জ্বলদর্চি

মহাভারতের কর্ণ - এক বিতর্কিত চরিত্র/ দশম পর্ব /দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

মহাভারতের কর্ণ - এক বিতর্কিত চরিত্র   
দশম পর্ব   

দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী                                             
                      

একসময় পান্ডব জননী কুন্তী কর্ণের দৃষ্টিসীমার শেষ প্রান্তে পৌঁছে একটি বিন্দুর মত বিলীন হয়ে গেলেন। বহুক্ষণ নদীতীরে স্থির হয়ে রইলেন অঙ্গাধিপতি কর্ণ। গর্ভধারিনীর শেষের কথাগুলো তার মনে তীব্র কষাঘাত করল বহু পূর্বের তাঁর নিজের জীবনে অনুরূপ এক ঘটনার কথা স্মৃতিতে জাগরিত হতে। 
বহু পূর্বের সেই ঘটনাও এমনই নির্জন নদী তীরে ঘটেছিল। একদিন স্নান ও ইষ্টবন্দনার পরে কর্ণ দেখেছিলেন এক অনার্য, উদ্ভিন্ন যৌবনা, তরুণী শবর কন্যা তাঁর কাছে কোন প্রার্থনার আশায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। তার প্রার্থনা জানতে চাওয়ার পরে সেই সরলমনা অনার্য শবর কন্যা তার কাছে দ্বিধাহীন কন্ঠে এক পুত্র সন্তান কামনা করেছিল। তার আজন্ম লালিত স্বপ্ন ছিল মহাবীর, তেজস্বী কর্ণের সন্তানকে গর্ভে ধারণ করবে। তার প্রার্থনা পূরন হলে সে তার শবর পল্লীতে ফিরে যাবে এবং কোনদিন তার গর্ভের সন্তান যে কর্ণের ঔরসজাত সন্তান সে কথা প্রকাশ করবে না বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কর্ণ তাকে তার এই প্রার্থনার পরিবর্তে অন্য কিছু প্রার্থনা করতে বলায় সে তাতে রাজী না হয়ে ফিরে যেতে চাইলে কর্ণ ভেবেছিলেন এই সময়ে যে যা চায় তিনি তাকে তাই দান করেন বলে বিশ্বচরাচর জানে। সে ক্ষেত্রে শবর কন্যাকে তার প্রার্থিত প্রার্থনা পূরণ না করলে তিনি সত্য পথ থেকে বিচ্যুত হবেন সেই চিন্তা করে কর্ণ সেই শবর কন্যার অভীষ্ট ইচ্ছা পূরণ করেছিলেন। এরপরে সেই শবর কন্যা আর কোনদিন তাঁর কাছে আসেনি এবং তিনিও তার কথা মনে রাখেন নি।      
কুন্তীর শেষের কথাগুলি মনে করে তার সেই মুহূর্তে মনে হল তাহলে তিনিও তো গন্ধর্ব মতে, বিবাহিত সেই শবর কন্যা, যার গর্ভে তিনি সন্তান উৎপাদন করেছিলেন, তাদের ভবিষ্যতের কথা বিসর্জন দিয়ে কোন ধর্ম পালন করেছেন? তিনিই তো সেদিন নীতি গর্হিত কাজ করেছিলেন। আর শুধু কি সেদিন তিনি শবর কন্যার প্রার্থনা পূরণ করেছিলেন না তার সরল নিষ্পাপ রূপলাবণ্যে মোহিত হয়ে নিজের শোনিত কিশোরীর শোনিতে মিশ্রিত করেননি?    
নিজের জীবনের সেই ঘটনাকে স্মরণ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে পশ্চিম দিগন্তে সৃষ্টির আদি দেবতা, দিবসের অধিদেবতা, নিজের ইষ্টদেবতাকে প্রণাম জানিয়ে অস্ফুট যন্ত্রণাবিদ্ধ কন্ঠে উচ্চারণ করলেন - "মাগো আমি তোমার হতভাগ্য, ভাগ্যপীড়িত সন্তান - আমাকে তুমি ক্ষমা করো"।         
      

জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇


হস্তিনাপুরে শ্রীকৃষ্ণের দৌত্য ব্যর্থ হয়ে গেছে। কৌরবেরা পাণ্ডবদের পাঁচটি গ্রাম দেবেন না, ফলে যুদ্ধ অনিবার্য। চারিদিকে সাজসাজ রব। ভারতবর্ষের রাজন্যবর্গ দুই পক্ষের শিবিরে এসে যোগদান করেছেন। এমন সময়ে একদিন কর্ণ তাঁর নিত্যনৈমিত্তিক প্রথানুযায়ী রাত্রির চতুর্থ প্রহরে গঙ্গাস্নানের নিমিত্ত নদীতীরে পৌঁছে স্নান করতে নামবেন এমন সময়ে বীভৎস দর্শন সর্বাঙ্গে পুরীষ লিপ্ত, আকন্ঠ মদ্যপান করে এক নিষাদ তাঁর পথ রোধ করে দাঁড়ালো। দেখলেই মনে ঘৃণার উদ্রেক হবে। কর্ণ খানিক অপ্রসন্ন হয়ে তাকে ঈষৎ রূঢ়কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন "এখানে কি প্রয়োজন"? সেই নিষাদ কর্ণের জিজ্ঞাসার উত্তরে বলল "কিছু চাইতে আসিনি, তবে তোমাকে সাবধান করতে এসেছি"। "কিসের সাবধান"? কর্ণের প্রশ্নের উত্তরে নিষাদ বলল "এই যে তুমি যে যা চায় নিজের ভালো-মন্দ বিচার না করে তাই দান করো সেই অভ্যাস ত্যাগ করার কথা বলতে এসেছি। চারিদিকে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। তোমার শরীরে নাকি এমন কোন বস্তু আছে যার জন্য তুমি অবধ্য। এক ব্রাহ্মণ এসে তোমার কাছে সেই বস্তুগুলি প্রার্থনা করবে, তুমি ঐগুলি কখনোই দান করবে না"। নিষাদের 
কথাগুলি শুনে কর্ণ চিন্তা করলেন "গত রাত্রিতে স্বপ্নে সূর্যদেব তাঁকে এই বিষয়ে সাবধান করেছিলেন, আবার প্রভাতেই নিষাদও সেই একই সাবধানবাণী উচ্চারণ করছে - এর রহস্য কি? অপ্রসন্নতা দূর করে কর্ণ তাকে প্রশ্ন করলেন "তুমি কিভাবে জানলে যে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে"। নিষাদ অট্টহাস্য করে বললে "তোমার বিপক্ষ শিবিরে আমিইতো সেই লোক স্থির করে দিয়েছি যে ছদ্মবেশে তোমার কাছে এই বস্তুগুলি প্রার্থনা করবে। তুমি তাকে কিছুতেই ওই দুটি বস্তু দিওনা, তার পরিবর্তে তুমি তাকে অন্য কোন মূল্যবান জিনিস দিতে চাইবে"। নিষাদের কথা শুনে কর্ণ চিন্তা করলেন বিপক্ষ শিবিরে তাহলে তাঁকে নিয়েই যত দুশ্চিন্তা, অথচ কর্নের নিজের জীবনের সম্বন্ধে কোন মায়া নেই। দেবতা ব্যতীত মানুষের অমরত্ব নেই। তিনি জানেন যুদ্ধে হয় অর্জুন অথবা তিনি যে কোন একজনের মৃত্যু অবধারিত। অবশ্য অর্জুনের সহায় স্বয়ং যদুপতি শ্রীকৃষ্ণ। তিনি চিন্তা করলেন দানে কুন্ঠা প্রকাশ করলে তাঁর অপযশ ঘোষিত হবে। তাই তিনি নিঃশঙ্কচিত্তে বললেন "তুমি কে আমি জানিনা, তবে জেনে রাখ সহজাত কবচকুণ্ডল কেন মানুষের যা সর্বাপেক্ষা প্রিয় ইহজগতে সেই পুত্র-কন্যা, ভার্যা, রাজ্য, ঐশ্বর্য এমনকি নিজের প্রাণ পর্যন্ত আমি ত্যাগ করতে প্রস্তুত কিন্তু আমার ইষ্টদেবতা বন্দনার পরে কোনো প্রার্থীকে আমি জানে বিমুখ করতে পারবোনা"। 
কর্ণের এই কথা শুনে নিষাদ বিরক্তি সহকারে আপন মনে বলতে লাগল "নির্বোধ, দানগর্বে দাম্ভিক - যে নিজের ভালো বোঝার চেষ্টা করে না তার মৃত্যু কে খন্ডন করবে"। এই কথাগুলি বলে নিষাদ নিষ্ক্রান্ত হয়ে যাওয়ার পরে কর্ণ দ্রুত নদীতে নেমে গেলেন স্নান করতে।                 
যুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছে। এমন সময় স্বর্গের দেবতারা তৎপর হয়ে উঠলেন মর্ত্যলোকে তাঁদের ঔরসজাত সন্তানদের জীবন রক্ষার জন্য। দেবরাজ ইন্দ্র অর্জুনকে বাঁচানোর জন্য ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে একদিন কর্ণের সূর্য বন্দনা করার পরে তা'র কাছে উপস্থিত হবেন তার সহজাত কবচকুণ্ডল হস্তগত করার জন্য। দেবরাজ ইন্দ্রের এই অভিপ্রায় দেব দিবাকর তাঁর ঔরসজাত সন্তান কর্ণকে সতর্ক করে দিতে এসেছিলেন। 
পূর্ব রাত্রের ঘটনা। যথারীতি কর্ণ শয়ন করেছেন এবং গভীর নিদ্রায় মগ্ন। এমন সময়ে সূর্যদেব কর্ণের কাছে নিদ্রাকালে স্বপ্নে উপস্থিত হয়ে বললেন "পুত্র কর্ণ, তোমার কাছে এসে যে যা প্রার্থনা করে তুমি তাই তাকে প্রদান কর, উত্তম। কিন্তু আমি তোমাকে আজ সতর্ক করে দিচ্ছি কদাচ তুমি তোমার অঙ্গের সহজাত কবচকুণ্ডল দানের কথা অঙ্গীকার করবেনা। এই দুটি জিনিস ব্যতিরেকে অন্য সমস্ত জিনিস দানের অঙ্গীকার করতে পার। যতদিন এই দুটি জিনিস তোমার কাছে থাকবে ততদিন তুমি পৃথিবীতে অজেয় ও অবধ্য থাকবে"।
 যে মানুষ সারাজীবন জন্মের কলঙ্ক বহন করে বেড়াচ্ছেন সূর্যদেবতার এই মমত্বময় দুশ্চিন্তায় কর্ণ বিস্মিত হয়ে গেলেন, অথচ তাঁর জন্মদাত্রী জননীর তাঁর সম্বন্ধে কোন মায়া ছিল না। সূর্যদেব স্বপ্নে কর্ণকে সতর্ক করে দিলেন সত্য, কিন্তু কর্ণের সঙ্গে তাঁর যে অচ্ছেদ্য বন্ধন সে কথা স্বীকার করলেন না। তিনি তাঁর দেবলোকের মাহাত্ম্য অক্ষুন্ন রেখে বললেন "আমি সহস্রাংশ সূর্য"। কর্ণ চিরকাল তাঁর দানের জন্য সুবিদিত। মৃত্যুভয়কে তুচ্ছ করে তাই কর্ণ বললেন-"হে দেব দিবাকর, আপনার এই করুনার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। কিন্তু আপনি যদি সত্যিই আমার শুভাকাঙ্ক্ষী হন তাহলে আমার দাননিষ্ঠায় আপনি বাধা দিচ্ছেন কেন? আর যদি পান্ডবদের হিতাকাঙ্খী হয়ে স্বর্গ থেকে দেবরাজ ইন্দ্র এক ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে মর্ত্যে এসে আমার তুল্য একজন সাধারণ মানুষের কাছ থেকে ভিক্ষা প্রার্থনা করেন সেক্ষেত্রে তাঁর প্রার্থনা পূরণ করা এক মহৎ কর্ম। আমি তাঁর প্রার্থনা পূরণ না করলে জগতে দানবীর বলে আমার যে খ্যাতি তাতে কি কলঙ্কের দাগ লেপন হবে না"? 
মহাকবি কালিদাসের পূর্বজন্মা মহাকবি ভাস মহাভারতের এই অংশে কর্ণের মনোভাব ব্যক্ত করে লিখেছেন 'সহস্র বৈদিক যজ্ঞে মুণি-ঋষিদের আহুতি আর মন্ত্রোচ্চারণের যে দেবতাকে মাথায় তুলে রাখা আছে, যিনি নিজে শত সহস্র দৈত্য দানবদের নিহন্তা, ঐরাবত যার বাহন, শচীপতি ইন্দ্রানী যার ঘরনী, সেই দেবরাজ ইন্দ্র যদি অর্জুনের মত ত্রিভুবন বিজয়ী পুত্রের প্রাণ রক্ষার জন্য কর্ণের কাছে ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে আসতে পারেন তাহলে কর্ণই তো এক্ষেত্রে মহান বলে বিবেচিত হবেন। এক্ষেত্রে যাচনা বৃত্তি দেবরাজের দেবত্ব হানি করে কর্ণের দানের মহিমাকে উজ্জ্বল করে তুলেছে। চিরকাল কর্ণ চেয়েছেন অর্জুনের থেকে তিনি শ্রেষ্ঠ একথা সকলে স্বীকার করুক। আজ যদি সেই অর্জুনের জীবন রক্ষার জন্য দেবরাজ ইন্দ্রকে তিনি কবচকুণ্ডল দান করেন সেক্ষেত্রে বলতে দ্বিধা নেই কর্ণ নিজের জীবনের মায়া না করে অর্জুনের জীবন রক্ষা করলেন'। 
             (….পরবর্তী সংখ্যায় দেখুন)

Post a Comment

2 Comments

  1. মহাকাব্য মহাভারতের বিতর্কিত চরিত্র সারথী পুত্র কর্ণ যে রাজপুত্র হয়ে ও আজন্ম বঞ্চিত পিতৃমাতৃ পরিচয় স্নেহ আদর থেকে। উদার দানশীল এবং মহাবীর হয়েও এক করুন রসে ভরা উপেক্ষিত চরিত্র। খুব ভালো লাগলো সেই ব্রাত্য মহাবীরের চরিত্রের এমন নিখুঁত বিশ্লেষণ।

    ReplyDelete
    Replies
    1. পর্বটি পুংখানুপুঙ্খ পড়ে আপনার সুচিন্তিত মতামত ব্যক্ত করে আপনি আমাকে নিবিড়ভাবে আবদ্ধ করেছেন ।আমি আপনার নাম জানি না ,তথাপি আমার তরফ থেকে আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাই।

      Delete