জ্বলদর্চি

মহাভারতের কর্ণ - এক বিতর্কিত চরিত্র -১২/দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

মহাভারতের কর্ণ - এক বিতর্কিত চরিত্র                                               
দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী                                                দ্বাদশ পর্ব                        


দ্রৌপদী বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করলেন " ভীষ্ম বা দ্রোণ অপেক্ষা ভয়ঙ্কর ভীষণ যোদ্ধা কৌরবপক্ষে কে আছে"?  " আছে সখি, তুমি কি মহারথী কর্ণের কথা বিস্মৃত হয়ে গেলে"? "কর্ণ কি এঁদের থেকেও বীর"? দ্রৌপদীর এই প্রশ্নের উত্তরে বাসুদেব বললেন "তুমি ভুলে গেলে কেন কর্ণ ও ভীষ্ম উভয়েই জামদগ্নির শিষ্য। ভীষ্ম যেমন ভয়ংকর কর্ণও তেমনিই। তোমার স্বয়ম্বরকালে উপস্থিত সমস্ত নৃপতিকুলের মধ্যে একমাত্র কর্ণই লক্ষ্যভেদ করেছিলেন। কর্ণ যেদিন ভয়ঙ্কর হবেন সেদিন কেবলমাত্র অর্জুন ছাড়া অন্য কোন পাণ্ডবভ্রাতা বা বীর তাঁর সঙ্গে জয়লাভ করতে পারবে না"। 
দ্রৌপদী চিন্তাক্লিষ্ট হয়ে জিজ্ঞেস করলেন "তাহলে কি উপায়? তাহলে তিনি তো এখনো সেইরকম ভয়ঙ্কর আছেন"। বাসুদেব ঈষৎ হাস্যে বললেন "আমি সেই ভয়ঙ্কর সাপের বিষ দাঁত ভাঙার ব্যবস্থা করেছি"। বিস্মিতা দ্রৌপদী প্রশ্ন করলেন "কিভাবে"? বাসুদেব বললেন "এখন সব কথা বলার সময় আসেনি, বরাননে। একদিন সব কথা প্রকাশ পাবে তখন জানতে পারবে, অধৈর্য হয়ো না"। 
দ্রৌপদী পুনরায় প্রশ্ন করলেন "যিনি শৌর্যে বীর, উৎপীড়িতের সহায়, ন্যায়-নীতির ধারক, দানবীর বলে জেনে এসেছি দ্যূতসভায় তাঁর আচরণ ও কদর্য বাক্যবাণ কি তারই পরিচায়ক ছিল"? ঈষৎ হাস্যে বাসুদেব বললেন "স্ত্রীজাতি পুরুষের উপরের কদর্য রূপটাই দেখে। তুমি কি তাঁর বলার প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত বুঝতে পারনি, যদি না বুঝে থাকো যুদ্ধ শেষে সে কথা ব্যক্ত করব" - এই বলে বাসুদেব নিজের তাঁবুতে ফিরে গেলেন। 
বাসুদেবের প্রহেলিকাময় শেষের কথাগুলি কৃষ্ণা হৃদয়ঙ্গম করতে পারলেন না। কিন্তু কি এক অজ্ঞাত কারণে কর্ণের প্রতি তার হৃদয় দৌর্বল্য পরবর্তীতে প্রকাশ পেয়েছিল।
কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের দশম দিনে অর্জুনের বাণে কুরু পিতামহ ভীষ্ম শরশয্যা নিলেন। সূর্যের উত্তরায়ন পর্যন্ত তিনি এইভাবে শরশয্যায় শায়িত থাকবেন। তারপর তিনি নিজের ইচ্ছায় অমৃতলোকে গমন করবেন। তার পিপাসা নিবারণের জন্য অর্জুন ধরিত্রীর বুকে শর নিক্ষেপ করে পাতালবাহিনী ভোগবতীর স্নিগ্ধ বারিধারা আনয়ন করে পিতামহ ভীষ্মর পিপাসা নিবারণ করেছেন। রাত্রির তৃতীয় প্রহর অতিক্রান্ত হওয়ার পরে ভীষ্মের সামান্যতম তন্দ্রা এসেছিল। সেই সময় কারও সন্তর্পন পদশব্দে সচকিত হয়ে ভীষ্ম প্রশ্ন করলেন "কে"?  বাষ্পরুদ্ধ ক্ষীণকণ্ঠে কর্ণ বললেন "পিতামহ, যে ব্যাক্তি চিরকাল আপনার নয়ন পথে আসা মাত্র আপনার অন্তরে বিদ্বেষ ও বিরক্তি উৎপাদিত হতো - আমি সেই অধিরথ সুতপুত্র রাধেয় কর্ণ। পিতামহের চতুর্দিকে যেসকল সশস্ত্র রক্ষীরা পাহারারত ছিল তাদের তিনি ইঙ্গিতে দূরে যেতে বললেন যাতে কর্ণের সঙ্গে তার কথোপকথন কারও শ্রুতিগোচর না হয়। 
সশস্ত্র রক্ষীরা দূরে যাওয়ার পরে তিনি কর্ণকে নিকটে আসার ইঙ্গিত করে বললেন " ভ্রাত, তুমি দূরে না থেকে আমার নিকটে এস"। কর্ণ নিকটে আসার পরে তিনি দক্ষিণ হস্ত প্রসারিত করে জড়িয়ে ধরে বললেন "কর্ণ, আমি তোমার প্রতি কখনো বিদ্বেষ পোষণ করি নি, কিন্তু তোমার আচার-আচরণ, শাণিত বাক্যে আমি বিরক্তি বোধ করেছিলাম, ক্ষুব্ধ হয়েছিলাম। তুমি মহাবীর, মহান যোদ্ধা। তুমি, আমি একই গুরুর নিকটে অস্ত্রশিক্ষা করেছি। তোমার মত এক বীরকে পাপিষ্ঠ দুর্যোধনের অধীনে ভিক্ষালব্ধ রাজ্যখন্ডে করদরাজা হিসেবে তার চাটুকারিতা করতে দেখে আমার ক্রোধ উপস্থিত হতো। অথচ ন্যায়ত ও ধর্মত এই রাজ্যখন্ড তার নয়। তোমার শৌর্য বীর্যের পরিমাণ আমার নিকট অবিদিত নেই। তুমি স্বীয় বাহুবলে রাজ্য জয় করে স্বাধীনভাবে সকলের সম্মানের পাত্র হতে পারতে। তোমাকে প্রতিনিয়ত উদ্বুদ্ধ করার জন্য আমি নিত্য ধিক্কারে জর্জরিত করেছি যাতে তোমার মধ্যে সুবুদ্ধির উদয় হয় সেই আশায়। কপট দ্যূতসভায় তোমার আচরণে যদিও আমি ক্ষুব্ধ হয়েছিলাম ও তোমাকে ধিক্কৃত করেছিলাম কিন্তু আমি নিশ্চিত ছিলাম যে তোমার অশালীন বাক্য দ্বারা তুমি পান্ডবদের উদ্বুদ্ধ করতে চেয়েছিলে। তুমি রাধেয় নও, তুমি কৌন্তেয়, পান্ডু মহিষী কুন্তীর তুমি জ্যেষ্ঠ সন্তান - সে কথা কি অবগত হয়েছি"? 


জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇


অস্ফুট কন্ঠে কর্ণ উত্তর দিলেন "আমার সেই জন্মরহস্য প্রথমে স্বয়ং যদুপতি শ্রীকৃষ্ণ এবং পরে পান্ডব জননীর মুখে অবগত হয়েছি"। সব শুনে ভীষ্ম বললেন "তাহলে ভ্রাতা, তুমি কালবিলম্ব না করে তোমার প্রাপ্য স্থান অধিকার করতে দ্বিধা করছ কেন?  তুমি অদ্যাবধি যুদ্ধে যোগদান করনি। তুমি পাণ্ডব শিবিরে যোগদান করে তোমার প্রাপ্য রাজ্য জয় করে নাও"। 
এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে কর্ণ বললেন " পিতামহ, আপনি কেন পারেননি পাণ্ডব শিবিরে যোগ দিতে? তারাও তো আপনার স্নেহের পাত্র। আপনার তো দুর্যোধনের নিকটে কোন ঋন ছিলো না। আপনার ভরণপোষণের জন্য যে অর্থ ব্যয় হয়েছে সে তো হস্তিনাপুরের রাজকোষ থেকে। ধর্মত ও ন্যায়তঃ হস্তিনাপুরের রাজ্য মহাত্মা যুধিষ্ঠিরের প্রাপ্য। অন্যায় ভাবে তাঁকে বঞ্চিত করে দুর্যোধন সব দখল করে রেখেছে একথা আমি স্বীকার করছি। কেন আপনি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধনুর্ধর হয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ বিসর্জন দিতে উদ্যোগী হলেন। কার্যত এই  অধর্মযুদ্ধে নিশ্চিত পরাজয় জেনেও সেই হতভাগ্যকে ত্যাগ করতে পারলাম না। আর আমার জন্মের পরে পান্ডবজননী আমাকে বিসর্জন দিয়েছিলেন। সেদিন সুত অধিরথ ও তার স্ত্রী রাধা আমাকে গঙ্গাবক্ষ থেকে তুলে এনে প্রাণ দান করে নিজ পুত্রের মত আমাকে বড় করে তুলেছেন। সুতপুত্রের পরিচয় ত্যাগ করে তাঁদের বৃদ্ধ বয়সে তাঁদেরকে ত্যাগ করে চলে যাওয়া কি আমার পক্ষে চরম কৃতঘ্নতার পরিচয় হবে না? অস্ত্র পরীক্ষাকালে লোভী, অহংকারী, পাপপরায়ন দূর্যোধন আমাকে মিত্র বলে স্বীকার করে আমাকে রাজ্য দান করেছিল। তার উপকারের বিনিময়ে তার দুর্দিনে আমি তাকে ত্যাগ করে চলে গেলে আমি কি ন্যায়তঃ ধর্মচারী হব? একই রক্তের আকর্ষণে বারবার আমি অর্জুনের কাছে যেতে চেয়েছিলাম কিন্তু আমার জন্মদাত্রীর অপরিণামদর্শিতা ও অবিবেচনার জন্য সে আমার কাছে শত্রুরূপে পরিগণিত হয়েছে। বলুন তো পিতামহ কৈশোরে অস্ত্র পরীক্ষাকালে আমার জন্মদাত্রী বা আপনি কি সর্বসমক্ষে আমার পরিচয় দিতে পারতেন না? আপনারাই তো এই বৈরীভাবের সূচনা করে দিয়েছেন। আজ আমি যদি পান্ডব শিবিরে যোগ দিই সে ক্ষেত্রে সমগ্র ক্ষত্রিয় সমাজে আমি লোভী স্বার্থপরায়ন বলে বিবেচিত হব। আপনি বরং আমাকে আশীর্বাদ করুন যাতে চির দুর্বিনীত পাপিষ্ঠদের দলে থেকে আগামীকাল থেকে পান্ডবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারি এবং যুদ্ধে ক্ষত্রিয়ের পরম গতি মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে আমার ভাগ্যপীড়িত, চিরবঞ্চিত জীবনের অবসান ঘটাতে পারি"। 
ভীষ্ম গাঢ়কন্ঠে হৃষ্টচিত্তে বলে উঠলেন "ধন্য তুমি, ধন্য কর্ণ। তোমার প্রতিটি ক্ষুরধার যুক্তি শ্রবণ করার পরে আমার আর কোনো বক্তব্য নেই। আমি তোমাকে অকুণ্ঠচিত্তে আশীর্বাদ করছি নিষ্কাম চিত্তে পুণ্য কামনায় ধর্মযুদ্ধ করে তুমি স্বর্গধামে গমন কর। জীবনেও যেমন তুমি মহান মৃত্যুতেও তুমি গরীয়ান হয়ে থাকবে"।               কর্ণ অশ্রুসজল চোখে পিতামহের পাদযুগলে নিজ মস্তক নত করে নীরবে বিদায় নিলেন। 
                                                  ………….পরবর্তী সংখ্যায় দেখুন

Post a Comment

0 Comments