জ্বলদর্চি

ঘটোৎকচের গল্প /মৌমিতা চ্যাটার্জী

 
ঘটোৎকচের গল্প

মৌমিতা চ্যাটার্জী


হিন্দু মহাকাব্য রামায়ণ ও মহাভারত বহুচরিত্র সম্বলিত। প্রত্যেক চরিত্র নিজস্ব চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের আলোকে আলোকিত হ‌ওয়া সত্ত্বেও ইতিহাস তাঁদের বীরত্ব, মহত্ব ও পরাক্রমকে কিছুটা আড়ালেই রেখেছে। অথচ এঁনাদের প্রচেষ্টা না থাকলে হয়ত বিজয়ীর সম্পূর্ণ বিজয়গাঁথা রচনা করা সম্ভবপর হত না। এমন‌ই এক চরিত্র মহাভারতের ঘটোৎকচ।

ঘটোৎকচ মহাভারতের একটি বিশেষ চরিত্র। ইনি হস্তিনাপুরের রাজা পাণ্ডুর দ্বিতীয় পুত্র ভীমের ও তাঁর রাক্ষস স্ত্রী হিড়িম্বার পুত্র। ঘটোৎকচ হিড়িম্বাপুরের (বৰ্তমানে অসমের ডিমাপুর) রাজা ছিল। তাঁকে আসামের কাছারিরা (আসাম-এর তিব্বত-বার্মী ভাষায় কথা বলা কয়েকটি জনগোষ্ঠীকে সামগ্রিকভাবে বোঝানো
হয়েছে)নিজেদের পূর্বপুরুষ বলে মনে করে। রাক্ষসদের জন্মরীতি অনুসারে ইনি জন্মমাত্রই যৌবনলাভ করেন। তাঁর মাথা ঘটের মত এবং তা কেশ(কচ)শূন্য বলে তাঁর নাম রাখা হয় ঘটোৎকচ। 

ঘটোৎকচের স্ত্রী অহিল্বতি। তাঁদের তিন পুত্র। অঞ্জনপর্বন, বারবারিক, এবং মেঘবর্ণ। তাঁর দ্বিতীয় পুত্র অঞ্জনপর্বনও কুরুক্ষেত্রের  যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। 

জন্মগত দিক থেকে ঘটোৎকচ আধা মানুষ ও আধা-রাক্ষস ছিলেন এবং ছিলেন অমিত শক্তির অধিকারী। গদা ছিল তাঁর যুদ্ধায়ুধ।


জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇



কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধতে তিনি পাণ্ডব পক্ষে যুদ্ধ করেন। যুদ্ধে তিনি কৌরব পক্ষের বহু রথী মহারথীকে পরাস্ত করেন। যুদ্ধের চতুর্দশ দিনে সূর্যাস্তের পরও যুদ্ধ চলেছিল। রাত্রিতে রাক্ষসদের শক্তি বেড়ে যায় বলে এসময় ঘটোৎকচ অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে ওঠেন। কৌরবপক্ষ অবলম্বনকারী অলম্বুশ কিংবা অলায়ুধ এর মতো অসুরকে এই সময় হত্যা করেন তিনি। এছাড়াও যুদ্ধের অষ্টম দিনে দ্রোণাচার্য, অশ্বত্থামা, দুর্যোধন, জয়দ্রথসহ বহু কৌরব মহারথী তাঁর হাতে পরাজিত হন।
অবশেষে কৃষ্ণের নির্দেশে তিনি মহারথী কর্ণের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হন। এরপর, দূর্যোধনের কথায়
অর্জুনকে বধের জন্য রাখা একাঘ্নি (বা এক-পুরুষ-ঘাতিনী) অস্ত্রে কর্ণ ঘটোৎকচকে বধ করেন।
মৃত্যুর পূর্বেও তাঁর বিরাট শরীরের নীচে পিষ্ট হয়ে, কৌরব সৈন্যবাহিনীর এক অক্ষৌহিণী সৈন্য নিহত হয়।
এখানে একটি বিষয় খেয়াল করা প্রয়োজন কৃষ্ণসহ দেবগণ প্রথম থেকেই অর্জুনকে রক্ষা করেছিলেন সর্বতভাবে। কৃষ্ণ কূটনীতি প্রয়োগ করেন ও ঘটোৎকচের মত বীর যোদ্ধাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেন।
একাঘ্নি (অন্য দুটি নাম বৈজয়ন্ত ও বাসব শক্তি ) বান ছিল অমোঘ কিন্তু এর প্রয়োগ এক বারই হতে পারত । ব্রহ্মশির, বৈষ্ণবাস্ত্র বা পাশুপতের মত এর বিশ্বব্যাপী সংহার ক্ষমতা ছিল না । কিন্তু একটি ব্যক্তির ওপর প্রয়োগ করলে সে দেব , অসুর,মানুষ যেই হোক না কোন তার মৃত্যু নিশ্চিত ছিল । দেবরাজ ইন্দ্র কৌশলে কর্ণের কবচকুন্ডল কেড়ে নেন এবং তার পরিবর্তে কর্ণকে এই একাঘ্নি অস্ত্র প্রদান করেন, এই একাঘ্নিই ঘটোৎকচের প্রাণ কেড়ে নেয়।

ঘটোৎকচ মহাভারতের একটি অন্যতম উপেক্ষিত চরিত্র। রাজপুত্র হ‌ওয়া সত্বেও সঠিক মর্যাদা তিনি লাভ করেননি। অথচ পিতৃকুলের প্রতি তিনি ছিলেন নিবেদিত প্রাণ।  ইনি জন্মের পর বিদায় কালে পাণ্ডবদের জানান যে,স্মরণমাত্রই তিনি পাণ্ডবদের সামনে হাজির হবেন। পাণ্ডবরা বদরিকা আশ্রমে যাওয়ার সময় ভীম তাঁকে স্মরণ করেন। ফলে অঙ্গীকার অনুসারে ইনি ভীমের সামনে হাজির হন। এরপর ভীমের আদেশে পরিশ্রান্ত দ্রৌপদীকে কাঁধে করে যথাস্থানে পৌঁছে দেন। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে পুত্র হিসেবে তিনি তাঁর কর্তব্যে কোনো ত্রুটি রাখেননি। কিন্তু সুখ সমৃদ্ধি, পিতা , পিতৃব্য, মাতামহীর স্নেহ লাভের সৌভাগ্য তাঁর বিশেষ হয়নি। পরবর্তী ক্ষেত্রে তাঁর পুত্র বার্বারিক সম্পর্কে কিছু তথ্য জানলেও তাঁর স্ত্রী বা অপর দুই পুত্র সম্পর্কে বিশেষ তথ্য পাওয়া যায় না।

উত্তরাখণ্ডের চম্পাওয়াতে, হিমাচল প্রদেশের মানালিতে এবং ইন্দোনেশিয়ার মধ্য জাভায় ঘটোৎকচের সম্মানে মন্দির নির্মিত হয়েছে। 
পরিশেষে বলা যায় কৃষ্ণের বিপুল সহায়তা, রণকৌশলনীতি এবং ঘটোৎকচের মত চরিত্র না থাকলে হয়ত বিজয়লক্ষ্মীকে অর্জুনের পক্ষে রায় ঘোষনা করতে যথেষ্ট বেগ পেতে হত। তাই নিঃসন্দেহে ঘটোৎকচকে মহাভারতের  একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র বলা যেতে পারে।

Post a Comment

0 Comments