যেতে যেতে পথে
রোশেনারা খান
পর্ব ৬৩
আজ ইংল্যান্ডে শেষ দিন। আগামিকাল ইণ্ডিয়া রওনা হব। সব গোছগাছ হয়ে গেছে। এবার ভালয় ভালয় পৌঁছাতে পারলে হল। বারমিংহাম থেকে দমদম ডিরেক্ট উড়ান হলে এত চিন্তার ছিলমা। খান সাহেবের শরীর ঠিক থাকলে এত ভাবতাম না।
শেষে দেশে ফেরার দিন এসেই গেল। সুটকেসের ওজন নিয়ে চিন্তায় আছি। কিছু মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চেয়েই ভার বেড়েছে। যাইহোক দুপুরে মাছের ঝোল ভাত রান্না করলাম। বাবলি আমাদের সঙ্গে নেওয়ার জন্য পরোটা আর পনিরের তরকারি বানিয়েছে। এছাড়াও বিস্কুট, চিপস, কোকোনাট বার,চকোলেট ইত্যাদি ব্যাগে ভরে দিয়েছে।
ওরা বারমিংহাম এয়ারপোর্টে আমাদের পৌঁছাতে এসেছিল। অদ্ভুত ব্যপার, আমার মনে কোনও প্রতিক্রিয়া হচ্ছে না। ওদের ছেড়ে যাওয়ার জন্য কোনও কষ্ট বা বাড়ি ফেরার জন্য আনন্দ, কোনটাই হচ্ছে না। সুক্ষ অনুভূতিগুলো আঘাতে আঘাতে ভোঁতা হয়ে গেছে।
রাতের ফ্লাইট, সারারাত ঘুম হয়নি, ঠিক সময়ে দিল্লি পৌঁছেছি। ফোনে মনির সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। বাবলিদের এখন গভীর রাত, নিশ্চয় ঘুমোচ্ছে।তাই ফোন না করে মেসেজ করলাম। দমদম পৌঁছে মনিকে পেলাম। ও ঠিক সময়েই গাড়ি নিয়ে এয়ারপোর্টে এসেছে। বাড়ি (মেদিনীপুর) পৌঁছাতে রাত ৮টা বেজে গেল। পাপু ছিল। রাতে রান্না করতে হয়নি, ও খাবার দিয়ে গেছল।
সকালে উঠে দেখলাম, সবকিছুই আগের মত আছে। বাচ্চারা স্কুলে যাচ্ছে, মাছওয়ালা হাঁক দিয়ে যাচ্ছে, ভিড় করে মেয়ে-বউরা রাস্তার কলে জল ভরছে। তবে ছাদের গাছগুলো জলের অভাবে বেশিরভাগই মরে গেছে। মাসের পুরো মাইনে দেওয়া স্বত্বেও কাজের মেয়ে রোজ জল দেয়নি। সকালে কাজে এসেছে, ওকে সঙ্গে নিয়ে আজ সারাদিন ধরে অনেক কাজ করলাম। অনেক পরিশ্রম হল, কিন্তু কিছু তো করার নেই। কাজের মধ্যে থাকলে কিছুটা অন্যমনস্ক থাকা যায়। ছোট ননদ এসেছিল, ওর কাছে শুনলাম মুকুলের অবস্থা ভাল নয়। শুনে খারাপ লাগলেও কিছু করার নেই। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমরা অসহায়। একদিন দেখতে যাব। খান সাহেবকে বলেছি কিছু টাকা দিতে। হাজার দশেক টাকা দেবে বলেছে। আসলে আমাদের তো কলসির জল ঢেলে ঢেলে খাওয়ার মত অবস্থা। পেনশন নেই, দুজনের চিকিৎসায়, বিশেষ করে ওনার চিকিৎসায় প্রচুর খরচ। দিন দিন চিকিৎসা খরচ বেড়েই চলেছে।
জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇
আজ বানুমাসি(আজহারউদ্দীন খানের স্ত্রী) এসেছিলেন দেখা করতে। অনেকেই আসছেন। ওইটুকু সময় ভাল লাগছে, আবার খারাপও লাগছে। রাত নেমেছে অনেকক্ষণ। পিয়ারুদের বাড়িরও আলো নিভে গেছে। আমার চোখে ঘুম নেই। ঘুমের ওষুধেও কাজ হচ্ছে না। রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে রাস্তার কুকুরগুলো কেঁদে উঠলে বুক কেঁপে উঠছে।
কখন চোখে ঘুম নেমেছিল, জানি না, ফজরের(ভোরের) আজানে ঘুম ভাঙতে দেখি পাশের মানুষটা অঘোরে ঘুমোচ্ছে।শারীরিক মানসিক কষ্টে মানুষটা জেরবার হয়ে যাচ্ছে। আজ চুল কেটে আসতে বললাম। ভেবেছি মুকুলকে দেখতে যাব। মণ্টুকে(ড্রাইভার) আসতে বলেছি। যদি আসে তবেই যাব, না হলে যাওয়া হবে না। এখন আর বাসে যাতায়াত করতে পারব না।
ড্রাইভার আসেনি। ওকে দিয়ে আর হবে না, আসব বলে টাকা নিয়ে যাবে, আসবে না। না আসার কারণ হিসেবে একটা কিছু বানিয়ে বলে দেবে। অন্য ড্রাইভার দেখতে হবে। আমাদের পক্ষে মাস মাইনে দিয়ে ড্রাইভার রাখা সম্ভব নয়, তাছাড়া প্রয়োজনও নেই।২/৩ মাসে একবার বাইরে যাওয়া। যাইহোক, কাল ড্রাইভার না পেলে বাসেই যেতে হবে। ছেলেটাকে দেখার জন্য মনটা ছটফট করছে। খান সাহেবকেও কলকাতা চেকআপে নিয়ে যেতে হবে। সারাদিন লাগবে। যাওয়ার আগে স্পন্দনে সমস্তকিছু টেস্ট করিয়ে সেই রিপোর্ট নিতে হবে।
মুকুল মেদিনীপুর এসেছিল ইনজেকশন নিতে, আমাদের সঙ্গে দেখা করে গেল। ওর হাতেই ওই সামান্য কটা টাকা দিলাম। সামান্য এইজন্য যে কিডনির চিকিৎসা কতটা ব্যয়বহুল তা তো জানি। এও জানি আজ মহরম, শোকের উৎসব। অনেকে ভাবছেন, শোকের আবার উৎসব হয় নাকি? হয়, হয়, উৎসব পালন করতে চায়লে শোকের ও উৎসব হয়। তা না হলে মঞ্জিলের দিন, মানে আজ, কলেজ মাঠে কেন মেলা বসে? কেন মহরমের মেলায় খাবার দাবার বিক্রি হয়। এই যে লাঠিখেলা, মশাল মিছিল। নিজেদের নিজেরাই অস্ত্রের আঘাতে রক্তাক্ত করা, এর ইতিহাসটা সবাই জানেনা। জানানোর দায়িত্ব যাদের তাঁরাও জানান না। থাক ওসব কথা। আজ কলেজমাঠে সমস্ত তাজিয়া গিয়ে মিলবে। শেষ হবে মহরম।
নভেম্বর মাসের কয়েকদিন হয়ে গেল। এখনো বাড়ি ঘর গুছিয়ে উঠতে পারিনি। জীবনটাকে তো আর গুছনো যাবে না। কিন্তু চিন্তা বাড়ছে ঘরের মানুষটাকে নিয়ে। ঠাণ্ডা লেগেছে, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে, রাতে ঘুমতে পারছে না। চোখমুখ ফুলে যাচ্ছে। মনে হয় ক্রিয়েটিনিন বেড়েছে। আজ বুধবার, ভাবছি আগামি শুক্রবার কলকাতা নিয়ে যাব। সব টেস্ট করাতে হবে। ভয় হচ্ছে, ডাক্তার যদি ডায়ালিসিস সুরু করার কথা বলেন? সেটা শুধু ব্যয়সাপেক্ষ নয়, খুব কষ্টদায়কও। জানিনা আর কত কষ্ট সহ্য করতে হবে। গতকাল রাতে উনি নিজেই বলছিলেন, ডাক্তার যদি ডায়ালিসিসের কথা বলেন, আমি করাব না। এত টাকা কোথায় পাব? তার চেয়ে যা হবার হবে। আমি আর ভাবতে পারছি না, ওর যদি কিছু হয়ে যায়, আমার কি হবে? আমি কী নিয়ে বাঁচব? কী ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে চলেছি। লোক তা কল্পনাও করতে পারবে না। সমালোচনা করতে পারবে।
কুইকোটায় একজন নতুন ডাক্তার এসেছেন, গতকাল ওনাকে দেখাতে নিয়ে গেছলাম। ডাক্তার বললেন, এটা অ্যালারজি থেকে হচ্ছে। ওষুধে কাজ হয়েছে। গত রাতে ভাল ঘুমিয়েছেন। শুক্রবার কলকাতা যাওয়া হচ্ছে না। সোমবার নিয়ে যাব। সঙ্গে মনি(আমার ভাই) যাবে। মেজদি গতকাল এসেছে, সন্ধ্যায় দিদিকে নিয়ে পাপুর বাড়ি গেছলাম। গির্জার ওখানে জগধাত্রী পুজো উপলক্ষ্যে মেলা বসেছে। দিদির হয়ত মেলাতে ঢোকার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু আমার ইচ্ছা তো ছিলই না, আমার পাও টানল না ওদিকে। জীবন আমার ধু ধু মরুভূমি হয়ে গেছে। কোন কিছুই মনে সেভাবে রেখাপাত করে না। শুধু কষ্টটা অনুভব করতে পারি। রাতে ছোট দেওর সালেকে ফোন করে জানলাম,মুকুলের খুব জ্বর। জানিনা কী আছে ছেলেটার কপালে? এদিকে উনি সবসময় মৃত্যুর কথা বলছেন। আমি নিতে পারছি না। আমার কথা ভাবছে না? এগুলো আমাকে এত কষ্ট দিচ্ছে যে মাঝে মাঝে রেগে গিয়ে ওনার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে ফেলছি।
গতকাল বিকেলে মুকুল আর ওর মা এসেছিল, ব্যাঙ্গালুরুতে চিকিৎসায় কোনও উন্নতি হয়নি। কয়েকদিন পর ওর মামা নাকি গুজরাট নিয়ে যাবে । আমাদের দেশে চিকিতসার হালই এরকম। আজ মেজোভাইয়ের বৌ আসবে, তাই বাজার করতে হবে। আগামিকাল কলকাতা যাব গাড়িতে। ট্রেনে বাসে কলকাতা শুধু নয়, কোনো জায়গা যাওয়া সম্ভব নয়। প্রথমবার ফরটিসে নিয়ে গেছলাম। এবার পার্কস্ট্রিটে নিয়ে গেলাম। ডাক্তার ওনাকে দেখে ৩৫ টা টেস্ট দিয়েছেন। এখানে ওনার ক্লিনিকে টেস্টগুলো হবে। বিকেলে রিপোর্ট পেলে ডাক্তার বলবেন,কী হয়েছে? কী করতে হবে।
বাংলাদেশ থেকে ডাক্তার দেখাতে এসেছেন এক দম্পতি, স্বামী ভদ্রলোক একটা কিডনি নিয়েই জন্মেছেন, চিকিৎসা করাতে এসে সেটা জেনেছেন। অনেকদিন ধরেই এখানে নেফ্রোলজিস্ট সুচন্দ দাসের কাছে চিকিৎসা করাচ্ছেন। সারাটা দুপুর ওদের সঙ্গে ওখাকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি, হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক, বোরখা-হিজাব, ভাষা ও সংস্কৃতি, ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করেই কাটিয়ে দিলাম। প্রসঙ্গত জানাই হিন্দু পরিবারটি বললেন, ওখানে যা না ঘটে তাকেও এখানকার সংবাদমাধ্যম অতিরঞ্জিত করে পরিবেশন করে।
রিপোর্ট দেখার পর ডাক্তার বললেন, ক্রিয়েটিনি বেড়েছে, হিমোগ্লোবিন কমেছে, এরজন্য ইঞ্জেক্সন লিখে দিয়েছেন। ওষুধ বদলে দিয়েছেন। তিন সপ্তাহ পরে আবার আসতে হবে। সন্ধ্যা ৭ টাতে ওখান থেকে বের হয়ে রাত ১১ টায় মেদিনীপুর পৌঁছালাম।
ক্রমশ
0 Comments