জ্বলদর্চি

পাঁচটি কবিতা: অনিরুদ্ধ সুব্রত

পাঁচটি কবিতা: অনিরুদ্ধ সুব্রত


নদীষু

ধ্যানের পাথরে উপবেশনের আগে
শুদ্ধ স্নানের নিমজ্জনে, সংলগ্ন বুকে
প্রত্ন হিমের পার্বত্য জীবন থেকে নেমে একদিন
ঘাতে, আঘাতে, প্রপাতে, শেষ হতে হতে ধীরে 
মধ্যাহ্ন-পাথর খণ্ডের পাশে, আশ্চর্য বয়েছে সে-- 
কখনও বলিনি, আমাকে ধরার ধারায় ফেলে
উচ্ছ্বসিত মেদিনী দীর্ণ করো সমুদ্র সঙ্গমে,
শুধু অবগাহনে নেমেছি সহজ প্রবাহ ঢেউয়ে,
সাধনার সু-সাধে, অসাধ্য ভেঙে ভেঙে সাধ্য
করেছে পূর্ণ, এই ব্রহ্ম-বোধ--- নদীটি আমার---
তবু অজান্তে স্বপ্ন শূন্য প্রান্তে কেন যে ধ্যান-ভগ্ন হয়ে
ঝাপসা অন্ধকারে খুঁজি প্রত্যহ--- তাকে
পরম প্রেম প্রস্তরে উপবেশনের ঠিক আগে।

                         

অজগর-অশান্তি

মুখে গিলে ফেলতে পারে এক লহমায়
লেজে জড়িয়ে দিতে পারে শ্বাসবন্ধ মৃত্যু
এম‌নই এক অজগর-অশান্তি
সওয়ার হয়েছি তার পিঠে---
ভিজে ও প্রসারণশীল--- ঠাণ্ডা চামড়া পেতে
বসেছি, স্পন্দিত স্ফীত ঘাড় ধরে 
হিলহিলে বাঁকা চলনে ঝুঁকে থেকে থেকে
জল, জঙ্গল, প্রান্তরে, আলো ও অন্ধকারে
জানি চায় শিকার, গলাধঃকরণের
দেখতে পাই না তার মুখগহ্বর, আলজিভ
ছুঁয়ে দেখিনি বিষ, লেজের বিষাক্ত কাঁটার
তবু বেশ জানি, যে কোনো ঝটকায়
খাদ্য হয়ে যেতে পারি তার
অশান্তি-অজগরের চোয়ালের ভিতর,
তাই উচ্চারণে প্রবল ক্ষুধার্ত শ্বাসকে শোনাই
ভয়ে ভয়ে 'শান্তই শান্তি...'  
যদিও শোনে না সে, জন্ম বধির 
শুধু নড়াচড়া পেলে কুঁচকে ওঠে তার শরীর
গোগ্রাসী খিদের স্যাঁতসেতে এক অশান্তি-অজগর।
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇


বুদ্বুদ

অপেক্ষা, অপেক্ষাকৃত বৃহত্তর
হয়ে উঠেছিল, বুকভর্তি বাতাসের ফুঁঃ-এ
যাপন উত্তীর্ণ জীবন-আয়তনের
সাবান-জলের মতো রসে
অগণিত মন্থন-মগ্ন নেশায়--
প্রসাধনী-গন্ধ ভর্তি রাসায়নিকে 
রক্ত, স্নায়ু, সুষুম্না, স্মৃতি, স্বপ্ন পঞ্চতন্রে
স্ফীত হতে হতে আর ভাসমানতার সুখে
হারিয়ে ফেলেছিল সমতা--
ঘনত্ব, অস্তিত্ব, বেধ, বোধে
হেসেফেলেছিল শেষমেশ সূর্যালোকে
ফেটে আকাশে মিলিয়ে যেতে,তবু
এমন একটিও ধ্বনি, শব্দ , চিৎকার
ছড়াতে পারল না চতুর্দিকে
অন্ততঃ যাকে বলা যায় অভিযোগ
তোমার ঔদাসীন্য-তরল তলে
প্রতিটি অন্তঃসারশূন্য অভিমান
আমার বুদ্বুদ।



হঠাৎ চোখ মেলে যায় 

ভোরবেলাকার আশ্চর্য গোপন দৃশ্যে-- ফের
ভাঙা, ছড়িয়ে থাকা, কাঁচের টুকরো গুলো
সেনাবাহিনীর কুচকাওয়াজের মতো যান্ত্রিক হয়ে
পরস্পর উদ্যোগী, নিঃশব্দ, তৎপর, জুড়ে যাচ্ছে

ফ্রেমে টেনে ঢুকিয়ে নিচ্ছে ছিটকে বেরিয়ে আসা
ছবি, যার গা থেকে মুছে দিচ্ছে
রক্ত, রোম, রসের জাদু-রাত
খুলে রাখা হচ্ছে ধমনী, শিরার আনন্দ পোশাক
ধুয়ে নেওয়া হচ্ছে জীবন হয়ে ওঠার অন্ধকার-গন্ধ
হেসে ওঠা দাঁত, মায়াময় আঙুল, স্পন্দনের ঠোঁট
অথবা শ্বেদ, স্বাদ, সিক্ত তরঙ্গ-বাহে 
আপ্লুত চর্ম-আবরণ

একটা সকাল দরজা খোলার আগে,
সেগুন কাঠের নক্সা-ফ্রেম ধরে নেয় আবছা পেইন্টিং 
আবার, প্রচলিত, প্রথাবদ্ধ, অভ্যস্ত
চেনা শতাব্দীর দেয়ালে পিঠ রেখে
অভ্যাসের পেরেকে ঝুলবে, এই ঘর,এই মিউজিয়ামে

অবাধ দর্শকের আগে, একটি সর্বজনীন 
জীবাণুনাশক‌ ছড়ানো বাতাসে---
তখন সারারাতের চুরমার কাঁচের গল্পটা
যথাসম্ভব দুঃস্বপ্নের দুর্ঘটনার নেশা হিসেবে
মোছা হচ্ছে, সংক্রমণ-প্রবণ চেতনার গ্যালারিতে 
ধীর লয়ে একটি প্রাচীন তানপুরা বাজানো হচ্ছে---

যখন সে চমকপ্রদ রাত ক্ষুদ্র ও সংকুচিত
গুটিয়ে রাখা পর্দা আর ঢাউস আলমারির পিছনে
যুগপত চুপচাপ ও সুখী, আত্ম-ব্যুঁদ
আনত গোপন ছুঁচ্ছে একা--- আহা সমুদ্র !


শরীরের নৌকো

বুক ছুঁয়ে খুঁজি বিশ্বাস সেঁকা উত্তাপ
কোন ধমনীটির গায়ে, কোথায় ঘর
কোথায় লুকিয়ে ঘুণপোকা কাটে
পাছে মরি তার দাঁতে, আঘাতে
অথবা শান্ত সুন্দর সন্তর্পণে 
ধুয়ে ধুয়ে রাখি জ্বালা, উষ্ণপ্রস্রবণে,
নিষিদ্ধ আলোর ভয়, না জ্বালা আগুনেরও
তবু, তুলে এনে গায়ে মাখি 
খনিজের উৎসাহী দাহ, অবিকল
বাঁচি, রক্ত নদীর স্রোত-প্রবাহ
ডিঙি চড়ে দূর দূর ঘাটে নামিয়ে নিই 
শরীরের উপযাজিত ভার,
শোনো দুই পার, আত্মজাত যত সার
তেষ্টা ও উষ্ণ অভিঘাত ফল
যত মরণের মননশীল খুশি
পাটাতন থেকে ঠেলে দিই ফেলে 
উজানী উন্মত্ত তরলে,
নিভৃত অরণ্য মুখী টানটান দাঁড়াবার
এই শেষ শৈত্যের দলা দলা উৎপাত।

Post a Comment

2 Comments

  1. প্রতিটি কবিতা গভীর মননের সাক্ষর রাখে। কবিকে কুর্নিশ।

    ReplyDelete
  2. দেবজিৎ ভট্টাচার্য্য।April 21, 2023 at 8:43 PM

    অ-নিরুদ্ধ বাবুর পাঁচটি কবিতাই মনোমুগ্ধকর। এই ভাল লাগার রেশ এখন বেশ কিছুক্ষণ রয়েই যাবে ।

    ReplyDelete