জ্বলদর্চি

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা-৬৮/প্রীতম সেনগুপ্ত

পর্ব ৬৮

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা

প্রীতম সেনগুপ্ত

 ১৮৮৬ সালের ১৬ অগাস্ট রাত ১টা ২মিনিটে মহাসমাধিতে লীন হলেন শ্রীরামকৃষ্ণ। তাঁর দেহাবসানের কয়েক সপ্তাহ পরে শোকাহত শ্রীশ্রীমা তীর্থযাত্রায় গমন করলেন। তাঁর সঙ্গে এই তীর্থযাত্রায় আরও যাঁরা ছিলেন, তাঁরা হলেন -- গোলাপ মা, লক্ষ্মীদিদি, শ্রীম পত্নী, কালী, যোগীন এবং লাটু। তাঁরা প্রথম গেলেন দেওঘর, সেখান থেকে বারাণসী ও অযোধ্যা দর্শন করে পৌঁছান বৃন্দাবনে। সেখানে কালাবাবুর কুঞ্জে অবস্থান করেন। এটি ছিল ভক্তপ্রবর বলরাম বসুর নিভৃত আবাস। একবার শ্রীরামকৃষ্ণ কালীকে বলেছিলেন, “তোর মধ্যে শ্রীকৃষ্ণের আংশিক প্রকাশ রয়েছে।” বৃন্দাবন অবস্থানকালে কালী বহু মন্দির পরিদর্শন করেন এবং দীর্ঘক্ষণ শ্রীকৃষ্ণের ধ্যানে মগ্ন থাকতেন। তিনি অত্যন্ত তিতিক্ষাপরায়ণ ছিলেন। স্থির করেন অন্যান্য বৈষ্ণব ভক্তদের সঙ্গে পদব্রজে বৃন্দাবন পরিক্রমা করবেন। ২১ দিন সময় লেগেছিল ১৬৮ মাইল প্রদক্ষিণ করতে।
 ১৮৮৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শুরুর দিকে কালী যখন বৃন্দাবনে রয়েছেন, এক সন্ধ্যায় শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তপ্রবর সুরেন্দ্রনাথ মিত্রকে দেখা দিয়ে বলেন, “তুমি কি করছ? আমার ছেলেরা কোনও থাকার জায়গা না পেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অন্য কোনও কাজ করার আগে এদের জন্য একটা ব্যবস্থা কর।” সুরেন্দ্র তৎক্ষণাৎ ছুটলেন নরেন্দ্রর গৃহে। তাঁকে জানালেন একথা। প্রতিশ্রুতি দিলেন কাশীপুরে ঠাকুরের সেবার জন্য যে পরিমাণ অর্থ দিতেন তা পুনরায় দিতে থাকবেন। নরেন্দ্র ও অন্যান্য ভক্তেরা বরানগরে একটি বাড়ি ভাড়া করলেন মাসিক দশ টাকায়। এভাবেই প্রতিষ্ঠিত হল সঙ্ঘের প্রথম রামকৃষ্ণ মঠ।
 বরানগর মঠ প্রতিষ্ঠার সংবাদ পাওয়ামাত্র কালী কলকাতায় প্রত্যাবর্তন করলেন ও গুরুভাইদের সঙ্গে একত্রিত হলেন। দ্বিতীয় তলের একেবারে দক্ষিণ দিকের ঘরটি ছিল ধ্যান ও অধ্যয়নের ঘর। এই ঘরটি ‘কালী তপস্বী’র ঘর হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠল। কারণ সকলের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একাকী তপস্যায় দিন অতিবাহিত করতেন। তপস্যাপ্রবণ ছিলেন, নিরামিষ আহার গ্রহণ করতেন, জুতো পরিধান করতেন না এবং মানুষের সংস্রব এড়িয়ে চলতেন। ধ্যান, শাস্ত্রপাঠ এবং শ্রীরামকৃষ্ণ ও শ্রীশ্রীমা বিষয়ক স্তোত্র রচনায় দিন অতিবাহিত করতেন। একদিন কালী বেলুড়ে নীলাম্বরবাবুর বাগানবাড়িতে অবস্থানরতা শ্রীশ্রীমায়ের কাছে গিয়ে স্তোত্রপাঠ করে শোনান। স্তোত্রটি তাঁর রচিত ও শ্রীশ্রীমা'র বন্দনাবিষয়ক -- প্রকৃতিং পরমামভয়াং বরদাং ইত্যাদি। স্তোত্রটি শুনে শ্রীশ্রীমা তাঁকে আশীর্বাদ করেন এবং বলেন -- “বিদ্যাদেবী সরস্বতী তোমার জিহ্বায় অধিষ্ঠিতা হন।” অতঃপর বরানগর মঠে যথাবিধি সন্ন্যাস গ্রহণের পর তাঁর নাম হল স্বামী অভেদানন্দ। স্বামীজীই এই নামকরণ করেন। সন্ন্যাসের পর একইরকমভাবে তপস্যায় দিন অতিবাহিত করতে থাকলেন। একদিন দুপুরের পর শ্রীম মঠে এসে দেখলেন বারান্দায় উত্তপ্ত ধুলোর উপর অভেদানন্দজীর দেহ অসাড় অবস্থায় পড়ে আছে। তিনি যোগীন মহারাজকে বললেন, “কালী মঠের কঠোরতা সহ্য করতে না পেরে দেহত্যাগ করেছে।” যোগানন্দজী সহাস্যে বললেন, “ও কি মরে? ওই শালা অমনি করে ধ্যান করে।”
 ১৮৮৭ সালের মার্চ মাসে স্বামী অভেদানন্দ, প্রেমানন্দ ও সারদানন্দ পুরী তীর্থে গমন করেন এবং সেখানে এমার মঠে ছ'মাস অবস্থান করেন। তাঁরা সমস্ত দিবসই তপস্যায় অতিক্রান্ত করতেন এবং জগন্নাথদেবের প্রসাদ পেতেন। রথযাত্রা অনুষ্ঠানেও যোগ দেন। কলকাতায় প্রত্যাবর্তনের পূর্বে তাঁরা কোনারকের সূর্য মন্দির, ভুবনেশ্বরে লিঙ্গরাজ শিব মন্দির, উদয়গিরি-খণ্ডগিরির বৌদ্ধগুহা দর্শন করেন। ১৮৮৮ সালে বিবেকানন্দ ও অন্যান্য আরও কয়েকজনের সঙ্গে অভেদানন্দজী যান এলাহাবাদে, যোগানন্দ স্বামীকে দেখতে। কারণ তিনি মারণ বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন।
 ১৮৮৯ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি শ্রীশ্রীমা'র সঙ্গে অভেদানন্দজী আঁটপুর হয়ে কামারপুকুর ও জয়রামবাটী গমন করেন। শ্রীশ্রীমায়ের সঙ্গে আরও অনেকে ছিলেন। জয়রামবাটীতে মায়ের কাছে কিছুকাল অবস্থানের পর অভেদানন্দজী উত্তরাখণ্ডে বিভিন্ন তীর্থস্থান পরিভ্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। শ্রীশ্রীমা এর জন্য তাঁকে অনুমতি প্রদান করেন। নির্মলানন্দজীও তাঁর সঙ্গে গমনে ইচ্ছা প্রকাশ করেন। সম্পূর্ণভাবে ঈশ্বরনির্ভর হয়ে তাঁরা যাত্রা শুরু করেন। দুজনেই সিদ্ধান্ত নেন কোনও অর্থ ব্যতিরেকেই ভ্রমণ করবেন এবং যেকোনও  স্থানে ঠাঁই পেলে শয়ন করবেন। নগ্নপদে, কটিবস্ত্র পরিধান করে যাত্রায় রত হন তাঁরা। ভিক্ষান্নে দিনযাপনের উদ্দেশ্যে দিনে একবার ভিক্ষাগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। পরিব্রাজক সন্ন্যাসী হিসেবে একটি মাত্র কম্বল, জলের পাত্র, লাঠি ও অতিরিক্ত কটিবস্ত্র সম্বল করে তীর্থযাত্রায় গমন করেন। প্রতিদিন কুড়ি থেকে পঁচিশ মাইল করে হাঁটতেন।
 পাঁচশো মাইলের বেশি হাঁটবার পর সন্ন্যাসীদ্বয় পৌঁছলেন গাজিপুর, বারাণসীর কাছে। সেখানে তাঁরা সাক্ষাৎ করলেন গাজিপুর হাইকোর্টের জাজ শিশিরচন্দ্র বসুর সঙ্গে। তিনি তখন পাণিনির সংস্কৃত ব্যাকরণ ও ঈশোপনিষদের শঙ্কর ভাষ্যের সংস্কৃত থেকে ইংরেজি অনুবাদ করছিলেন। এই কাজে তাঁকে সহায়তা করেছিলেন অভেদানন্দজী। এই সময় শ্রীরামকৃষ্ণের আর এক ত্যাগী সন্তান হরিপ্রসন্ন ( স্বামী বিজ্ঞানানন্দ ) গাজিপুরে ইঞ্জিনিয়র হিসাবে কর্মরত ছিলেন। দুই গুরুভ্রাতাকে কাছে পেয়ে তিনি অত্যন্ত আনন্দিত হন। দুজনকে ঘুরে দেখান জায়গাটি। একদিন হরিপ্রসন্ন এক দ্বৈতবাদী পণ্ডিতের সঙ্গে অভেদানন্দজীর আলাপ করিয়ে দেন। অদ্বৈতবাদী অভেদানন্দজীর সঙ্গে সেই পণ্ডিতের তর্কসভার একটি দিন স্থির হয়। তর্কযুদ্ধ স্থায়ী হয়েছিল ঘণ্টাখানেকের জন্য। অভেদানন্দজী পণ্ডিতকে তর্কে পরাস্ত করেন। হরিপ্রসন্ন ও নির্মলানন্দ স্বভাবতই আনন্দিত হন। গাজিপুরে পওহারি বাবার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন অভেদানন্দজী। গুহায় বাসরত এই পরম যোগী ও ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষের সঙ্গে কথা বলে মুগ্ধ হন। 
 গাজিপুর থেকে সন্ন্যাসীদ্বয় পৌঁছান দেবাদিদেব শিব ও মা অন্নপূর্ণাক্ষেত্র বারাণসী। এই প্রাচীন শহরের নানা মন্দির দর্শন করেন তাঁরা। বারাণসীর দুই মহাপুরুষ ত্রৈলঙ্গ স্বামী ও ভাস্করানন্দের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এখানে কিছুদিন থেকে যান রামজন্মভূমি অযোধ্যায়। এরপর লখ্নৌ পরিদর্শনান্তে তপস্বীগণের পরমস্থান হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত হরিদ্বার-হৃষিকেশে পৌঁছান। হৃষিকেশে অন্যান্য সাধুসন্তদের মতোই সাধনকুটির নির্মাণ করে তপস্যায় মগ্ন হন। ভিক্ষান্নে আহার সম্পন্ন করতেন। হৃষিকেশ থেকে একশো মাইল উচ্চে পদব্রজে পৌঁছান দেবপ্রয়াগ, যোশীমঠ, বদ্রিনাথ, কেদারনাথ, উত্তরকাশী, গঙ্গোত্রী এবং যমুনোত্রীতে। সেই সময় এই সমস্ত স্থানগুলিতে পদব্রজে পৌঁছানো ছিল অত্যন্ত কষ্টসাধ্য, কেননা স্থানগুলি ছিল অতি দুর্গম। এই ভ্রমণকথা অভেদানন্দজী লেখেন ‘My Life-Story’ গ্রন্থটিতে।
অবশেষে অভেদানন্দ ও নির্মলানন্দ হৃষিকেশে প্রত্যাবর্তন করলেন। এই সময় অভেদানন্দজী ব্রহ্মসূত্রের শঙ্করভাষ্য অধ্যয়ন করেন ধনরাজ গিরির কাছে। যিনি ছিলেন কৈলাস মঠের মোহন্ত ও ভারতীয় ষড়দর্শন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। পরবর্তী সময়ে স্বামী বিবেকানন্দ হৃষিকেশে আসেন এবং অভেদানন্দ বিষয়ে তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন। ধনরাজ গিরি উত্তর দেন -- “অভেদানন্দ -- এক অলৌকিক প্রজ্ঞা!”


জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇




Post a Comment

0 Comments