বিস্মৃতপ্রায় কবি মণীন্দ্র রায়
নির্মল বর্মন
"কী জানি কী অপরাধে অর্ধপথে ধ্বসে গেল সেতু"
--মণীন্দ্র রায়
ক্রেতাত্বভঙ্গুল ঘুণধরা সমাজে কবি মণীন্দ্র রায়ের ভাবনায় যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। এহেন কবি মনীন্দ্র রায় অধুনা বাংলাদেশের পাবনা জেলার "শিতলাই" গ্রামে ১৯১৯ সালের ৪ঠা অক্টোবর পৃথিবীর রূপ রস গন্ধের স্বাদ অনুভব করেছিলেন। ছোট থেকেই দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্তরের গল্প উপন্যাস পড়ে তার মর্মবাণী হৃদয়ে গেঁথে রাখতে পেরেছিলেন। অল্প বয়সেই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ মৈত্রের সাহচর্য লাভ করেছিলেন। কলকাতার সুরেন্দ্রনাথ কলেজ থেকে ইংরেজিতে সাম্মানিক স্নাতক হন। এই সময়ের কালজয়ী দুজন সাহিত্যিক ও শিক্ষক বুদ্ধদেব বসু ও বিষ্ণু দে'র সান্নিধ্য লাভ করেছিলেন । কবি সমর সেনের "শ্রীহর্ষ" পত্রিকার সঙ্গে খানিক যুক্ত ছিলেন। পরে "সত্যযুগ" পত্রিকার সম্পাদনার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন। সুধীন্দ্রনাথ দত্তের "পরিচয়" পত্রিকায় মণীন্দ্র রায়ের "দাদুরী" বাংলা কবিতা প্রকাশিত হয়। এই থেকেই বাংলার সারস্বত সমাজ মণীন্দ্র রায়কে চিনতে শুরু করলেন। বন্ধু ননী ভৌমিক, কবি জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র ও চিত্রশিল্পী রথীন মৈত্রের অনব্রত উৎসাহ ও উদ্দীপনায় সাড়া দিয়ে কাব্য জগতে প্রবেশ করেন।২৮শে আগস্ট ২০০০সালে ৮০ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
কবি সমর সেনের "শ্রীহর্ষ" প্রকাশনা সংস্থা থেকেই কবি মণীন্দ্র রায়ের প্রথম কাব্যগ্রন্থ "ত্রিশঙ্কু" প্রকাশিত হয়ে পাঠকের হৃদয়ের স্থান লাভ করে। 'সীমান্ত' ও 'নিষ্পন্ন' নামে দুটি কবিতা পত্রিকার সম্পাদকও ছিলেন বটে। তেভাগা আন্দোলন নিয়ে "ইয়াসিন মিঞা" নামে বড় কবিতা লিখেছিলেন। "মোহিনী আড়াল" কবিতার জন্য ১৯৬৬ তে মণীন্দ্র রায় কে 'সাহিত্য আকাডেমি' পুরস্কারে সম্মানিত করা হয়েছিল। মণীন্দ্র রায় ১৯৯৩ এ "সনেট সমগ্ৰ" গ্ৰন্থের জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারের রবীন্দ্র পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন।
কবি মনীন্দ্র রায় এর গ্রন্থ সম্ভার:-
"ত্রিশঙ্কু" ১৯৩৯; "একচক্ষু" ১৯৪২ ; "ছায়া সহচর" ১৯৪৪; "সেতুবন্ধের গান" ১৯৪৮; "অন্যপথ"১৯৫১; "কৃষ্ণচূড়া" ১৯৫৫ ; "অমিল থেকে মিলে" ১৯৫৮; " মুখের মেলা" ১৯৫৯ ; "অতিদূর আলো রেখা"১৯৬২ ; "মোহিনী আড়াল" ১৯৬৬ ; "কালের নিঃস্বন" ১৯৬৬ ; "নদী ঢেউ ঝিলিমিলি নয়" ১৯৬৮ ; "ভিয়েতনাম" ১৯৬৯; "এই জন্ম, জন্মভূমি" ১৯৬৯; "জামায় রক্তের দাগ"১৯৭০; "নাটকের নাম ভীষ্ম"১৯৭০ ; "আমাকে বাঁচতে দাও" ; "আমাকে জাগতে দাও" ১৯৭১ ; "ঘণ্টা ঘড়ি" ১৯৭৪; "মাথায় জড়ানো জলপাই পল্লব" ১৯৮৪; "ভালো থেকো" ১৯৯৯।
"একচক্ষু" কাব্যগ্রন্থে কবি মণীন্দ্র রায় পরিষ্কারভাবে কবিতার আঙ্গিক সম্বন্ধে সচেতন বার্তা, শব্দচয়নের মুন্সিয়ানা, ভাষার শৈল্পিক ভাবনা, ছন্দ, অলংকার ও চিত্রকল্পের সামগ্রিক অনায়াস শিল্পসিদ্ধি উপহার দিয়েছেন। প্রখ্যাত কবি বিষ্ণু দে "একচক্ষু" কাব্যের সমালোচনায় লিখেছেন---
"অভ্যস্ত দক্ষিণ একচক্ষুপণা থেকে সস্তার বাম একচক্ষু পণার সহজ প্রলোভনে না ভুলে লেখক তাই খোঁজেন সত্তার সম্পূর্ণতা-- কমিউনিস্টদের ভাষায় সততা,দ্বন্দ্বাশ্রয়ী ভৌতিকবাদে যার দার্শনিক সমর্থন"।
"একচক্ষু" কাব্যগ্রন্থের চিত্রকল্পের কারুকার্য সহজেই হৃদয় গ্রাসী, যেমন-----
"সূর্যাস্ত বন্দরে স্তব্ধ বণিক- মাস্তুল।
নিরুপায়, বন্ধ হল আদায় উশুল।
সন্ধ্যার জাহাজ যেন পিশাচের বাসা"।।
কবি মনীন্দ্র রায় 'গুপ্তচিত্র' কবিতায় কৃষক জীবনের প্রতিচ্ছবি সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন---
তারি বুকে
ভাসে অজন্মার হাড়জ্বালা ছাপ, সে বছর পাঁচ ছেলে
মেয়ে বউ খাওয়াতে না - পেরে, জীবনের চালে গিয়ে
হেরে, মেঠো হাড়ী চুকাতে সন্তাপ তারি তলে খুঁজেছে
আশ্রয়"।
কবি মণীন্দ্র রায় তেভাগা আন্দোলনের পটভূমিতে অসহায় গরিব কৃষকের সন্তান হারানোর অসহ্য যন্ত্রণা ও তা থেকে উত্তরণের চালচিত্র "ইয়াসিন মিঞা" কবিতায় ফুটিয়ে তুলেছেন-----
" হাজার
চাষীর খামারে ওঠে তেভাগার উপদ্রুত সাড়া।
সেদিন সুলালগঞ্জে হিংস্র ক্ষুধা খান্ডবের রোষে
জ্বলে গেল কতো ঘর---- একটি কিশোর
সূর্যাস্তের সে তিমিরে প্রাণ দিয়ে হল সন্ধ্যাতারা।
এখনো স্মৃতিরপটে দেখা যায় রহিমের দেহ--
রক্তপরিপ্লুত, মৃত, চোখে তবু কী এক জিজ্ঞাসা"!
কবি রায় "ইয়াসিন মিঞাকে বর্তমান সময় ও সমাজে 'একালের নচিকেতা' হিসাবে প্রতিপন্ন করতে চেয়েছেন , কারণ পুত্র শোককে কাজের মাধ্যমে অমৃতের আস্বাদন অনুভব করতে চায় সুতরাং ' ইয়াসিন মিঞা''র প্রতিক্রিয়া ও অবনের হৃদয়ানুভব ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে কবিতাটি কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত করেছেন-----
"ঝুঁকে ঝুঁকে চলে যায় আসন্ন আঁধারে
শীর্ন দেহখানি তার। কাজে ডুবে পেয়েছি আরাম?
দুটি পাখি উড়ে গেল ; আলো জ্বলে কার আঙিনায়।
পৃথিবী চলেছে। হেসে অবনী জানাল মনে মনে---
এ জীবন এত স্বচ্ছ ,বাণী তার এতোই আদিম,
অথচ মানুষ তার লিপি ভুলে যায়"।
কবি রোমান্টিক প্রেমের কবিতাতেও যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল ,"অতিদূর আলোরেখা", কবিতার মধ্যে আমরা উপলব্ধি করি-----
"মুহূর্তেই পৃথিবীর চেহারা বদলায়।
চারিদিকে ঋজু শাল, হাওয়া নেই, শূন্যতার বুকে
গম্ভীর মাদল বাজে ঘন অন্ধকারে।
মনে হল একা আমি, উৎসবের দিন
অতিদূর আলোরেখা, কোনো ঘরে আর স্মৃতি নেই,
তুমিও ভুলেছ একেবারে"!
কবি মনীন্দ্র রায় 'অন্যপথ' কাব্যগ্রন্থে স্বাধীন ভারতে জটিল কুটিল ছন্নছাড়া রাজনীতি ও শাসক শোষণের অত্যাচারের চিত্র এঁকেছেন কবি, যেমন----
"তারা চায় শত জতুগৃহের দাহ
শত দ্রৌপদী বিবস্ত্র সভা মাঝে।
তুমি তো তাদেরই অন্ধ স্বার্থবাহ,
থাকবে শিশু ও ভ্রুণহত্যার কাজে"।
কবি রায়ের "অতিক্রান্ত" কবিতায় সৌন্দর্য ভাবনা আঙ্গিক সুষমা সুললিত ভাষায় পরিবেশন করেছেন---
"নব ফাল্গুনে কখনো বা তার
সাড়ায় কেঁপেছে নতুন পাতা,
ভুঁইচাঁপা খোলে চকিত দুয়ার
দিঘি ভরে ঢেউয়ে নীলের খাতা।
শুধু ঐটুকু, তার বেশি নয়
একসুরে সাধা সেই রাগিনী
কখনো গোপনে খুঁজেছে প্রণয়,
কখনো বা সাজে বৈরাগিনী"।
কবি মণীন্দ্র রায় পূর্ণ সময়ের লেখক ছিলেন।। আর কবিতার বিষয়বস্তুর গঠন কৌশল ও আঙ্গিক সৌন্দর্য চিরন্তন শাশ্বত যা আধুনিক বাংলা কবিতা পাঠকের হৃদয়কে আপ্লুত করে রাখবে। সুতরাং কবিও চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন যদিও তিনি বিস্মৃতি প্রায় কবিদের তালিকায় স্থানলাভ করার পথে। তবুও কবি দীর্ঘ চল্লিশ বছর ধরে কবিতা রচনা করেছেন এবং পাঠক হৃদয়ে পাক্কা আসন লাভ করেছেন।
0 Comments