জ্বলদর্চি

প্রয়াত লিটল ম্যাগাজিনের প্রাণপুরুষ সন্দীপ দত্ত। শ্রদ্ধা ও স্মরণে কলম ধরলেন লেখক শিল্পীরা।


প্রয়াত লিটল ম্যাগাজিনের প্রাণপুরুষ সন্দীপ দত্ত। শ্রদ্ধা ও স্মরণে কলম ধরলেন লেখক শিল্পীরা।


লিটল ম্যাগাজিনের লেখক কবিরা একজন স্নেহশীল অভিভাবক হারালেন 
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
(কথাসাহিত্যিক) 

সন্দীপের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল,  তবে যোগাযোগ নেই অনেক দিন, আজকাল এরকমই হয়েছে। তবে আমরা যেমন লিটল ম্যাগাজিন সম্পর্কে উদাসীন , তেমনটি তিনি ছিলেন না। এক প্রগাঢ় ভালবাসা দিয়ে তিনি লিটল ম্যাগাজিনের একটি অমিত মূল্যবান গ্রন্হাগার তৈরি করেছিলেন । এইরকম উদ্যোগ নেওয়ার মতো বুকের পাটা ক'জনের আছে ? তাঁর এই অসাধারণ কাজটির জন্য  তিনি অবশ্যই স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। লিটল ম্যাগাজিনের লেখক কবিরা একজন স্নেহশীল অভিভাবক হারালেন । 


ফাল্গুনের পথ না ভোলা পথিক
অনিতা অগ্নিহোত্রী
(কবি, সম্পাদক, কথাসাহিত্যিক) 

বাঙালির একক চেষ্টায় যে সব গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়েছে এবং দীর্ঘ জীবন পেয়েছে তার মধ্যে সন্দীপ দত্তের লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি অন্যতম, সাম্প্রতিকতমও বটে। ফেসবুকে যে শোকের উচ্ছ্বাস  আজ দেখছি তা একই সঙ্গে দেখাচ্ছে,  কত  মানুষ সন্দীপ দত্তের কাছে ঋণী ছিলেন এবং কী পরিমাণ  ভালোবাসা পেয়েছেন তিনি। গত বছর বার্ষিক সমাবর্তন অনুষ্ঠানে গিয়ে ছাত্রছাত্রী-গবেষকদের কথা শুনে তার একটা আন্দাজ পেয়েছিলাম। ওই অনুষ্ঠানে যাওয়ার নিমন্ত্রণও আমার চেয়েই নেওয়া। সন্দীপদাকে বলেছিলাম, একবার  ডাকবেন আমাকে। বিশাল গাছের মতো মানুষটির কাছে অনায়াসে চাওয়া যায়, এটা  জানতাম। যেবার ডাকলেন,  আমি কলকাতার বাইরে।  কাজেই আব্দার করলাম, পরের বারের জন্য। তাও হল। বহু প্রিয় বন্ধু সম্পাদকের সঙ্গে একটি মনোজ্ঞ সন্ধ্যা কাটিয়ে এলাম। সন্দীপদা একবার  মৃদু স্বরে বলেছিলেন, খুব ভালো লাগল, তুমি এলে। এবার লাইব্রেরিতে এসো। বছরের শুরুতে অন্য কোনও কারণে ফোন করে বলেছিলেন,  একবার এসো। সন্দীপদা জীবনের অন্তিম পর্বে পৌঁছানোর আগে আমরা জানতে পারিনি  তাঁর দীর্ঘ হাসপাতাল বাসের কথা। আমাদের কি খুঁজে ছিলেন তিনি? লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরির দায়িত্ব কি কাউকে দিয়ে গেছেন?  এই প্রতিষ্ঠানকে আমরা কি ভাবে  এগিয়ে নিয়ে যাব? তার চিকিৎসার ব্যবস্থা যাঁরা করেছিলেন তাঁদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। আমি তো কিছুই পারিনি,  দাদার ভালোবাসা টুকু নেওয়া ছাড়া। সারাদিন পথে আজ। জব্বলপুর থেকে দিন্দোরি, দিন্দোরি থেকে সামনাপুর, দীর্ঘ পার্বত্য পথ বসন্তের আয়োজনে সাজানো। কত যে রং! পলাশের পতাকা দিকে দিকে। সারা পথ সন্দীপদার কথা ভাবছি। কুণ্ডম বলে এক গ্রামের কাছে পথের দু ধার রাঙা হয়ে আছে  ঝরা পলাশে। দু'হাতে ফুল তুলে দাদার জন্য দিলাম। আমিও তো লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদক আজ। আন্দোলন এর সব পথিকৃৎ এর জন্য এটা সম্ভব হয়েছে।  সন্দীপ দত্ত তাঁদের মধ্যে  সব চেয়ে বড় যোদ্ধা। ফাল্গুনের পথ না ভোলা পথিক।


সংগ্রহশালাটি আজ বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতির জগতে অপরিহার্য। 
সাধন চট্টোপাধ্যায়
(কথাসাহিত্যিক) 

সন্দীপের সঙ্গে পরিচয় তাঁর প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার আগে থেকেই। তরুণ বয়সে, তাঁর বর্তমান লাইব্রেরিটির পাশেই ‘চতুষ্কোণ’ পত্রিকায় লেখালেখির উৎসাহে আসত। এর কিছু পরেই, কী প্রতিকূল পরিবেশে লিটল ম্যাগাজিনের প্রতি প্রতিষ্ঠানের উপেক্ষা ও অবহেলা দেখে, সংগ্রহের ও সুরক্ষার মন্ত্রে তরুণটি দীক্ষিত হলো এবং ইতিহাস গড়ে তুলল–সংগ্রামের দিনগুলো কাছ থেকে দেখেছি। ওর চলে যাওয়া বুকে খুব বিঁধছে। সংগ্রহশালাটি আজ বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতির জগতে অপরিহার্য। ওর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আবেদন জানাই কীভাবে লাইব্রেরিটিকে যথাযথভাবে টিকিয়ে রাখা যায়–আসুন সকলে মিলে কোনো পথসন্ধানে ব্রতী হই।


স্নেহের সন্দীপ 
শুভাপ্রসন্ন
(চিত্রশিল্পী) 

সন্দীপের জীবনের উদ্দেশ্য ছিল উজ্জ্বল উদ্ধার। বণিক বংশে জন্মালেও ওর ব্যবসা বা অর্থ রোজগারের স্পৃহা কোনোদিন ছিল না। কৈশোরে দেওয়াল পত্রিকা ‘বর্তিকা’ র হাত ধরে ওর সাহিত্য শিল্পের প্রতি আগ্রহ ক্রমশ লিটল ম্যাগাজিনের লাইব্রেরির উৎস হয়ে দাঁড়ায়। একক প্রচেষ্টায় এই সংগ্রহ অভিনব। একসময় অসংখ্য গবেষক, লেখক, কবি , নাট্যকারের নিয়মিত যাতায়াত ছিল। এছাড়া নানান বিষয়ে আলোচনা সভা, কবিতা, গল্প পাঠ, ছবি নিয়ে আলোচনা হত প্রতি সপ্তাহে। মেঝেতে সতরঞ্চি পেতে চারিদিকে অসংখ্য দুষ্প্রাপ্য লিটল ম্যাগাজিনের পরিবেশে সে আড্ডা-আলোচনার এক আলাদা আকর্ষণ ছিল। দোতলা থেকে চা-বিস্কুট আসত অভ্যাগতদের জন্য।

সন্দীপ স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি নিয়ে একদিকে লাইব্রেরি অন্যদিকে নিজের লেখালেখি নিয়ে জীবন চালাত। নিয়মিত দুষ্প্রাপ্য প্রায় হারিয়ে যাওয়া গল্প, প্রবন্ধ সংগ্রহ করে একটি চটিবই প্রকাশ করত যার নাম ছিল ‘উজ্জ্বল উদ্ধার’ । আমার ছাত্রপ্রতিম সন্দীপ আমায় ভালবাসত। আমরা পরস্পর একই বলয়ের মধ্যে ঘোরাঘুরি করতাম। বিদেশ থেকে এলেই লাইব্রেরি তে বন্ধুদের ডেকে সেবারের ইউরোপ যাত্রা আর প্রদর্শনীর কথা শোনাতে হত। কখনো প্রোজেক্টারে ছবি দেখিয়ে। সন্দীপও আমার দিল্লীর প্রদর্শনীতে আমায় সাহায্য করার জন্য গিয়েছিল। এরকম সাহিত্য শিল্পপ্রেমী বা সাহিত্য শিল্পের প্রতি উৎসর্গ প্রাণ বিরল। অসংখ্য মানুষ তাকে ভালবাসত আর ওকে ঘিরে এক সাহিত্যতীর্থ গড়ে উঠেছিল টেমার লেনের ছোট্ট গলির সেই লাইব্রেরি ঘরে। অনুজ সন্দীপের মৃত্যুতে সাহিত্যজগৎ এক অকৃত্রিম বন্ধুকে হারাল।
লিটল ম্যাগাজিনের ইতিহাসে উজ্জ্বল নাম সন্দীপ দত্ত  
ঈশিতা ভাদুড়ী 
(কবি, প্রাবন্ধিক) 

যখন পৃথিবী ডিজিটাল হয়নি, আমরা লিখতে এসেছিলাম। সেই আশির দশকে। শুধু লিখেই ক্ষান্ত ছিলাম না। পত্রিকা করার ভূতও ঘাড়ে চেপে বসেছিল। সেই সময় সন্দীপদার সঙ্গে পরিচয়, সন্দীপ দত্ত, লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি, টেমার লেনের সেই ঘর। সেই তখন, যখন লিটল ম্যাগাজিন থেকেই আমরা লেখা আরম্ভ করেছিলাম, যখন সেই লিটল ম্যাগাজিন আমিও করব মনস্থ করে বৈঠকখানা বাজার থেকে কাগজ কিনে টানা-রিক্সা চেপে প্রেসে গিয়েছি, প্রেস মানে লেটারপ্রেস, আজকের ডিজিটাল পরিবেশ নয়। সেই পত্রিকা বার করেছিলাম, সন্দীপদার উপদেশ সঙ্গে নিয়ে। পরে যখন পত্রিকা প্রকাশ বন্ধ করে দিলাম, বকেছিলেন খুব। 

আমাদের সময় জন্মদিন আর কত পালন হত আমাদের! সন্দীপদা পরিচয় হওয়ার পর থেকে প্রতি জন্মদিনে একটি পোস্টকার্ডে শুভেচ্ছা পাঠাতেন। একথা ঠিক, পরবর্তীতে আমি জন্মদিনে সন্দীপদার পোস্টকার্ডের জন্যেই মুখিয়ে থাকতাম। 

লিটল ম্যাগাজিন সংক্রান্ত যে কোনও প্রয়োজনে ছুটে গেছি তাঁর কাছে, এছাড়াও। খুবই স্নেহপ্রবণ ছিলেন, সাহায্যপরায়ণও। মনে আছে, সুইডেন যাওয়ার ছক করছিলাম যখন, নিজে উদ্যোগী হয়ে সুইডেন থেকে প্রকাশিত  'উত্তরদেশে'র সম্পাদক ড. সমীর কুমার মিত্র  আর 'উত্তরপ্রবাসী'র সম্পাদক ড. গজেন্দ্র কুমার ঘোষের ঠিকানা দিয়েছিলেন, যদি আমার কোনও কাজে লাগে। 

বছর তিনেক আগে দেবজ্যোতি কর্মকার যতীন্দ্রমোহন বাগচীর বাড়িতে যমশেরপুরে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন, আমাদের কয়েকজনকে কলকাতা থেকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। সেই অনুষ্ঠানের সুবাদে সন্দীপদার সঙ্গে অনেকটা পথ একসঙ্গে এক গাড়িতে যাওয়া এবং ফেরার সময় অনেক গল্প করে এবং সেই অনুষ্ঠানের দুদিনে নতুন করে আবার তাঁকে চিনলাম। তখনও অসুস্থই ছিলেন, তবুও উদ্যম কিন্তু পূর্ণমাত্রায় ছিল। 

লিটল ম্যাগাজিন নিয়ে তাঁর বিপুল কর্মকাণ্ডের কথা সর্বজনবিদিত। কীভাবে যে অত পত্রিকা কত আদরে সংরক্ষণ করেছেন দেখার মতন। সন্দীপ দত্ত লিটল ম্যাগাজিনের ইতিহাসে উজ্জ্বল নাম হয়ে রয়ে যাবেন চিরকাল। সন্দীপদার চলে যাওয়া বাংলা সাহিত্যের অপূরণীয় ক্ষতি।

প্রমেথিউসের মত
অচিন্ত্য বিশ্বাস
(প্রাবন্ধিক)

মাথায় কাগজের তাজ। নির্লিপ্ত মহারাজকে দেখতাম বইমেলা আলো করে বসেছেন। মনে তখনো চোরা মফসসল। হাওয়া মোরগ হয়তো, দেখনদারি শুধু! পরে বুঝেছি সন্দীপ দত্ত একটি উদ্দীপনার নাম। তাঁর বয়স থেমে আছে। ঋষিণ মিত্রের মত, সত্য গুহ বা বার্ণিক রায়ের মত। ওই যাঁরা  স্বীকার করেন, সন্ধানে থাকেন আর মগ্ন হতে পারেন। আধুনিক কবিতায় সুর লাগান ঋষিণ দা। একালের গদ্য পদ্য আন্দোলন নিয়ে বই ভাবেন সত্য দা। কবিতাকে সম্মান দিতে চান বার্ণিক। সন্দীপ দত্ত তেমনি, সংগঠক আবিষ্ট তন্ময় প্রভাবী সক্ষম।

১৯৯৫ হবে। বললেন, সাহিত্যে দলিত নিয়ে বলুন। সভাপতি নারায়ণ মুখোপাধ্যায়। বলা গেল। একবার বললেন, কথা আছে। টেমার লেনের দপ্তরে উড়ে যাওয়া উশখুশ পাতার শব্দ। 'আমার কাছে সুবর্ণবণিক সমাজের পত্র পত্রিকা আছে, আপনি করালে গবেষণা করতে পারি।' বললাম, দারুণ হবে। সুবর্ণবণিকরা ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলার সমাজ-বদলের প্রয়াস করেছেন। 'চতুরঙ্গ'-এ রবীন্দ্র নাথ শচীশকে সোনার বেণে ভেবেছেন, বিনা কারণে নয়। কথাগুলোর কোন চারা রইল না। উনি গবেষণাটি করলে উপকার হত।

লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলন একটি দর্শনের নাম। হাওয়া মোরগ যেমন দিগদিশারি। সন্দীপ দত্ত সেটা প্রমাণ করলেন। বহু পত্রিকাই তো দেখলাম। দুই ফর্মার ছিপছিপে মৃদু থেকে ষাট ফর্মার পৃথুলা আস্ত বিজ্ঞাপিত মলাট -- আখাম্বা ঢাক। সন্দীপ বাবু সারাটা জীবন সাজিয়ে গুছিয়ে গেলেন! বলিহারি প্রত্যয়। বাংলা সাহিত্যের প্রমেথিউস! শ্রদ্ধা নিরবধি।

লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরির কী হবে!
সৈয়দ কওসর জামাল
(কবি, প্রাবন্ধিক)

সন্দীপের সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ হয়েছিল ১৯৭৮ সালের প্রথমে, শিল্পী শুভাপ্রসন্নের কলেজ রো-র বাড়ির স্টুডিয়োতে। সন্দীপ তখন পত্রপুট নামের একটি পত্রিকা করে। এর পরই আমরা বন্ধু হয়ে উঠি। আমি ওর বাড়িতে গেছি। পঁচিশে বৈশাখ পত্রপুটের একটি সংখ্যা বেরোবে, সন্দীপ সম্পাদনার কাজে আমার সাহায্য চায়। আমি আমার কবিবন্ধুদের লেখা সংগ্রহ করে দিই। সন্দীপ যুগ্ম-সম্পাদক হিসেবে আমার নাম ছেপেছিল।
১৯৭৮ সালের মে মাসেই আমি আকাশবাণীর চাকরি নিয়ে শিলিগুড়ি চলে যাই। কিছুদিন পর সন্দীপের চিঠি। ও কার্সিয়াং আকাশবাণীতে ঘোষকের পদের জন্য পরীক্ষার ডাক পেয়েছে, তাই আমার কাছে আসছে। সন্দীপ এসেছে শিলিগুড়িতে আমার কাছে, একদিন কাটিয়ে পরদিন সকাল সকাল কার্সিয়াং গেছে। ফেরার পথে আবার সঙ্গে কাটিয়েছে সারাদিন। এই সময় ওর কাছে লিটল লাইব্রেরি স্থাপনার কথা  শুনি। আমি উৎসাহ দিই এবং উত্তরবঙ্গ থেকে পত্রিকা সংগ্রহ করে ওকে পাঠাবার প্রতিশ্রুতি দিই। সেইমতো মাসখানেকের মধ্যেই প্রায় শতখানেক পত্রিকা বড়ো ব্যাগে পুরে কলকাতা পাঠাই সন্দীপের কাছে। বয়ে নিয়ে গেছিল তরুণ কবি আনন্দ সরকার। 
এরপর চাকরিসূত্রে কলকাতার সঙ্গে আমার যোগাযোগ ক্ষীণ হয়েছে, কলকাতা এলেও সন্দীপের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়নি।
তবে অনুষ্ঠানে, বইমেলায় দেখা হয়েছে। কথা হয়েছে। জ্বলদর্চির অনুষ্ঠানেও মেদিনীপুর শহরে দেখা হয়েছে। শেষ ওর সঙ্গে মঞ্চে দেখা হয়েছে গত বছর, বীরভূম লিটল ম্যাগাজিন মেলায়, বোলপুরে। ইদানীং মনে হচ্ছিল অসুস্থ শরীর নিয়ে এত এত অনুষ্ঠানে সন্দীপের উপস্থিত থাকা ঠিক হচ্ছে না। কিন্তু খ্যাতির মোহ দুর্মর। লিটল ম্যাগাজিন মেলা হলে ওর নৈকট্যবোধ করা স্বাভাবিক। কিন্তু অনাহূত হয়েও ওকে হাজির হতে দেখেছি মেলায়, এবং আয়োজকরা সাগ্রহে মঞ্চে তুলেছে। 
এক্ষণে আমার একটিই দুশ্চিন্তা, লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরির কী হবে। সন্দীপ একবার বলেছিল ওর মৃত্যুর পর লাইব্রেরির কী হবে সে ভাবনা ওর নয়। সত্যি কথা। অন্যদেরই সে দায়িত্ব নিতে হবে। আমি দুশ্চিন্তামুক্ত নই।
আন্তরিক শ্রদ্ধা 
সন্মাত্রানন্দ 
(কথাসাহিত্যিক)

একটা বড়ো কাজকে সারা জীবনের ব্রত করে তুলতে পারেন, এমন মানুষের সংখ্যা জগতে চিরকাল অত্যন্ত কম। এখন আরও কম। প্রয়াত সন্দীপ দত্ত সেই বিরল মানুষদের একজন ছিলেন। লিটল ম্যাগাজিন বা সংক্ষিপ্ত সাময়িক পত্রের সংগ্রহ ও গবেষণার কাজে আত্মনিয়োগ করে তিনি আমৃত্যু সাহিত্য-সরস্বতীর অক্লান্ত সেবা করে গেছেন। সাহিত্যের এত বড়ো আত্মজন আর কেউই ছিলেন না। তাঁর আকস্মিক প্রয়াণ আমাকে গতকাল থেকেই ব্যথাতুর ও উদ্বিগ্ন করে রেখেছে। তরুণ সাহিত্যসেবীরা এর পর থেকে কার কাছে যাবেন? যাঁরা সাহিত্যের আধুনিক যুগের ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করবেন, তাঁরাই বা কোথায় যাবেন এর পর? দুঃখভারার্ত চিত্তে আমি প্রয়াত সন্দীপ দত্তের আদর্শ ও স্মৃতির প্রতি আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। 

এই বিপুল সম্পদ কী নষ্ট হয়ে যাবে!    
অর্ণব পণ্ডা
(কবি)

অগ্রজ কবিবন্ধু মানসকুমার চিনির মাধ্যমে সন্দীপ দত্তের সঙ্গে আলাপ কলিকাতা লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরিতেই। সবে রৌদ্রছায়া পত্রিকা শুরু করেছি।প্রথম সংখ্যা দিয়েছি ওনার হাতে।তিনি উল্টেপাল্টে দেখে কিছু পরামর্শ দিলেন।তারপর সযত্নে তুলে দিলেন পড়ার টেবিলে।এরপর বিভিন্ন সময়ে দেখা হয়েছে বিভিন্ন জায়গায়।ততদিনে সদস্য হয়ে গেছি লাইব্রেরির। সর্বদাই হাস্যময় আন্তরিক ছিলেন ,এবং সেটা সবার প্রতিই। তাঁর ʼউজ্জ্বল উদ্ধার ʼবাংলা লিটল ম্যাগাজিনের অমূল্য সংযোজন।তাঁর চলে যাওয়া অপূরনীয় ক্ষতি আমাদের। সবথেকে বড় কথা কী হবে এবার  লাইব্রেরির? এই বিপুল সম্পদ কী নষ্ট হয়ে যাবে!    


যেন থেমে না যায় : শতজল ঝর্ণা
উৎপল ঝা 
(কবি)

এ কথা সর্বজন স্বীকৃত , বাংলা লিটল ম্যাগাজিন যে  আজ বাংলার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে নিজের  ঋজু,নির্ভীক, আত্মমর্যাদা সম্পন্ন মননশীলতার পরিচয় স্থাপন করতে পেরেছে সেই কৃতিত্বের অন্যতম দাবিদার , লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা সন্দীপ দত্ত। বাণিজ্যিক পত্রিকাগুলির সমান্তরালে লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের 'শতজল ঝর্ণার ধ্বনি' প্রতিষ্ঠার কাজটি মোটেই সহজসাধ্য ছিল না । কিন্তু পাঁচ দশকেরও বেশি সময়কালে তাঁর ধারাবাহিক প্রয়াসের মাধ্যমে তিনি অক্ষরকর্মীদের মধ্যে সেই আত্মবিশ্বাস সঞ্চারিত করতে পেরেছিলেন। লিটল ম্যাগাজিন আজ শ্রদ্ধার আসনে প্রতিষ্ঠিত। 

পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি আজ থেকে পঁচিশ বছর আগে যখন লিটল ম্যাগাজিন মেলার সূচনা করেছিল তার নেপথ্যে ছিল অজিতেশ ভট্টাচার্য, দেবকুমার বসু, নবকুমার শীল এবং অবশ্যই সন্দীপ দত্তের আন্তরিক প্রয়াস । অন্যরা আগেই লোকান্তরিত হয়েছেন, সন্দীপবাবুর প্রয়াণে একটি গৌরবময় যুগের যেন অবসান ঘটল ।

তাঁর সঙ্গে যে প্রায় তিন দশকের বন্ধুত্বের সূচনা , তাও ঐ লিটল ম্যাগাজিনের সূত্রেই।  প্রতি বছর লিটল ম্যাগাজিন মেলায় বিভিন্ন বিষয়ে লিটল ম্যাগাজিনের প্রদর্শনীর দায়িত্ব তিনি সানন্দে বহন করতেন । 
এবং বেশ কয়েক বছর আমার জন্মদিনে তাঁর কাছ থেকে পোস্টকার্ডে শুভেচ্ছা বার্তা পাওয়া ছিল এক আনন্দময় অভিজ্ঞতা ।সেই পোস্টকার্ডে নির্দিষ্ট দিনটির ঐতিহাসিক ঘটনারও উল্লেখ অন্য এক তাৎপর্য বহন করত।
এমন অভিজ্ঞতা বোধকরি অনেকেরই হয়েছে ।

এই সেদিনও আমাদের 'এবং জলঘড়ি ' পত্রিকার সাম্প্রতিকতম সংখ্যাটি উন্মোচনের জন্য শারীরিক অসুস্থতা অগ্রাহ্য করে, 
কফি হাউসের ত্রিতলে  'বইচিত্র ' সভাঘরে উপস্থিত থেকে লিটল ম্যাগাজিনের প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগের পরিচয় রেখেছেন। 

কিন্তু ব্যক্তিগত ক্ষতি ছাপিয়ে আজ প্রবল হয়ে উঠছে লিটল ম্যাগাজিনের সামূহিক ক্ষতির আশঙ্কা । তিল তিল করে  লিটল ম্যাগাজিনের যে বিপুল সংগ্রহশালা তিনি গড়ে তুলেছেন,  যা জাতীয় সম্পদের অভিধা দাবি করে, তা যেন আমাদের অবহেলায় ভেসে না যায়,   তা যেন রক্ষা পায় , তাহলেই লিটল ম্যাগাজিনঅন্ত প্রাণ মানুষটির প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধা নিবেদন করা হবে ।

সন্দীপবাবুর স্মৃতির প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি ।
                       

প্রণাম
চক্রধর দাস 
(সম্পাদক এগরা কথা-ছন্দ লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও  গবেষণা কেন্দ্র) 

আমাদের এগরা কথা-ছন্দ লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি উদ্বোধন করেন ১৩-০৩-২০১৩। একান্ত স্বজন সন্দীপদা তৎকালীন ভারতীয় জাদুঘর এর ডাইরেক্টর অনুপ মতিলালকে সাথে নিয়ে এসে পবিত্রকর্মটি করে যান।মেদিনীপুর জেলার লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি হিসেবে এগরা র প্রতি গর্ব অনুভব করেন। ওনার আশীর্বাদে ধন্য হযে এই লাইব্রেরিতে ২৬ হাজারের অধিক পত্র পত্রিকায় সমৃদ্ধ । কিন্তু ওনার যে বিশাল সম্পদ রযেছে তা সর্ব সাধারণের জন্য কীভাবে কাজে আসবে পরবর্তী দিনে, চিন্তাও হয। এই সম্পদের সংরক্ষণ আশা রাখি পরবর্তী প্রজন্ম করবেন। সন্দীপদা শান্তিতে ঘুমান। আমাদের প্রণাম । 

লিটল ম্যাগাজিনের অভিভাবক
ভাস্করব্রত পতি
(প্রাবন্ধিক। সম্পাদক - পুণ্যিপুকুর)

খুব বেদনাদায়ক খবর। সন্দীপদা তথা আমাদের প্রিয় সন্দীপ দত্ত আর নেই। লিটল ম্যাগাজিন করবো আর সন্দীপদার সঙ্গে আলাপ পরিচয় থাকবে না -- তা কি হয়? আমার সম্পাদিত 'পুণ্যিপুকুর' পত্রিকার সূচনালগ্ন থেকে পাশে পেয়েছি সন্দীপ দাকে। সবসময় উৎসাহিত করতেন বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করার জন্য। একসময় ওনাকে জানিয়েছিলাম যে, পুণ্যিপুকুর পত্রিকার একটি বিশেষ সংখ্যা হবে 'চুল' নিয়ে। খুব অবাকই হয়ে গিয়েছিলেন। সাধারণ চুল কখনও লিটল ম্যাগাজিনের বিষয় হতে পারে, এটা ভেবেই চমকিত হয়েছিলেন। উৎসাহ দিয়েছিলেন। বিভিন্ন সাহিত্য সভাতে দরাজ ভাবে প্রশংসা করতেন পুণ্যিপুকুরের রাবণ সংখ্যা, গাজন সংখ্যা, ঘুড়ি সংখ্যা, পুণ্যিপুকুর ব্রত সংখ্যা সম্পর্কে। জীবনের শেষ দেখাতে মহাবোধি সোসাইটি হলে  হাতে তুলে দিয়েছিলাম 'পুণ্যিপুকুর' পত্রিকার পুণ্যিপুকুর সংখ্যা। সেদিনেও খোঁজ নিয়েছিলেন চুল সংখ্যার বিষয়ে। 

সৌভাগ্য হয়েছিল সন্দীপদার লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরী দর্শনের। শুধু লাইব্রেরী নয় তা। এটি আসলে বইয়ের মন্দির মসজিদ গীর্জা। এখানে এলে প্রশান্তিতে ভরে যায় মন প্রাণ হৃদয়। আজ তিনি নেই। লিটল ম্যাগাজিনের জগৎ আজ অভিভাবক শূন্য। আমরা বিচলিত লিটল ম্যাগাজিনের সংরক্ষণের ভবিষ্যৎ নিয়ে। যাইহোক, অনন্তলোকে ভালো থাকুন সন্দীপদা। 


সন্দীপ দত্ত :  স্বপ্নপথিক
দিলীপ মহান্তী
(কবি ও প্রাবন্ধিক)

সন্দীপ দত্ত নেই! লিটল ম‍্যাগাজিন তার প্রকৃত অভিভাবককে হারাল। তার সবচেয়ে প্রিয় কাছের মানুষ তাকে ছেড়ে চিরদিনের জন্য এই মায়াভরা পৃথিবী থেকে  অনেক হতাশা ও স্বপ্ন নিয়ে দূরে কোথাও চলে গেলেন। হাজার অবহেলা ও অবজ্ঞা থেকে তিনি লিটল ম‍্যাগাজিনকে একটু সম্মানজনক জায়গা দেওয়ার জন্য সারাজীবন লড়ে গেছেন। যে কাজ কোনো ব‍্যক্তিমানুষের করা সম্ভব নয়, তাই তিনি করেছেন। এই লড়াই তাঁর সম্পূর্ণ একার। অসম এক লড়াইয়ে জীবন উৎসর্গ করেছেন। আমাদের মনে পড়তে পারে বুদ্ধদেব বসুর কথা। তিনিও চেয়েছিলেন, 'কবিতার জন্য পরিচ্ছন্ন আর নিভৃত একটু স্থান করে দেবো, যাতে তাকে ক্রমশ প্রকাশ‍্য উপন‍্যাসের পদপ্রান্তে বসতে না হয়'। যদিও সন্দীপ দত্তের লড়াইয়ে বুদ্ধদেব বসুর নাম আসা উচিত নয়। এতখানি পরিশ্রম, কঠিন কাজ ও ত‍্যাগ বুদ্ধদেব বসুকে করতে হয়নি, তবু মনে এল। আমরা ২০২ রাসবিহারী অ্যাভিনিউ দেখিনি কিন্তু ১৮ এম টেমার লেন দেখেছি। বহুবার নিজস্ব প্রয়োজনে সেখানে হাজির হয়েছি।

তখন এম.এ. পড়ি‌। স্পেশাল পেপার আধুনিক কবিতা। একদিন পৌঁছে গেলাম টেমার লেনের লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্রে। যার প্রতিষ্ঠাতা ও কর্ণধার সন্দীপ দত্ত। পরিচয় পর্বেই খুবই আপনজন হয়ে উঠলেন। তারপর সেই লিটল ম‍্যাগাজিনের পাহাড় প্রমাণ সংগ্রহের আকর্ষণে কত কতবার ছুটে গেছি। কত কত ম‍্যাগাজিনের পাতা পাগলের মতো উল্টে পাল্টে দেখেছি। প্রয়োজনীয় প্রবন্ধের পৃষ্ঠা সংখ্যা লিখে দিয়েছি, সন্দীপ দা ফটোকপি করে রেখেছেন। আরো যাঁরা লাইব্রেরিতে আসেন তাঁদের ডেকে দেখিয়েছেন এই ছেলেটি মেদিনীপুর শহর থেকে এখানে আসে পড়াশোনা করতে। পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। এরপর এম. এ. পাশ করার পর আমিই প্রথম 'কৃত্তিবাস' পত্রিকা নিয়ে গবেষণার কাজ ( পিএইচ. ডি.) শুরু করলাম। একদিন লাইব্রেরিতে গিয়ে সন্দীপ দা'কে জানালাম। বিষয় শুনে সন্দীপ দা'র মুখ গম্ভীর, থমথমে হয়ে উঠল। চোখ হয়ে উঠল রক্তবর্ণ। তাঁর চেহারায় ফুটে উঠল তীব্র প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, ক্রোধ, ঘৃণা ও আরো অনেক কিছু...। তিনি প্রতিষ্ঠান বিরোধী জানতাম, জানতাম তিনি বাজারি পত্রিকাকে ঘৃণা করেন, কিন্তু...। দেখলাম একজন মানুষের শিরদাঁড়া কতটা সোজা হতে পারে। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম: 'সন্দীপ দা, কৃত্তিবাসের পুরনো সংখ্যা গুলো পাওয়া যাবে?' বললেন: 'ওই পত্রিকা ছুঁতে গা ঘিনঘিন করে। বমি পায়।' আমি ধাক্কা খেলাম। অবশ্য তাঁর এই ক্রোধ, ঘৃণা ও প্রতিবাদের প্রকাশ দীর্ঘস্থায়ী হল না, একটু পরেই কৃত্তিবাসের কয়েকটি পুরনো সংখ্যা তাক থেকে নামিয়ে আমার কাছে এনে বললেন: 'অন্য বিষয় ভাবলে খুশি হতাম।' 

তবে সন্দীপ দা যে ধাক্কাটা আমাকে দিলেন তার প্রভাবেই সেই শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েই আমার গবেষণার ধরণটা পাল্টে গেল। আমি সম্পূর্ণ নিজের মতো করে কাজটি শেষ করলাম। সেই সময় দু একজন বাদে কৃত্তিবাসের প্রায় সব কবিই জীবিত ছিলেন। আমি তাঁদের কারুর সাক্ষাৎকার নিইনি বা তাঁদের কাছে যাইনি। সন্দীপ দা'র ক্রোধ, ঘৃণা, প্রতিবাদ, প্রতিরোধ আমার মধ্যেও সঞ্চারিত হয়েছিল। তিনি আমাকে আত্মমর্যাদাবোধের শিক্ষা দিয়েছিলেন। বুঝেছি, এই আকালে প্রকৃত স্বপ্ন দেখার মানুষ সন্দীপ দত্ত। আর বেশিরভাগই ভণ্ড, স্বার্থপর ও ধান্দাবাজ। সন্দীপদা আপনাকে শ্রদ্ধা ও প্রণাম। এবার আপনি অনন্ত বিশ্রাম নিন ও মানুষের হৃদয়ে বাঁচুন।


লিটল ম্যাগাজিন পরিবারের অপূরণীয় ক্ষতি
কেশব মেট্যা
(সম্পাদক - মহুল, কবি)

লিটল ম্যাগাজিনের প্রাণপুরুষ সন্দীপ দত্ত চলে গেলেন অমৃতলোকে। ওঁর সাথে আমার কোনো ছবি নেই। তবে কয়েকটি ছবি ছিল, যখন তিনি মেদিনীপুর লিটল ম্যাগাজিন মেলা কিংবা নন্দনে অনুষ্ঠিত লিটল ম্যাগাজিন মেলায় মহুল পত্রিকার স্টলে এসেছেন। অনেক বছর আগে। সেসব এখন আর নেই। একটা গম্ভীর মানুষ, কাঁধে ব্যাগ নিয়ে ধীরে ধীরে হাঁটছেন। ঘিরে আছেন লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদক - কর্মীরা। স্টলে গিয়ে পত্রিকা সংগ্রহ করছেন। না, বিনামূল্যে নয়। একবার নন্দন চত্বরে লিটল ম্যাগাজিন মেলায় মহুল এর একলাইনের কবিতার বিশেষ সংখ্যা ‘ঠোঙার ভিতর বোমা’ তাঁর দিকে এগিয়ে ধরেছি, মুচকি হেসে জানালেন অন্যরকম ভেবেছো, ভালো, পাতিরাম থেকে নিয়েছি। এটা শোনার পর বুকে বল আর সাহস কতটা বেড়েছিল সে তরুণ বয়স জানে। প্রশংসাও করেছিলেন মহুল এর ‘কবি অমিতেশ মাইতি সংখ্যার’। শহর থেকে মফসসল, মফসসল থেকে গ্রাম যেখানেই লিটল ম্যাগাজিন নিয়ে উৎসব অনুষ্ঠান সেখানেই তাঁর উপস্থিতি। লিটল ম্যাগাজিন এর প্রতি তাঁর আগ্রহ ও সংগ্রহের আকুলতা আমাদের সাহস ও প্রেরণা যোগায়। তাঁর প্রয়াণ লিটল ম্যাগাজিন পরিবারের অপূরণীয় ক্ষতি। 


"আছে ভাবের তালা দেই ঘরে, 
          যে ঘরে সাঁই বাস করে"

গৌতম মাহাতো
(কবি, সম্পাদক) 

স্তম্ভ মানে ভরসা। আর এই ভরসার পূর্ণতা আসে তার উপর রচিত আচ্ছাদন থেকে। আসলে প্রতিটি ম্যজিকের পেছনে থাকে একটা দৃঢ় লজিক। লজিক য্যামোন ম্যাজিকটা জানে ম্যাজিকও তেমনই। ম্যাজিকটা ডানা মেলল ১৯৭৯ সালের ৮ই মে। তার আগে পর্যন্ত 'লিটল ম্যাগাজিন' নামক সাহিত্য আকর বস্তুটি ছিল উপেক্ষার আরেক নাম। সেই তিন নম্বর অজ সন্তানের মত টিকে থাকা অধ্যায়টি প্রথম বেঁচে ওঠার ডানা মেলতে শুরু করল প্রথম যে স্তম্ভটির হাত ধরে তিনি আর কেউ নন টেমর লেনে একটা সামান্য একতলা ঘরের মালিক সন্দীপ দত্তের হাত ধরে। শুরু হল ব্রাত্য, উপেক্ষিত সাহিত্যের আঁতুড় ঘরকে সত্যিকারের ঘরে রূপান্তরিত করারর অদম্য প্রয়াস। গড়ে তুললেন "লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরী ও গবেষণা কেন্দ্র"। সে সব ইতিহাস আজ আর নতুন কিছু নয়। যিনি আস্থা ও আশ্চর্যের দ্বৈরথ নিয়ে নাড়িয়ে দিতে লাগলেন সমগ্র বাংলার মনন ও চেতনাকে তিনি আমাদের আপনজন, সন্দীপদা(সন্দীপ দত্ত)। 
       কে কত সুন্দর নৈপন্যপূর্ণ লিটল ম্যাগাজিন করছে সেটা তাঁর কাছে তেমন মূল্য পেত না তিনি আপ্লুত হতেন গৃহস্থের মত নতুন সদস্যের আগমণে। ছোট, বড়, গ্রাম, মফঃস্বল থেকে শহর, নগর সবাই ছিল তাঁর কাছে অত্যন্ত আপনজন। বুক দিয়ে আগলে রাখতেন যতটা লিটল ম্যাগাজিনগুলোকে ততটাই আগলাতেন ছোট,খাটো, কম, বেশি সব সম্পর্কগুলোকেও। এই লাইব্রেরীটা লাইব্রেরী ছিল না শুধু, ছিল আমাদের মত ধুলোবালিদের জন্য একটা মুক্ত আকাশ। একটা ছোট্ট ঘটনা না বললেই নয়। সম্ভবত বছরটা ২০০৯ কি ১০। মেদিনীপুর লিটল ম্যাগাজিন মেলা তখন সামান্য সোজা হবার চেষ্টা করছে, সেই বছরই প্রধান অতিথি হিসেবে এলেন সন্দীপদা। আমাদের কয়েকজন কাঁচুমাচু মুখে তাঁকে আমন্ত্রণ জানাতে গিয়ে বলে -- সন্দীপদা গাড়িটা যদি কলকাতা থেকে হয় তাহলে আমাদের টাকাটা সামান্য কম লাগে।  দুবার যাতায়াতের খরচটা জোগাড় হলে সে ব্যবস্থাও করে ফেলব। 
 আমাদের চমকে দিয়ে বলেছিলেন-- আমি তো সেলিব্রিটি নই, লিটল ম্যাগাজিনের সামান্য একজন কর্মী মাত্র। তোমরা লড়াইটা জেলায় শুরু করেছো আমি সেই লড়াই-এ সামিল হতে চাই আমায় একটু সুযোগ দিও ওতেই হবে। আর যাতায়াত! সে আমি ট্রেনে চলে যাব, ভেবো না। গাড়ির ব্যবস্থা করলেই বরং আমি বিব্রত বোধ করব।

      এই হৃদয়টাই আচমকা হারিয়ে গ্যালো, আর বিশেষ কিছুই না। বাকি সবই তো হারায় কালের খিদেতে কিন্তু মাঝে মাঝে হ্যামলিনের সেই বাঁশি ওয়ালা আসে কখনও সখনও। তারপর সকলকে চমকে দিয়ে লজিকের ম্যাজিক স্টিক ঘুরিয়ে ভ্যানিস হয়ে যান, সন্দীপদার মত।

    "আছে ভাবের তালা দেই ঘরে, 
                          যে ঘরে সাঁই বাস করে।।
     ভাব দিয়ে খোল ভাবের তালা
        দেখবি সে মানুষের খেলা 
           ঘুচে যাবে শমন-জ্বালা
                          থাকলে সে রূপ নিহারে।। 
ভাবের ঘরে কি মূরতি 
ভাবের লণ্ঠন ভাবের বাতি 
ভাবের বিভাব হয় এক রতি 
                           অমনি সে রূপ যায় সরে।।"
 


জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇







Post a Comment

3 Comments

  1. কাজের মধ্যেই অমরত্ব লাভ করবেন উনি। খারাপ লাগা রয়ে গেল!

    ReplyDelete
  2. জ্বলদর্চি -র এই স্মরণ স্মরণীয় হয়ে থাকবে। আমার মোবাইলে বেশি লেখার সামর্থ্য নেই আর।
    শোকাহত হয়ে আছি। আত্মত্যাগী মানুষটার সাথে আমার সম্পর্ক গত ৭৩ থেকে। জামাল একটা সত্য ভালো লিখেছেন, শেষের দিকে অসুস্থ শরীর নিয়ে ছুটে বেড়ানোটা সন্দীপদার ঠিক হয় নি। এখন তাঁর সংগ্রহ শালাটা কিভাবে রক্ষা করা যায় তার চেষ্টা করলে ভালো হয় । বাংলা সাহিত্য একাডেমীর কাছে তরুণ সাহিত্যকর্মীরা যদি এ-ব্যাপারে ধর্নআ দেন দিনের পর দিন,তবে যদি কিছু হয়...

    ReplyDelete
  3. উপরের কথাগুলো আমি প্রভাত মিশ্র লিখলাম।

    ReplyDelete