জ্বলদর্চি

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় // ঈশিতা ভাদুড়ী


স্মৃতি ডট কম ১৫

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় // ঈশিতা ভাদুড়ী
 
ভালোবাসা বহুদিন আগেই / বাসে উঠে পড়তে না পেরে / দাঁড়িয়ে গেছে / হয়ত এখনও বাস-স্টপে / মুখ তার / আঠারো বছরের শ্যামল ইস্পাত / হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। / এক একদিন ইচ্ছে করে / ফিরতি বাসে উঠে চলে যাই / দেখে আসি তাকে / এক এক দিন আমার যাওয়ার সম্ভাবনায় / বৃষ্টি আসে / আকাশকে আষাঢ় ব’লে ডাকতে ইচ্ছে করে। / ‘এই যে, এতে দেরী করলে কেন / ব’লে কেউ কব্জিটা শক্ত ক’রে / ধ’রে নামিয়ে নেবে / আঠারো বছরের মুখে কিছুটা ইস্পাত থাকে / এখন হাতে পিস্তল রাখা বারণ / তাই নীল ইস্পাতটুকু মুখে / ভালোবাসার কাছে কিছুই নেই এমন / কার্তুজ বন্ধুরা রাজনীতি / একটি বর্ষাতিও নয় / বরষায় তাকে খুব একা দেখব বোধ হয় / যদি ফিরতি বাসে যাই – এমন কবিকে প্রেমিক না ভেবে উপায় নেই! 

অপু ট্রিলজি ফিল্মের অপুর সংসারে দেখে ফেলেছি সৌমিত্রকে শর্মিলাকে। পথের পাঁচালীতে বালক অপুকে দেখেছি, যেখানে সে তার বাবা ও বোনকে হারিয়েছে, তারপর অপরাজিতর কৈশোরে তার মাতৃবিয়োগ দেখে অবশেষে অপুর সুখ দেখেছি। অপর্ণার (শর্মিলা ঠাকুর) সঙ্গে অপ্রত্যাশিত বিবাহ, এবং তাদের রোমান্টিক অভিনয় ও একটি অদ্ভূত রসায়ন এমন একটি স্তরে পৌঁছে দিল যে, অভিনয় তখন আর শুধুমাত্র অভিনয় রইল না।

দেবী, ক্ষুধিত পাষাণ, ঝিন্দের বন্দী, তিন কন্যা কী সব সিনেমা! একে একে সেসব দেখতে থাকলাম। আর, তাঁর অসামান্য অভিনয়ে মুগ্ধ হতে থাকলাম, কখনও রোমান্টিক চরিত্রে, কখনও বিশেষ চরিত্রে, মাঝে মাঝে ফেলুদার বুদ্ধিদীপ্ত অভিনয়। কাকে ছেড়ে কাকে রাখি প্রথমে! শুধু তো সিনেমা নয়, তাঁর একাধিক নাটক টিকটিকি, আত্মকথা খুব উল্লেখযোগ্য ছিল। সৌমিত্র রয়ে গেছেন তাঁর কাজের মাধ্যমে আমাদের বুকের মধ্যে।

২০০৮ সালে, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আত্মকথা নাটকের পরিচালনা ও অভিনয় করেন, মারাঠি নাটকের বাংলা অনুবাদ। একজন বৃদ্ধ মানুষ, শুভঙ্কর, একজন বিখ্যাত লেখক। তাঁর থেকে অনেক কম বয়সী মেয়ে প্রজ্ঞা তাঁর জীবন নিয়ে পর্যালোচনা করে সত্যগুলি এমনভাবে আঁকেন, মানুষটির মধ্যে থাকা অসত্যের স্তরগুলিকে উচ্ছেদ করার চেষ্টা করে, যেন সে শুভঙ্করের সামনে একটি আয়না ধরে তাঁর মধ্যে থাকা অসত্যের স্তরগুলিকে উন্মুক্ত করে ধীরে ধীরে। তাঁর জীবনের সবচেয়ে কাছের দুই মহিলা তাঁর স্ত্রী উত্তরা এবং শ্যালিকা বাসন্তীর সঙ্গে প্রতারণা দেখাতে শুরু করে। তাঁর বিচ্ছিন্ন স্ত্রী উত্তরার হঠাৎ একটি টেলিফোন কল একটি টার্নিং পয়েন্ট হয়ে ওঠে। প্রজ্ঞা তার বয়সের তিনগুণ এই লোকটির প্রতি আবেগগতভাবে আকৃষ্ট হয় এবং শুভঙ্কর অসহায়ভাবে তাকিয়ে থাকে। বাস্তব এবং সাহিত্য একত্রিত হতে শুরু করে এবং মিশে যায় এবং আবার আলাদা হয়। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ছাড়া শুভঙ্করের চরিত্র আর কেউই এমন সফলভাবে ফোটাতে পারতেন না। যখন প্রজ্ঞা তাঁকে মিথ্যার যাপনের জন্য অভিযুক্ত করে, তাঁর মুখে সেই বিভ্রান্তিকর ভ্রুকুটি এবং একটি হাত তাঁর কপাল ঘষে তাঁর উদ্বেগ দূর করতে চেষ্টা করে, তাঁর অস্থিরতা, তাঁর শারীরিক ভাষার তুলনা হয় না। 

এরপর ‘ফেরা’তে অঞ্চলপ্রধানের চরিত্রে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। একজন অভিনেতা কি সত্যিই একটি ‘চরিত্র’ হয়ে ওঠেন, বা, হওয়া সম্ভব? সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কিন্তু সারাজীবন এই দুরূহ কাজটাই করেছেন। ‘চরিত্র’ হয়ে ওঠার পাশাপাশি চরিত্রের সঙ্গে এক অদ্ভুত দূরত্বও বজায় রেখেছেন, যার ফলে শুধু চরিত্রটির ব্যক্তিগত হাসি-কান্না-ব্যথা-আনন্দ নয়, আমরা চরিত্রটির আর্থ-সামাজিক চেহারাটিও বুঝতে পারি। 
আমাদের অল্পবয়সে সৌমিত্র উত্তমকে নিয়ে দড়ি টানাটানি চলতো। বেশির ভাগ মানুষ হাত তুলতেন উত্তমকুমারের দিকে। আমি সৌমিত্রকে ভালোবাসতাম। আমার চেয়ে বয়সে বড় মানুষেরা এমন চোখে তাকাতেন আমার দিকে, যেন আমি একটা আহাম্মক। সবাই উত্তমকুমারের সঙ্গে একটু দেখা করার জন্যে কত লোলুপ থাকতো। আমি বুঝতাম না উত্তম সৌমিত্রর তুলনা কেন আসবে! পরে আমি ভেবেছি এবং বুঝেছি উত্তম তো স্টার ছিলেন। আর, সৌমিত্র একজন অভিনেতা ছিলেন, একজন কবি, একজন নাট্যকার, একজন আবৃত্তিকার, একজন সম্পাদক। সৌমিত্র সমগ্রভাবে এক মানুষ ছিলেন। সেই মানুষটিকে আমি ভালোবেসেছিলাম। তাঁর কণ্ঠের স্বকীয়তা, তাঁর আবৃত্তি, তাঁর অভিনয়, তাঁর কবিতা, তাঁর কথা বলার ভঙ্গিমা, সর্বোপরি তাঁর সুদর্শন চেহারা আলোড়িত করেছে আমাকে, আমার মতন আরও অনেকে। 
যতীন্দ্রমোহন বাগচীর১২৫ তম জন্মশতবর্ষে যতীন্দ্রমোহনের কবিতার ক্যাসেট করা হয়েছিল। সেই কারণে আমি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে কবিতাপাঠের রেকর্ডিং করার অনুরোধ করে ফোন করেছিলাম, প্রথমে আমার পরিচয় দেওয়াতে বলেছিলেন 'হ্যাঁ হ্যাঁ আপনাকে জানি তো, আপনার কবিতা পড়ি তো!' এই কথা শোনার পর কতদিন যে আমার পা আর মাটিতে পড়েনি!



জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇



Post a Comment

2 Comments