জ্বলদর্চি

আমি আমার মতো/পর্ব -২১ /সুকন্যা সাহা

আমি আমার মতো
পর্ব -২১
সুকন্যা   সাহা

চৈত্র সেল  সেলের চৈত্র

আমাদের ছোটোবেলায়  বছরে দু বার জামা কাপড় কেনা কাটার চল ছিল ।এক পুজোর  সময়ে  আর এক  এই পয়লা বৈশাখ উপলক্ষ্যে । পুজোর জামা কাপড় মূলতঃ ছিল ঝকমকে , গ্লসি ধরনের । সারা বছরের বিয়ে বাড়ি ,অনুষ্ঠান বাড়ি   সবরকম  উৎসব অনুষ্ঠান কভার   করার জন্য  আর চৈত্র সেলের কেনাকাটি মূলতঃ ছিল সুতীর , ছাপা  গরম কালের পোশাক আশাক । সারাবছরে   এই দুই দফায় জামা কাপড় কেনা হলেও কোনোও বিয়ে বাড়ি বা অনুষ্ঠান বাড়ি যাওয়ার আগে খুঁজে পাওয়া যেত না  একটাও ভালো জামা । কারণ গুছিয়ে রাখা হত না যে কোনোও কিছুই ঠিকভাবে আলমারিতে । 

সারাবছর মা অফিস করার সুবাদে চূড়ান্ত ব্যস্ত থাকতেন; ফলে মেয়েদের পোষাক পরিচ্ছদের  দিকে নজর দেওয়ার তেমন সুযোগ ছিল না । আর এখনকার মতো কথায় কথায় শপিং মল আর সারাবছর ধরে মার্কেটিং এর ব্যপারই ছিল না ... ছিল না এত অনলাইনে  কেনাকাটির বাহুল্য। শনি রবিবার মায়ের ছুটির দিনে গড়িয়াহাট বা হাতিবাগানে চৈত্র সেলের বাজার  করতে যাওয়ার মজাই আলাদা ছিল ... তবে আমরা নর্থের  দিকে থাকি বলেই হয়তো হাতিবাগানেই যাওয়া হত বেশি... গরমের দুপুরে পড়ার জন্য সাদা সূতীর আদ্দির কাপড়ের ফুল তোলা বা হরিণ আঁকা ছোটো ছোটো টেপ ফ্রক ; ছিটের কাপড়ের হাতকাটা ফ্রক এসবই ছিল বেশি ... মায়েদের জন্য  সূতীর ব্লাউজ আর নরম সূতীর ছাপা শাড়ি এই ছিল সারা বছরের অফিস করার জামাকাপড় । তবে  সেলের বাজারে তন্তুজ   থেকে তাঁতের ধনেখালি বা বেগমপুরীও কেনা  হত   কয়েকটা ... অবশ্য সে  সব মায়ের ভাগ্যে শিঁকে ছিঁড়ত না । দেওয়া থোওয়াতেই চলে যেত ।হাতিবাগানে হকার্স কর্নারের কাছে  গরমের মধ্যে ঘেমে নেয়ে  হকার কাকুরা চেঁচাত পঞ্চাশের মাল কুড়ি টাকায় না নিলে  ঠকবেন ... মা দিদি বউদিরা নিয়ে যান ... এত  সস্তা আর কোত্থাও পাবেন না ... মায়ের আঁচল  ছেড়ে  যখন   সবে  ল কলেজে পা বাড়িয়েছি  চৈত্র সেলে একা একাই  ঘুরে বেড়াতাম গড়িয়াহাটের বাজারে । টুকটাক কেনা কাটিও করতাম...রুমাল, সেফটিপিন বা ব্যাগ নাইটি... আর অবাক  হয়ে লক্ষ্য করতাম বাড়ির মেয়ে বউদের  দরাদরি ...দোকানদার পঞ্চাশ বললে  অনেকে দশ   থেকে শুরু করত... তারপর না পোষালে হাঁটা লাগত... শেষে  দোকানদার আবার কম্প্রোমাইজ করে ডেকে নিত কাস্টমারকে । কথায় বলে না কাস্টমার লক্ষী ! এই কেনাকাটি নিয়ে স্বামী স্ত্রীতে  কত ঝগড়া ঝাঁটি চুলোচুলিও দেখেছি। সেফটিপিন থেকে গেঞ্জীর দড়ি । ঠাকুরের সূতীর জামা থেকে চায়ের কাপ সেলের  বিকিকিনির হাটে হরেক পসরা  হরেক আইটেম । টাউন হলের ঠিক উল্টো দিকে উত্তরা মার্কেটের পাশে ছিল ফ্রুট জুস /সরবতের দোকান (এখনও আছে) চৈত্রের ঠা ঠা রোদ্দুরে তেতে পুড়ে বাজার করার  পর গলা ভেজানোর জন্য  বরাদ্দ   ছিল দশটাকার ম্যাঙ্গো শেক ... ওপরে গুঁড়ো দুধ আর কাজু কিশমিশ ছড়ানো সেই আম দইয়ের ম্যাঙ্গো লস্যি ছিল অমৃত !কোনো কোনো বার ট্রাম ডিপোর পাশে ঠিক শ্যামবাজারের  মুখটায় ডিম্পির দোকানের ধোসাও খাওয়া  হত... ঠান্ডা  ঘরে বসে সেই মুচমুচে পেপার ধোসা সাথে আনলিমিটেড সাম্বর  আর চাটনি ! পুজোর  সময়  এই কেনাকাটির চেহারাই ছিল অন্যরকম ; সে কেনা কাটিতে বাবা  থাকত  সঙ্গে  ফলে বাজেট থাকত বেশী...হাতিবাগান বা গড়িয়াহাটের সীমানা পেরিয়ে  সে  সময় নিউমার্কেট অবধিও যাওয়া হত বৈকি !
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇
আমাদের  বাড়িতে  বরাবরই দেওয়া থোওয়ার  চল  ছিল  বেশী। একে বাঙাল বাড়ি  তায়  যৌথ  পরিবার ... নিজেদের   না  হলেও ঠাকুমা , জ্যেঠিমা  , পিসিমাদের   দিতেই  হবে  ... এমন  ব্যাপার   ছিল। সে বেড়াতে  গেলেই হোক, বা পয়লা বৈশাখ , পুজো যে কোনো পার্বনে ।  মনে  আছে  ঠাকুমার   জন্য  বাবা  নিজে পছন্দ   করে সাদা খোলের   তাঁতের   শাড়ি  কিনতেন ।  ঠাকুমাই ছিলেন  সংসারের সর্বময়ী কর্ত্রী।

                 এখন  তো  অনলাইন মার্কেটিং এসে যাওয়ায়  সেলের বাজার তার কৌলিন্য হারিয়েছে ... মানুষজন এখন  সারাবছরই কিনছে;  সব  উইক এন্ডেই শপিং  মলে দারুন  ভীড়।গোটা দুনিয়াটাই  এখন   বিরাট  বাজার ... এসি  থেকে ফ্রিজ ল্যাপটপ  থেকে  মোবাইল বারান্দার   গাছ  থেকে  সোফাসেট রান্নার আনাজপাতি  থেকে আইস ক্রীম  সবই হাতের মুঠোয় মোবাইলের   ক্লিকের   অপেক্ষা ... পেমেন্ট  গেটওয়েও  রকমারি ... গুগুল পে , ফোন পে, ইউপি আই ওয়ালেট  শুধু ব্যাংকে   রেস্ত   থাকলেই  হল ... এখন সেলের জামাকাপড় বিক্রি হয় ফেসবুকে অ্যাড   দিয়ে  এবং  কোনো ডিসকাউন্ট ছাড়াই... মলিন মুখ  হকাররা বেচে   দিচ্ছে ছোটো ছোটো হকার্স  কর্নার ; বেশ কিছু ছোটো দোকান মিলে  তৈরী  হচ্ছে   বড়  বড়  রিটেল স্টোর ... বিগ বাজার ,  বাজার  কোলকাতা  সেখানে  ঘড়ি  থেকে  জুতো  সবই অ্যাভেলেবল  , তিনটে   কিনলে  একটা  ফ্রি... গাদা গুচ্ছের  অফার ... সেই  সব রিটেল স্টোরও হাত বদল  হচ্ছে রাতারাতি... আমরা  শুধু  দর্শক ... নীরব  দর্শক ...

Post a Comment

0 Comments