জ্বলদর্চি

নূতন জাতীয় শিক্ষানীতিতে চার বছরের ডিগ্রী কোর্স - কিছু প্রশ্ন কিছু শঙ্কা/ সজল কুমার মাইতি


নূতন জাতীয় শিক্ষানীতিতে চার বছরের ডিগ্রী কোর্স - কিছু প্রশ্ন কিছু শঙ্কা 

অধ্যাপক সজল কুমার মাইতি


জাতীয় শিক্ষানীতি (NEP) ২০২০ আমাদের দেশের কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা ২৯ শে জুলাই, ২০২০ তে অনুমোদন করেছে। এর অন্যতম উদ্দেশ্য হল ভারতের উপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করা; যারফলে সকলে উচ্চ গুনমানের শিক্ষা পাবে এবং ফলস্বরূপ আমাদের দেশ সারা পৃথিবীর মধ্যে এক ন্যায়সংগত ও প্রানবন্ত জ্ঞান সমাজে পরিনত হবে।

নূতন শিক্ষানীতির ভিত্তিমূলক নীতি হল শিক্ষায় সবার প্রবেশাধিকার, সমতা, গুনমান, শিক্ষার ব্যয়বহনযোগ্যতা ও দায়িত্বগ্রহনযোগ্যতা। এই নীতি এটা নিশ্চিত করতে চায় যে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা একজন ভাল ব্যক্তি মানুষ তৈরি করবে। সেই ব্যক্তি মানুষের মধ্যে থাকবে যুক্তিপূর্ন চিন্তাশীলতা, অন্যের প্রতি সহানুভূতিশীলতা, অন্যের অবস্থা বোঝার ক্ষমতা, সাহসিকতা, সহনশীলতা, বৈজ্ঞানিক মানসিকতা, সৃজনশীল কল্পনা ও নৈতিক মূল্যবোধ। এই নীতির ভিত্তি অনেক বিস্তৃত। এতে বহুমুখী বিষয় শিক্ষা ও বৌদ্ধিক শিক্ষার সুযোগ থাকবে। শিক্ষা পাঠক্রম হবে নমনীয়, বিভিন্ন বিষয়ের সৃজনশীল জোটবন্ধনের সুবিধা, কারিগরি শিক্ষার সংহতিকরনের সুযোগ, ও প্রযুক্তির সদ্ব্যবহার। এছাড়াও এই শিক্ষা ব্যবস্থায় থাকবে বহুমুখী প্রবেশ ও বহির্গমনের সুযোগ।

স্নাতক ও স্নাতকোত্তর প্রোগ্রামগুলি সম্পূর্ণরুপে পুনর্গঠন করা হবে। প্রতি বছর সার্টিফিকেট দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে ও অর্জিত ক্রেডিট স্নানান্তরযোগ্য করা হবে। সারাদেশে উচ্চ শিক্ষার নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে Higher Education Commission of India (HECI) কাজ করবে। National Research Foundation (NRF) সারাদেশে সর্বোচ্চ সংস্থা হিসেবে গবেষণামূলক মানসিকতা বৃদ্ধিতে ও গবেষণার ক্ষমতা বৃদ্ধিতে কাজ করবে। দেশের সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির শিক্ষার মান, স্বীকৃতি প্রদান ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে একই ধরনের নিয়মনীতি প্রয়োগ করা হবে। এইরকম কিছু উল্লেখযোগ্য  শর্ত হল ছাত্রদের আর্থিক সাহায্য প্রদান, মুক্ত ও দূরশিক্ষার প্রসার, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ প্রদান ও অনুপ্রাণিতকরন এবং ভারতীয় ভাষার প্রসার।

নূতন জাতীয় শিক্ষানীতিতে চার বছরের স্নাতক প্রোগ্রামের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এই প্রোগ্রামে বহুবার প্রবেশ ও নির্গমনের সুযোগ থাকবে। সময়ের মধ্যে উপযুক্ত সার্টিফিকেট দেওয়ার ব্যবস্থা থাকবে। অন্যান্য অনেক কিছুর মধ্যে এম ফিল প্রোগ্রাম রদ করা হবে। 

চার বছরের এই স্নাতক প্রোগ্রাম মোট আটটি সেমিস্টারে বিভক্ত থাকবে। ছাত্রদের এই চার বছরে ১৬০ - ১৭৬ ক্রেডিট পয়েন্ট পেতে হবে অনার্স অথবা গবেষণা সহ পাশ করার জন্য। ছাত্রদের এই চার বছরের প্রোগ্রামের প্রথম তিনটি সেমিস্টারে কিছু সাধারণ বিষয় ও প্রারম্ভিক বিষয় পড়তে হবে। এই প্রারম্ভিক বিষয়গুলি হল প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, কলা ও সমাজ বিজ্ঞান। সাধারণ বিষয়গুলির মধ্যে থাকবে  -  ইংরেজি, একটি আঞ্চলিক ভাষা, পরিবেশ বিজ্ঞানের ওপর বিষয়, স্বদেশ বা ভারতকে জানার বিষয়, স্বাস্থ্য ও সুস্থতা বা যোগার বিষয় এবং ক্রীড়া বিষয়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং বৃহৎ ডেটা বিশ্লেষণ। কলা, বিজ্ঞান ও বানিজ্য - যে কোন শাখার ছাত্রদের ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য। তৃতীয় সেমিস্টারের শেষে প্রতিটি ছাত্রকে একটি মেজর সাবজেক্ট নিতে হবে যেটি সে গভীরভাবে পড়াশোনা করবে। এছাড়া, ছাত্রকে আর ও দুটি মাইনর সাবজেক্ট নিতে হবে যেগুলি বিষয় ভিত্তিক অথবা আন্তঃবিভাগীয় বিষয় হতে হবে। এর সঙ্গে একটি কারিগরিবিদ্যা বিষয়। সপ্তম সেমিস্টারের শুরুতে প্রতিটি ছাত্রকে একটি রিসার্চ প্রজেক্ট নিতে হবে। সঙ্গে একটি বিষয় ভিত্তিক বা আন্তঃবিভাগীয় উন্নত বা অগ্রনী বিষয় নিতে হবে এবং একটি রিসার্চ মেথডোলজির বিষয় ও নিতে হবে। অন্তিম সেমিস্টার কেবলমাত্র প্রজেক্টের জন্য বরাদ্দ থাকবে। এই রিসার্চ প্রজেক্ট হবে মেজর সাবজেক্টের ওপর বা আন্তঃবিভাগীয় বিষয়ের ওপর। 

চার বছরের এই স্নাতক প্রোগ্রামে বহুবিধ প্রস্থান ও প্রবেশের সুযোগ থাকবে। এক বছর শেষে অর্থাৎ দুটি সেমিস্টার শেষে ছাত্রদের সার্টিফিকেট দেওয়া হবে। এই সময়ে ছাত্ররা তাদের পছন্দের বিষয়গুলি পড়ার সুযোগ পাবে। দু বছর অর্থাৎ চারটি সেমিস্টারের পাঠ শেষে ছাত্রদের একটি ডিপ্লোমা দেওয়া হবে। তিন বছর অর্থাৎ ছয়টি সেমিস্টার পাঠ শেষে ছাত্রদের একটি ব্যাচেলার ডিগ্রী প্রদান করা হবে। চার বছর অর্থাৎ আটটি সেমিস্টার পাঠ শেষে ছাত্রদের সাম্মানিক বা গবেষণা সহ একটি ব্যাচেলার ডিগ্রী প্রদান করা হবে।


প্রতিটি স্তরের জন্য প্রয়োজনীয় ক্রেডিট ঘন্টা নির্দিষ্ট করা আছে। একটি সার্টিফিকেটের জন্য প্রায় ৪০- ৪৪ ক্রেডিট ঘন্টা পাঠদানের দরকার পড়বে। একটি ডিপ্লোমার জন্য প্রায় ৮০- ৮৮ ক্রেডিট ঘন্টা, একটি ডিগ্রীর জন্য ১২০-১২৩ ক্রেডিট ঘন্টা এবং সাম্মানিক বা গবেষণা সহ একটি ডিগ্রীর জন্য ১৬০-১৭৬ ক্রেডিট ঘন্টা পাঠদানের দরকার পড়বে। প্রথম দুটি ক্ষেত্রে আর ও ১০ ঘন্টার দক্ষতা বৃদ্ধির কোর্স করতে হবে। তার মধ্যে ৬ ঘন্টার  ইন্টার্নশীপ অথবা শিক্ষানবীশ হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। বিশেষ ক্ষেত্রে এই সময়ের বৃদ্ধি করা যেতে পারে। এই ধরনের অভিজ্ঞতা ছাত্রকে বিশেষ বিশেষ কাজের উপযুক্ত করে তুলবে। 

বিশেষ পরিস্থিতিতে এই সময় বৃদ্ধি করার কারণ হল যাতে ছাত্র তার ডিগ্রী অর্জন করার সকল শর্ত পূরন করতে সমর্থ হয়। এই কোর্স চলাকালীন ক্রেডিট পয়েন্ট অর্জনের সুযোগ থাকবে ও তা জমা থাকবে Academic Bank of Credit (ABC) স্কীমের মাধ্যমে। এই ক্রেডিট অর্জন ও জমা থাকার সর্বোচ্চ সময় সীমা হল সাত বছর। এই সাত বছর অতিক্রমের পর ছাত্রকে পুনরায় ভর্তি হতে হবে পুরোনো শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রমানপত্রের ভিত্তিতে।

চার বছরের স্নাতকস্তরের পাঠক্রমের বিষয়সমূহ ও পাঠদানের সময় 

এই চার বছরের স্নাতক কোর্সের প্রথম তিনটি সেমিস্টারে নিম্নলিখিত বিষয়গুলির পাঠদান করতে হবে ও তাদের পাঠদানের সময় ও নিচে উল্লেখ করা হল।

সাধারণ বিষয় - ভাষা শিক্ষা ( একটি আঞ্চলিক ভাষা ও ইংরেজি ), স্বদেশ বিষয়ক জ্ঞান ( Understanding India), পরিবেশ বিজ্ঞান বা শিক্ষা, ডিজিটাল ও প্রযুক্তিগত সমাধান, গনিত ও গাননিক চিন্তন এবং বিশ্লেষণ, স্বাস্থ্য ও সুস্থতা, যোগা শিক্ষা, এবং ক্রীড়া ও উপযুক্ততা। এই বিষয়গুলি সকল ছাত্রের জন্য প্রযোজ্য। প্রথম তিন সেমিস্টারে বিষয় ভিত্তিক পেপার ও থাকবে। যেমন - প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, সমাজ বিজ্ঞান ও মানবিক বিদ্যা, আন্তঃবিভাগীয় বিষয়, ও কারিগরিবিদ্যা। তৃতীয় সেমিস্টারের শেষে প্রতিটি ছাত্রকে বিষয় ভিত্তিক বা আন্তঃবিভাগীয় কোন বিষয় মেজর বিষয় হিসেবে পছন্দ করতে হবে এবং দুটি মাইনর বিষয় ও পছন্দ করতে একইভাবে। সঙ্গে একটি কারিগরি বিষয় নেওয়া ও বাধ্যতামূলক। এই সকল বিষয়গুলির পাঠদানের সময় নিচে উল্লেখ করা হল।

সাধারণ বিষয় 

ভাষা শিক্ষা ( ৬+৬= ১২ ক্রেডিট ঘন্টা ); স্বদেশ বিষয়ক জ্ঞান (৩ ক্রেডিট ঘন্টা ); পরিবেশবিদ্যা শিক্ষা (৩ ক্রেডিট ঘন্টা ); ডিজিটাল ও প্রযুক্তিগত সমাধান এবং গনিত ও গাননিক চিন্তন ও বিশ্লেষণ ( ৪ ক্রেডিট ঘন্টা );  স্বাস্থ্য ও সুস্থতা, যোগ শিক্ষা, ক্রীড়া ও উপযুক্ততা ( ২ ক্রেডিট ঘন্টা )।

বিষয় ভিত্তিক ক্ষেত্রের প্রারম্ভিক বিষয়গুলি

এই বিষয়গুলি ও তাদের পাঠদানের সময় নিচে দেওয়া হল।

প্রাকৃতিক বিজ্ঞান ( ৬ ক্রেডিট ঘন্টা ); সমাজ বিজ্ঞান ( ৬ ক্রেডিট ঘন্টা ); মানবিক বিদ্যা (৬ ক্রেডিট ঘন্টা )। 

আন্তঃবিভাগীয় বিষয় 

বিষয় ভিত্তিক বা আন্তঃবিভাগীয় মেজর বিষয় (৪৮ ক্রেডিট ঘন্টা ); দুটি মাইনর বিষয় (৩৬ ক্রেডিট ঘন্টা )।

বিষয় ভিত্তিক অ্যাডভান্সড বিষয় 

রিসার্চ ও রিসার্চ প্রজেক্ট (১৮ ক্রেডিট ঘন্টা ): এর অংশগত ভাগ এইরূপ-

রিসার্চ মেথোডলজি( ৬ ক্রেডিট ঘন্টা ); রিসার্চ প্রস্তাব ( ৪ ক্রেডিট ঘন্টা ); রিসার্চ ইন্টার্নশীপ ( ৪ ক্রেডিট ঘন্টা ); প্রজেক্ট রিপোর্ট (৪ ক্রেডিট ঘন্টা )। এছাড়াও -

হাতে কলমে জ্ঞানার্জন/ উদ্ভাবনকারী প্রজেক্ট ( ৩ ক্রেডিট ঘন্টা ); স্থানীয় শিল্প / ব্যবসা /অন্যান্য ক্ষেত্রে ইন্টার্নশীপ (৪ ক্রেডিট ঘন্টা )।

কিছু প্রশ্ন কিছু শঙ্কা

UGC এর এই প্রস্তাব নিয়ে বিস্তর চর্চা চলছে। আশার তুলনায় আশঙ্কাময় অনেকেই। নতুন এই প্রস্তাবে অজানা আশঙ্কা সবার মনের মধ্যে মনে হয় দানা বেঁধেছে। কি জানি কি হয় এমন একটা ভাব। অনেক প্রশ্নের উত্তর এখনো অজানা। কোথায় গেলে এর উত্তর পাওয়া যেতে পারে তার হদিস ও কেউ দেওয়ার মতো নেই মনে হয়।

পরিকাঠামোগত সমস্যা

এই চার বছরের ডিগ্রী প্রোগ্রাম চালু হলে অতি স্বল্প সংখ্যক কলেজ বাদ দিলে আমি মনে করি অধিকাংশ কলেজের এই অতিরিক্ত ক্লাসরুম সরবরাহ করা ক্ষমতা নেই। অতিরিক্ত ক্লাসরুম তো দূরের কথা, বর্তমানে যে পরিমান ক্লাসরুমের প্রয়োজন অধিকাংশ কলেজই তা সরবরাহ করতে সম্পূর্ণরুপে ব্যর্থ। অতিরিক্ত ক্লাসরুম সরবরাহের প্রশ্নই ওঠে না। অধিকাংশ কলেজে প্রতিটি সেমিস্টারের অনার্স ও জেনারেলের ছাত্রদের জন্য আলাদা আলাদা কোনো ক্লাসরুম নেই। এমনকি কম্বাইন্ড ক্লাসরুমে ক্লাস নেওয়ার সুবিধা ও নেই। অর্থাৎ এত ছাত্রছাত্রী একসঙ্গে accommodate করার মতো ক্লাসরুম বহু কলেজেরই নেই। মফস্বল ও গ্রামীণ কলেজগুলিতে ক্লাসরুমের আলোচনা যত কম করা যায় তত মঙ্গল।

এবার আসি প্রাকটিক্যাল ক্লাসের জন্য ল্যাবরেটরির কথায়। বিজ্ঞান বিষয় ছাড়াও এখন প্রায় প্রতিটি শাখাতে প্রাকটিক্যাল দরকার হয়। বানিজ্য শাখায় কম্পিউটার ও আরও কিছু বিষয়ে প্রাকটিক্যাল দরকার পড়ে। এমনকি সমাজ বিজ্ঞান ও মানবিক বিদ্যায় ও বিশেষ করে ল্যাঙ্গোয়েজে ল্যাঙ্গোয়েজ ল্যাবের দরকার পড়ে। অধিকাংশ কলেজে ছাত্রের তুলনায় ল্যাবের ক্ষমতা অপর্যাপ্ত। অনার্স ছাত্রদের যেখানে টেনেটুনে প্রাকটিক্যাল করাতে হয়রানি হতে হয়, সেখানে জেনারেল ছাত্রদের অবস্থা অনুমেয়। বহু নতুন কলেজে বিজ্ঞান শাখা খোলার প্রথম কয়েক বছর কোন ল্যাবই ছিল না। এমনকি চালু কলেজে নতুন বিষয়ে বিজ্ঞান খোলার প্রথম দুবছর কোন ল্যাব ছিল না। অন্য কলেজের ল্যাবে নামমাত্র প্রাকটিক্যাল করে কোনমতে সামাল দেওয়া গেছে। এই যখন শহর এলাকার কলেজের অবস্থা, তখ মফস্বল ও গ্রামীন কলেজগুলির কথা চিন্তা করলে সত্যিই আশঙ্কিত নয় আতঙ্কিত হতে হবে। বহু কলেজে কম্পিউটার ল্যাবই নেই। যে কয়টা কলেজে আছে, সেখানে কম্পিউটারের সংখ্যা অপ্রতুল। তাছাড়াও প্রায় সব কলেজে প্রয়োজনীয় সফটওয়্যার আদৌ নেই। নাম কা ওয়াস্তে প্রাকটিক্যাল হয়। এমনকি যে সকল কলেজে পিজি আছে সেখানে আর ও করুণ অবস্থা। বর্তমান পরিকাঠামো যখন বতর্মান পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থ, তখন নতুন অতিরিক্ত চাহিদা পূরন কিভাবে সম্ভব তা শুধু অনুমেয়।

লাইব্রেরির অবস্থা বেশিরভাগ কলেজে সঙ্গীন। বহু নতুন সরকারি কলেজে লাইব্রেরিয়ান ই নেই। আংশিক ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক জোড়াতালি দিয়ে কাজ চালাচ্ছেন। সিস্টেমেটিক বই রাখা বা সর্ট করার কোন ব্যবস্থাই নেই। কোন কর্মচারি ও নেই লাইব্রেরিতে। এই হল বহু কলেজ লাইব্রেরির হাল। লক ডাউনের পর বহু কলেজে ই নতুন কোন বই কেনা হয় নি। কারণ, না আছে সরকারি সাহায্য না আছে UGC এর সাহায্য। অথচ, নতুন সিলেবাস অনুসারে নতুন বই ছাড়া ছাত্রদের পড়াশোনা সত্যিই কঠিন। নতুন অতিরিক্ত একবছরের জন্য নতুন সংখ্যক অতিরিক্ত ছাত্রদের উপযোগী বই ও অন্যান্য চাহিদা পূরণ কিভাবে সম্ভব চিন্তা করা ও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। লাইব্রেরিগুলি বই রাখার rack এর ব্যবস্থা করতে পারছে না  অর্থের অভাবে। ফলস্বরূপ, বহু কলেজে বই এদিকে ওদিকে মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। শিক্ষার মূল উপকরণগুলির যখন এই হাল, বতর্মান পরিস্থিতির সামাল দেওয়া যখন কঠিন, তখন নতুন পরিস্থিতিতে নতুন প্রোগ্রাম সামাল দেওয়া সত্যিই দুরুহ।

শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী

কলেজগুলিতে শিক্ষকের চাহিদা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। ছাত্র সংখ্যা বৃদ্ধি, সেকশন বৃদ্ধি এইসব কারণ আছে। এই চিত্র  বহু কলেজে দেখা যায়। নিয়মিত নতুন শিক্ষক নিয়োগ না হওয়া, সঙ্গে পুরোনোদের রিটায়ার হয়ে যাওয়ার জন্য শিক্ষকের অপ্রতুলতা শিক্ষাদানে প্রচণ্ড সমস্যা সৃষ্টি করছে। নতুন নতুন অনেক কলেজ হয়েছে, যেখানে একজন দুজন শিক্ষক দিয়ে নতুন নতুন বিভাগ খুলে দেওয়া হয়েছে। সরকারি কলেজগুলিতে বদলিনীতির ফলে এক কলেজ থেকে অন্য কলেজে নিয়ে গিয়ে কোন রকমে চালানো হচ্ছে। কিছু কিছু কলেজে তিন থেকে চারজন শিক্ষক দিয়ে UG ও PG উভয় বিভাগ জোড়াতালি দিয়ে চালানো হচ্ছে। তাও বছরের পর বছর। নতুন নতুন বিষয়ের শিক্ষক নেই। বিশেষ বিশেষ স্পেশালাইজেনের শিক্ষক দুর্লভ। নতুন শিক্ষক নিয়োগ ও অনিয়মিত হয়ে গেছে। নতুন সিবিসিএস সিস্টেমে এই অভাব আর ও বেশি করে অনুভূত হচ্ছে। 

কলেজ অফিসগুলিতে কর্মচারির অভাব প্রতিটি কলেজেই। তার ওপর বিভিন্ন ধরনের এত স্কলারশিপের ছড়াছড়ি যে সেগুলো সামাল দেওয়া এই স্বল্প সংখ্যক কর্মচারি বেষ্টিত অফিসের সম্ভব নয়। সেজন্য প্রতিটি কলেজে শিক্ষকদের এই গুরু দায়িত্ব শেয়ার করতে হয়। এরজন্য ক্লাসে খামতি থেকে যাচ্ছে। নতুন ও ছোট কলেজগুলিতে শিক্ষকদের আর ও অনেক বেশি এই দায়িত্ব বহন করতে হয়। উপরি হল NAAC বিষয়ক মহোৎসবের প্রস্তুতি। শিক্ষকদের সেই দায়িত্ব ও প্রায় সবটাই নিতে হয়। অতএব, নিয়মিত শিক্ষা চর্চা এতে ব্যাহত তো হবেই। 

ল্যাব ও লাইব্রেরিগুলিতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মচারীর সংখ্যা দিন দিন কমছে। উপযুক্ত নতুন কর্মচারি নিয়োগ বন্ধ। দুর্বল জনবল নিয়ে বতর্মান পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যখন দুরুহ হয়ে দাঁড়াচ্ছে, তখন চার বছরের অতিরিক্ত চাপ সামলানো অসম্ভব। এর  ফলে গুনমান বজায় রাখা একরকম অসম্ভব।

অর্থসংস্থান

সবচেয়ে বড় প্রশ্ন ও শঙ্কা হল এই পরিবর্তনের প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থান কোথা থেকে হবে? কেন্দ্রীয় সরকার থেকে টাকা কলেজগুলি সাধারণত সরাসরি পায় না। যদি না সেগুলি সরাসরি কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন হয়। UGC এর মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের আর্থিক সাহায্য কলেজগুলি পেয়ে থাকতো। এখন তা প্রায় বন্ধ। গবেষণা ( মেজর ও মাইনর) তাও কমে কমে তলানিতে ঠেকেছে। রাজ্য সরকারের আর্থিক সাহায্যের তথৈবচ অবস্থা। দৈনিক কলেজ চালানোর খরচ জোগাড় করা অসম্ভব হয়ে উঠেছে। চক, ডাস্টার, কাগজ, কালি, খাতার খরচ সংকুলান করাই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিজ্ঞান বিভাগগুলির কেমিক্যাল ও অন্যান্য কনজুমেবল কেনার ও পয়সা নেই। অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষক ও ছাত্রদের কাছ থেকে চাঁদা তুলে পরিস্থিতি সামাল দিতে হচ্ছে।

নতুন শিক্ষা নীতি থেকে অর্থের সংস্থানের কোন উত্তর নেই। পরিকাঠামো ও অন্যান্য খরচ কোথা থেকে আসবে সেটা স্পষ্ট নয়। সরকারি অনুদান না  ছাত্রদের ফি বৃদ্ধির মাধ্যমে আসবে সে বিষয়ে কোন স্পষ্ট নির্দেশিকা নেই। নতুন চার বছরের কোর্স চালু যদি হয় ছাত্রদের বর্ধিত আর্থিক বোঝার মাধ্যমে, তাহলে একটা আশঙ্কা থেকেই যাবে। ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে কলেজে কলেজে বিশৃঙ্খলা ফিরে আসবে না তো!

জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করুন। 👇

Post a Comment

0 Comments