জ্বলদর্চি

জঙ্গলমহলে জৈন ধর্ম ও সরাক সম্প্রদায়- ২য় পর্ব /সূর্যকান্ত মাহাতো

জঙ্গলমহলের জীবন ও প্রকৃতি

পর্ব - ৬৩

জঙ্গলমহলে জৈন ধর্ম ও সরাক সম্প্রদায়- ২য় পর্ব

সূর্যকান্ত মাহাতো


"হাজার বছরেরও বেশি প্রাচীন জৈন ধর্মীদের বর্তমান 'মনুষ্যাবশেষ'(human relics) বলে পরিচিত সরাকদের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্যের কথা ডালটন সাহেব উল্লেখ করেছেন। সেটা হল, ব্রিটিশ আমলে কোন অপরাধের জন্য তারা নাকি শাস্তি পায়নি। এইজন্য তারা খুব গর্বও অনুভব করে।"(পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি/বিনয় ঘোষ, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা ৪৪৯)

"তারমানে ব্রিটিশ অত্যাচারের বিরুদ্ধে জঙ্গলমহলের অন্যান্য জাতি ও সম্প্রদায় যখন গর্জে উঠেছিল সরাকরা তখন নীরবতা বজায় রেখেছিল! ডালটনের কথা ধরলে, তার মানে পরবর্তীকালে অর্থাৎ স্বাধীনতা আন্দোলনেও নিশ্চয়ই তারা কোন রকম ভাবেই অংশ নেয়নি? এমনটা তো ধরে নেওয়া যেতেই পারে। যেখানে চুয়াড় বিদ্রোহের মতো একটার পর একটা বড় বড় বিদ্রোহ জঙ্গলমহল জুড়ে গড়ে  উঠেছিল!"

"না। তার কারণটাই ছিল তাদের ধর্মীয় আদর্শ।"

"কী রকম সে আদর্শ?"

"সরাকরা কোনরকম বিদ্রোহ বা আন্দোলনের পক্ষে নয়। এটা তাদের 'নীতি বিরুদ্ধ'। এই প্রসঙ্গে ই.টি. ডালটন একটি ভালো কথা বলেছেন, "They are essentially quiet and law abinding community living in peace among themselves and with their neighbours."
তারা সর্বদাই অহিংস থাকার চেষ্টা করে। সে কারণে তারা 'কাটা' শব্দটি কোনদিন ব্যবহার করেনি। প্রাণী হত্যার ঘোর বিরোধী বলেই রক্তের মতো 'লাল' কোন কিছুই তারা খায়নি। যেমন লাল পুঁইশাক, গাজর, লাল সিম, ব্যাঙের ছাতা, ডুমুর প্রভৃতি। তাদের নিষিদ্ধ খাদ্য তালিকা নিয়ে একটি মজার ছড়ার কথা উল্লেখ করেছেন যুধিষ্ঠির মাজী তাঁর গ্রন্থে,

"উমুর ডুমুর পুড়ুং ছাতি
তিন খায় না সরাক জাতি।"

"এ ছাড়াও আরো কতকগুলো বৈশিষ্ট্যের কথা ডাল্টন সাহেব বলেছেন, যেমন দেখতে সুন্দর ও বুদ্ধিদীপ্ত চেহারার সরাকরা পিছনের চুলগুলো উঁচু করে গুলি পাকিয়ে বাঁধে। সূর্য না উঠলে খাবার যেমন খায় না তেমনি প্রাণী হত্যাও করে না। একমাত্র পার্শ্বনাথের পুজো করে তারা।"

"এখন পুরুলিয়াতে অনেক জৈন মন্দির শিব মন্দিরে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে বরাকরের বহু সুন্দর সুন্দর পাথরের তৈরি অনেক জৈন মন্দির পরবর্তীকালে শিব মন্দিরে রূপান্তরিত হয়েছে। এটা কি হিন্দু ও ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রভাব নাকি সরাকরাও শৈব ছিলেন?"

"সরাসরি শৈব ছিলেন কিনা সেটা বলা শক্ত। তবে এখানকার সরাকরা বরাবরই শিবের উপাসক। এতে হিন্দু বা ব্রাহ্মণ সংস্কৃতি প্রভাবের ফল আছে বলে মনে হয় না। জৈন তীর্থঙ্কর ঋষভদেব যে এখানে মহাদেবে রূপান্তরিত হয়েছেন তার বরং একটা যুক্তি খোঁজার চেষ্টা হয়েছে।"

"কী রকম যুক্তি।"

"তিব্বতীদের কাছে তীর্থঙ্কর 'ঋষভদেব' হলেন 'ধর্মপাল'। তিনি আবার কৈলাসের অধিষ্ঠাতা দেবতা। তারও পরনে বাগছাল, গলায় নরমুণ্ডের মালা, হাতে ডমরু, এবং ত্রিশূল। যেন শিবেরই অভিন্ন রূপ।(সরাক সংস্কৃতি ও পুরুলিয়ার পুরাকীর্তি/ যুধিষ্ঠির মাজী,পৃষ্ঠা- ১৮) তাই শিব পূজা আসলে তাদের গোত্র পিতা ঋষভদেবেরই পূজা বলে তাদের ধারণা।"


জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇



"সরাকদের জৈন মন্দিরগুলো যেভাবে শিব মন্দিরে পরিণত হয়েছে তার কি কোন কারণ জানা গেছে?"

"বরাকরের জৈন মন্দিরগুলোর শিব মন্দিরে রূপান্তর বিষয়ে একজন 'রাণী'-র ভূমিকার কথা শোনা যায়। তার নাম 'রাণী হরিপ্রিয়া'। ১৪৫৯ খ্রিস্টাব্দে এই রাণীই নাকি মন্দিরগুলোর 'জৈন বিগ্রহ' সরিয়ে 'শিব লিঙ্গ' প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।"

"এ বিষয়ে প্রামাণ্য কোন তথ্য কিছু আছে কি? নাকি একজন রাণীর নাম নিয়ে সেটার গুরুত্ব বাড়ানো হয়েছে?"

"এটাই তো আমাদের দোষ। যা কিছু আমাদের অজানা তাকেই অস্বীকার করার একটা প্রবণতা থাকে। সেখানে জানার চেষ্টা ততটা থাকে না। 'রাণী হরিপ্রিয়া' সম্পর্কে সব থেকে বড় প্রমাণ হল, ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টার(W. W. Hunter) এর 'Statistical Account of Bengal, Vol- XVII' গ্রন্থটি। সেখানে পরিষ্কারভাবে বলা আছে
"On the most modern is an inscription in old Bengali dated 1383 of the saka era. Corresponding to A.D. 1455 recording the dedication of some idols by Haripriya the favourite wife of a king."

"সরাকদের পদবী আসলে কী?"

"অনেক আগে তথা মধ্যযুগে সরাকদের কোন পদবীই ছিল না। সরাসরি তারা 'সরাক' শব্দটাই নামের শেষে ব্যবহার করত। পরবর্তীকালে সিং, মাজী, মন্ডল, নায়েক, পাত্র, বৈষ্ণব প্রভৃতি পদবীর ব্যবহার শুরু হয়েছে। এই পদবীগুলো আবার রাজাদের দেওয়া বলে মনে করা হয়। তবে এই পদবীগুলো কেবল পশ্চিমবঙ্গের সরাকদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। সরাকদের মূল গোত্র হল দুটো, 'আদিদেব' ও 'ঋষিদেব' বা ঋষভদেব। এছাড়াও কমবেশি 'শান্ডিল্য', 'কাশ্যপ', 'অনন্তদেব', 'ভরদ্বাজ', 'গৌতম' প্রভৃতি গোত্রও কমবেশি প্রচলিত রয়েছে।"

"আগে সরাকরা যে পদবী ব্যবহার করত না, তার কি কোন প্রমাণ আছে?"

"আছে। 'কৃষ্ণলীলামৃতসিন্ধু' ও 'শ্রীরূপ সনাতন সংবাদ ও উপাসনা' নামে দুটি গ্রন্থই তার সবথেকে বড় প্রমাণ।"

"এমন গ্রন্থের নাম তো কখনো শুনিনি!"

"পুরুলিয়ার রঘুনাথপুর থেকে 'কৃষ্ণলীলামৃতসিন্ধু' গ্রন্থটির পান্ডুলিপি আবিষ্কৃত হয়েছিল। রচয়িতা হলেন জগৎ রামের পুত্র রামপ্রসাদ রায়। রানীগঞ্জের টি.ডি.বি. কলেজের অধ্যাপক ডক্টর বিশ্বনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এই গ্রন্থ নিয়ে গবেষণা করেই ডক্টরেট ডিগ্রী লাভ করেন।পুঁথিটি তার কাছেই গচ্ছিত আছে। এই গ্রন্থে প্রথম 'রামদুলাল সরাক' বলে একজনের নাম পাওয়া যায়। এই আবিষ্কৃত প্রাচীন গ্রন্থের আরও একটি গুরুত্ব হল, সরাকরা যে সাহিত্য সংস্কৃতির চর্চা করতেন এই গ্রন্থ তারও একটা বড় প্রমাণ।(সরাক সংস্কৃতি ও পুরুলিয়ার পুরাকীর্তি, পৃষ্ঠা -১৯)
দ্বিতীয় যে বইটি 'শ্রীরূপ সনাতন সংবাদ ও উপাসনা' তার খন্ডিত পান্ডুলিপিটি ছিল শ্রীধরম সিং(সরাক) এর হস্তাক্ষরে রচিত। ১১৯১ সালের ১৫ই ফাল্গুন এই পান্ডুলিপির কাজ শেষ হয়েছিল। তার মানে সরাকদের 'সিং' পদবীটি ১১৯১ সালে বা তার পরবর্তী সময়ে ব্যবহৃত হয়েছে। এমনকি তাদের পদবী লাভও ওই সময়কেই ধরা যায়।"

"কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তী তার চন্ডীমঙ্গল কাব্যে সরাকদের সম্পর্কে বলতে গিয়ে লিখেছেন,

"সরাক বসে গুজরাটে জীবজন্তু নাহি কাটে
সর্বকাল করে নিরামিষ।
পাইয়া ইনাম বাড়ি বুনে নেত পাট শাড়ি
দেখি বড় বীরের হরিষ।"

"তারা জৈন সম্প্রদায় বলে প্রাণী হত্যা করে না। তাই তারা নিরামিষাশী। এটা তো জানা কথা। কিন্তু তারা যে কাপড় বোনার কাজ করত বা তাঁতের কাজ করত এটা তো জানা ছিল না। এটা কি তাদের পেশা ছিল?"

"সেটা তো ছিলই। তবে এখন যেমন চাষবাসের পাশাপাশি ব্যবসা-বাণিজ্যও করে। আবার তাদের একটি অন্যতম পেশা হল মহাজনি কারবার।আসলে সরাকরা হলেন বরাবরই শিল্পীর জাত। ভাস্কর্য শিল্প কিংবা মন্দির নির্মাণ ছিল তাদের মধ্যে অন্যতম। পুরুলিয়ার ছড়া, তেলকুপী, পাকবিড়রা, দেউলঘাটা, দুলমি, পবনপুর, বোড়াম, পাড়া, ছড়রা, সেনেড়া প্রভৃতি অঞ্চলে যে জৈন মন্দিরগুলো নির্মিত হয়েছিল সেগুলো সরাকদের হাতেই তৈরি হয়েছিল। যদিও পরবর্তীকালে হিন্দু ব্রাহ্মণরা সরাকদের সেইসব নির্মিত বহু মন্দির ও ভাস্কর্যকে নষ্ট করে দেয়।"

"সরাকরা কাপড় বুনত বলে 'ব্রহ্মবৈবর্ত' পুরাণে তাদেরকে 'জোলা' বলে উল্লেখ করা হয়েছে..."

"আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, এটাকে গোঁড়া ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের একটা পরশ্রীকাতরতা ও চক্রান্ত বলা যেতে পারে।"

"এ কথা মনে হওয়ার কারণ।"

"কারণ সরাকদের তসর ও পাট শিল্পের দক্ষতা ও সুনাম ব্রাহ্মণরা সেইসময় সহ্য করতে পারেনি। তাই তাদের 'জোলা' বলে উপহাস করেছিলেন।(সরাক সংস্কৃতি ও পুরুলিয়ার পুরাকীর্তি, পৃষ্ঠা- ৭) জোলাদের কাপড় বোনার সঙ্গে সরাকদের কাপড় বোনার একটা তফাত আছে। জোলারা মোটা কাপড় বুনে। কিন্তু সরাকরা মোটা কাপড় তো বুনতই না, তারা ছিলেন কেবল নেত ও পাট শিল্পী।"

"কিন্তু আপনি কোন তথ্যের ভিত্তিতে 'ব্রহ্মবৈবর্ত' পুরাণকে বিভ্রান্তিকর বলছেন?"

Gazetter of Manbhum District গ্রন্থে G. Coupland এই সম্পর্কে কি বলেছেন দেখো, তাহলে তোমার উত্তর পেয়ে যাবে
"The origin of the cast is ascribed in the Brahma Vai bartha purana to the union of Jolha man with a woman of the kuvinda or weaver cast. This however merely shows that at the time when the puran was composed or when the passage was interpolated the saraks had already taken to wearing as a means of livelihood."
"আসলে সরাকরা যেহেতু শিল্পীর জাত তাই একটা সময় তারা তাদের সেই সৃজনশীলতাকে নেত ও পাট শিল্প বোনার কাজে লাগিয়েছিল। সরাকদের মেয়েরাও সৃজনশীল ও শৈল্পিক কাজে দারুণ রকমের দক্ষ। তাদের শিল্প প্রতিভাকে ফুটিয়ে তুলতেন বাড়ির নানারকমের দেওয়াল চিত্রের মধ্য দিয়ে। পুরুলিয়ায় দেওয়াল চিত্রের বহর দেখেই সরাকদের বাড়িগুলো চিনে নেওয়া যায়।"

"কী ধরণের ছবি থাকে সেখানে?"

"কোথাও হয় তো বর্গক্ষেত্রের উপর নাগ সাপ, বৃত্ত করে আঁকা পদ্ম, বাগান বেড়, দুর্গার মেড় এই ধরণের সব জটিল চিত্র। শিল্পকলা যেন তাদের রক্তে। যেকোন কাজেই তারা সেটা প্রকাশ করে। এমনকি মকরের সময় যে পিঠা বানায় সেগুলোকেও নানান নকশার আকার দিয়ে গড়ে তুলে।" 

"সরাকদের বিবাহ রীতিও অনেকটা ব্যতিক্রমী।

"কী রকম?"

"সরাকদের বিবাহ অনুষ্ঠানে কোন রকমের ফুলশয্যা বা বাসর রাত্রি নেই। এমন কি বিয়ের পর বর ও কনেকে বেশ কিছুদিন আলাদা রাখারও চল আছে।"

"এমন ব্যতিক্রম কেন?"

কারন তাদের ধারণা এই সময়কাল হল তাদের মিলনের সময়কাল। আর এই মুহূর্ত বা সময়ে তাদের মধ্যে যদি দূরত্ব তৈরি করতে পারা যায়, তাহলে মনের মধ্যে মিলনের আকাঙ্ক্ষা আরো বহুগুণ বেড়ে যাবে। তাই দ্বিরাগমনের প্রথা এই সম্প্রদায়ের মধ্যে দারুণ রকমের জনপ্রিয়। বিয়ের সময় বরের মাথায় টোপর থাকে না। থাকে পাগড়ি ও মোড়।"

"সরাকদের উপর হিন্দু ব্রাহ্মণদের আক্রমণটা ঠিক কখন ঘটেছিল?"

সপ্তম শতাব্দীতে। তবে দশম থেকে চতুর্দশ শতাব্দীতে সেই মাত্রা বহুগুন বেড়ে গিয়েছিল।তারপর বর্গী আক্রমণকে যদি ধরা হয় তবে মধ্যযুগকেই চিহ্নিত করা যেতে পারে। কারণ ওই সময় 'কালুবীর' নামেও এক দুর্ধর্ষ হানাদার সরাকদের উপর আক্রমণ করেছিল।"

"'কালুবীর' বলে তো কোন যোদ্ধার নাম শুনিনি। তার তথ্য কীভাবে পেলেন?"

এক প্রাচীন টুসু গানে এই কালুবীরের নামের উল্লেখ রয়েছে।
'কালুবীর কালুবীর বিজয় আগমন
সরাক পাড়াতেরে দিলেক দরশন
সরাকদের একে একে মারল ধরিয়া
সরাকদের হাল জোয়ালটা রইল পড়িয়া।'

পুরুলিয়ায় জৈন ধর্মাবলম্বী সরাক সম্প্রদায়ের তৈরি এক প্রাচীন শিল্প সভ্যতার ধ্বংসসাধন আজও তাই নানা বিতর্কে জর্জরিত।

তথ্যসূত্র: ১) সরাক সংস্কৃতি ও পুরুলিয়ার পুরাকীর্তি/ যুধিষ্ঠির মাজী
২) পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি/ বিনয় ঘোষ
৩) অহল্যাভূমি পুরুলিয়া(১ম পর্ব) সম্পাদনা- দেবপ্রসাদ জানা

Post a Comment

1 Comments