জ্বলদর্চি

পুষ্প রাণী জানা (রাষ্ট্রপতি পুরস্কারপ্রাপ্ত মাদুর শিল্পী, সারতা, সবং) /ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ৪৭

পুষ্প রাণী জানা (রাষ্ট্রপতি পুরস্কারপ্রাপ্ত মাদুর শিল্পী, সারতা, সবং) 

ভাস্করব্রত পতি

পশ্চিম মেদিনীপুরের এক প্রত্যন্ত গ্রাম 'সারতা'। সবংয়ের অন্যতম এক জনপদ। মাদুর শিল্প ও শিল্পীদের গ্রাম। সেখানেই বাস করেন পুষ্প রাণী জানা। সারতার বুক থেকে এক গুচ্ছ মাদুরকাঠিকে যাদুকাঠি বানিয়ে জয় করেছিলেন গোটা ভারতের মননশীল মানুষের মনপ্রাণ। উজ্জ্বল করেছিলেন সবংয়ের মুখ, মেদিনীপুরের মুখ, পশ্চিমবঙ্গের মুখ। তাঁর হাতের অপূর্ব শিল্প সুষমায় সামান্য মাদুরকাঠি হয়ে উঠেছিল এক শৈল্পিক অঙ্গাণু। ১৯৮০ সালে তৎকালীন ভারতীয় রাষ্ট্রপতি নীলম সঞ্জীব রেড্ডি তাঁর হাতে তুলে দিয়েছিলেন রাষ্ট্রপতি পুরস্কার। রাষ্ট্রপতি পুরস্কার প্রাপ্ত সবংয়ের প্রথম মাদুর শিল্পী। সেসময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী এবং অর্থমন্ত্রী ছিলেন প্রনব মুখোপাধ্যায়। 
পুষ্প রাণীর দশ হাত নেই। আছে মাত্র দুটি হাত। সেই দুহাতেই বাজিমাত করেছিলেন তিনি। তবে দশ আঙুল যেন কথা বলতো তাঁর সাথে। স্বামী স্বর্গীয় অভিরাম জানার সাথে বিয়ের পর মাত্র ১৬ - ১৭ বছর বয়সে মাদুর বোনা শিখেছেন। সবং থানার প্রথম মাদুর শিল্পী হিসেবে পেয়েছিলেন রাষ্ট্রপতি পুরস্কার। গর্ভবতী অবস্থায় দিল্লি গিয়েছিলেন পুরস্কার আনতে। সে সময় তাঁর সাথে গিয়েছিলেন স্বামী অভিরাম জানা এবং কেদার প্রামানিক। সে এক আশাতীত অভিজ্ঞতা।

একজন নববিবাহিত গ্রাম্য বধূ হয়েও তিনি যে অমর কীর্তি সেসময় স্থাপন করেছিলেন সেসময়, তা মেদিনীপুর জেলাবাসীকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল বলা যায়। স্বাভাবিকভাবেই পুষ্প রাণী জানা হয়ে উঠেছেন 'মেদিনীপুরের মানুষ রতন'। 
বাপের বাড়ি নারায়ণবাড় গ্রামে। ১৯৫৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন। চরম দারিদ্রতার মধ্যে তাঁর বেড়ে ওঠা। সবং তথা মাদুরকাঠির এলাকায় থাকতে থাকতে তাঁর মনে জন্মায় মাদুরের প্রতি প্রেম। ভালোবাসা। মাদুর বোনার নানা কৃৎকৌশল শিখে নিয়েছিলেন নিজের আগ্রহে। আর তারপর নিজের এবং পরিবারের পেটের ভাত জোগাড়ের জন্য মাদুরকাঠিকে বেছে নেন আপন করে। সে কাজে সফল তিনি। আর এ কাজে পাশে পেয়েছিলেন প্রিয় স্বামীকেই। পুষ্প রাণী জানার অকপট স্বীকারোক্তি, অভিরাম জানার সক্রিয় সহযোগিতা এবং অনুপ্রেরণা ছাড়া তিনি এই সাফল্য পেতেন না কোনও দিনই। 
তাঁর যাবতীয় কর্মকুশলী মসলন্দ মাদুরকে কেন্দ্র করেই। অতি সূক্ষ্ম এই মাদুর তৈরিতে তিনি দক্ষতা দেখিয়েছেন। প্রত্যন্ত সবংকে ভারতের দরবারে পরিচিতি পাইয়ে দিয়েছেন। আরবি শব্দ 'মসনদ' থেকে এসেছে 'মসলন্দ' শব্দটি। যাঁর অর্থ বসবার বড় গদি। কেউ কেউ বলেন, মোঘল আমলের আগে থেকেই ওড়িশা সংলগ্ন মেদিনীপুরে মাদুর শিল্পের প্রচলন ছিল। মাদুরের সর্বোৎকৃষ্ট শ্রেণী 'মসলন্দ' এর প্রসিদ্ধি ঘটেছিল মোঘল আমলেই। সরকারি খাজনা পর্যন্ত সেসময় নেওয়া হোতো মাদুরে। সেই মসলন্দ মাদুর আজও যাঁরা টিকিয়ে রেখেছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন সারতার পুষ্প রাণী জানা। 

মোট ৪ বার রাজ্যের সেরার শিরোপা পেয়েছেন তিনি। ১৯৭৮-১৯৭৯ তে রাজ্য কারুশিল্প প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় স্থান পান। এরপর ১৯৭৯-১৯৮০ এবং ১৯৮০-১৯৮১ তে জুটলো প্রথম স্থানের খেতাব। এছাড়া ২০০১ সালে WORLD CRAFTS COUNCIL ASIA PACIFIC REGION এ দ্বিতীয় স্থান পেয়েছিলেন মাদুর তৈরির জন্য। সে বছর ১৮-১৯ শে সেপ্টেম্বর কুয়ালালামপুরে ন্যাচারাল ফাইবার ক্যাটাগরিতে ২৫ তম আসর বসেছিল WWC ASIA PACIFIC এর। মসলন্দ মাদুর বুননের জন্য ১৯৯৯ এর ২২-২৬ শে মার্চ সম্মানিত হন তিনি। 
তিন মেয়ে ও দুই ছেলেকে নিয়ে সংসার। তিন মেয়ে উমা, সীমা ও সোমাও আজ দুর্দান্ত মাদুর শিল্পী। দুই ছেলে প্রদীপ ও সুদীপও জানে মাদুরের কাজ। স্বামী অভিরাম জানা আজ আর নেই। কবেই মারা গিয়েছেন। তিনিও একজন প্রতিষ্ঠিত মাদুর শিল্পী ছিলেন এতদঞ্চলে। পুষ্প রাণী জানার সতীন কাননবালা জানাও মাদুর বুনে অনেক পুরস্কার পেয়েছেন। আজ তাই বলা যেতেই পারে, মাদুর তৈরি পুষ্প রাণী জানার পরিবারের বংশগত গরিমা। যা তাঁদের দিয়েছে খ্যাতি এবং শ্রদ্ধা। একটা সুন্দর হস্তশিল্পকে পাথেয় করে গোটা পরিবার বুঁদ হয়ে রয়েছে। 

আজও মাদুর বোনেন বছর সত্তরের পুষ্প রাণী জানা। তাঁর হাতের নৈপুণ্যে তৈরি হাজার হাজার টাকা দামের মাদুর চালান হয় দেশ বিদেশে। বর্তমানের উঠতি মাদুর শিল্পীদের কাছে তিনি এখন অন্যতম আদর্শ। মাদুরকাঠিকে আপন করে 'মেদিনীপুরের মানুষ রতন' হয়ে তাঁর জীবনের চলার পথ বেছে নিয়েছেন অসামান্য মসলন্দকে আশ্রয় করে।



জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇



Post a Comment

0 Comments