জ্বলদর্চি

একমুঠো ভিয়েতনাম /দ্বিতীয় পর্ব /স্বপন কুমার দাস

একমুঠো ভিয়েতনাম 
দ্বিতীয় পর্ব

স্বপন কুমার দাস
                    


ভিয়েতনামের রাজধানী হ্যানয় মহানগরী হলেও মহানগরীর জৌলুস চোখে পড়লো না আমার। একটি বড় শহরের মতোই মনে হলো। তবে হ্যানয়ের পথঘাট ভালই। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। যানজট ও তেমন হয়না। রাস্তার দু’ ধারের সাজানো গোছানো দোকান গুলিতে ভিড় তেমন নাই। তবে ফুটপাতের সুসজ্জিত ফুলের দোকানগুলিতে বেচাকেনা হচ্ছে ভালই। অর্থাৎ এ দেশের মানুষের সৌন্দর্য প্রীতি আছে এটা বলা যেতেই পারে। এ দেশেরও জাতীয় ফুল পদ্ম। ফুলের দোকান গুলিতে প্রচুর পদ্ম ফুলের সম্ভার চোখ এড়ায়নি আমার।
হঠাৎ কড়া ব্রেকের ধাক্কায় গাড়ি থেমে গেল। সামনে লোকে লোকারণ্য। সবাই হাঁটছে। ড্রাইভার বললো, “নাইট মার্কেটে পৌঁছে গেছি। গাড়ি আর যাবে না। এবার হাঁটতে হবে”।অগত্যা গাড়ি থেকে নেমেই আমরা হাঁটতে শুরু করলাম।
সুন্দর আলো ঝলমল প্রশস্ত রাস্তার বুকেই চলছে নাচ, গান, আনন্দ,স্ফুর্তি।

রাস্তার দু’ধারে স্ট্রিট ফুডের সাজানো সম্ভার। টুলে বসে হাজার হাজার মানুষের রসনা তৃপ্তি হচ্ছে সেখানে। এটাই এ দেশের রীতি। অভিনবত্ব।
রাস্তার দু’দিকেই সারি সারি দোকান। বাচ্চাদের নানা রকমের খেলনা আর মনোহারি জিনিসের সাজানো পসরা।আমার দেশের গ্রাম্য মেলার প্রতিচ্ছবি বললে বোধ হয় ভুল হবে না। 


জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇



তবে একটি নতুন জিনিস আমাদের শ্যেনদৃষ্টি এড়াতে পারেনি। সেটি হলো, রাস্তার ধারে এক চিলতে আসন পেতে অসাধারণ ছবি আঁকছে শিল্পীরা। সেগুলি থেকে চোখ ফেরানো মুশকিল। অবশ্য এ দেশের আর্টের বিশ্বজোড়া একটা সুনাম আছে। তা ছাড়া এটি অনেকের জীবিকাও বটে।                                                   

আমার ছেলে তো একটি এক্রাইলিক পেন্টিং কিনেই নিল শেষমেশ। শুধু কি তাই ? পছন্দের টুকি টাকি কেনাকাটা করতে করতে কাঁধের ব্যাগটা কখন যে ভর্তি হয়ে গেছে, বুঝতেই পারিনি।
রাত্রি প্রায় দশটায় আমরা নৈশভোজ সেরে নিলাম নাইট মার্কেটের স্ট্রিট ফুডেই। রাস্তার ধারে টুলে বসে আনন্দ ভোজন। মজাটাই আলাদা। দেশী বিদেশী বহু মানুষ খাচ্ছে এ ভাবেই। খাবে নাই বা কেন ? মেলা হলেও একটুও নোংরা নাই কোত্থাও। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পরিবেশ। তা ছাড়া ভিয়েতনামের মানুষগুলিও খুব অতিথি বৎসল। সমস্যা শুধু ভাষা নিয়ে। সবাই ইংরেজী জানে না। অবশ্য না জানাটাই স্বাভাবিক। অসুবিধা হলে  আকারে ইঙ্গিতে কাজ চলে যায়। যাক্, একটি নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হলো আমার অভিজ্ঞতার ঝুলিতে।
আর সামনে নয়। এবার পিছনে ফেরার পালা। নাইট মার্কেটের চোখ ধাঁধানো আলোকসজ্জা আর সুসজ্জিত দোকানগুলির মনলোভা পশরা দেখতে দেখতে রাত্রি প্রায় এগারোটায় আমরা ফিরে এলাম সেই স্টাটিং পয়েন্টে।
এই জনারণ্যে গাড়িটা খুজে বের করা সত্যিই আয়াস সাধ্য। আমাদের ভাগ্যদেবী প্রসন্ন ছিলেন বলেই অনায়াসে গাড়িটি আমরা খুঁজে পেয়ে গেলাম। তড়িঘড়ি গাড়িতে ওঠা মাত্রই গাড়ি চলতে শুরু করলো। মাঝ রাতের ফাঁকা পথ ধরে প্রায় আধ ঘণ্টার মধ্যেই আমরা ফিরে এলাম হোটেলে।
পরের দিন সকাল থেকেই আকাশের মুখ ভার। ঝিরঝিরিয়ে বৃষ্টি হচ্ছে মাঝে মাঝে। কিন্তু প্রোগ্রাম ঠাসা। বেরোতেই হবে আমাদের। হ্যানয়ের বেশ কয়েকটি দ্রষ্টব্য স্থান আজ না দেখলে, না দেখাই থেকে যাবে।
অগত্যা সকাল ন’টার মধ্যেই হোটেলে প্রাতঃরাশ শেষ করেই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম আমরা। সঙ্গী মাত্র দু’টি ছাতা। যদিও তা দিয়ে মাথা বাঁচলেও শরীর বাঁচবে না পাঁচটি প্রাণির। কিন্তু নান্য পন্থা। সুযোগ হলে আর একটি ছাতা কিনে নেওয়া যাবে ‘ক্ষণ।
চল্লিশ মিনিটের মাথায় গাড়ি গিয়ে থমলো হো চি মিন্ কমপ্লেক্স-এর এন্ট্রান্স গেটের সামনেই। হাল্কা বৃষ্টি হয়েই চলেছে। বৃষ্টির মধ্যেই মানুষের ভিড়। অবশ্য সবাই পর্যটক। ছাতা কিংবা টুপি মাথায় দিয়েই সোৎসাহে হাঁটছে সবাই।
কড়া সিকিউরিটি চেকিং-এর পর আমরা ঢুকে পড়লাম কমপ্লেক্সের ভিতর। প্রসস্ত ঝাঁ-চকচকে রাস্তা ধরে আমরাও হাঁটা শুরু করলাম। রাস্তার দু’ধারে সাজানো বাগানে ফুটন্ত ফুলের জলসায় নৃত্যপটিয়সী বর্ষার নাচন দেখতে দেখতে এগিয়ে চলেছি সামনে। 

ভাগ্যদেবী বোধ হয় আমাদের প্রতি প্রসন্ন ছিলেন। হঠাৎ সামনে এলো একটি ছাতার দোকান। বৌমা কাল বিলম্ব না করেই একটি ভিয়েতনামি ছাতা কিনেই আমার হাতে ধরিয়ে দিল। সব সমস্যার নিরসন হলো। অবশ্য বৃষ্টিও দীর্ঘ স্থায়ী হলো না। কিছুক্ষণের মধ্যেই রোদ উঠলো ঝলমলিয়ে।
দেখার মতো অনেক কিছুই আছে এই কমপ্লেক্স-এ। এক দিনে সবটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা বেশ কষ্টসাধ্য। তবুও চেষ্টার ত্রুটি ছিল না আমাদের।
প্রথমেই এলো হো চি মিন-এর সমাধিসৌধ। প্রায় তিন দশক ধরে উপনিবেশিকতা বিরোধী জাতীয় আন্দোলনকে নেতৃত্ব দিয়ে ভিয়েতনামে স্বাধীনতার প্রথম  সূর্যোদয় ঘটিয়েছিলেন যে মানুষটি, তিনি আর কেউ নন ভিয়েতনামের মনের মানুষ, প্রাণের মানুষ হো চি মিন। তিনি অবশ্য আঙ্কল হো নামেই বেশি পরিচিত। তাঁর নামাঙ্কিত এই কমপ্লেক্সে আজও সযত্নে রক্ষিত আছে তাঁর সমাধি মন্দির। 

তাঁর সমাধি মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে চোখে ভেসে উঠলো স্কুলজীবনে পড়া ভিয়তনামের স্বাধীনতা যুদ্ধের রক্তাক্ত ইতিহাস। আমি ইতিহাসের ছাত্র না হলেও স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস পড়তে বড্ড ভালবাসতাম। আমার দাদু ছিলেন একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী। তা ছাড়াও ছোটবেলায় বাবার কাছে শুনেছি আমার দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ভয়াবহ ইতিহাস। মনের অজান্তে আমি কখন যে স্বাধীনতার ইতিহাসের একজন ভাল পাঠক হয়ে গেছি, তা আমি নিজেই বুঝতে পরিনি।
হ্যাঁ, আমি পড়েছি। তন্ন তন্ন করে পড়েছি ভিয়েতনামের স্বাধীনতা যুদ্ধের সুদীর্ঘ রক্তাক্ত ইতিহাস। মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছি স্বাধীনতা যুদ্ধের ভয়াবহতা। ইতিহাসে  আছে, ফরাসী সম্রাট ষোড়শ লুই এর আমলে যখন ভিয়েতনাম চলে গিয়েছিল ফরাসীদের কব্জায়, তখনই তৈরী হয়েছিল ‘ভিয়েতনামিজ কমিউনিস্ট পার্টি’। এবং সেই পার্টির সর্বাধিনায়ক ছিলেন হো চি মিন। পরবর্তীকালে  এই পার্টিরই নাম হয়েছিল ‘ইন্দোচীন কমিউনিস্ট পার্টি’।
১৯৪৪-৪৫ সালে জাপান ও ফ্রান্সের যৌথ শোষণে যখন ভিয়েতনামে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ হয়, সেই সময়কালে মার্কিন বাহিনী হিরোসীমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক  বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়। ফলে জাপান দুর্বল হয়ে পড়ে। সেই সুবর্ণ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ১৯৪৫ সালের ২-রা সেপ্টেম্বর ভিয়েতনামে প্রথম স্বাধীনতার সূর্যোদয় ঘটে। ভিয়েতনামে প্রতিষ্ঠিত হয় গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র। এই সরকারকে নেতৃত্ব দেন অবিসংবাদিত কমিউনিস্ট নেতা হো চি মিন। তিনিই হলেন ভিয়েতনামের জাতির জনক। তাঁর সমাধিক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে তাঁর উদ্দেশ্যে শতকোটি প্রণাম জানিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করলাম।
একটু পরেই সামনে এগিয়ে এলো হো চি মিন-এর বাস ভবন। অতি সাধারণ কাঠের পাটাতন যুক্ত একটি দ্বিতল বাড়ি। সেখানেই আছে তাঁর অফিস ঘর। বিলাসিতার চিহ্নমাত্র নেই সেখানে। আছে তাঁর ব্যবহৃত জিনিসপত্র। আছে সেই গাড়িটিও, রাষ্ট্রপতি হো চি মিন যেটি ব্যবহার করতেন। আছে বাসগৃহ সংলগ্ন একটি সুসজ্জিত ফল ও ফুলের বাগান। একটি পুকুর ও আছে।
ভাবতে অবাক লাগে-রাষ্ট্রপতি হো চি মিন কোনদিন বিলাসবহুল রাষ্ট্রপতি ভবনে বাস করতে সম্মত হননি। আমৃত্যু অতি সাধারণ ছিল তাঁর জীবনযাত্রা। তাই আজও সযত্নে রক্ষিত আছে তাঁর সমস্ত স্মৃতি।
এই কমপ্লেক্সে আছে ভিয়েতনামিজ উইমেন’স মিউজিয়াম।  লাক্ষা দিয়ে তৈরী হস্তশিল্প সামগ্রী তৈরীর একটি কেন্দ্র ও আছে এখানে। আছে একটি প্যাগোডাও।
নির্দিষ্ট সময়ে দেখা শেষ করে আমরা ফিরে এলাম কমপ্লেক্স গেটে। গাড়ি দাঁড়িয়েই ছিল। সওয়ার হলাম সব্বাই। আবার ছুটলো গাড়ি।                                                        ক্রমশ …….


Post a Comment

0 Comments