জ্বলদর্চি

শুধু স্রোতে ভাসা (সামাজিক গল্প) /চিত্রা ভট্টাচার্য্য

শুধু স্রোতে ভাসা (সামাজিক গল্প)

চিত্রা ভট্টাচার্য্য


সোনালী রোদের স্নিগ্ধ হাসিতে  উৎসবের আমেজ মেতেছে মুম্বাইয়ের আকাশ। ঘর ছাড়া বাউলের বেশের অন্তরালে আরব সাগরের বুক থেকে ভেসে আসা উদাসী হাওয়ায় বিলাসী বাণিজ্য নগরী রঙে রসে সেজেছে চিরকুমারের সাজে। বন্দর নগরীর সদা ব্যস্ত যান্ত্রিক মন কে ব্যকুল করে কানে কানে বাতাস জানিয়ে দিয়ে যায় "বসন্ত এসে গেছে"। সপ্তাহ শেষের ছুটির দিন গুলোতে ঘরের চার দেওয়ালের ঘেরাটোপে বন্দী থেকে হাঁপিয়ে  উঠেছে অতনু। সুদূরে মিলিয়ে যাওয়া ঝকঝকে কালো পীচের মসৃণ আঁকাবাঁকা শহরের রাজপথের কোলাহল ছাড়িয়ে নির্জন মাঠ প্রান্তর ধূসর পাহাড়ের গা ঘেঁষে একাকী লং ড্রাইভে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। মনের অতল গভীরে  জমে থাকা পাহাড় প্রমাণ না বলা কথারা, বুকের বন্ধ সিন্দুক ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চায় ,পারেনা।    অনেকদিন পর সকালের নির্মল আলোয় জাতীয় সড়ক ধরে স্টীল কালারের সদ্য কেনা নতুন হুন্ডাই গাড়িটি  তে ঝড় তুলে একাকী নিরুদ্দেশে চলেছে  সে। ,                                                                                 এ পৃথিবীর ধূলি মাটি স্পর্শ করার পর নিজের অজান্তেই কেটে  গিয়েছে বত্রিশ টি নব বসন্ত-।-জীবনের অনেকটা পথ একলাই  চলে এসেছে ,পাওয়া না পাওয়ার হিসেবের খাতা নিয়ে কখনো অঙ্ক কষতে বসে নি। চলার পথে কুড়িয়ে পাওয়া অজস্র অভিজ্ঞতায় তিলে তিলে সঞ্চয়ের ঝুলি ভরে নিজেকে সমৃদ্ধ করলেও বেড়াতে বেরিয়ে একাকী ড্রাইভিং সীটে বসে বড়ো নিঃসঙ্গ লাগে। ছোট থেকেই  পিতৃহীন অতনু মায়ের স্নেহচ্ছায়ায় একাকী বড়ো হওয়া শান্ত গম্ভীর প্রকৃতির।   মুষ্টিমেয় দুতিন জন খেলার সাথী সহপাঠি অন্তরঙ্গ বন্ধু সুদীপ সুজয় আর লীনা ছাড়া ল্যাপটপ লেখা পড়া গল্পের বই ,ছবি আঁকার রঙ তুলির ক্যানভাসে নিজের দুনিয়া গড়েছিল। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের  হোস্টেল লাইফের বাঁধ ভাঙা যৌবনের উচ্ছলতায় সবার সাথে মিলে মিশে থাকলেও কোথায় যেন এক স্বতন্ত্রতা ওর বরাবর বজায় ছিল। অন্তর্মুখী ছেলেটি কে শামুকের খোলস থেকে বেরিয়ে বহির্মুখী করার প্রচেষ্টার অন্ত ছিল না বন্ধুদের কিন্তু লাভ হয় নি |..   গ্রাজুয়েশনের  পর চাকরী নিয়ে সুদীপ এলাহাবাদে ,সুজয় বিদেশে পাড়ি দিয়েছে। অতনু মুম্বাইয়ের আই আইটি তে রিসার্চে ব্যস্ত হলে  লীনা যাদবপুর থেকে এমটেক করে নেট পাশের পর দিল্লীর সরকারী কলেজে লেক চারার পদে নিযুক্ত । অতনু নিয়মাফিক  পোস্টডক করতে  গিয়েছে     নিউইয়র্কের কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি তে। শত অনুরোধ সত্ত্বেও ইউনিভার্সিটির টপার  লীনা রাজী হয়নি বিদেশে যেতে।   তিন বছর বাদে পোস্টডকের পর  অতনু কম্পিউটার সাইন্সের প্রফেসর হয়ে আবার মুম্বাই ফেরৎ এসেছে। হোয়াটসআপে সোস্যাল মিডিয়ায় ভার্চুয়াল যোগাযোগ   কাজের চাপে দেখা সাক্ষাৎ বহুদিন কারোর সাথে হয়নি। লীনা অবশ্য মুম্বাইতে অতনুর কাছে এসেছে যখনই  সুযোগ পেয়েছে ।  লীনার ওপর খুব রাগ হয় ,বলা নেই কওয়া নেই কাউকে কিচ্ছুটি না জানিয়ে এ পৃথিবীর আলো বাতাস থেকে চিরতরে বিদায় নিলো। ওর হঠাৎ চলে যাওয়ায় চারদিকে যে শূন্যতার সৃষ্টি  হয়েছে অতনুর তা মানতে খুব কষ্ট হয়।                                             
 সেদিন রাতে হোয়াটসআপে শেষ বারের মত একটা শুধু ম্যাসেজ এসেছিল "ভারী অসহ্য লাগছে এ পৃথিবীর দিনগুলো। এবার যেতে হবে ,'হে বন্ধু বিদায় ';! " তারপর সুইচ অফ ফোনটি আর অন হয় নি। অতনু কিছু বুঝে ওঠার আগেই পরদিন সকাল বেলায় সব শেষ হয়ে যাওয়ার মর্মান্তিক খবর এসেছিল। যে দুঃসংবাদ পাওয়ার জন্য এতটুকু ও প্রস্তুত ছিল না ওরা। প্রাণচঞ্চল হাসিখুশী মেয়ে ,জীবন নিয়ে যার প্রতি নিয়ত স্বপ্ন দেখা সে কেন সুইসাইড করবে?  "লীনা নেই" দুবছর হয়ে গিয়েছে ' আজো মন মানতে চায় না। ওরা পরস্পর কে কথা দিয়েছিল এক সাথে পথ চলার।লীনা কথা রাখেনি। সব অঙ্গীকার তুচ্ছ করে এভাবে ওর বিদায়ে স্থম্ভিত অতনু যখন একাকী থাকে বারংবার এক চিন্তায় বিদ্ধস্থ হয় । ওর না বলা কথা শোনার জন্য পাশে আজ অপেক্ষায় কেউ নেই। কেন যে  আদ্যন্ত ঘরোয়া অদৃশ্য শৃঙ্খলার বাঁধনে গড়ে ওঠা মনের লীনা কলেজ ইউনিভার্সিটির সদা উজ্জ্বল এক সময়ের টপার মেয়েটি স্টুডেন্টসদের  ক্লাস নেওয়া ছেড়ে ফ্যাশন টেকনোলজিতে যোগ দিয়েছিল ? কেন ই বা ছুটে গেলো দিল্লীর গ্ল্যামার সর্বস্ব ফ্যাশান দুনিয়ার রাম্পে হাঁটতে ? বাইরের পৃথিবীর ডাকে সাড়া দিয়ে কেন এমন অচেনা ভোগ সর্বস্ব  দুনিয়ার অজানা আকাশে পাখামেলে দিয়েছিলো কে জানে ?      

                   

জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇


 আসলে মানুষের মনের চাওয়ার অলিগলি বড়ো বিচিত্র ,খেয়ালী। সে শুধুই স্রোতে ভেসে যেতে চায় সু স্থির হয়ে কোথাও বসে থাকে না এক মূহুর্তের তরে। এ মন তো নিজে ও জানে না সে কি চায় ?       মনে আছে ওদের তখন ক্লাস টেন ,সাউথসিটি মলে বালিগঞ্জ বা ঢাকুরিয়ার মোড়ে অনেক উঁচু বিল্ডিং গুলোর মাথায় টাঙানো শ্যাম্পু ,সাবান বা প্রসাধনের বিজ্ঞাপনে শাড়ি,গয়নায় সাজানো সুন্দরী মডেলদের লাস্যময়ী চেহারার বিরাট হোর্ডিং গুলোর দিকে মুগ্ধ দৃষ্টি তে তাকিয়ে থেকে কিশোরী লীনা বলতো ওমনি সুন্দর ঐ মডেল দের মত বিজ্ঞাপনের নায়িকা হতে চায়। একরাশ  আত্মবিশ্বাস নিয়ে এক গাল হেসে ওর অমলিন সুন্দর চেহারায় খুশীর ঝিলিক  তুলে বলতো  "দেখবি ,আমার  ছবি ও ওমনি এক দিন আকাশের গায়ে দুলবে ,আর প্রতিদিন হাজার হাজার পথচারির  সাথে তোরা ও পথ চলতে গিয়ে  মুগ্ধ চোখে গ্ল্যামার কুইন কে দেখে বলবি ঐ দ্যাখ আমাদের সেই লীনা। কী দারুণ! বিউটিফুল দেখাচ্ছে ওকে।''                                                                                                                                            কিন্তু স্বপ্ন আর বাস্তবের মধ্যে বিস্তর ব্যাবধান। দিল্লীর কলেজে স্টুডেন্ট দের ক্লাস নিয়ে,কলিগ দের সাথে মিষ্টি মধুর সম্পর্ক গড়ে তুলে বেশ তো কাটছিল সোনায় মোড়া দিনগুলো।  কিন্তু হঠাৎ করেই যখন সামনে এলো লীনার অধরা স্বপ্ন পূরণের সুযোগ -- ফ্যাশান ওয়ার্ল্ডে যোগ দেওয়ার চিঠি টি আনন্দে আত্মহারা হয়ে প্রথমই  অতনু কে জানালো।   কিন্তু  ওর বারণ না মানা আগ্রহ কোনো নিষেধ শোনেনি। তারপর এক বছর ও কাটেনি এমন কি ঘটনা মনের ওপর বিস্তর চাপ সৃষ্টি করেছিল যে এই সুন্দর পৃথিবী থেকে  চিরতরে মায়া কাটাতে ওর দুবার ভাবতে হয়নি?   সুইসাইড নোটে সজ্ঞানে শুধু লিখেছিল "আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়"। রহস্যময় যে ঘটনা  সে  কাউকেই জানতে না দিয়ে  নীরব শীতল মরণের কাছে আত্মসমর্পণ করে জীবনবোধ কে মাটি চাপা দিয়েছিল - -অযথা কি প্রয়োজন তাকে কবর খুঁড়ে বার করার  ?.তবুও কোন ভুলের মাশুল গুনতে এমন আত্মবলিদান ? সে জটিল প্রশ্নের উত্তর অতনুর জানা নেই। এলোমেলো অজস্র প্রশ্নরাশি একা থাকার সময় ওকে পাগল করে তোলে। এক অসহ্য মানসিক যন্ত্রনা  পিষে মারে ,আপন মনে সমাধান খোঁজে , রাগে চুল ছেড়ে--মাথা চাপড়ায়। সেই  নার্সারী ক্লাস থেকে সেন্টজেভিয়ার্স স্কুল হয়ে যাদবপুরের ইউনিভার্সিটি  --একসাথে কাটানো দিন গুলো।সিনেমা গান টিভি ,সুপারস্টার ,ক্রিকেট ,ফুটবল ক্লাব রাজনীতি আমেরিকা রাশিয়া চায়না হয়ে ইন্ডিয়া পাকিস্থান ইত্যাদি বিভিন্ন আলোচনা নিয়ে লড়াই ঝগড়া যুক্তি তক্কর পর মুখ দেখাদেখি বন্ধ ,শেষে আবার ভাব। চোখের কোণ জল টলটল করে জ্বালা ধরায়। বন্ধুত্বের মত নিঃস্বার্থ পবিত্র সম্পর্ক পৃথিবীতে আর কোনো সম্পর্কেই বুঝি হয় না।                                            এই মুহূর্তে অতীত ওকে তাড়া করে। কলকাতায় কাটানো স্কুল ছেড়ে কলেজের প্রথম বড়ো হওয়া কৈশোর ছেড়ে যৌবন কে আঁকড়ে ধরা বয়ঃসন্ধিকালের সেই মহেন্দ্র ক্ষণ। -                                                             
                                                                    
ওর আজব খেয়ালী মন উদ্দেশ্য  হীন ভাবে অনেকটা পথ উদ্ভ্রান্তের মত এলোমেলো ঘুরে প্রায় তিন ঘন্টা ড্রাইভের পরে বেশ ক্লান্ত,হয়ে পরপর তিনটে ধাবার তৃতীয় টা ফাঁকা দেখে সেখানেই গাড়ি পার্ক করে ব্রেড স্যান্ডউইচ ওমলেটের সাথে পাঞ্জাবী মসলা দেওয়া ঘন দুধের  চা দিয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে নিয়েছে। নানা রঙের বোগেনভোলিয়ায় ,আর রক্ত করবীতে সাজানো শহুরে রাস্তায় আকাশ ছোঁয়া হালকা বাদামী রঙের গায়ের ওপর ডিপ চকোলেট রঙের বর্ডার আঁকা একই রকম বিল্ডিং গুলোর রাজ প্রাসাদের মত বিশাল গেট, আধুনিক  শপিংমল ,শহরের ঐতিহ্য নামি দামি  রেঁস্তোরা গুলো কে পিছনে ফেলে কখন যে চলে এসেছে মুম্বাই শহরতলী পার হয়ে বাদলাপুরের গ্রামের দিকে খেয়াল করেনি। মুম্বাইয়ের মত এত বড়ো অচেনা শহরে পড়তে এসে  প্রথম পা ফেলে মায়ের বন্ধু নির্মলা আন্টির থানে জেলার উল্লাসনগরের ফ্ল্যাটে বেশ কিছুদিন কাটিয়েছিল।                                    
থানে ,ঠাকুরলী ,ডোম্বিবিলি উল্লাসনগর ,অম্বরনাথ শহরতলীর খুব চেনা অঞ্চল গুলো মুগ্ধ চোখে চেয়ে থেকে  চলে এসেছে  বাদলা পুরের জল শুকিয়ে যাওয়া নদীর ধারে। যেখানে বালুর চর পেরিয়ে নদী ধুধু মাঠের মত মাঝে মাঝে বালির ফাঁক ফোঁকর দিয়ে ক্ষীণ জলধারা সূর্যের  আলোয় চিকচিক করে উঠে জানান দেয় নদী এখানে অন্তঃসলিলা। বালি খুঁড়ে টলটলে নির্মল জল মটকা ভরে নিয়ে যায় গ্রামবাসীরা। বালির চড় ধরে কিছুটা পথ এগোলেই শতবর্ষের পুরোনো এক আম্রকুঞ্জ তলের নিরিবিলি মনোরম গ্রামটি অতনুর ভারী প্রিয়। গ্রাম ছাড়িয়ে পায়ে চলা পথে এগিয়ে গেলে জল থৈ থৈ    টৈ টুম্বুর স্বচ্ছ নীলাভ গভীর নদীটি  'বারভি নাম নিয়ে বাঁকা তলোয়ারের মত পাহাড়ের পা ছুঁয়ে সুদূরে মিলিয়েছে মোহনার দিকে।  কৃষ্ণচূড়া, শিমুলের আবীর রাঙা লাল ফুলের সাথে হলদে অমলতাস মিলে মিশে পথ টি ফুলে ছেঁয়ে গিয়েছে। মনে হয় বনতলে কে যেন তার প্রিয় রেশমী কার্পেট টি বহুযত্নে বিছিয়ে রেখেছে। পাহাড়ি পথের এ দিক টায় শাল শিরিষ মেহগিনি সেগুন ছাড়াও ডুমুর বয়ড়া হর্তুকি  অর্জুন কত গাছেদের সারি। পাহাড়ি পাখিদের অবাধ বিচরণ , মিলন পিয়াসী ডাকে মন উতলা হয়। ,নীল আকাশের গায়ে নিশ্চিন্তে হেলান দিয়ে গৈরিক পাহাড়ের ঢাল ওপর থেকে নীচে নামার সময় মাঝে মাঝে বিরতি নিলে এ অঞ্চলে  নিত্য দিন উদয়াস্ত খেটে খাওয়া মানুষ তাদের ঘর বাড়ি বসতি নিপুন হাতের যত্নে সেখানে গড়ে তুলেছে। সহজ সরল প্রাকৃতিক জীবনে ঐশ্বর্য্যের দাম্ভিকতার বিন্দুমাত্র চিহ্ন নেই। আছে শুধু বন পাহাড় নদীর অকৃত্রিম লীলা। সরল সহজ পাহাড়ি গাঁয়ের বধূরা কাজল টানা ভীরু চোখে তাকিয়ে ,খিলখিলিয়ে হাসে ,কপালে বড়ো মেটে সিদুঁরের টিপ পরে মাথায় আঁচল টেনে ঘোমটা দেয়। নাকে চক চকে পাথর বসানো বাঁকা নোলক দুলিয়ে আসা যাওয়ার পথে হাত পা নেড়ে নিজেদের সুখ দুঃখের সাতকাহনের গল্প করে। চলার ছন্দে পায়ের রুপোর মলে ঝিনিক ঝনক শব্দ সগর্বে বাজে। ওদের হাসির লহরীতে সাদা ঝকঝকে মুক্তোর মত দাঁতের সারিতে প্রাণের আবেশ মেশানো আন্তরিক সারল্য। নদী থেকে জল তুলে একের পর এক  হাঁড়ি মাথায় চাপিয়ে পাহাড়ের ঢালু বেয়ে রুক্ষ পথে তরতর করে এগিয়ে যায়। অতনুর বেশ লাগে স্বল্প সুখের ঘরকন্নায় মানিয়ে নেওয়া গ্রামের শান্ত জনপদ বধূর এমন পটে আঁকা স্নিগ্ধ ছবিটি।  
     দিগন্ত জুড়ে বাতাসে ফাগের রঙ দোলের খেলা চলছে। সামনেই বারভি ড্যামের শোশো গর্জনে জলোচ্ছাসের নিরবধি বয়ে যাওয়ার সঙ্গে ভেজা বাতাসের স্পর্শ। খানিক দূরেই আবছা হাজিমলং পাহাড়ের উঁচু খাড়াই মাথা। সুদূর বিস্তৃত পাহাড়ের তামাটে ঢেউ খেলানো মাথা গুলো চারদিক ঘিরে সদা জাগ্রত প্রহরীর মত সতর্ক দৃষ্টি মেলে আগলে রেখেছে ঐশ্বর্য্যের দম্ভে বিলাসীতায় মত্ত মুম্বাই কে। পাহাড় নদীর সঙ্গম স্থলে একটু উঁচু জায়গায় বসে অতনুর ইচ্ছে সারাদিন ধরে রং তুলী নিয়ে ক্যানভাসে ঝর্ণা নদী পাহাড়ের ছবি আঁকবে।  বারভি  ড্যামের পরিচিত এক সাহেবের বাংলোতে গাড়িটি পার্ক করে পিঠের বোঝাটাকে ঠেলে তুলে মাঝ বরাবর রেখে স্বচ্ছন্দে বুনো পথের মধ্য দিয়ে সোজা এগিয়ে চলেছিল যেখানে বারভির শেষ তট রেখাটি মিলেছে পাহাড়ের পায়ের কাছে। আকাশে হালকা কালো মেঘের ছায়া ,ঘড়ি বেলা বারোটার কাঁটা ছুঁয়েছে। তবুও গাছে ঢাকা বুনো গন্ধে ভরা কাঁকর বিছানো এবড়ো খেবড়ো পাহাড়ি পথ ভারী মনোরম।  হঠাৎ চলার পথের পাশে কাঁটা ঝোঁপের লতা পাতার আড়ালে খসখস আওয়াজে  চমকে তাকিয়ে ভূত দেখার মত, দেখে রোগা ফর্সা  লম্বা গড়নের  ঘন কালো আঁখি পল্লবের মাঝে উজ্জ্বল  চোখের তারার এক যুবতী মেয়ে বেশ বন্য সুন্দরী হাতে পায়ে ধূলো মাটি মাখা,পরনে  নানা রংবেরঙের পুরোনো ছেঁড়া ফাঁটা  রাজস্থানী পোশাক ঘাগরা চোলি কালো ওড়না দিয়ে মাথায় ঘোমটা টানা।  ঝোঁপের আড়াল থেকে বেরিয়ে কাছে এসেছে  কপালের সামনে রুক্ষ লালচে চুল গুলো পাকানো পাটের দড়ির মত হাওয়ায় দুলছে। মৃদু স্বরে হিন্দিতে ফিশফিশিয়ে বলে ''বাবু , হেই বাবু ! আমাকে কিছু খেতে  দিবি ,-খুব তেষ্টা পেয়েছে আমি ভুখা আছিরে ,দানাপানি কাল থেকে পরে নাই। অতনু অবাক হয়ে তাকিয়ে বলে তুই কে রে ? এ গহন জঙ্গলে কোথা থেকে এলি ?  " আমি গুঞ্জা। রাতের শয়তান গুলো খুব পিছে তাড়া করলে  আমি  ওদের চোখে ফাঁকি দিয়ে এই বনে লুকিয়েছি। বাবু তুই আমাকে বাঁচা।"                                                                                                                                           কিছুটা সময় বাক্য হারা হয়ে চেয়ে থাকে ,তারপর সম্বিৎ ফিরে পায় অতনু। যন্ত্র চালিতের মত ঘন গাছের আড়ালে গিয়ে ব্যাগ থেকে জলের বোতল ও খাবারের প্যাকেট বার করে এগিয়ে দিলে একটু ও সবুর সয় না, চিলের মত ছোঁ মেরে প্যাকেট টি কেড়েই গোগ্রাসে খেতে শুরু করলে অতনু বোঝে অভুক্ত মেয়েটির কি সাংঘাতিক ক্ষুধার জ্বালায় জ্বলছিল ।  
  কিছুটা ধাতস্থ হয়ে এবার সে  নির্দ্বিধায় বলে আমি বাঞ্জারা  আছি রে। হাইওয়ের পথের ধারের যেখানে সেখানে ঝুপড়িতে বাস। আমরা খড়কুটোর মত ভেসে বেড়াই , বাপের ঠিক নেই তবে জন্মদাত্রী মা খুব ভালোবাসে। ধাবায় আসা রাতের বেলায় ট্রাক ড্রাইভার শয়তান গুলোর নজর থেকে বাঁচাতে কিছু শুকনো চিরে সঙ্গে বেঁধে দিয়ে বলে ''এই নরক থেকে পালা গুঞ্জা মহাকাল  তোকে রক্ষা করবে ।" জলের হাঁড়ি নিয়ে ঝুপড়ি ছেড়ে বেরোই নদী তে গোসল সারতে। ডুব সাঁতার দিয়ে পালিয়ে আসি এ পাড়ে , ভিজে কাপড় গায়ে শুকোলো।রাত টা কাটলো গাছের ডালে বসে। সকাল হলে নদীর পাড়ের ঐ ভাঙা নৌকার ছৈ এর মধ্যে লুকিয়েছি। দলের বাঞ্জারা পুরুষ গুলো শকুনের দৃষ্টিতে খুঁজছে। আমাকে না পেয়ে মা কে  জ্বলন্ত লোহার ছ্যাঁকা দেবে , চ্যালা কাঠের বারি মারবে। এ দিকে তোকে আসতে দেখে মনে হলো আর ডর নাই তুই মহাকালের দূত  হয়ে বুঝি আমাকে বাঁচাতে এলি।       
   গল্পের বইয়ের পাতায় প্রায়ই বাঞ্জারাদের কথা পড়েছিল অতনু।--এই সম্প্রদায় একসময়ে রাজস্থানের মরু অঞ্চল এবং গুজরাটের দিক থেকে এসে ক্রমশঃ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়লেও ,এদের বৃদ্ধি হয় স্বৈরাচারী নারীদেহ লোলুপ ব্রিটিশ রাজশক্তি ও সেনা বাহিনীদের অত্যাচারে। ভোগবিলাসে মত্ত ব্রিটিশ জাতি নিজের দেশ ছেড়ে পরদেশে এসে আমোদ আহ্লাদ ফূর্তির লালসা কামনা মেটাতে নিত্য নতুন ঘরের স্ত্রী মেয়েদের ফুসলিয়ে ,ভয় দেখিয়ে টেনে হিঁচড়ে সেনা ছাউনিতে নিয়ে নাচ গানের হুল্লোড় শেষে নির্মম ভাবে বালাৎকার ধর্ষণ করতো। সব রকম ব্যাভিচার ,সম্ভোগকরে লালসা মিটে গেলে তাদের পরিত্যাগ করে ছুঁড়ে ফেলে দিলে  সামাজিক জীবনে সেই হতভাগ্য নারীদের আর ঠাঁই মিলতো না।অচ্ছুৎ হয়ে সংসারের মূলস্রোত থেকে হারিয়ে গিয়ে বাঞ্জারা দলে মিশে ভব ঘুরে হয়ে অজানা পথের অনির্দিষ্ট নিশানায় জীবন যাপন করতে লাগলো। গুঞ্জার সরল মুখখানি ঘন কালো চোখের তারার দিকে চেয়ে থেকে মূহুর্তের মধ্যে অতনুর মনে হয় এই  অসম সাহসী অসহায় মেয়েটিকে এই ঘোর জঙ্গলের  বিপদের মাঝে ছেড়ে যাওয়া অসম্ভব , অমানবিক কাজ হবে। ও যে ছোটবেলা থেকেই দেখেছে  সমাজসেবী  নির্মলা আন্টির সাথে ওর মা কে ও বারবার যে কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে  কঠিন  বিপদের সামনে ও রুখে দাঁড়াতে।                      বাঞ্জারা দালালের দল ,পথচারি বা ট্রাক ড্রাইভার দের চোখ এড়িয়ে খুব সাবধানে একে বন থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু এই পোশাকে দিনের আলোয় ওকে দেখলে  শত্রু পক্ষ নিমেষে চিনে ফেলবে।  অতনুর এতখানি জীবনে একাকী পথচলায় এই প্রথম এমন অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা।                                                                                                                                                      এবারে মেয়েটিকে  পিঠের ব্যাগ থেকে  অতিরিক্ত পোশাক পাজামা টিশার্ট জ্যাকেট সানগ্লাস টুপি তে সেজে আসতে বলে      যদি ও অতনু প্রায় ৬ ফুট লম্বা সুঠাম স্বাস্থ্যের অধিকারী ওর পোশাক পাঁচ ফুট চার ইঞ্চির গুঞ্জার গায়ে পুরোই বেমানান। কিন্তু খুব সাবলীল গুঞ্জা নিমেষে ঢলঢলে ছেলেদের পোশাক গুঁজে পরে সানগ্লাস টুপিতে সেজে অতনুর সামনে এসে দাঁড়ালো। কালিঝুলি মাখা গুঞ্জাকে এক নজরে বাঞ্জারা মেয়ে বলে মোটেই চেনা যায় না। প্রায় ছায়া ছায়া অন্ধকার বনে নামলে ওরা সাহেব বাংলো তে ফিরে কেয়ারটেকার কে জরুরি প্রয়োজনে শহরে ফিরে যাচ্ছে জানিয়ে গাড়িতে স্টার্ট ও এক্সিলেটরে চাপ দিয়ে স্পীড তুলে দ্রুত গতিতে অন্য পথে গ্রাম ছাড়িয়ে চলতে শুরু করে। গুঞ্জা কে পিছনের সীটে ঘুমিয়ে থাকার নির্দেশ দিয়ে অতনু সতর্ক দৃষ্টিতে ড্রাইভ করতে থাকে। গ্রাম থেকে বেরোনোর পর আশেপাশের শহুরে রাস্তায় বাঞ্জারাদের  জটলায় জলজ্যান্ত মেয়েটা হাতছাড়া হয়ে কর্পূরের মত কোথায় উবে গেল হয়তো তার ই খোঁজ চলছিল ।       
অধীর বিস্ময়ে হাঁ হয়ে চেয়ে আছে মেয়েটি।এই  চাকা লাগানো বাক্স টার ভিতর টা কেমন সুগন্ধি ঠাণ্ডা ! নরম সীটে ডুবে গিয়ে আরামে চোখ বুজে আসছে । এইসব নানা রঙের ছোটো বড়ো সুন্দর গাড়ি গুলোকে ও রাস্তা দিয়ে অনবরত শব্দ তুলে ছুটে যেতে দেখেছে। দলের নির্দেশে ছোট বেলায় সিগন্যালে দাঁড়ানো গাড়ি গুলোর জানলার কাঁচে আঙুলের টোকা মেরে মালিকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে  কত  ভিক্ষে চেয়েছে, আরো একটু বড়ো হলে কত বার গোলাপ ফুল ,মুরগীর পালকের ঝাড়ন ,গাড়ি মোছা লাল কাপড়   বিক্রি করেছে বটে কিন্তু এতখানি বয়সে এমন গাড়ির চড়া এই প্রথম। ওদের পায়ে হাঁটা সর্বস্ব যাযাবরের জীবনে দলের সাথে স্থানান্তরে যেতে বেশীর ভাগ সময় ঠ্যালার গাড়িতে বা কদাচিৎ উটের পিঠে  চড়ে মরুপ্রান্তর পাহাড় পর্বত পার হয়েছে। এমন বিস্ময় কর আরামের  যাত্রা এই প্রথম , নিজের  মনেই চেঁচিয়ে বলে ''ওরে! গুঞ্জারে তোর কত ভাগ্যি।'' সে অস্বাভাবিক উত্তেজনায় বকবকানি শুরু করেছিল কিন্তু অতনুর ধমক খেয়ে চুপ করে পিছনের সীটে এলিয়ে থাকে।      
                                                               প্রায় চল্লিশ মিনিট ড্রাইভের পর জনবহুল শহরের ন্যাশানাল হাই ওয়ের রাস্তায় প্রচুর গাড়ির মিছিলে মিশে গেছে ওর স্টীল কালারের গাড়ি তবু ও মনে শঙ্কা জাগে। অনেক দ্বিধা কাজ করে,--এতো অল্প পরিচয়ে কোন বিশ্বাসে ওর ব্যাচেলর্স রুমে নিয়ে চলেছে এই সম্পূর্ণ অজ্ঞাত কুলশীল পথের মেয়েটি কে ? কী হবে এরপর ? মানব চক্ষুর নজর এড়িয়ে কোথায় নিরাপদে লুকিয়ে রাখবে একে ? প্রতিবেশী বন্ধু দের তীর্যক দৃষ্টির বাঁকা প্রশ্নের উত্তরে কি বলবে ? অতনুর মাথা উঁচুকরে বাঁচা সামাজিক জীবনে  বাস্তবিকই কোনো জবাব জানা নেই। মুহূর্তের আবেগের খেয়ালে কোনো ভুল সিদ্ধান্ত হলো না তো ? মা কাছে থাকলে কোনো অসুবিধা  ছিল না। একটা সহজ উপায় ঠিক হতো। 
এতক্ষণ গুঞ্জা বকুনি খেয়ে চুপচাপ শান্ত মেয়েটি হয়ে বসে ছিল। প্রায় ঘন্টা খানেক পার হয়ে গিয়েছে হাইওয়ের অকূস্থল ছাড়িয়ে অনেক দূর চলে এসেছে ওরা। এবার গুঞ্জার মুখে খৈ ফোটে -- বলে ঐ যে দূরে রেল লাইনের পাশে পথের ধারে নাবাল জমি গুলোয়  দেখলে অন্ধকারে টিমটিমে আলো জ্বালানো  ঐ তাঁবু গুলো -- বুনো ঝাকড়া অর্জুন গাছের আড়ালে সব আমার চেনা। অন্ধকারে ও বেশ চিনতে পারি। আরো পিছনে ঝোঁপের দিকে ঐ যে নীচু নীচু ঝুপড়ি গুলো দেখলে ওখানেই গর্ভবতী মায়েরা বাচ্চার জন্ম দেয়। অযত্নে অবহেলায় জন্মানো শিশু গুলো দিব্যি বেঁচে থাকে তারা সহজে কেউ মরেনা। মনে আছে মাস পাঁচ হলো শহর নদী পার হয়ে রাজপথ জনপদ ঘুরে শেষে কচ্ছের রান উপত্যকায় থেকেছিলাম। এদিক সেদিক ঘুরে রাজ্য রাজধানী পেরিয়ে এই বন্দরে এসেছি। অতনু ভাবে এদের জন্মের নথি পত্র শিকড় সূত্র কিছু নেই। নদী তে বান এলে তার জল যেমন সব ভাসিয়ে ধুইয়ে নিয়ে যায় তেমনি এরা ও বানভাসি হয়ে উপল খণ্ডের মত গড়াতে গড়াতে এক দেশ থেকে আর এক দেশে ভেসে বেড়ায়। ও প্রায়ই দেখেছে ,অনেক রাতে হাইওয়ে দিয়ে ফেরার সময় সিগন্যালে বা যান জটে গাড়ি ফেঁসে গেলে এই বাঞ্জারা শ্রেণীর স্ত্রী লোক গুলো অদ্ভুত সাজ পোশাকে গাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়  কোলে একটি শিশু ,হাতে দুটি ,একটি বাচ্চাদের দেখিয়ে ভিক্ষে চায়। এরা সুযোগ পেলে  রাস্তা ঘাটে একাকী ছেলে মেয়ে চুরি করে পালায় এবং অন্যত্র বিক্রি করে। এই তো সেদিন হীরানন্দানি তে ২৫শে ডিসেম্বরের যে ওপেন ফাংশান চলছিল সেখানে বাঞ্জারা ছেলেরা পকেটমারীর দায়ে ধরা পড়ায় হৈচৈ মারপিঠ তুমুল গন্ডগোল শুরু হয়ে গিয়েছিল।    
এদের পুরুষেরা দিনের বেলায় প্যারিসপ্লাষ্টার দিয়ে বানানো পুতুল বা  চীনে মাটির খেলনা ,ফ্লাওয়ার ভাস ঘর সাজানোর টুকিটাকি জিনিসের পসরা সাজিয়ে বসে। কেউ বা বাতের ব্যাথা কমানোর ঔষধি তেল ,নানা রকম পাথর ,জরি বুটি শিকড় বাকর ,দাঁতের পোকার ওষুধ ইত্যাদি বিক্রি করে। গুঞ্জা সহজ সুরে বলে ওসব কিছু নয় সব ধোঁকাবাজি। বুজরুকি। এদের কালাধান্দা ভালো মানুষের ধারণায় আসবে না। তুই ভাবতে পারিস  বাবু, চাল চুলো হীন ঐ বাঞ্জারা পরিবারে মেয়ে সন্তান জন্মালে পুরুষরা আনন্দে উৎসবে মাতে। কাঁসর ঘন্টা ঢোল করতাল বাজিয়ে সারা রাত ধরে খানা পিনা নাচ গান করে। কে- ন জানিস? সংসারে মেয়ে এলো মানে মুফতে ব্যবসায় লাভ। মেয়েটির মা খুব বেশী হলে চৌদ্দ থেকে সতের বছরের। মা কে তো ব্যাবসায় খাটানো চলছেই এদিকে মেয়ে ও বড়ো হয়ে যাচ্ছে। মা মেয়ে দুজন কেই বিনা খরচে, বিনা পরিশ্রমে এই লাভজনক ব্যাবসায় খাটানো যাবে। নয়তো চড়াদামে বিক্রি ও হতে পারে। ওদের টাকার সুখ মেটাতে গুঞ্জা রতুয়া সুরতীয়া বসকির দল প্রতি রাতে চুমকী বসানো সোনালী রূপালী জরির শাড়ি আর ঝুটো মুক্তোর গয়নায় কোনে সেজে পায়ে মল বাজিয়ে নিত্য নতুন লোক দেখানো বরের সাথে বাসর ঘরে সোহাগ রাত কাটাতে যাই। শুধু সংসারের আয়ের জন্য না বালিকা মেয়ে টিকে ওদের আদিম লালসার শিকার হতে হয়। কখোনো অল্প দামের বিনিময়ে একটা তরতাজা মেয়ে কে ছিবড়ে করে ফেলে রক্তাক্ত করে ছাড়ে হিংস্র বর্বরতায়। সেদিন রতুয়া কে নীল শাড়ি তে পরীর মত সুন্দর সাজিয়ে দিল পরভীন দিদি। আর ওদের  ডেরায় পোঁছে দিলো ভজু ভাইয়া ,সেই থেকে রতুয়ার দেহ টা খারাপ হয়ে আছে , সে আর কথা বলে না হাসে না ভয়ে কুঁকড়ে থাকে। বাঞ্জারা বৌ ,মেয়েরা আপত্তি জানালে তাদের ঘরের পুরুষেরাই অবাধ্য মেয়ে বৌ দের ওপর চাবুক কষায় , খেতে দেয়  না আগুনের ছ্যাঁকা দিয়ে অকথ্য নির্যাতন চালায়। আমাদের মেয়েরা যে কত হাত ঘোরে কত ঘাটের জল খেয়ে গরু ছাগলের মত জীবন ধারণ করছে তার ঠিক  নেই রে বাবু । ঐ যে খাটিয়া পাতা দেখলি ,হাইওয়েতে ধাবার সামনে ট্রাক ড্রাইভার গুলো রাতে ওখানে খেয়ে জিরোতে বসলে বাজার দর দেখে দাম ঠিক হয়  আমাদের  ঘরের পুরুষের সাথে। গভীর রাতের ভ্রমর হয়ে  সমাজের আরো অনেক গণ্য মান্য মানুষ আছে যারা অন্ধকারে মৌচাকে মধুর মজা লুটতে আসে। দিনের আলোয় ওরা  সভ্য সমাজের অতি স্বীকৃত জন ,তাদের জন্ম পরিচয় আছে। তাদের বৈধ শরীরে অবৈধ হাঙ্গরের ক্ষিদে--এবং তা  মেটাতে গুঞ্জা রতুয়া দের পরিবারের দাদারা ভাইরা স্বামীরা এমন কি বাবারা পর্যন্ত দালালি করে.খদ্দের ধরে ঘন্টা মিনিটের হিসেবে  উপযুক্ত দাম উসুল করে নেয়।  বলতো বাবু এই ভাবে কেন কীটের মত বেঁচে থাকা ?  বাঞ্জারা ছেলেরা  ভিক্ষে বৃত্তি থেকে চুরি ছিনতাই পকেটমারি করে ছেলেবেলা পার করে বড়ো হয়ে দালাল ,গুন্ডা বদমাশ তৈরী হয়। মেয়েরা ঘরের কাজের সাথে  ভিক্ষে করে ছোটবেলা কাটিয়ে যৌবনবতী হলে দেহ ব্যাবসায় নেমে  রূপের বেসাতি করে সংসারের আয়ের জন্য। এ কঠিন পৃথিবীতে আমাদের কোথাও ঠাঁই নাই। বলে একবার যদি সুযোগ পাই এই দুর্ভাগা দের মধ্যে পরিবর্তন এনে এমন অন্ধকারের জীবনে আলোর দিশা দেখাতে চাই। গভীর আত্মবিশ্বাস ঝরে ওর গলায়। মহাকাল আমার সহায় তাই শরীরে যৌবন এই কুড়ি ,বাইশ বছরেও বাহার আনেনি। খদ্দের দের নজরের তালিকায় ব্রাত্য হয়ে ছিলাম কিন্তু কয়েক দিন ধরেই শুনছি ওরা   বর্ডারে চালান করবে ,চোরাই পথে লাহোরে বিক্রি হয়ে যাবো। বাবু এবার ধরা পড়লে মরণ আমার হবেই। তবে মরার আগে একবার শেষ চেষ্টা করবো বলেই দল ছেড়ে পালানোর চেষ্টা করেছি ।                                                                                                                                     অতনুর মনেই হয় না এই  শিক্ষা দীক্ষাহীন প্রতিবাদী মেয়েটি  নিরক্ষর হলে ও মোটেই বুদ্ধি হীন নয়। ব্রিটিশ রা এ দেশ ছেড়ে কবে চলে গিয়েছে কিন্তু  ,তাদের জুলুমদারির নোংরা রুচির বীজ এদেশের মানুষের রক্তে মিশে গিয়েছে। ৭৬ বছরের স্বাধীন ভারতবর্ষে এদের কোনো অধিকার নেই?  অতনুর কানে বাজে প্রধান মন্ত্রীর "বেটী বাঁচাও " স্লোগান। সেই বেটিদের দলে কি গুঞ্জারা পরে না ? ওরা কি এই দেশের নাগরিক নয় ?  এদের ও তো সুস্থ স্বাভাবিক জীবন নিয়ে বাঁচার অধিকার আছে। সরকারি অনুদান বা কোনো মদত এদের জুটবে না, রেশন কার্ড নেই ,ভোটার কার্ড! বা আঁধার কার্ড ! নাগরিকত্বের পরিচয় পত্র কিছুই এদের নেই। সামনে শুধুই অন্ধকার। 
  অনেকটা সময় পার হয়ে গিয়েছে উত্তেজনায় ক্ষুধা তৃষ্ণার বালাই ছিল না। কোনো রেঁস্তোরায় গুঞ্জা কে প্রকাশ্যে  নিয়ে যাওয়া ঠিক হবেনা ধরা পড়ার ভয় আছে।  সামনেই স্ট্রীট ফুডের দোকান থেকে প্যাকেট নিয়ে রাতের খাবার মিটিয়ে গাড়ি.যত বাড়ির দিকে এগোচ্ছে ,অতনুর মাথায় দামামা বেজেই  চলেছে। পথের বিপদ থেকে তখন ছিল মেয়েটিকে  রক্ষার  চেষ্টা। এখন এক কামরার ঘরে বদ্ধ চার দেওয়ালের মধ্যে অভ্যস্থ তার একাকী জীবনে সম্পূর্ণ অপরিচিত এই পথের মেয়েটি কে নিয়ে  থাকতে খুব ই সংস্কার ,ও আভিজাত্যে বাঁধছে। ভাবতে পারছে না সে কি করবে ?    
  রাত এগারোটা হলো পাওয়াই লেকের ধারে অতনুর বারো তলার ওপরে  ফ্ল্যাটে পৌঁছতে। লিফ্টে উঠে গুঞ্জা আবাক ! বাবু এ কোথায় তাকে নিয়ে এলো ?  তবে কী এখানে ও কিছু  অঘটন ঘটবে? রাতের বিভীষিকা ময় ট্রাক ড্রাইভারের আতঙ্ক ওকে গ্রাস করেছে। রাস্তার ধারের হোটেলের পিছনে নিভৃতে ঘর গুলোর কথা মনে পড়ছে।মহাকালের দূতের  ওপর আর বিশ্বাস ভরসা থাকে না ,--ফ্ল্যাটের দরজায় পৌঁছে সে শক্ত শাল কাঠের মত গ্যাট হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কোনো মতেই ঘরে ঢুকতে চায় না।ও বোঝে না এতো রাতে ফ্ল্যাট বাড়িতে ব্যাচেলারের দরজায় দাঁড়িয়ে জেদ দেখাতে থাকলে অতনুর পক্ষে পরিস্থিতি কত জটিল হয়ে উঠবে। নিরুপায় একগুঁয়ে জেদী মেয়েটা কে বোঝানো ছেড়ে দিয়ে একরকম  জোর করে ঠেলেই ঘরে ঢুকিয়ে দরজায় তালা লাগিয়ে দেয়। সারাদিনের পরিশ্রম ও চিন্তায় মাথায় যেন একশ কেজির বৃহৎ বোঝাটি কেউ চাপিয়ে দিয়েছে। ক্লান্ত অবসন্ন শরীরে স্নান ঘরে ঢুকে শাওয়ার টি খুলে দিলে কিছুটা আরাম বোধ হলেও স্নান সেরে এসে দেখে আর এক  মহাবিপদ গুঞ্জা ফুঁপিয়ে কাঁদছে। কিছু বোঝাতে গেলে ডাক ছেড়ে কান্না শুরু করবে।                     ওর মন নরম হয় ,ভাবে যার মুক্ত খোলা আকাশের তলে থাকাই অভ্যাস ,সে এই বারো তলার ওপরে বদ্ধ ঘরের খাঁচায় থাকবে কি করে ? ওকে ওয়াশ রুম ব্যবহার  শিখিয়ে স্নান সারতে বলায় সেখানে ও বিস্তর আপত্তি। যে মেয়ে পাহাড়ি ঝর্ণার সাথে নাচে  ,দীঘির জলে ঝাঁপায়, নদীতে ডুব সাঁতার কেটে শত্রু পক্ষের চোখে ধূলো দিয়ে পালায়  সে কেমন করে আধুনিক স্নান ঘরের নিয়ম জানবে। গুঞ্জা যে হঠাৎ হাওয়ায় ভেসে আসা মুক্ত প্রাণের প্রতীক। বনের পাখিতো খাঁচায় বন্দি হয়ে পাখা ঝাপ্টাবেই।    রাত বাড়ছে ও বেডরুম গুঞ্জা কে ছেড়ে দিয়ে দক্ষিণ খোলা এই ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতে রাখা ফোল্ডিং ইজিচেয়ারে ,জ্বলন্ত সিগারেট হাতে সেখানেই চাদর নিয়ে আধ শোয়া হয়ে গা এলিয়ে দিয়েছে। ভাবছে যতদিন কিছু ব্যবস্থা না হয় ও রাত এখানেই দিব্যি কাটাবে। ছোট্ট এই উন্মুক্ত বারান্দায় এক টুকরো রাতের আকাশ থেকে চাঁদ চেয়ে থাকে। আজ হোলী  ছিল পূর্ণিমার আলো আকাশ জুড়ে , রাতের নিস্তব্ধ তরঙ্গ হীন শান্ত পাওয়াইয়ের জলে ও তার রূপালী ছায়া মৃদু ঢেউ তুলে যায়। দিনের আলোয় এখানে বসেই  শ্যাওলা রাঙা জলে নীল আকাশের ছায়া পরে। মাছ শিকারী সাদা বক আর সারস গুলোর সারাদিন হুটোপাটি চলে। বিকেল থেকে সন্ধ্যেরাত পর্যন্ত কলেজ পড়ুয়া দের দুরন্ত যৌবনের হাসি আড্ডায় জমে ওঠে লেকের ধার। ভেজা হাওয়ায় শরীর জুড়িয়ে গেলেও একরাশ চিন্তারা পিছু ছাড়ে না। ফোন খুলে দেখে বেশ কত গুলো মিস কল রয়েছে সব মায়ের। রিং ব্যাক করে লাভ নেই মা এতো রাতে  ঘুমিয়ে পড়েছে। কাল বিকেলের প্লেনের টিকিট মাকে পাঠিয়ে দিলে কেমন হয় ?  অতনুর মাথায় দামামা বাজাটা এখনো থামে নি ---সিগারেটে সুখ টান দিয়ে মনে পড়ে নির্মলা আন্টির আশ্রমের কথা।  ফোনের কল লিষ্টে  নাম্বার টা অন্ততঃ পাওয়া যাবে । ধোঁয়ারা দলা পাকিয়ে গোল গোল হয়ে আধ খোলা গ্রীল পেরিয়ে অন্ধকারে মিশে যায়। ও নিজেই ভেবে পায় না এ কেমন বিপদে  জড়িয়ে পরেছে।  সারা রাত আধো ঘুম আধো জাগরণে কাটে। বিভীষিকা ময় দুঃস্বপ্নেরা তাড়া করে বেড়ায়। লীনা সাদা ধবধবে। ফ্যাকাশে রক্ত শূন্য মুখে তাকিয়ে সাদা গ্রাউনে সেজেছে গাঢ় করে কাজল দিয়ে চোখ আঁকা খোলা চুলে ''অতনু গোল্লা পেলি ''বলে  দুই হাতে তালি বাজিয়ে অকারণে হাসছে। নাচছে ও যেন কদাকার রূপে।
 বাঞ্জারার দল জোর ধাওয়া করে ওদের ধরে ফেলে গাছের সাথে হাত পা কষে বেঁধে রেখেছে। হৈহৈ করে পাওয়াইয়ের জল  সাঁতরে সব ফ্ল্যাটের তলায়, ওরা সাংঘাতিক হিংস্র আগুন জ্বালিয়ে উদ্দম নাচ শুরু করেছে।  ঢম ঢম করে ঢোল বাজাচ্ছে কানের পর্দা ফাটিয়ে। আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল স্বপ্নের বাঞ্জারারা নয় বাস্তবের গুঞ্জা দরজা পেটাচ্ছে ,মেঝের এক কোণে কুন্ডলি পাকিয়ে ওড়না গায়ে জড়িয়েই মেয়েটি ঘুমিয়ে ছিল রাতে। এখন জেগে গিয়ে ভাবছে গোসল খানায় যাবে কি করে ? মহাজ্বালা! এখন ভোর সাড়ে পাঁচ টা ,ঘুটঘুটে অন্ধকার। মুম্বাইতে সকাল হয় বেশ দেরীতে।  অতনু  চা বানিয়ে  ফ্লাক্সে ঢেলে রেখে   বারান্দায় ফিরে এসে মা কে ফোন করে। কুশল বার্তা জানিয়ে বলে রেডী হয়ে থাকো ,আজ বিকেলের ফ্লাইটে তোমাকে মুম্বাই আসতে হবে।        
                                                                                                                     ওপার থেকে মার উদ্বিগ্ন গলায় জানায়  ব্যাংকে খুব চাপ ছুটি পাওয়া যাবে না। কয়েক দিন খুব ব্যস্ত থাকবে ,তারপর অবশ্যই আসবে। উতলা মা প্রশ্ন করে এত জরুরি তলব কেন ?- 
অতনু আর ভাঙে না ,বলে এমনি ,-তুমি এলে বেশ হয়। 
কথা বাড়ায় না ,ফোন রেখে দেয়.। .-                                                                                                                নির্মলা আন্টির ফোন রিং হচ্ছে।  ওর তর সয় না।  কয়েকবার  রিং হোতেই আওয়াজ শুনে আন্টি ঠিক চিনেছে। সব কথা মন দিয়ে শোনার পর কাশীদ বীচের কাছে মহিলা ওয়েলফেয়ার সমিতির  ঠিকানায় চলে আসতে বলেন। মুম্বাই শহর থেকে প্রায় আশি কি,মি,র মত দূরত্বে কাশীদ বীচের মাঝ বরাবর রাস্তায় পড়বে আশ্রম টি । ঐ  বীচটি  চেনা জায়গা , সাগরপাড়ের প্রত্যন্ত এক গ্রামে  মৎস জীবিদের বাস। দুবার বেড়াতে গিয়ে জেলেদের ডেরায় মাছ ভাত খেয়েছিল। ভারী সুন্দর ঝাউয়ের সাথে নারকেল গাছের সারি দিয়ে সাজানো, সোনালী বালুময় তপ্ত সমুদ্রবেলা ভূমি। প্রায় ঘন্টা তিনেকের রাস্তা ,গুগুলে ঠিক পথ চিনে চলে যেতে পারবে। নির্মলা মা এখন আশ্রমেই,থাকবে , অতনুর কাজ গুঞ্জাকে সাবধানে সেখানে পৌঁছে দেওয়া। খুব বেশী দেরী করা যাবে না বেলা বাড়ার আগেই প্রতিবেশী দের কৌতূহল সপ্রশ্ন দৃষ্টি এড়িয়ে ওদের বেরিয়ে পড়তে হবে। চা ব্রেড বাটারে ব্রেকফাষ্ট সেরে এখন খুব শান্ত গুঞ্জা বিনা বাক্য ব্যয়ে রেডি হয়ে নিয়েছে অতনুর ই পাজামা টিশার্টে। নতুন দিনের ঝকঝকে সকালের নির্মল আলোর ঝর্ণা ধারার আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে অতনু প্রণাম জানায় সেই সর্ব শক্তি মান দেবতাকে। ওর একান্ত চাওয়া গুঞ্জার জীবনের সেই দুর্বিষহ রাত গুলো যেন কখোনো না ফিরে আসে। ওর বিদ্রোহী সাহসী মন আরো দৃঢ় হোক। ওর এই বিস্ময়কর মুক্তির প্রয়াস যেন বিফলে না যায়। শ্যাওলা সবুজ কচুরি পানার মত স্রোতে ভেসে বেড়ানো জীবনে পরিবর্তন আসুক। ওর দৃঢ় বিশ্বাস  নির্মলা আন্টি ঠিক আলোর পথ দেখাবে। গুগুলের পথ নির্দেশিকা ফলো করে গাড়ির চাকা ঘুরছে ওরা পাওয়াই পেরিয়ে গিয়ে  হাইওয়ে ধরে ব্রিজের ওপর উঠে স্পীড  বাড়িয়ে দিয়েছে । কাশীদ বীচে যাবার রাস্তা পরিষ্কার দেখাচ্ছে  নেটে যানজট নেই বললেই চলে।  নীল লাইন গুলো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে স্মার্টফোনের ঝকঝকে পর্দার ওপর ।

Post a Comment

2 Comments

  1. অসাধারণ গল্প। গল্প কিন্তু বাস্তবতার
    পরশে মাখামাখি বুনো গুঞ্জার উত্তরণের কাহিনী খুবই মনোমুগধকর। খুব ভালো লাগলো। এরকম অতনু ঘরে ঘরে জন্মাক।
    অসহায় মেয়েগুলো দানবীয় স্পর্শমুক্ত হয়ে শুধু পশু নয় দেবতাও আছে পৃথিবীতে, এটুকু বিশ্বাস নিয়ে নিশ্বাস ফেলুক।

    ReplyDelete
  2. বাস্তব সমস্যা। লেখিকার ভাষার ব্যবহার ও দৃশ্যপট বর্ণনা অনবদ্য। তবে বাস্তবে র অতনু এতটাই ইমোশনাল আর কর্ত্যব্য পরায়ণ হবে তো?
    লেখিকার কাছে আরও প্রত্যাশা রইল

    ReplyDelete