লাগে দোল পাতায় পাতায় (পঞ্চম পর্ব)
মিলি ঘোষ
এমনও হয়
মিউজিক্যাল চেয়ারে আর জায়গা হলো না শীতের। বসন্ত সে চেয়ারের দখল নিয়েছে। গাছেরাও তাদের কাজের ধারা পাল্টে ফেলেছে। এখন পাতা খসানোয় তাদের আর আগ্রহ নেই। বরং ডালে ডালে কচি পাতাদের জন্ম দিতেই তারা ব্যস্ত। সব সুখ যেন এতেই। এই সময়ে গাছগুলো বড্ড অহংকারী হয়ে ওঠে। কেমন করে ঘাড় ঘোরায়! হেলে দুলে নিজের রূপ দেখায়। কখনও বা মৃদু মন্দ বাতাসে অন্যের মন ভোলানোর চেষ্টাতেও মাতে। দিনের শেষে বিষণ্ণ সূর্য বাড়ির পথে পা বাড়ালেই, দখিনা বাতাস এসে দোল দিতে থাকে।
ফেব্রুয়ারি মাস। সামনেই মধুবন্তীর জন্মদিন। মা মারা যাবার পর থেকে জন্মদিনটা কেমন তেতো লাগে মধুবন্তীর। দুঃখ যাদের সরাসরি স্পর্শ করে না, তাদের কাছে ঝাঁপি না খোলাই ভালো। হাজারো শুভেচ্ছা, হাজারো ভালোবাসার মধ্যেও একটা কাঁটা যেন বুকের ঠিক মধ্যিখানটায় এসে বেঁধে। জন্মদিনে, জন্মদাত্রীকে কাছে না পাওয়ার কষ্ট মুখের হাসি দিয়ে ঢেকে রাখে মধুবন্তী। কিন্তু এবছর ওর যন্ত্রণা আরও এক ধাপ বেড়েছে। বসন্তের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে একটা ভয়ানক ভারী অভাববোধ মধুকে ঘিরে ধরেছে।
মধুবন্তীর সেই রাতের কথা মনে পরে, যেদিন অনুরাগের অনুরোধে ও গেয়েছিল, "আমার মল্লিকা বনে ...."
তারপর গানে গানে, ভালোবাসায় ভালোবাসায় পার হয়েছে বহু রাত। প্রতিটা জন্মদিন মধুবন্তীর জীবনে এসেছে নতুন নতুন রূপে।
পরিমলবাবু মধুবন্তীকে ডেকে বললেন, "এখন তো অনেকটাই সেড়ে উঠেছি। চলো, সবাই মিলে কাছাকাছি কোথাও ঘুরে আসি। অনুকেও বলব। এলে ভালো, নাহলে আমরা তিনজন বেরিয়ে পড়ব।"
মা'র ইচ্ছা পাহাড় আর বাবা'র সমুদ্র। মধুবন্তীকে ডাকলেন ঠিকই, কিন্তু পাহাড়, সমুদ্র নিয়ে নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ চালালেন অনেকক্ষণ। এ যুদ্ধের যে মীমাংসা হবে না, সে মধুবন্তীও জানে।
মধুবন্তীর মাথা ধরে যাচ্ছিল। এক সময় অধৈর্য্য হয়ে 'উফ্' বলে ফেলে মধু, যা কানে যায় দু'জনেরই। তাতে লজ্জা পেয়েই হোক বা নিজেদের দ্বারা এই কাজ কোনওভাবেই সম্ভব হবে না বুঝেই হয়তো, চুপ করে যান দু'জনেই।
সুপ্রিয়াদেবী বললেন, "মধুকেই জিজ্ঞেস করো না, ওর কোথায় যাবার ইচ্ছা।"
এই একটা ব্যপারে দুজনেই সহমত হলেন এবং কোথায় যাওয়া হবে, তা ঠিক করার দায়িত্ব পুরোটাই মধুর ঘাড়ে চাপিয়ে দিলেন।
জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇
কী বলবে মধুবন্তী ? সত্যি ওর কোথায় যেতে ইচ্ছা করে, বলতে কি পারবে ?
চলন্ত ট্রেন থেকে দেখতে পাওয়া মাঠের মাঝে একটা দুটো বাড়ি, চোখের আড়াল হলেই, যে বাড়িগুলো মন থেকে মুছে যায়, মধুবন্তী'র ইচ্ছা হয় একবার সেখানে যেতে। ওখানে কারা থাকে, কেমন তাদের জীবনযাত্রা মধুর খুব জানতে ইচ্ছা করে।
মনের ইচ্ছা মনে রেখেই মধুবন্তী বলল, "টস হোক।"
টস করে জিতলেন বাবা। সুতরাং সমুদ্র।
স্বাভাবিকভাবেই মায়ের মুখ বেজার। কিন্তু মধুর সিদ্ধান্ত মানতে বাধ্য হলেন তিনি। হয়তো কোথাও তাঁর আশা ছিল, মধু তাঁকেই সমর্থন করবে। কিন্তু মধু টস করতে বলতেই আশঙ্কা ঘনীভূত হয়।
এখন টসে হেরে ভাবছেন, "মধুকে দায়িত্ব না দিলেই হতো।"
দীঘা যাওয়া হবে শুনে,অনুরাগ আগ্রহ দেখাল। উৎসাহ নিয়ে হোটেল বুক করে দিল।
ওর আগ্রহ দেখে মধুবন্তী আশা করেছিল, অনু নিশ্চয়ই যাবে ওদের সঙ্গে। অনেক দিন পর, গলায় কিছু সুরও গুনগুন করেছে মধু'র।
কিন্তু অনুরাগ নিজের জায়গায় অটল। কারণ সেই একই, কাজের চাপ, ছুটি নেই ইত্যাদি ইত্যাদি। আশাহত হয়ে বেশ একটু মনমরা হয়ে গেল মধু। বেড়াতে যাওয়ার আনন্দ পুরোটাই যেন মাটি। আরও অবাক হলো বাবা, মায়ের ফুর্তি দেখে। এমন করছে, যেন নতুন বিয়ে হয়েছে। গা জ্বলে যাচ্ছে মধুবন্তীর।
পরদিন মধুবন্তী অফিস থেকে ফেরা মাত্র সুপ্রিয়াদেবী একটা প্যাকেট নিয়ে এসে হাজির। তার থেকে বেরোল তাঁর নিজের শাড়ি আর তাঁর বরের জন্য একটা পাঞ্জাবী।
গদগদ হয়ে বললেন, "দেখ তো মধু, কেমন হয়েছে ? বহুদিন পরে বেড়াতে যাচ্ছি তো, তাই একটু কেনাকাটা করলাম। পাঞ্জাবীর কালারটা তো তোর বাবার খুব পছন্দ হয়েছে।"
মধু কিছু বলার আগেই শাড়িটা নিজের গায়ে ফেলে বললেন, "এটা মানাবে না, আমাকে ?"
মধুবন্তী কাষ্ঠ হেসে বলল, "খুব মানাবে। দু'টোই চমৎকার!"
মুখে না বললেও, ভেতরে ভেতরে গজরাতে লাগল মধুবন্তী, "এদের সঙ্গে বেরিয়ে, আমার আনন্দটা কোথায় ? আমার জন্মদিন, না এদের বিবাহ বার্ষিকী ? শাড়ি কিনে আবার দেখাতে এসেছে!"
একবার ভাবল বলে দেবে, "তোমরা ঘুরে এসো। আমি থেকে যাচ্ছি।"
তারপর ভাবল, "থাক। এবারটা ঘুরে আসি। আর যাব না।"
দীঘায় হোটেলে পৌঁছে পরিমলবাবুই রিসেপশনে কথা বললেন। এক পাশে রাখা পরপর চেয়ার গুলো দেখিয়ে ওদের বসতে বলে আধার কার্ডগুলো নিয়ে গিয়ে রিসেপশনে দেখালেন।
যে ছেলেটি ঘর দেখাতে নিয়ে গেল, সে বলল, "একটা রুম ফার্স্ট ফ্লোরে, আর একটা গ্রাউন্ড ফ্লোরে।"
আঁতকে উঠল মধুবন্তী, "সে কী! আমি একা থাকতে পারব না, একটা ফ্লোরে।"
"আরে এখানে সিকিউরিটি আছে। কিচ্ছু ভয় নেই। পাশাপাশি ঘরগুলোতে লোকজন ভর্তি।" কথাটা বলেই পরিমলবাবু এক তলার নির্দিষ্ট ঘরটিতে চাবি ঘুরিয়ে নিজেদের জিনিসপত্র ঢুকিয়ে দিলেন।
মধুবন্তী মাথার চুল ছিঁড়তে বাকি রাখল।
বলল, "তাহলে মা আমার সঙ্গে ওপরের ঘরে থাকবে। আপনি থাকুন এক তলায়।"
"ওটি হবে না। অনেক বছর পর বেড়াতে এসেছি।" বলতে বলতে পরিমলবাবু নিজেদের ঘরে তালা দিয়ে লিফটের দিকে এগোলেন।
লিফটের দরজা টেনে মধুকে বললেন, "আরে, কত সুন্দর ঘর তোমার। ব্যালকনিতে বসলেই সামনে সমুদ্র। এমনিতেই মন ভালো হয়ে যাবে।"
মধুবন্তী দাঁত কিড়মিড় করল, "হ্যাঁ, আর উনি যেন এক তলার ব্যালকনি থেকে মরুভূমি দেখবেন!"
লিফট থেকে বেরিয়ে মধুবন্তীর ট্রলিতে পরিমলবাবু হাত দিতেই কড়া গলায় বলল মধু, "লাগবে না। আমারটা আমিই টানতে পারব।"
পেছন ফিরে না তাকালেও, মধুবন্তী বুঝতে পারল, বাবা-মা নিজেদের মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় করলেন।
যে ছেলেটি এসেছিল, সে চাবিটা মধুবন্তীর হাতে দিয়ে ঘর দেখিয়ে দিল।
মধুবন্তী চাবি ঘুরিয়ে দরজা খোলা মাত্র ঘরের মধ্যে ফটাস্ করে একটা বেলুন ফাটল। তার থেকে লাল, নীল, চিকমিকে কাগজ বেরিয়ে এসে, ভরিয়ে দিল গোটা ঘর। রিমঝিম বৃষ্টির মতো কাগজের টুকরোগুলো মধুর গায়ে মাথায় ঝরে ঝরে পড়ে, চুপ করে বসে অপেক্ষা করতে লাগল। ভাগ নিতে চাইল আনন্দের।
তারপর বারান্দা লাগোয়া দরজা ঠেলে ধীরে ধীরে বেরিয়ে এল অনুরাগ।
বেসুরো গলায় অনুরাগ গাইছে, "হ্যাপি বার্থডে ডিয়ার মধু...."
মধুবন্তী আর কিছু দেখতে চাইল না। দু'হাত দিয়ে মুখ ঢেকে দাঁড়িয়ে রইল। অনুরাগ এসে মধুকে নিজের কাছে টেনে নিতেই মধুবন্তী অনুরাগের বুকে মাথা রেখে এতদিনের জমে থাকা সমস্ত কান্নায় নিজেকে উজাড় করে দিল।
তখনই বাইরের দরজাটা দুম করে বন্ধ হলো।
পরিমলবাবু স্ত্রীকে বলতে বলতে লিফটের দিকে এগোচ্ছেন, "চলো, চলো খিদে পেয়ে গেছে খুব।"
কথাটা কানে যেতেই মধুবন্তী কান্না জড়ানো গলায় জানতে চাইল, "প্ল্যানটা কার ? বাবা, না মা'র ?"
অনুরাগ, মধুবন্তীর কানের কাছে মুখ এনে বলল, "দু'জনেরই।"
বিছানার পড়ে থাকা অনুরাগের ভ্রাম্যমানটি হয়তো বা লজ্জায় মুখ লুকিয়েছিল।
এমন শুভক্ষণে তারও ইচ্ছা হলো দু'কলি গাইবার, "লাগে দোল, লাগে দোল, লাগে দোল পাতায় পাতায় বকুল বোনের শাখে ...."
অনুরাগ, মধুবন্তী দু'জনেই মুখ বাড়িয়ে দেখল, 'বাবা কলিং'।
মধুবন্তী বলল, "ধরো ফোনটা।"
অনুরাগ বাধা দিল।
হাসতে হাসতে বলল, "এখনও তোমার মনে হচ্ছে, ধরবার জন্য বাবা ফোনটা করেছে ?"
( সমাপ্ত )
0 Comments