জ্বলদর্চি

যেতে যেতে পথে-৬৭/রোশেনারা খান

যেতে যেতে পথে

রোশেনারা খান

পর্ব ৬৭

সকালে চা খেতে খেতে দীপ বলল, সেক্সপিয়রের জামাই মেডিসিনের ডাক্তার ছিলেন। মাঝে মাঝে সার্জারিও করতেন। তখন নাকি বিভিন্ন কায়দায় রোগ সারানো হত। গলার ভিতরে ব্যথা হলে জ্যান্ত ব্যাঙ মুখের ভিতর ধরা হত, ব্যাঙ্গের মুখের লালা গলার ভিতরে গেলেই গলা পরিস্কার হয়ে যেত। প্লেগ নিয়েও একটা ছড়ার কথা বলল।
ক্যম্বরিয়ার ন্যাশনাল পার্কে আমাদের কটেজ।


     আর খবর শুনতে বা পড়তে ভাল লাগে না। শুধু মৃত্যু আর ধ্বংসের খবর। গতকাল(২৩ জুলাই) কাবুলে বোমা বিস্ফোরণে ৮০ জন মারা গেছে। রোজ কোথাও না কোথাও জঙ্গিহানা হচ্ছেই। আমরা এদেশে আসার পর বাংলাদেশে দু’বার হয়েছে। এছাড়াও ফ্রান্সে, জার্মানিতে জঙ্গিহানা ঘটেছে। এভাবে সাধারণ মানুষের জীবন বিপন্ন করে কী লাভ হয় বুছি না। তবে এটুকু বুছি এদের পিছনে  শক্ত হাতের মদত রয়েছে। পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে বিশ্বের সমস্ত মুসলিমদের সন্দেহের চোখে দেখা হচ্ছে। তাদের হেনস্থা করা হচ্ছে। কয়েকদিন আগে দীপ বলছিল, ওর এক সহকর্মী  ডাক্তার রোহিলা খাতুনের বাড়িতে হঠাৎ পুলিশ হানা দেয়। রোহিলা পাকিস্তানি, বিয়ে করেছে ব্রিটিশকে। ওঁদের ছেলে ইসলাম ধরম মানে। লম্বা দাড়িও রেখেছে। একদিন নেট সার্চ করে অমাজনে বই খুঁজতে গিয়ে আই এস আইদের একটি বই দেখতে পায়। এই বইটি দেখার অপরাধে পুলিশ সন্দেহ করে বাড়িতে হানা দিয়ে ছিল। 

     সবই দেখছি, শুনছি, কিন্তু মন থাকছে অন্য এক জায়গায়। কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। আজ দীপ আবার খান সাহেবকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছল, বি পি ঠিক আছে, একটা করে ট্যাবলেট খেতে দিয়েছে। জানি ওঁর খুব কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু আমার করার কিছু নেই। সহ্য করতেই হবে।
আয়রা ফোর্স

    আগামীকাল এক জায়গা বেড়াতে যাওয়া হবে। দীপ অনেক আগে কটেজ বুক করে রেখেছে। তা না হলে ওনার এই অবস্থায় কোথাও যাওয়ার কথা ভাবতে পারতাম না।  যদিও এই সবকিছুই করেছে আমাদেরব কথা ভেবে। বিকেল তিনটের সময় রওনা হয়ে ম্যানচেস্টার, ব্ল্যাকপুল, ল্যাঙ্কাসায়ার পার হয়ে লেক ডিসট্রিক্টে পৌঁছালাম। এরপর যেদিকে তাকায়, শুধু পাহাড় আর পাহাড়। পাহাড়ের কোলে পাহাড়। কোথাও গরু ভেড়া চরছে, কোথাও ফসল কেটে নেওয়া দিগন্ত বিস্তৃত নেড়া মাঠ। কোথাও গাদা হয়ে রয়েছে গম বা যবের কাঠি। তারপর শেষ ১৫ মাইল রাস্তা খুবই অপ্রসস্থ। দুটি গাড়ি কোন রকমে পাশ কাটাতে পারবে। রাস্তার একটা দিক জঙ্গলে ঢাকা। তারই মধ্যে দেখা যাচ্ছে পাহাড়, পাহাড়ের কোলে লেক। আসলে আমরা ন্যাশনাল পার্কে ঢুকে পড়েছি। আবার সবুজ প্রান্তর, বেলা ফুরিয়ে আসছে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে, গাড়ি ছুটে চলেছে। পথের যেন শেষ নেই। দূরে পাহাড়ের গায়ে ছোট্ট ছোট্ট কুড়েঘর দেখা যাচ্ছ্‌, ইন্দিকেটারের নির্দেশ মত গাড়ি ডান দিকে বাঁক নিল। কিছুটা যাওয়ার পর বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মত একটি কাঠের বাড়ি দেখা গেলে, সেখানে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, দূর থেকে যে কুঁড়েঘরের মত বাড়িগুলো দেখছিলাম ওগুলোই আমাদের কটেজ।

      নুড়ি বিছানো একফালি সমতল জায়গায় গাড়ি রেখে মেয়ে গেল রিসেপ্সনে চাবি আনতে। এখন আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি এটা ইংল্যান্ড ও স্কটল্যান্ডের বর্ডার ক্যাম্বরিয়া। এই জায়গাটি লেক ডিসট্রিক্ট নামে বেশি পরিচিত। কটেজের  তালা খুলে ভিতরে ঢুকে দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি ৮ টা ৩৫ বাজে। মেঘলা ওয়েদার,   গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টিও পড়ছে, কিন্তু দিনের আলো আছে এখনো।  এই জনমানবহীন জঙ্গলে কয়েকটা কটেজ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। মেয়ে যে চাবি নিতে গেছল, ওখানেও কোনও মানুষ নেই। দেওয়ালে ঝোলানো নির্দেশিকা দেখে চাবি নিয়ে আসেছে। ওখানে কয়েকটি ফোন নাম্বার দিয়ে লেখা আছে, এর যে কোনও নাম্বারে ফোন করলে দুরের গ্রাম থেকে ডিম, দুধ, মুরগি দিয়ে যাবে। আমাদের সব কিছুই নিয়ে আসা হয়েছে। কাপড়জামা ছেড়ে ফ্রেস হয়ে সোফায় গা’এলিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে বন্ধুদের নিজের বর্তমান অবস্থান জানাতেই ছবি  পাঠানোর অনুরোধ আসতে লাগল। কিন্তু হঠাৎ ওয়াইফাই কানেকশন সমস্যা শুরু করলে আইপ্যাড রেখে টেবিলে রাখা গাইডবুক খুলে বসলাম। এই জায়গাটি হল  হার্টসপ গ্রাম। আমাদের কটেজের ডান দিকের পাহাড়টির নাম হার্টসপ ডোড। উচ্চতে ৬১৮ ফুট। আসার পথে যে লেকটি দেখেছি, তার নাম  ‘উলস ওয়াটার’।


জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇



     সকালে ঘুম থেকে উঠে পাহাড় আর জঙ্গলের নীরব সখ্যতা দেখে বাকরহিত  হয়ে গেলাম। পাখির কলতান ছাড়া আর কোনও শব্দ শুনতে পাচ্ছি না। কিছুক্ষণ  আগেই রোদটাকে পাহাড়ের চূড়ায় আটকে থাকতে দেখলাম, কখন যে লাফ মেরে নীচে নেমে এসেছে টের পাইনি। আমরা ১০টার দিকে বেরিয়ে পড়লাম উলস ওয়াটার লেকের উদ্দেশ্যে। গতকাল কটেজ খোঁজার টেনশনে চারপাশটা সেভাবে তাকিয়ে দেখা হয়নি। কী সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য! পাহাড়ের পেছনে পাহাড়। পাহাড়ের গা বেয়ে ঝর্নার জল গড়িয়ে নিচে নেমে বয়ে চলেছে। মেয়ে বলল্‌, জায়গাটা সুইৎজারল্যান্ডের মত। প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে দেখতে আমরা উলস ওয়াটার  লেকের সামনে এসে গেলাম। এই জায়গাটার নাম ‘গ্লেন রাইডিং’। টিকিট করে ষ্টীমারে চড়ে দারুণ সব দৃশ্য দেখতে দেখতে ‘হাও টাউন’ এ পৌঁছে গেলাম। ওখানে বেশ কিছুক্ষণ বেড়িয়ে ফেরার জন্য স্টিমারে চড়লাম। আগের স্টিমারটির  নাম ছিল, ‘লেডি অফ দা লেক’।এই লঞ্চটির নাম ‘রেভন’, এক ধরণের পাখির নামে নাম।

    আমরা চলেছি ‘আয়রা ফোরস’ এর উদ্দেশ্যে। অনেকটা দূর থেকে জল আছড়ে পড়ার শব্দ শুনতে পাচ্ছি। যারা দেখে ফিরে আসছেন, তাঁরা বললেন, হাফ মাইল ওপরে উঠতে হবে। চিন্তা খান সাহেবকে নিয়ে, উনি কতটা পারবেন্‌, তার  ওপর নির্ভর করছে আমাদের ওপরে ওঠা। আমরা ধিরে ধিরে ওপরে উঠতে লাগলাম। পথ খুবই বন্ধুর। একটু বেসামাল হলেই নিচে পাথরের ওপর বয়ে যাওয়া আয়রা ফোরসের স্রোতে গিয়ে পড়তে হবে। ১৮০৮ খ্রিস্টাব্দে কবি উইলিয়াম ও তাঁর বোন ডরোথি এই পথ দিয়ে যাওয়ার সময় স্রোতের ধারে সোনালি ড্যাফোডিল ফুটে থাকতে দেখে এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে তার পরেই  তিনি তাঁর বিখ্যাত  ‘ড্যাফোডিল’ কবিতাটি রচনা করেছিলেন। পথের ধারে একটা গাছের লম্বা গুঁড়ির ওপর পিন কুশনের ওপর অজস্র মুদ্রা গাঁথা রয়েছে। খান সাহেব এখানে বসে বললেন, তোমরা যাও আমি বসছি। আর একটুখানি হাঁটতেই আয়রা ফোরসের সামনে পাথরের ব্রিজের ওপর দাঁড়ালাম। অনেক ওপরে আর একটা ব্রিজ দেখা  গেলেও আমরা আর ওঠার সাহস দেখালাম না।

      ফেরার দিন আমরা শিশু সাহিত্যিক বেট্রিক পটারের মিউজিয়ামে গেলাম।  এখানে দেওয়ালে একটা ঘড়ি দেখলাম, যেটি ১০০ বছর ধরে সময় দেখিয়ে যাচ্ছে, একবারও থামেনি। মিউজিয়ামটি বাচ্চাদের খুব ভাল লাগবে। উনিডমায়ার লেকে গেলাম। ২ বছর পূর্বে এখানে এসেছিলাম।  এখান থেকে আমরা বাড়ির পথে রওনা দিলাম।

   সবই দেখছি, সবই করছি, কিন্তু বুকের ভিতরটা জ্বলে যাচ্ছে। অনন্তকাল ধরে কার যেন অপেক্ষায় বসে আছি। এখানে কাজ বলতে এদের পছন্দের পদ রান্না করা। দুবেলা বেড়ানো আর উল বোনা। এখন আপেলগুলো বেশ বড় হয়েছে। কিছু  কিছু অ্যাপেল গাছের তলায় ঝরে পড়েছে। কিছু ভাল লাগার সঙ্গে নিজেকে জড়িয় রাখার জন্য কতরকম ভাবে চেষ্টা করছি, তার হিসেব নেই। মেয়ে জামাইও চেষ্টার ত্রুটি করছে না। কাল আবার একটা নতুন জায়গায় বেড়াতে যাওয়া হবে। জায়গার   নাম ‘ডেভন’।কটেজ বুক করা রয়েছে। খাবার দাবার বেঁধে নিয়ে  সেপ্টেম্বর সকাল ন’টার দিকে রওনা হলাম।
হো টাউন

     আজও গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। সেখানে ওয়েদার কেমন? কে জানে। ৪ ঘণ্টা ৩০ মিনিটের পথ। ডেভনের কাছাকাছি পৌঁছে দেখলাম সমুদ্রও আমাদের পাশাপাশি  রয়েছে। সমুদ্রের কাছাকাছি কটেজ গুলোতে খোঁজ নিতে শুরু করলাম। এই ছোট ছোট কটেজগুলি স্ট্যান্ডের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। দেখতে বেশ সুন্দর। একটি রেস্টুরেন্টে জিজ্ঞেস করে এবং বোর্ডে লেখা নির্দেশিকা পড়ে ভিতরের দিকে একটু খানি এগিয়ে যেতেই মনে হল যেন স্বর্গে পৌঁছে গেলাম।

                                   ক্রমশ

Post a Comment

0 Comments