বাগদি চরিত (চতুর্থ পর্ব)
শ্রীজিৎ জানা
পাড়ার সবাই জানে খুদা সাগরীর সঙ্গে পারবে না। এক সময় খুদা কিছু না করতে পেরে রাপে টংটং করে হাঁটা দেয়। আর গলার শিরা ফুলিয়ে দাঁত কড়মড়িয়ে খিস্তি দিতে থাকে
—- ঢ্যামনা শালীর সঙে কেউ পারবেনি। ওমনি বলে পেটার খালের মেইয়া। পেটার বাগদি জোঁটা। কত কাউচান করবি কর। মোর ছেঁড়া গেল।
— তুইও এসে দেখবি, কারো কপালে কাকবল আজ জুটবেনি। তোর মুখে কে ম্যাটা লাগায় দেখব! এই সাগরী বাগদি ছাড়া তোর কোন নাঙ দেখে আমি দেখব!
খুদার ছেলে মেয়েরা জেনে যায় আজ ভাগ্যে কষ্ট আছে। সারাদিন তাদের ভাত জুটবে না। তাদের মা দুয়ারে ঠায় বসে থাকবে। মরা দাদু ঠাকুমাকে গাল পাড়বে বিস্তর। মামা ঘরের দাদু দিদাকে শাপ -শাপান্ত করবে একগাদা। তারপর বাখুলের লোকেদের ঠেস দিয়ে গালিগালাজ চলবে এক প্রস্থ। তাদের নিজেদেরকেই মুড়ি অথবা পান্তা বেড়ে খেতে হবে। কপাল খারাপ হলে দু'চার ঘা পড়তেও পারে পিঠে।
সন্ধ্যা গড়িয়ে খুদা ঘরে ফিরে আসে। দুপুরে ওস্তাদের ঘরে ভাত খেয়ে নিয়েছেয় সে। যদিও ছেলেমেয়ে দুটোর কথা একবার মনে পড়েছিল তার। কিন্তু তখন রাগে সংসারের সব টানই যেন শিয়ালকাঁটা হয়ে বুকে ঘনঘন ফুটছিল। ঘরে এসে দেখে ছেলেমেয়েরা ঘুমিয়ে পড়েছে। সাগরীও পাশের খুদি ঘটায় ঘুমে অচেতন। খুদার একটাই মাত্র ঘর। তিন দিকে দুয়ার। ছ্যানা দুটো হওয়ার পর পিছন দিকটায় ঝিটচাল নামিয়ে খুদি ঘর করেছে সে। ঘরের ভিতরে একটা মাটির মাচা আছে। তার পেট তলে সংসারের ভীর কুটি জিনিসপত্র। কুটুম বাটুম এলে, রাগ গোসা হলে, হয় খোদা নয় সাগরী এই ঘরে শোয়। খুদা ছ্যাচা বাঁশের কপাট হালকা করে ঠেলে ঘরে ঢুকে। বটু গুনিনের ঘর থেকে বেরিয়ে বেল পুকুরের পাড় গিয়েছিল।পাঁচটা চপ নেয় সেখানে। একটা চপ দিয়ে দু গ্লাস দেশি গিলে । আজ খুব বেশি খায় না। ঘরে ঢুকে সাগরীর গা ঘেঁষে শুয়ে পড়ে। খুদা জানে এখন তাকে কি করতে হবে। সাগরে কি করবে। খুদা প্রত্যেক বারের মত সাগরীর গায়ের উপর জোর করে উঠে পড়ে। মদের তেজ খুদার শরীরে মনে কিছুটা জোর বাড়িয়ে দিয়েছে। সাগরী তখনো গাল পেড়ে চলে। খুদা সেদিকে কান দেয় না। সে তখন দক্ষ মাঝির মত লগি ঠেলে নৌকা বেয়ে চলে। একসময় সাগরীর গাল পাড়া থেমে যায়। বিছানায় নেতিয়ে পড়ে সাগরী। কিছুক্ষণ পর উঠে ছ্যানা দুটোকে জাগিয়ে চারজনে চপরদিয়ে মুড়ি খেয়ে এক বিছানায় শুতে যায়।
পেটার খালের নাম আছে চারদিকে। খাল পাড়ে বাগদিদের বসতি। এক সময় লাঠি খেলায় পেটার বাগদিদের সাথে কেউ পেরে উঠত না। জষ্টির কালি পূজাতে কানে দুল পরে, মাথায় লাল শালু বেঁধে,কপালে লাল টকটকে সিঁদুরের চওড়া তিলক কেটে লাঠির প্যাঁচে ঝড় তুলত। চাঙরি খেলত তারা। লাঠির ডগে দড়িতে পাথরের মোটা ঢিল বেঁধে মাথার উপর বনবন ঘোরাত। পাশাপাশি দুটো চাঙরি সুদর্শন চক্রের মতো ঘুরত। পরস্পর আঘাতে যার ঢিল ভেঙে গুঁড়ো হয়ে যেত, হারত সে। সেকালে পেটার বাগদিরা ছিল জমিদারদের বিশ্বস্ত পাইক বরকন্দাজ।সেইসব লেঠেল আজ নেই। হাল আমলের লাঠিয়াল দু'একজন বেঁচে থাকলেও তাদের বুড়া হাড়ে সেই জোর আর নেই। তবে খাল পাড়ের দাপট এখনো ভয় ধরায়। সেকালে রাজা জমিদারের পাইকগিরি করা পেটার লেঠেলদের আজ পার্টির লোকেরা ব্যবহার করে। রাজা বদলেছে। শাসনের ধরণ বদলেছে।লাঠির বদল হয়নি। লাঠিয়ালের বদল হয় নি। রাগ মরে নি। শুধু রাগের আঘাতে মরে চলেছে একই মানুষের দল। খালি পেটার নয়,ঢোলের নয়,বাঙলার বাগদিদের কাছে এই সত্য আড়াল করে রেখেছে ধান্দাবাজরা। এমন কি বাগদিরাও মাথামোটা। তারা এই স্বজাতি কিংবা ভিনজাতির বিরুদ্ধে লাঠি ধরাকে বীরত্ব ভাবে।এমন বীরত্বের ভিতর কোন গৌরব নেই, আছে আত্মঘাতী অবিমৃষ্যকারীতা। বাগদিরা বোঝে না।সাগরীকে দোষ দেবে কারা? সেই নীচ বীরত্বের গর্ব নিয়েই সাগরী কথায় কথায় খুদাকে শাসায়।
—জান ত আমি কথাকার ঝিউড়ি? গায়ে হাত তূললে নি,তমাকে মোর বাপ দাদারা পঁশ বিছিয়ে কেটে দিবে এগবারে।
খুদা জানে এইসব কথার কথা। রাগলে সাগরী এরকম বাখান দ্যায় তাকে। খুদা রাগে না।সাগরীকে সে তার জীবনে পয়া ভাবে। সাগরীই তার মাথায় প্রথম ভাবনাটা ঢোকায়।
—গুনীনি করবে তুমি আর অস্তাদের বউ বসে বসে টাকা লিবে ক্যানে?
—-তুই মেইয়া জাত সব বুজলে ত ফুরি যেত। যত হোক সে অস্তাদের পরিবার। অস্তাদ মোকে হাত ধরে সব শিকিছে। মোর ত একটা কত্তব্য আছে,না কি?
—-কত্তব্য বলে কি তার ওলোতলে সব ঢেলে দিবে! তমার মাগ-ছ্যানা নাই! তাবাদে নিজের বাপের ভিটা থাকতে এখনো ক্যানে তার ভিটায় লটাবে? বাপের ভিটায় মা মনসা কি একটু জল পাবেনি? সাগরী কি মায়ের থানে ছড়াঝাট দিবার জোগ্গ নয়?
খুদা এবার থমকে যায়। মনে মনে ভাবে,সাগরী কথা গুলো অনাহ্য কিছু বলেনি। ঠিকই তো। বাপের ভিটেতে বসে সে গুনীনী করতে পারে। নিজেদের বাস্তুতে মনসার থান প্রতিষ্ঠা করলে বাস্তুর মঙ্গল। কত লোকজনের পায়ের ধূলা পড়বে তাদের বাস্তুতে। মাল পাড়ার সুনাম ছড়াবে। সাগরীর কথামতো মাঝেসাঝে ওস্তাদের বাড়িতে গেলেই হোলো। পয়সা দিলেই তো ফুরি গেল ঝামেলা। সম্পর্ক ওস্তাদের সঙ্গে ছিল বলে কী তার সংসারকে টানতে হবে সবদিন! এতটা ঊদার নয় খুদা। আবার নেমকহারাম হতেও সে পারবে না কোনদিন। তবে সাগরীর যুক্তি তার মনে গেঁথে যায়। মুখ দিয়ে খুদার কথা বেরোচ্ছে না দেখে,সাগরী মুখ খুলে,
—আজকাল বেশি মনুষত্যা দেখাতে যেও নি। লোকে সব ঝেড়েপুঁছে লিবে আর তুমি আঁটি চুষে মরবে।
খুদার চোখেমুখে এবার বউয়ের কথার সমর্থনের আভাস ফুটে ওঠে। ব্যস্,যেমন ভাবনা তেমন কাজ। বাস্তুর ঈশান কোণে ঝিটাবেড়ার মন্দির করবে বলে খুদা মনস্থির করে।পাঁচকড়ি আচায্যিকে ডেকে আনে। বাস্তুর ওই কোণায় মন্দির করা যাবে কিনা আচায্যি গণনা করে বলবে। তারপর তাঁর হাতেই বাস্তু বন্দ দেওয়া হবে। কথাটা লোখার কানে তুলে ময়না। লোখা সেইমাত্র চিতনের ঘর থেকে ফিরেছে।
মাথার উপর বৈশাখের গনগনে আঙরার আঁচ। চারদিক সেই আঁচে জ্বলে পুড়ে সেদ্ধ হওয়ার জোগাড়। চিতনের এখন দু'পয়সা রোজগারের মরসুম। বোশেখ-জষ্টি মানেই চিতনের তালরসের ব্যবসা রমরমা চলে। খগেন মাস্টার ছাড়া মিঠা রস কেউ ছোঁয় না। সবার তাড়ির প্রতি ঝোঁক। চিতন বলে,
— মোর তাড়ির এমন গুন পেট ঠান্ডা রাখবে,বায্য করিয়ে পেট পরিস্কার রাখবে। আার পা না টলিছি ত মোর নাম শালা চিতন বাগ্দি লয়।
বর্ষার মুথ অব্দি চিতনের ঘরে খদ্দেরের ভীড় লেগেই থাকে। ষাট -সত্তর টাকা বোতল পর্যন্ত তাড়ি বিক্রি করে চিতন।
শিলাইয়ের পেটের ভিতর তালহিঁড়। পশ্চিম পাড়ে সিমুলিয়া,রাধাবল্লভপুর। নদীটা এখানে যেন ধনুষ্টংকার রুগীর মতো বাঁক নিয়েছে। সেই বাঁকের কোলে তালহিঁড়ের চর। দু'পাড়ে উঁচু বাঁধ। বান বন্যার সময় তালহিঁড়ের তল পাওয়া যায় না। খালি জেগে থাকে চোদ্দ-পনেরটা খাড়াই তালগাছ। তালগাছ গুলো কেউ লাগায় নি।তবে তালহিঁড়ে যার জমির সীমানায় গাছ,সে হল সেই গাছের মালিক। সব গাছের মালিকানা পশ্চিম পাড়ের লোকদের। চিতন গাছ পিছু দু'শ টাকা করে ডাক দ্যায়। পশ্চিম পাড়ের ঝম্পা সাঁত কয়েকটা গাছ ডাকে। তবে চিতন নামকরা গেছাল।গাছ তার সাথে কথা বলে। তালগাছের নাড়িনক্ষত্র তার জানা। চৈত্রের মুখে মোধা কামারের কাছে যায়। বসে থেকে হাঁসুয়ায় শান দিয়ে আনে। তারপর গাছে বাঁশ দিতে লাগে। লোখা গাছে বাঁশ বাঁধতে পুরোদমে হাত লাগায়। বিনিময়ে পুরো ডাড়ির সিজিনে লোখা বিনা পয়সায় তাড়ি খায়।
তালহিঁড়ের কোন গাছ ফলা আর কোনটা নাড়া চিতনের জানতে বাকি নেই। সেই হিসেবেই গাছের দর তুলে। চুক্তি পাকা হলে গাছে বাঁশ দ্যায়। গাছের গড়ন বুঝে চিতন বাঁশ জোগাড় করে। লম্বা শর খঁচা গাছ হলে বাঁশ হবে শরখঁচা। গাছের তলপেট বাঁকা হলে পেট বাঁকা বাঁশও জোগাড় করে চিতন।
তারপর কোমরের পিছনে হেঁসো গুঁজে নেয়।রাঁশের কঞ্চির পা -দানি বেয়ে তরতরিয়ে গাছের মাথায় উঠে যায় চিতন।তার আগে গাছে মাথা ঠুকতে ভুলে না সে। গাছ তার কাছে দেবতা। এই তিন চার মাস ডার পরিবারের মুখে অন্ন জোগাবে এই তালহিঁড়ের তালবৃক্ষ।
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করুন। 👇
1 Comments
বেশ লাগছে
ReplyDelete