জ্বলদর্চি

যেতে যেতে পথে /রোশেনারা খান/পর্ব ৬২

যেতে যেতে পথে
রোশেনারা খান
পর্ব ৬২

কতগুলো দিন,মাস কেটে গেল, কত কি জীবন থেকে হারিয়ে গেল। কতকিছু থেমে গেল, কতকিছুর প্রয়োজন ফুরিয়ে গেল। কতকিছুর প্রতি আকর্ষণ হারালাম। বলতে গেলে জীবনটাই সম্পূর্ণ বদলে গেল। কী ছিল, কী হল! বাড়ি ফিরতে ভয় করছে।  কতকিছুর মুখোমুখি হতে হবে, মেনে নিতে হবে। তবুও ফিরতে হবে। তাই গোছগাছ সুরু করেছি। ছোট ছেলেমেয়েদের জন্য টুকটাক সপিং করেছি। শীতের কিছু জামাকাপড় বাবলি কিনে দেয়েছে। 
      এখনো ভাবছি বাড়ি ফিরে কী করব? দুজনে কীভাবে সময় কাটবে?  মরার আগেই আমি মরে গেলাম? এ ইসব ভেবে বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করছে না। যাইহোক যে বইদুটো  ছাপাতে দিয়ে এসেছি সেগুলোর খবর নিতে হবে। যা লেখা  আছে আরো দুখানা বই হবে, তবে ওটা নিয়ে পরে ভাবব, আগে এই দুটো কেমন হয় দেখি। কোনদিন ভাবিনি আমার নিজের বই হবে।
   আজ জাহাঙ্গিরকে (খুড়তুতো দেওর)ফোন করে মুকুলের খবর নিলাম। ওর দুটো কিডনিই যে ড্যামেজ হয়েছ, তার জন্য ডাক্তার অ্যাণ্টি দায়ালিসিস ক্যাপসুল  দিয়েছেন। বলেছেন, এতেই ঠিক হয়ে যাবে। তবে চেকআপে থাকতে হবে। ডাক্তার সপ্তাহে একদিন যাওয়ার কথা বলেছিলেন, জাহাঙ্গির সেটা বাড়িয়ে ১০ দিন করেছে। সেটাই যাওয়া মুশকিল। যাক, ছেলেটা ভাল হয়ে উঠুক। ওকেও ডাক্তার খান সাহেবের মত প্রোটিন জাতীয় খাবার খাওয়া নিষেধ করেছেন। 
     এখানে এসে সেভাবে নিজের প্রতি খেয়াল রাখা হয়নি। যার ফলে হঠাৎ  একদিন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বুঝতে পারলাম, আমার অনেকখানি ওজন বেড়ে গেছে। কোথায় যেন পড়েছিলাম এই মানসিক পরিস্থিতিতে ওজন বেড়ে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক। কী খাচ্ছি? কতটা খাচ্ছি? কতবার খাচ্ছি? এবিষয়ে খেয়াল না থাকার কারণে নিজের অজান্তেই ওজন বেড়ে যায়।
     আর এখানে ভাল লাগছে না। বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করছে। ফিরেই ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। কিন্তু ফিরে গেলে আর আসা হবে না। খান সাহেবকে আর  নিয়ে আসা যাবে না। তাই বাকি দিনগুলো থেকে যাচ্ছি। তাছাড়া জারাকে ছেড়ে যেতে হবে ভাবলেই ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। বাড়ি ফিরে কেমন লাগবে কে জানে? এখানে দিন এখন অনেক ছোট হয়ে গেছে। মে মাসে যখন এসেছিলাম, তখন ১০টা পর্যন্ত দিনের আলো  থাকত। এখন দেখছি পাঁচটা বাজতে না বাজতেই লনের রোদ্দুর লাফিয়ে প্রথমে নাশপাতি গাছে, তার পরেই চেরি গাছের মাথা থেকে কোথায় যেন হারিয়ে যায়। এখানে এখন সকালের দিকটা হয় কুয়াশা ঢাকা নয় মেঘে ঢাকা খাকে। 


জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇



    আজ কয়েক দিন দেখছি সারাদিনই মেঘলা থাকছে। আজকের ওয়েদার রিপোর্ট বলছে রোদ উঠবে। এখন সময় সকাল সাড়ে সাতটা। রোদ ওঠেনি, ওরাও মা-মেয়ে ঘুম থেকে ওঠেনি। দীপের নাইট ডিউটি চলছে। ওর ফিরতে দেরি হবে। গত দু’রাত আমারও ঘুমের সমস্যা হচ্ছে। খান সাহেবেরও হচ্ছে। যেদিন এমন হয়,  সেদিন দুটো করে ঘুমের পিল খেয়েও ঘুম আসে না। এভাবেই জীবনের বাকি সময়টা কাটাতে হবে, সময়ের সঙ্গে আপোষ করা ছাড়া কী-ই বা করতে পারি? 
      অক্টোবরে বাড়ি ফিরব, কিন্তু দুরগাপুজো সামনে হওয়াতে ছবি আসতে  পারছে না। কেউ একজন সামনে দা্ড়িয়ে ঘরদোর পরিষ্কার না করালে কাজের লোক ভাল করে পরিষ্কার করবে না। গাছগুলো বেঁচে আছে কিনা যে জানে? থাক ওসব কথা। দেশের খবর জানতে ল্যাপটপ অন করে বসব। খবর বলতে রাজনীতি আর ধর্ষণ ছাড়া তেমন কিছুই খবরই থাকে না। দেশে মহিলাদের নিরাপত্তা বলে কিছু নেই। গত বছর আমাদেরই রাজ্যে কামদুনির ঘটনার কথা মনে পড়লে আজ  ও বুক কেঁপে ওঠে। ২০১৩ সালের জুন মাসে দক্ষিণ ২৪পরগনার কামদুনি গ্রামে এক মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছিল। বছর কুড়ির একটি কলেজ পড়ুয়া মেয়ে কলেজ থেকে ফেরার সময় নিখোঁজ হয়ে যায়। কয়েকজন সমাজবিরোধী ওকে একটি প্রাচীর ঘেরা মাঠে নিয়ে গিয়ে গণ ধর্ষণ করে এবং নির্মমভাবে হত্যা করে। দেশজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল। মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী এসেছিলেন পরিবারটিকে সান্তনা দেবার জন্য। তিনি ফেরার জন্য গাড়িতে উঠছেন সেই সময়ই মৌসুমি ও টুম্পা কয়াল তদন্তের বিষয়ে প্রশ্ন করলে, তিনি চিৎকার কিরে বলে ওঠেন, এরা সব মাউবাদী। একথা শুনে মানুষ আরও ক্ষেপে ওঠে। মেয়েটির বাবা প্রথম দিকে অনড় থাকলেও শেষ পর্যন্ত দারিদ্রতার কাছে হার স্বীকার করেন। ওঁদের গ্রাম থেকে সরিয়ে নিয়ে গোপন যায়গায় রাখা হয়। যাতে কেউ না যোগাযোগ করতে না পারে এবং পরিবারের একজনকে সরকারি চাকরি দেওয়া হয়। অপরাধি কয়েকজনের  ফাঁসির হুকুম হয়েছিল।
     এখন বিকেল ৭ টা, ওয়েদার খুব ভাল।খান সাহেবকে নিয়ে হাঁটতে বেরিয়েছিলাম। বাইরে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা, গাছের ঝরে পড়া লাল পাতায় পথ ঢেকে গেছে। আজ একটা চরম সত্যি অনুভব করলাম, একজন মা পৃথিবীতে তার সন্তানকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসে। সন্তানই মায়ের কাছে সবচেয়ে প্রিয়,তার সঙ্গে অন্য কোন কিছুর তুলনা চলে না।সব সম্পর্ককে ছাপিয়ে যায় মা ও সন্তানের সম্পর্ক। মায়ের কাছে এ এক অমূল্য ধন।‘ধন ধন ধন ধন/ বাইরে গাঁদার বন/ এ ধন যার ঘরে নাই তার কিসের জীবন’? এসব ছেলে ভোলানো ছড়াতে তার উল্লেখ রয়েছে। আজকের সমাজে, পরিবারে মা ও সন্তানের সম্পর্কের সংজ্ঞা কিছুটা বদলে গেছে জানি। ধিরে ধিরে হারিয়ে যাচ্ছে অজানা কবিদের মুখে মুখে বানানো ছেলে ভোলানো ছড়া। হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের ইতিহাস ও সংস্কৃতির একটি ধারা, যা আমাদের  চেনায়।
      আজ সকালে ঘুম থেকে উঠেই দেখছি চারিদিক কুয়াশায় আবছা। মেঘ, কুয়াশা আমার ভাল লাগে না। মনে হয় ডিপ্রেশনে চলে যাচ্ছি। ভীষণ মনখারাপ লাগে। মন যদিও এমনিতেই খারাপ। কিছু তো করার নেই। তাই কাজে মন দিলাম। যে কয়েকটা দিন আছি, মেয়েটা একটু আরাম করুক। এরপর তো  একাকেই সামলাতে হবে।  আমাদের দেশে হলে একটার যায়গায় ১০ টা লোক রাখতে পারত। এখানে সেটা কোনদিন সম্ভব হবে না।
     এখানে আমাদের দেশের টিভি চ্যানেলগুলো এদেশের বিজ্ঞাপনগুলো দেখায়। কিডসদের চ্যানেলে যে সমস্ত অনুষ্ঠানগুলি দেখায় তাতে একদিন বরফ মানুষের মূর্তি দেখে তোর ছেলেবেলায় বইমেলা থেকে কেনা বইটার কথা মনে পড়ে গেল।  সেই গল্পটাও  বরফ মানুষকে নিয়ে। তোর মনে পড়ে? নাচনদের বাড়িতে প্রচুর গল্পের বই ছিল। ওদের বাড়ি থেকে বই নিয়ে এলে আমরা তিনজন কাড়াকাড়ি করতাম, কে আগে পড়বে?
    গতকাল বিকেলে নিনাদির বাড়ি গেছলাম। কয়েকদিন ধরেই ডাকছিলেন। বেশ কিছুক্ষণ গল্প হল নানা বিষয় নিয়ে। কিছুদিন হল কলকাতায় যে ওনার জামাইবাবু মারা গেছেন, তা নিয়ে উনি কয়েকদিন খুব আপসেট ছিলেন।ভদ্রলোক হার্ট অ্যাটাকে মারা গাছেন। ডাক্তার ডাকারও সময় দেননি। বোনঝি কাঁদতে কাঁদতে বলেছে, মাসি তুমি কেন এখানে থাকলে না? তা হলে এমনটা ঘটত না। নিনাদির মুখে একথা শুনে মনে মনে ভাবছিলাম, আমি জানি, যা ঘটার তাকে কোনও ভাবেই আটকানো সম্ভব নয়। সবই একদিন হারিয়ে যায়, সবই একদিন হারিয়ে যাবে। এই পৃথিবীটাও একদিন তলিয়ে যাবে। সেদিন খুব মজা হবে।
    কী সব লিখছি! মাথাটা গেছে।আজ সকাল থেকে মেঘ রোদের খেলা চলছে। একদিকে নরম রোদ উঠেছে, আর একদিকে কালো মেঘে আকাশ ঢেকে রয়েছে। রোদটা সূর্যগ্রহণের রোদ মনে হচ্ছে। বহুদিন আগে পূর্ণগ্রহণ হয়েছিল। বাবলি বকুল তখন বেশ ছোট। আজ মন ভাল করার মত দুটি খবর আছে। ভারতীয় বিজ্ঞানীরা মঙ্গলগ্রহে যান পাঠাতে সক্ষম হয়েছে। যা আজ পর্যন্ত পৃথিবীর কোনো দেশ পারেনি।নাসাকেও হারিয়ে দিয়েছে। আর একটা ভাল খবর হল, কে কে আর খুব ভাল খেলছে। এই খবরে বকুল খুব খুশি হবে। ক্রিকেট পাগল বলতে যা বোঝায়, ও হল সেই পাগল।
                                 ক্রমশ

Post a Comment

0 Comments