জ্বলদর্চি

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা-৬৬/প্রীতম সেনগুপ্ত

পর্ব ৬৬
শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা

প্রীতম সেনগুপ্ত

স্বামী অভেদানন্দ

 ১৮৬৬ সালের ২ অক্টোবর, মঙ্গলবার, উত্তর কলকাতার আহিরিটোলায় নিমু গোস্বামী লেনে জন্মগ্রহণ করেন কালীপ্রসাদ চন্দ্র। তাঁর পিতা রসিকলাল চন্দ্র ওরিয়েন্টাল সেমিনারি স্কুলের ইংরেজি শিক্ষক ছিলেন। এক পুত্র ও এক কন্যা সন্তানকে রেখে তাঁর প্রথমা স্ত্রী পরলোক গমন করেন। এরপর আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবদের অনুরোধে তিনি দ্বিতীয়বারের জন্য দারপরিগ্রহ করেন। দ্বিতীয়া স্ত্রী ছিলেন নয়নতারা দেবী। চৌদ্দ বৎসর বয়সে রসিকলালের সঙ্গে বিবাহ হয় তাঁর। অত্যন্ত শান্ত প্রকৃতির ও আধ্যাত্মিকভাবসম্পন্না ছিলেন। আদর্শ পত্নী ছিলেন তিনি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নয়টি সন্তানের জন্ম দেন, যার মধ্যে প্রথম পাঁচটি অল্প বয়সে মারা যায়। অবশিষ্ট চারজনের মধ্যে দ্বিতীয়জন হল কালী। কালীর জন্মের পূর্বে নয়নতারা দেবী মা কালীর কাছে পুত্র সন্তানের জন্য প্রার্থনা জানিয়েছিলেন। তাই পুত্র সন্তান জন্মের পর নাম দেন কালীপ্রসাদ। এই কালীপ্রসাদই উত্তরকালে শ্রীরামকৃষ্ণদেবের সন্ন্যাসী সন্তানদের অন্যতম স্বামী অভেদানন্দ।
 ১৮৭১ সালে পাঁচ বছর বয়সে কালী গোবিন্দ শীলের পাঠশালায় ভর্তি হন। সেখানে দুই বৎসর অধ্যয়ন করেন। অক্ষর শিক্ষা লাভ হয় এবং রামায়ণ ও মহাভারতের কাহিনি শ্রবণ করেন। নৈতিকভাবযুক্ত সংস্কৃত স্তোত্র মুখস্থ করতে শুরু করেন। এরপর যোগদান করেন যদু পণ্ডিতের বঙ্গ বিদ্যালয়ে। সঙ্গে সঙ্গে সন্ধেবেলায় হাতিবাগানে সংস্কৃত বিদ্যালয়ে সংস্কৃত শিক্ষা চলতে থাকে। সংস্কৃত ব্যাকরণ শিক্ষা লাভ করতে থাকেন। কালী অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র এবং নিমগ্ন পাঠক ছিলেন। এই সময়ে প্রথাগত শিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে তিনি ধ্রুপদী সংস্কৃত সাহিত্যের রসাস্বাদন করতে শুরু করেন। এর মধ্যে ছিল হিতোপদেশ, রঘুবংশম, কুমারসম্ভবম, শকুন্তলা এবং ভাত্তি-কাব্যায়ম। তিনি ছন্দঃশাস্ত্রে পারঙ্গম হয়ে ওঠেন এবং সংস্কৃত ছন্দকাব্য রচনা করতে থাকেন। দশ বছর বয়সে কালী সুপরিচিত ওরিয়েন্টাল সেমিনারি স্কুলে ভর্তি হন। এই স্কুলে তাঁর পিতা যে ইংরেজি শিক্ষক ছিলেন সে কথা পূর্বেই উল্লিখিত হয়েছে।


জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇



 শরীরচর্চা সম্বন্ধে কালী উদাসীন ছিলেন না। বিদ্যাচর্চার পাশাপাশি এটিও করতেন আন্তরিকভাবে। বন্ধুদের সঙ্গে গঙ্গায় নিয়মিত সাঁতার কাটতেন এবং বাড়ির পাশেই একটি আখড়ায় ব্যায়াম করতে যেতেন প্রতিদিন। হার্বার্ট স্পেনসরের ‘এডুকেশন’ বইটি পাঠ করে কালী দেখেন লেখক দাবি করেছেন, যারা অসম্ভব ব্যায়ামাদি করে থাকেন, তাদের বুদ্ধিবৃত্তি হ্রাস পায়। এটি জানার পর আখড়ায় যাওয়া সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দেন কালী। তিনি উইলসনের ভারতের ইতিহাস পাঠ করেন। সেখান থেকে জানতে পারেন বেদান্তের মহান ব্যাখ্যাতা শঙ্করাচার্যের কথা। শঙ্করের জীবন ও কর্ম তাঁকে উদ্বুদ্ধ করে। শঙ্করের মতো মহাপণ্ডিত দার্শনিক হবেন এমন ইচ্ছা পোষণ করতেন।
১৮৮০-র দশক। কলকাতা তখন ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী। ধর্মীয়, রাজনৈতিক কিংবা সাংস্কৃতিক -- সবদিক দিয়েই এই শহর তখন আন্দোলনমুখর। কালী সেই সময় বক্তৃতা শুনছেন মহান জাতীয় নেতা সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের, প্রখ্যাত ব্রাহ্ম নেতা কেশবচন্দ্র সেন ও প্রতাপচন্দ্র মজুমদারের এবং খ্রিস্টীয় ধর্মযাজক রেভারেণ্ড কালীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের। সেই সময় খ্রিস্টীয় প্রচারের গ্রাস থেকে হিন্দু ধর্মকে রক্ষা করতে তৎপর হয়ে উঠেছিলেন হিন্দু ধর্মের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ। ১৮৮২-৮৩ সাল নাগাদ সুবিখ্যাত পণ্ডিত শশধর তর্কচূড়ামণি হিন্দুধর্মের ব্যাখ্যা করতে শুরু করলেন বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির নিরিখে। তিনি হিন্দু দর্শনের ছয় রীতি ( Six systems ) বিষয়ে পরপর বক্তৃতা প্রদান করতে থাকেন। কালী নিয়মিত সেইসব বক্তৃতা শুনতে যেতেন অ্যালবার্ট হলে। একদিন তাঁর কাছে পতঞ্জলির যোগসূত্র বিষয়ে শিক্ষালাভের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কিন্তু শশধর জানিয়ে দেন তাঁর সময়াভাবের কথা এবং অন্য এক পণ্ডিত কালীবর বেদান্তবাগীশের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। 
 শাস্ত্রশিক্ষার বিষয়ে কালীর আগ্রহ ছিল লক্ষ্য করার মতো। তিনি বেদান্তবাগীশের সঙ্গে যখন সাক্ষাৎ করতে গেলেন, সেই সময় বেদান্তবাগীশ পতঞ্জলি যোগসূত্র সংস্কৃত থেকে বাংলায় অনুবাদ করছেন। তিনিও কালীকে জানালেন সময়াভাবের কথা। তবে সকালবেলায় স্নান করার আগে তাঁর ভৃত্য যখন তাঁর গাত্রে তৈল মর্দন করে সেই সময়টা তিনি কালীকে যোগসূত্র ব্যাখ্যা করতে পারবেন বলে জানালেন। কালী এই প্রস্তাবে সানন্দে রাজি হয়ে গেলেন এবং প্রতিদিন সকালে পণ্ডিতের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে শুরু করলেন। তিনি যোগসূত্র পাঠ করতেন এবং পণ্ডিত তার ব্যাখ্যা করতেন। এইভাবে কালী যোগ দর্শন বিষয়ক পাঠ সমাপন করেন।
 এরপর শিবসংহিতা বইটি ক্রয় করলেন। সেটি পাঠ করে হঠযোগ, কুণ্ডলিনী যোগ, প্রাণায়াম এবং রাজযোগ বিষয়ে শিক্ষালাভ করলেন। তাঁর ইচ্ছা ছিল হঠযোগের একটি বিশেষ পদ্ধতি - খেচরি মুদ্রা সহায়ে সমাধিতে নিমগ্ন হবেন। কিন্তু যথাযথ যোগীর নির্দেশ ব্যতীত এটি না করাই শ্রেয়, একথা জেনে বিরত থাকলেন।
 কীভাবে কালী শেষমেশ শ্রীরামকৃষ্ণদেবের সংস্পর্শে এলেন সেই বিষয়ে স্বামী গম্ভীরানন্দজী ‘শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তমালিকা’ গ্রন্থে চমৎকার বর্ণনা দান করেছেন। সেটি এইরকম --“...যোগশাস্ত্রপাঠে তিনি জানিলেন যে, উপযুক্ত গুরুর নিকট যোগাভ্যাস করা আবশ্যক। তদনুসারে গুরুর সন্ধানে মন আকুল হইয়াছে এমন সময়ে সহপাঠী যজ্ঞেশ্বর ভট্টাচার্যের নিকট তিনি দক্ষিণেশ্বরের পরমহংস শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ধান পাইলেন। 
 শ্রীরামকৃষ্ণকে দেখিবার আগ্রহে তিনি ( সম্ভবতঃ ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যভাগে ) একদিন কাহাকেও কিছু না বলিয়া পদব্রজে দক্ষিণেশ্বর চলিলেন। পথ অজ্ঞাত। অনেক দূর চলার পর যখন জানিলেন যে, দক্ষিণেশ্বর পশ্চাতে ফেলিয়া আসিয়াছেন, তখন আবার বিপরীত দিকে হাঁটিয়া দ্বিপ্রহরে কালীবাড়ির উত্তরের প্রবেশদ্বার অতিক্রমপূর্বক বেলতলা ও পঞ্চবটীর পার্শ্ব দিয়া মন্দিরপ্রাঙ্গনে উপস্থিত হইলেন। কিন্তু সংবাদ লইয়া জানিলেন যে, পরমহংস মহাশয় কলিকাতায় গিয়াছেন, রাত্রে ফিরিবেন। অগত্যা তিনি হতাশমনে ক্লান্তদেহে পরমহংসদেবের গৃহের উত্তরের বারান্দ্য় বসিয়া আছেন, এমন সময় আর একজন যুবক সেখানে উপস্থিত হইলেন। ইনিই শশী বা পরবর্তীকালের স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ। শশীর সঙ্গলাভ করিয়া কালীপ্রসাদের বিশেষ সুবিধা হইল। কালীবাড়ির কর্মচারীদের সঙ্গে পরিচয় থাকায় শশী উভয়ের জন্য প্রসাদ সংগ্রহ করিলেন এবং পরমহংসদেবের কথাপ্রসঙ্গে সময়ও সুন্দর কাটিয়া গেল।
 রাত্রি নয়টায় শ্রীরামকৃষ্ণ লাটুর সহিত ফিরিয়া নিজকক্ষে ক্ষুদ্র শয্যাটিতে উপবেশন করিলেন। অতঃপর কালীপ্রসাদ শ্রীরামকৃষ্ণের নির্দেশে আহূত হইয়া তাঁহাকে ভূমিষ্ঠ প্রণাম করিলেন। ঠাকুরের প্রশ্নের উত্তরে তিনি আত্মপরিচয় দিয়া জানাইলেন ‘আমার যোগসাধনার ইচ্ছা আছে। আপনি আমায় শিখাবেন কি?’ পরমহংসদেব এই প্রশ্নে স্বল্পক্ষণ মৌন থাকিয়া উত্তর দিলেন, ‘তোমার এই অল্প বয়সেই যোগশিক্ষার ইচ্ছা হয়েছ -- এ অতি ভাল লক্ষণ। তুমি পূর্বজন্মে যোগী ছিলে। তোমার একটু বাকী ছিল। এই তোমার শেষ জন্ম। আমি তোমায় যোগশিক্ষা দেব। আজ বিশ্রাম কর; কাল এসো’।”

Post a Comment

0 Comments