু আমি বলছি যে এই স্বপ্নাদেশের ব্যাপারগুলো কি আদৌ বিশ্বাসযোগ্য?"

"আসলে তোমাকে এর পিছনের ইতিহাসটাও একটু খুঁজতে হবে। তাহলেই এই বিষয়টা পরিষ্কার হওয়া যাবে। এই উৎকল রাজের স্বপ্নাদেশের বিষয়টিকেই যদি ধরা যায়, তাহলে দেখো, উৎকল রাজা একসময় এখানকার দস্যু দমনের যে অভিযান করেছিলেন সেটাই ছিল এই রহস্যের আসল কারণ।"

"কী রকম?"

"দেখো' পূর্বেই বলেছি 'ধর্মরাজ' হলেন' এখানকার 'গ্রামদেবতা'। এই দেবতা বরাবরই অব্রাহ্মণদের  দেবতা। এখানকার স্থানীয় নিম্ন বর্গের মানুষদেরই পূজ্য দেবতা ছিলেন। মনে করা হয়, রাজার দস্যু অভিযানের সময় এখানকার মানুষ বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। এবং অন্যত্র পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। তখনই তারা এই দেবতাকে হয়তো 'মটগোদায়' ফেলে চলে যায়। তাদের পূজ্য দেবতার "কচ্ছপ মূর্তি" মাটিচাপা পড়ে যাওয়া তাই অসম্ভব কিছু ছিল না। পরবর্তীকালে আদিবাসীদের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হলে ফের এখানে পূজার প্রচলন শুরু হয়। মাটির তলা থেকে পুনরুত্থানের পর রাজ বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তিন দিন সেখানে পূজিত হওয়ার পর মটগোদায় সেই মূর্তি নিয়ে আসা হয়েছিল। এবং সেখানে জেলে পন্ডিত দিয়ে পূজা আরম্ভ হয়েছিল।"

"আর এই 'শনিমেলা'র উদ্ভব কি তখন থেকেই?"

"'শ্যামসুন্দরপুর' এর রাজাই এই 'পূজা' ও 'শনিমেলা'র সমস্ত ব্যয়ভার তখন বহন করতেন। তবে শনিবারটিও বেশ তাৎপর্যময়। রাজা নাকি মাঘ মাসের শনিবারেই স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন। তাই এই সময়ই পূজা ও মেলা বসে। এর বেশি কিছু আর তথ্যসূত্র পাওয়া যায়নি। তখন রাজা নিয়ম করে হাতি কিংবা পালকিতে চড়ে মেলায় আসতেন পূজার সামগ্রী নিয়ে। তারপর পূজা আরম্ভ হত। শ্যামসুন্দরপুরের রাজার পর দ্বারভাঙার মহারাজও সেই মর্যাদা কিছুদিন রক্ষা করেছিলেন। তবে সর্বত্র যখন গ্রীষ্মকালে ধর্মরাজের পূজা অনুষ্ঠিত হয় তখন এখানে কেন মাঘ মাসে তার উত্তর আজও মেলেনি।"
"তবে এই 'শনিমেলা' এক সময় আদিবাসীদের মেলা ছিল বলে মনে করা হয়।"

"সে কি! এমন কথা তো কখনো শুনিনি! এ তথ্য আপনি কোথায় পেলেন?"

"আরে 'বিনয় ঘোষ' তো তার গ্রন্থে এটা স্পষ্টভাবেই বলে দিয়েছেন। 'এই শনিমেলা সাঁওতালদেরই মেলা ও উৎসব'" (পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি, প্রথম খন্ড, পৃষ্ঠা ৩৮৪)।

"তার এমনটা মনে হওয়ার কারণ?"

"কারণ মেলায় সাঁওতাল মেয়েদের উজ্জ্বল উপস্থিতি ও নাচ-গান ছিল একসময় এই মেলার প্রাণ। দিন দশটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত চলতো তাদের নাচ গান। তবে বিনয় বাবু ১৯৬৮ সালে যখন মটগোদা এসেছিলেন তখন তিনিও সে নাচ দেখেননি। তার মানে এই নাচ ছিল আরো প্রাচীন। তবে অনুসন্ধান করে ও মেলায় সাঁওতাল রমনীদের উপস্থিতি দেখেই তিনি এ ধারণা করেছিলেন। তবে এখন যে সেটা একেবারেই সকলের মেলা হয়ে উঠেছে এটাই এই মেলার প্রাণ।"

তথ্যসূত্র: পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি(প্রথম খন্ড)/ বিনয় ঘোষ

Post a Comment

0 Comments