মহাভারতের কর্ণ - এক বিতর্কিত চরিত্র
দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী
পঞ্চদশ পর্ব
অর্জুনকে সে প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সুযোগ না দিয়ে বাসুদেব তীক্ষ্ণকণ্ঠে বললেন "কর্ণ, এখন তুমি ধর্মের নীতি অনুসরণ করার কথা বলছ। কিন্তু তুমি তোমার নিজের কৃতকর্মের কথা স্মরণ করে বলতো তুমি কি ধর্মনীতি সর্বদা অনুসরণ করেছ? দ্যূতসভায় যখন রজস্বলা একবস্ত্রা কৃষ্ণাকে এনে দুঃশাসন, শকুনি, দুর্যোধন তাঁকে লাঞ্ছনা করেছিল তখন কি তুমি তাদের নীতির কথা স্মরণ করে বাধা দিয়েছিলে না ত্যাগ করেছিলে? যখন যুদ্ধের ত্রয়োদশ দিবসে একযোগে সপ্তরথী আক্রমণ করে বালক অভিমুন্যকে হত্যা করেছিল তখন তোমার এই ধর্মনীতি কোথায় ছিল"? এই কথা শুনে কর্ণ লজ্জায় অধোবদন করলেন বিশেষত্ব অভিমন্যুর প্রসঙ্গে নীরব রইলেন। দ্রৌপদীর প্রসঙ্গ স্বতন্ত্র এবং তার অন্তর্নিহিত ব্যঞ্জনা তিনি বাসুদেবকে পূর্বেই ব্যাখ্যা করেছেন।
অতঃপর বাসুদেব অর্জুনকে ইঙ্গিত করলেন শত্রুকে আঘাত করার এই হচ্ছে প্রকৃষ্ট সময়। কিন্তু অর্জুন বাসুদেবকে বললেন "সখা, নিরস্ত্র শত্রুকে বধ করাতো যুদ্ধের ন্যায়-নীতির বিরুদ্ধাচরণ করা, বিশেষত কর্ণের মত যোদ্ধাকে এভাবে বধ করলে সমগ্র ক্ষত্রিয়কুলে আমার সুনামের প্রতি কি কলঙ্ক লেপিত হবে না? অধিকন্তু এভাবে তো যুদ্ধ করার শিক্ষা লাভ করি নি"?
অর্জুনের এইকথা কর্ণের শ্রবন গোচর হওয়ামাত্র তিনি ভাবলেন আমি অস্ত্রধারণ না করলে অর্জুন তো আমার প্রতি অস্ত্র নিক্ষেপ করবে না এবং পাণ্ডবেরাও নিষ্কণ্টক হবে না, তাই তিনি সেই অবস্থাতেই ধনুক হস্তে নিয়ে অর্জুনকে লক্ষ্য করে এক ভয়ঙ্কর অস্ত্র নিক্ষেপ করলেন। বাসুদেবের অতিক্ষিপ্র রথচালনায় সে অস্ত্র অর্জুনের মস্তকে আঘাত না করে বাহুতে আঘাত করল। কর্ণের এই অস্ত্রত্যাগের পরে অর্জুনের যুদ্ধ করার আর কোনো বাধা থাকল না এবং বজ্রাগ্নি সমতুল্য এক ভয়ঙ্কর অস্ত্রে কর্নের মস্তক ছেদন করলেন।
জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇
ঠিক সেই মুহূর্তে যেন মনে হলো কৌরব পক্ষের সঙ্গে অন্তরীক্ষে, জলে-স্থলে সর্বত্র এক হাহাকার ধ্বনিত হল। সেই হাহাকার দূর থেকে দূরান্তরে যেয়ে সুদূর দিগন্তসীমা অতিক্রম করে যেন কোন অমর্ত্যলোক পর্যন্ত প্রসারিত হল। মনে হলো স্বয়ং সূর্যদেব বুঝি বেদনায় অস্তাচলে চলে গেলেন। আর অর্জুনের মনে হল তাঁর রথের নিচে মেদিনী মাতাও যেন কি এক অব্যক্ত বেদনায় কেঁপে উঠলেন। অর্জুন যেন স্পষ্ট দেখতে পেলেন এক নিরাকার তেজঃপুঞ্জ কর্ণের দেহ থেকে নির্গত হয়ে মহাশূন্যের উদ্দেশ্যে উত্থিত হয়ে সূর্য মন্ডলের জ্যোতিঃপুঞ্জে বিলীন হয়ে গেল। আর তখনই শ্রীকৃষ্ণ নীরবে দক্ষিণ হস্তে আশীর্বাদের মুদ্রা করে এক দীর্ঘশ্বাস ফেললেন যা অর্জুন দেখতে পেলেন না। পশ্চিম দিগন্তে মনে হল ভগবান ভর্গদেব তাঁর রক্তবর্ণ কিরণ দিয়ে তাঁর এই ভক্ত সন্তানের রক্তাক্ত শরীর স্পর্শ করে সেই রক্তে নিজের দেহ রঞ্জিত করে স্নান করার নিমিত্তে সুদূর পশ্চিম সাগরে অবগাহন করতে গেলেন। তাঁর এই একান্ত ভক্ত সন্তানকে রক্ষা করতে না পারার লজ্জাই যেন পশ্চিম দিগন্তের অস্তাচলে প্রতিফলিত হয়ে তখনও তা আরক্তিম করে রেখেছে।
কর্ণের মৃত্যু সংবাদে কৌরব পক্ষে বিষাদের ছায়া নেমে এল। দুর্যোধন বুক চাপড়ে হাহাকার ধ্বনিতে বিলাপ করতে লাগলেন "হা বন্ধু কর্ণ, আমি আমার প্রাণের অধিক মিত্রকে হারালাম। পিতামহ ভীষ্ম, গুরু দ্রোণাচার্য, মহাবীর কর্ণ সকলেই চলে গেলেন - এ অবস্থায় কে আমাকে রক্ষা করবে"?
অষ্টাদশ দিবসে কুরুক্ষেত্রের প্রান্তরে ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা ভীষন, আত্মীয় নিধনকারী, লোকক্ষয়কারী যুদ্ধের অবসান ঘটল। দুপক্ষের প্রায় সমস্ত বীরেরা ক্ষত্রিয়ের পরমগতি লাভ করেছেন। অগণিত সেনা নিহত হয়েছেন। মৃত পশুর দুর্গন্ধ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। ভারতবর্ষে বীরযোদ্ধা বলতে পঞ্চপান্ডব ছাড়া আর বেশি কেউ বেঁচে নেই। রণভূমি লক্ষ লক্ষ শবে সমাচ্ছন্ন - শিবা, কুক্কুর, বৃক ও নরমাংসভোজী পিশাচের ক্রীড়াভূমি হয়ে উঠেছে।
হস্তিনাপুর রাজপ্রাসাদ থেকে সহস্র সহস্র পুরনারীগণ ধৃতরাষ্ট্র, গান্ধারী, কুন্তী ও বিদুরের সমভিব্যাহারে কুরুক্ষেত্র রণভূমি এলেন তাঁদের মৃত পুত্র, স্বামী ও আত্মীয়দের শবদেহ যথোচিত সৎকারের নিমিত্ত ও শেষ দেখার বাসনায়।
যুধিষ্ঠির, অপর ভ্রাতাগণ, দ্রৌপদী এবং বাসুদেবও তাঁদের সহিত অনুগমন করলেন। সেই শ্মশানভূমিতে তখন এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা ঘটল। এই সময়ে বাসুদেব তাঁর পিতৃষ্বসা পান্ডব জননী কুন্তীর সমীপবর্তী হয়ে মৃদু অথচ যুধিষ্ঠিরের শ্রুতিগোচর কণ্ঠে বললেন "আর্যা সময় হয়েছে সেই জ্বলন্ত চরম সত্য প্রকাশ করার আপনার পুত্রদের ও দ্রৌপদীর কাছে। কর্ণের যথার্থ পরিচয় প্রকাশ না করলে তার যথোচিত সৎকার ও তর্পনাদি হবে না এবং পান্ডু বংশধরদেরই সেই কর্তব্যকর্ম করণীয়"। কুন্তী এই কথা শ্রবণ করে বক্ষে করাঘাত পূর্বক হাহাকার রবে উচ্চৈস্বরে ক্রন্দন করে ভূলুণ্ঠিত হয়ে বললেন "বাসুদেব এ মর্মান্তিক লজ্জা ও যন্ত্রণা থেকে তুমি আমাকে উদ্ধার কর। তুমিই ওদের কাছে সেই সত্য প্রকাশ কর"। পঞ্চপান্ডব ও দ্রৌপদী বিস্মিত হয়ে বাসুদেবকে প্রশ্ন করলেন "কি সেই চরম সত্য মা প্রকাশ করতে মাতা কুণ্ঠিত হচ্ছেন"?
বাসুদেব শান্ত কোমল কন্ঠে বললেন " সখা অর্জুন, চিরদিন তুমি যাকে তোমার একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী, প্রতিযোদ্ধা ভাবতে, যাকে বধ করার জন্য তুমি আজীবন কৃতসংকল্প ছিলে সেই কর্ণ কিন্তু সুতপুত্র রাধেয় নন, তিনি তোমাদের জননী কুন্তীর পুত্র কৌন্তেয়, তিনি তোমাদের সকলের অগ্রজ। এই সত্য তোমরা জানতে না কিন্তু মহান হৃদয় কর্ণ তা জেনে ছিলেন এবং সেইজন্যই জননী কুন্তীকে দেওয়া তাঁর প্রতিশ্রুতি মত বহুবার সুযোগ পাওয়া সত্ত্বেও তোমার অপর ভ্রাতাদের তিনি কখনো ক্ষতি করেননি"। বাসুদেবের মুখনিসৃত বাক্য শ্রবণ করার পরে পঞ্চভ্রাতা সেখানে স্থানুর মত দাঁড়িয়ে রইলেন। জীবনে তাঁরা বহু কষ্ট সহ্য করেছেন, বহু কঠোর নির্মম আঘাত সহ্য করেছেন কিন্তু আজকের এই নির্মম সত্যের আঘাত তাঁদের কাছে অসহনীয়। দ্রৌপদীও পুত্রশোকের নিদারুণ কষ্ট ভুলে বিস্ফারিত নেত্রে পাষাণবৎ হয়ে গেলেন।
কিছুক্ষণ পরে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির বললেন "বাসুদেব এ তুমি কি বলছ? একি সত্য? আর যদি তা সত্য তাহলে তুমি বা জননী কেন আমাদের কাছে এই চরম সত্য পূর্বে প্রকাশ করলে না, আমরা তো তাহলে ভ্রাতৃঘাতী হতাম না"। বাসুদেব গাঢ় অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বললেন "এই সময়ে এই সত্য প্রকাশকালে নিশ্চয় আমি পরিহাস করছি না। আর্যা কুন্তীর দিকে একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দেখুন তিনি কি নিদারুণ যন্ত্রণায় বিদ্ধ হচ্ছেন। বালিকা বয়সের চাপল্যে, কৌতুহলের বশবর্তী হয়ে, ক্ষনিকের দূর্বলতার ফসল এই পুত্র ভগবান সূর্যদেবের ঔরসে আর্যা কুন্তীর গর্ভের প্রথম সন্তান কর্ণ। কিন্তু লোক অপবাদের ভয়ে তিনি সন্তান জন্মগ্রহণ করা মাত্র তাকে এক পেটিকায় ভরে অশ্বনদীতে বিসর্জন দিয়েছিলেন। সেই পেটিকা স্রোতের টানে ভাসতে ভাসতে গঙ্গা নদীতে আসার পরে সুত অধিরথ ও তার স্ত্রী রাধা সেই পেটিকা থেকে নবজাতককে উদ্ধার করে পুত্র-স্নেহে তাকে মানুষ করেন"।
বাসুদেবের প্রকৃত তথ্য জ্ঞাপনের পরে অর্জুন উচ্চঃস্বরে রোদন করে বললেন "এই কারণেই কি চিরদিন তাঁর প্রতি এক অদ্ভুত অমোঘ আকর্ষন অনুভব করেছি, বাসুদেব। তাঁর প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করলেও তার বহুবিধ সুকীর্তির কথা স্মরণ করে ঈষৎ শ্রদ্ধা পোষণ না করে পারিনি। সমরাঙ্গনে তাঁকে নিরস্ত্র দেখে কি এক অন্তরের টানেই বোধ হয় তাঁর প্রতি অস্ত্র বর্ষণ করতে বিরত ছিলাম বা দ্বিধাগ্রস্ত হয়েছিলাম। হায়, জননীর অকারণ অপরাধবোধের নিমিত্ত আজ আমাকে ভাতৃঘাতীর কলঙ্ক ও পাপ গ্রহণ করতে হলো। অথচ কর্ণ ও অর্জুন একত্র হলে স্বর্গের দেবতাদের জয় করাও অসাধ্য ছিল না"।
………….পরবর্তী সংখ্যায় দেখুন
0 Comments