শ্রীজিৎ জানা
গেছাল হওয়া সোজা নয়। চিতন বলে,
—সবার হাতে রস হলে ঢের হোত! শুদু গাছে হাঁড়ি ঝুলালেই হবে নি। শুদ্দশাদ্দ বলে একটা ব্যাপার আছে বুইলে।
গাছ কাটার কাছেই রসের আসল চাবিকাঠি। গাছকাটা মানে তালের মোচা কাটার কৌশল। চিতন বলে তালভঁড়া। ফলারগাছের চেয়ে নাড়া গাছ রস দেয় বেশি। গাছে হাঁড়ি বাঁধার আগে তালভঁড়াকে দলতে হয়। সারেঙ জালের ছ্যাঁড়া দিয়ে চিতন তিন চারদিন ধরে ভঁড়ার দলাইমলাই চালায়। তারপর চিতনের দক্ষ হাত মোচা কাটতে শুরু করে। একবারে আঁশ পাতলা করে মোচার মুখ কাটতে হয়। নইলে এক মাসেই মোচা কাটা শেষ, তো রস পড়াও বন্ধ। মোচার মুখে হাঁড়ি বাঁধার আগে হাঁড়ি পুড়িয়ে কালো করে নেয়। গত বছরের হাঁড়িকেও কাজে লাগায় চিতন।মোচা কাটার গুনে তিন চার মাস ধরে চিতন রস বিক্রি করে।ইদানীং তাড়িতে জল মেশাতে শুরু করেছে সে। নেশার জিনিসে একটুআধটু দুনম্বরী করলে দোষ নাই। এরকম কথা বলে নিজেকেই নিজে সমর্থন জানায়। এখন জলের বোতল মাপে রস বিক্রি করে। চিতনের ঘরে বসে আগে অনেকেই তাড়ি খেত। সেইসব পাট কবেই তুলে দিয়েছে। সকাল ন'টা দশটা থেকে তাড়ির ঠেক চলত দুপুর অব্দি। হাবিজাবি কথার সূত্র ধরে শুরু হত তর্কাতর্কি। যাচ্ছেতাই খিস্তিখাস্তা। দু'একবার হাতাহাতি পর্যন্ত ঘটনা গড়ায়। চিতনের তাড়ির ঠেকে শুধু দুলে -বাগ্দি নয়, মাহিষ্য কায়েত বামুন সবাই জড়ো হত। বেশিরভাগ দিন ঝগড়ার সূত্রপাত হত তাদের উস্কানিতে। তারপর হাতাহাতিতে শেষ করত বাগদিরা। খগেন মাস্টার একদিন চিতনকে জোর শাসায়,
—কুনু দিন তরা মানুষ হবি নি। তোর তাড়ি খেয়ে নেশা করে তোর দয়রেই ক্যাচাল করে চলে যাচ্চে। তাদের পরচনায় তরা নিজেরা নিজেরা গুঁতাগুঁতি কচ্চু। অরা তোদের দয়রে কচ্চে।তুই জিয়ে অদের দয়রে কর দিখি। অদের মান সম্মান আছে! তোদের নাই—বল! ক্যানে জানু? কারণ অরা চিরদিন তোদেরকে ছোট জাত ভাবে।বাগদির দুয়ারে উঁচু জাত এসে ন্যাংটা লাচ করবে,তুই পারবি নি। তোদের সে মুরাদ নাই। পেটের দায়ে তাড়ি বিক্রি কোরু, ঠিক আছে। ঘরে ছ্যানা বউ আছে। বসে খাওয়া যেদি বন্ধ না কোরু সব গাছের ভঁড়া কেটে ফেলি দুব। তোকে বলে দিলম।
—-এগদম ঠিক বলেছ দাদা। উ আমাদের কুনু কথা শুনবেনি। দাও দেখি, সব কেটে ফেলি দাও। না খেতে পাই না পাব। সকাল থিকে রাত তক কত চিল্লাচিল্লি সোজ্জ করি বল দিখি। মোর দয়রে খাবি আর মোর দয়রেই কাউচান করবি!
সেইদিন থেকেই চিতনের ঘরে তাড়ির ঠেক বন্ধ হয়ে যায়। গাছ থেকে রস নামিয়ে বোতলে ভরে রাখে চিতন। তাড়ির খদ্দের এলেই টাকা নিয়ে বোতল ধরিয়ে দ্যায় সে। ইদানিং চিতন দেখে ছেলেছোকরা রীতিমত তাড়ির দিকে ঝুঁকেছে। তবে চিতন অতসব ভাবে না। ভেবে তার কাজ নেই। এই দুনিয়ায় আজকাল কে কার কথা ভাবে! সবাই নিজেরটা গুছিয়ে নিতেই ব্যস্ত। চিতনের ছোটবেলার কথা মনে পড়ে। সামান্য প্যাকাটির মুখে আগুন দিয়ে বিড়ির মতো একটা টান দিয়েছিল সে। সুড়ুৎ করে এক দলা ধোঁয়া আচমকা গলায় আটকে সে কি কাশি! গোয়াল ঘরে লুকিয়ে খাচ্ছিল চিতন। শেষমেষ কাশির তোড়ে ছুটে আসে সবাই। কাশি থামাবে কি সেই অবস্থায় বাপের হাতের দমাদ্দম থাবড়া বসে পিঠে। মারের জ্বালা আর চক্ষুলজ্জায় কদিন ঘর থেকে বেরোতে পারেনি চিতন। আজকাল বাড়ির বড়দের সেইরকম শাসন নেই। শাসন করতে ভয় পায়। একে একটি দুটি সন্তান সবার। তার উপর দিনকাল যা পড়েছে সামান্য ধমকেছো কি অম্নি গলায় ফাঁস নতুবা বিষ ঢেলে নেবে মুখে। শিলাবতীর পাড় অঞ্চলে এরকম আত্মহত্যা হামেশাই ঘটছে। তারচে যতটা চেপেচুপে, গায়ে হাত বুলিয়ে বোঝানো যায়। কিন্তু চরা না শুনে ধর্মের কাহিনী। লঘু গুরু মানা মানির দিন কবেই শেষ হয়েছে। বাপ বেটা এক গ্লাসেই মজে আছে নেশার ঠেকে। চিতন ভাবে পঞ্চু খুড়োর কথাই সত্যি,
—বুইলি চিতনা সবই কলির ফের! সময় কে অপেক্ষা কর, সব রসাতলে যাবে। এত অনাচার ভগমান সজ্জ করবে মনে কোরু!
চিতন কিছু মনে করে না।কার ছেলে ফুটলো কি মরল চিতন ভাবে না। তার তাড়ি বিকোলেই হল। নিজেও দুবারে মিলে আট দশ গ্লাস তাড়ি খায়। লোখা তার সঙ্গ দ্যায়। খগেন মাস্টার আসে মাঝেসাঝে। তার জন্য মিষ্টি রসের ব্যবস্থা রাখে চিতন।জগাও সেদিন হাজির হয়।চিতনের ঘরের পাশে কুলিপুকুর। তার পাড়ে করঞ্জ গাছের নিচে তাদের তাড়ির ঠেক বসে। জগার দায়িত্ব তাড়ির চাঁট তৈরি করে আনা। দলবেরা পাড়ার জগা ঢোলের নামকরা শিকারী। কালসাবার মাঠে,তালহিঁড়ের চরে, বালিবিলে সে মাছ ধরা আর পাখি শিকারে ওস্তাদ। ঢোলের সকলে জানে জগার ঘরে মাছ মাংসের ছাড়ান নেই কোনদিন। লোখা বলে,
—বুইলে মাস্টার জগার সঙে মাছ কথা বলে। অর গায়ের গন্ধ শুঁয়ে মাছেরা নিজে থিকেই চলে এসে।পাখিরাও তাই করে।
এসব শুনে জগা পিটপিট করে হাসে। সবার মুখে তার শিকারের প্রশংসা শুনে ভিতরে একটা চাপা গর্ব অনুভব করে সে। বহুক্ষেত্রে জগার কাজ দেখলে গর্ব হওয়ার কথা।কত রকম জাল বুনতে পারে জগা। পাখি ধরার কত রকম ফাঁদ সে তৈরি করতে পারে চোখের নিমিষে। জলে ঘাই মারা দেখে বলে দিতে পারে ওটা কি মাছ। পুকুর কিংবা খাল বিলের ধারে গর্ত দেখে চিনে নেয় কাঁকড়া নাকি জিয়লমাছের গর্ত।
সেদিন চিতন সকালেই খবরটা পাঠায় লোখাকে। রাতে জগার ডাঁককলে চারটা ডাঁকপাখি পড়েছে। শিলাই চরের ডাঁকপাখির মাংসের স্বাদই আলাদা। খগেন মাস্টার বলে,
—ডাঁক মাংস খুব উপকারী। কিন্তু ইসব মারা আজকাল অন্যায়। জেল পর্যন্ত হতে পারে,বুইলু।
লোখা সওয়াল করে বসে,
—সাদেস্বপ্নে ত মাচ্চি মাস্টার। ইতে আবার দোষ কুথা? মানুষ ত মারিঠি নি, মারিঠি একটা পাখি তাতেও জেল জরিমানা?
সেই ডাঁকমাংসের চাঁট দিয়ে তাড়ির ঠেক বসে কুলিপুকুরের ধারে। খগেন মাস্টার সেদিন আসে না। তিন জনেই একপেট করে তাড়ি ভরে নেয়। নেশার চোটে অন্য দিনের চেয়ে লোখা একটু বেশিই বকতে থাকে।
একে তাড়ির নেশা তার উপর ময়না খুদার মন্দির তৈরীর কথা লোখার কানে তুলে। খুদা সেইমাত্র চান সেরে তুলসীথানে জল দিচ্ছিল। লোখা দুয়ারে বসে তেল ঘষতে ঘষতে খুদার দিকে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দ্যায়।
—কি রে শুনিঠি তুই নকি ভিটার ঈশান কণে মনসা মন্দির করবি?
—ক্যানে! তোর কি আপত্তি আছে?
—-আপত্তি ক্যানে থাকবে? তবে ভিটা মাপ করে মন্দির বসাবি, ইটাই বলিঠি।
—-ভিটা আমি ক্যানে মাপ কত্তে যাব?
—-ভিটাটা ত মোদের পাঁচ ভাইয়ের, না কি? থাইলে পাঁচ জনের মত না লিয়ে তোর পছন্দ মত জাইগা লিয়ে মন্দির কচ্ছু ক্যানে?
—-আমি আগেই জানতম।কেউ বাধা না দেউ তুই ঠিক দিবি। তোর মতো পেঁচুয়ার আর কেউ আছে মাল ভিটায়?
—-নাাজ্জ কথা বোললম বলে পেঁচুয়ার ত বলবি। তোর মত মাগের কথায় চলিনি,বুজলু।
এতক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে শুনছিল সাগরী। এবার তার ধৈর্যের বাঁধে ফাটল ধরে। ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলায় চিলচিৎকার শুরু করে দেয়।
— মাগের কথায় চলবেনি ত কি তোর কথায় চলবে। আর তোর মাগের মত সাগরী বাগ্দি লাগানিবাজানি নয়।ঘরকে এসতে না এসতেই ভাতারের কানে বিষ ঢেলে দুব, তার ব্যালা?
ময়নাও থেমে থাকার পাত্রী নয়।
—লাগাব নি ত কি কোরবো! বাপের ভিটায় সবার অধিকার আছে। নিজেরা পছন্দ সই জাগা বেছে লিলে ত হবে নি।
—-মা মনসার মন্দির কোরবো তাতেও তোদের গায়ের জ্বালা! মা সোজ্জ করবে মনে কচ্চু?
—-মা কি তোর একার নাকি। ওই ত ভুজুংভাজুং দিয়ে লোক ঠকাচ্চু। তোর গুনিনি বিদ্যা লোখাকে বুঝাতে এসি সিনি।
—-মায়ের নাম লিয়ে বোড়ো দাদার নামে অপবাদ দেউঠু তোকে খরিশে চটাবে দেখবি।
—-তোর শাপে মোর স্বামীর কিচ্ছু হবে নি বুজলু! সৎ পথে থাকলে কারো বাপের সাধ্যি নাই ক্ষতি করা। তাবাদে শুকুনের শাপে গরু কুনুদিন মরে নি।
দুই ভাইয়ের তর্কাতর্কি ক্রমে দুই বউয়ের তুমুল ঝগড়ার দিকে যাচ্ছে দেখে,লোখা তার বউকে ঘরের দিকে টেনে নিয়ে যায়। ধীরে ধীরে সাগরীর চীৎকারও ম্রিয়মান হয়ে পড়ে। যদিও আগুন তখনও নেভে না।
0 Comments