জ্বলদর্চি

মহাভারতের কর্ণ - এক বিতর্কিত চরিত্র/দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

মহাভারতের কর্ণ - এক বিতর্কিত চরিত্র   
ষোড়শ পর্ব      

দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী                                                                 
যুধিষ্ঠির অশ্রুসজল কণ্ঠে কুন্তীকে বললেন "মা, এ তুমি কি করলে? কর্ণের মত সন্তানকে স্বীকার করতে তোমার তো কোনো অগৌরবের বা লজ্জার কারণ ছিলনা। এই সিংহাসন তো তাঁরই প্রাপ্য ছিল। আজ তাঁকে হত্যা করে তাঁর প্রাপ্য সিংহাসনে বসা কি আমার পক্ষে চরম লজ্জা ও অগৌরবের হবে না"?                 
বাসুদেব যুধিষ্ঠিরের বাহুমূলে ঈষৎ চাপ দিয়ে বললেন "আর্যা কুন্তীকে আর আপনারা বাক্যবাণে বিদ্ধ করবেন না, তিনি তো আপনাদের থেকেও অধিক যন্ত্রণা ভোগ করছেন। নিজের জ্যেষ্ঠ পুত্রের মৃত্যুতেও তিনি সাবলীলভাবে উচ্চৈঃস্বরে ক্রন্দন করে তাঁর মর্ম যন্ত্রণা প্রকাশ করতে পারছেন না কেবলমাত্র লোকলজ্জার ভয়ে। এই কথা বলতে বলতেই তাঁর দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো দ্রৌপদীর অনবগুন্ঠিত মুখের দিকে। তিনি লক্ষ করলেন সেই নীল পদ্ম পলাশ লোচনার আয়ত চক্ষুর সীমা ছাপিয়ে অবিরল ধারায় অশ্রু নির্গত হয়ে তাঁর দুই কপোল প্লাবিত করেছে। তাঁর দুই চোখে অপরিসীম বেদনা ও অনুতাপ। তিনি হয়তো প্রকাশ করতে পারছেন না যুধিষ্ঠির বা অর্জুনের মত। স্বয়ম্বর সভায় তাঁর ক্ষুরধার মন্তব্যে যে মানুষকে বিদ্ধ করেছিলেন তিনিই হয়ত তাঁর জ্যেষ্ঠ স্বামী হতেন। তাঁর প্রতি এক অমোঘ আকর্ষণে বিদ্ধ হয়েছিলেন। 
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇
বাসুদেব কোমল কন্ঠে দ্রৌপদীকে বললেন জানি তুমিও পুত্র শোকাতুরা অথচ তুমিও এই সংবাদে বিচলিত, তথাপি তুমিই একমাত্র নারী যে আর্যা কুন্তীকে তাঁর এই দুঃসময়ে তাঁকে প্রবোধ দিতে পারো। সদ্য পুত্র ব্যথার সঙ্গে নিদারুণ লজ্জা, অপমান ও অনুশোচনায় তিনি দগ্ধ। উনি তোমারও জননী। ওঁকে সান্ত্বনা দিয়ে তুমি পুত্রীর কার্য কর। বাসুদেবের এই কথা শুনে পাঞ্চালী কুন্তীর নিকটে গিয়ে বীররক্ত সিঞ্চিত মৃত্তিকার উপরে বসে কুন্তীর মস্তক নিজের কোলে নিয়ে আকুলভাবে কেঁদে উঠলেন। তাঁরও তো লজ্জা ও অনুশোচনার শেষ নেই।                                অতঃপর যুধিষ্ঠির, যুযুৎসু প্রভৃতিরা কর্ণ সহিত কৌরব ভ্রাতাদের ও আত্মীয়স্বজনদের মৃতদেহের সৎকার কর্ম করে যমুনাতে গিয়ে স্নান করে হস্তিনাপুরে প্রত্যাগমন করলেন। 
কয়েক বছর পরের কথা। পাণ্ডবেরা হস্তিনাপুরের রাজা হয়েছেন, যদুপতি শ্রীকৃষ্ণ দ্বারকায় চলে গেছেন। দ্বাপর যুগ শেষ হয়ে কলিযুগের প্রবেশ ঘটেছে। গান্ধারীর অভিশাপে যাদব, বৃষ্ণি, অন্ধক বংশের বীরেরা নিজেদের মধ্যে কলহ-বিবাদে মারামারি করে সকলে সবংশে নিহত হয়েছেন। অগ্রজ বলরাম যোগ বলে দেহত্যাগ করেছেন।            

কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের মহানায়ক বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণ অবসন্নভাবে এক বৃক্ষ তলে বসে ক্লান্তি অনুভব করলেন। তাঁর মানসচক্ষে অতীতের সমস্ত ঘটনাবলী একে একে উপস্থিত হল। জন্মাবধি তিনি পৃথিবীতে ধর্ম সংস্থাপনের জন্য সমস্ত দুর্জন, দুর্বৃত্তদের বধ করে আজ জীবনের সায়াহ্নে এসে তিনি পৌঁছেছেন। দেহীর অবশ্যম্ভাবী পরিণতি মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে। জীবনের প্রদোষবেলায় পৌঁছে আর আত্মপ্রবঞ্চনা করতে চান না। তিনি ধর্ম রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে এমন অনেক কৌশল অবলম্বন করেছিলেন ন্যায় ও সত্যের বিচারে, মনুষ্যত্বের মাপে যা সঙ্গত হয়নি। এত বড় কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ তো তাঁরই পরিকল্পিত, কর্ণ বধও তাঁর এই প্রকারের একটি। কর্ণকে নিজের হাতে বধ করেননি, কিন্তু কর্নের মৃত্যুর প্রধান কারণ তো তিনিই। ইচ্ছে করলেই তাঁকে বাঁচাতে পারতেন। কর্ণের সত্য পরিচয় সকলের কাছে প্রকাশ করলে পাণ্ডবেরা ছাড়াও ভীষ্ম, দ্রোণ প্রভৃতিরা কখনোই তাঁর বিরুদ্ধে যেতেন না। সকলেই তাঁকে বুকে টেনে নিয়ে আলিঙ্গন করতেন। তিনি ও ভাইদের এবং অন্যান্যদের সাথে সাগ্রহে মিলিত হতেন। সে উদারতা তাঁর ছিল, কিন্তু বাসুদেব সে চেষ্টা কখনোই করেননি। তিনি জানতেন কর্ণ তাঁর পিতৃষ্বসা কুন্তীর প্রথম সন্তান, হোক না সে কুমারী বয়সের, শাস্ত্রে তো সেই সন্তানকে স্বীকৃতি দেওয়া আছে। তিনিই কর্ণের সর্বাপেক্ষা অধিক অনিষ্ট করেছেন তাঁর কাছে তাঁর জন্মের প্রকৃত পরিচয় জ্ঞাপন করে যার ফলে তিনি পান্ডবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আত্মরক্ষার পথ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। কর্ণের মত ব্যক্তি ভাতৃবধ করবেন না - এসত্য শ্রীকৃষ্ণ জানতেন। বহুদিন ধরে তিনি কর্ণ বধের চক্রান্ত করেছেন। যার জন্য কৌশলে তিনি কবচকুণ্ডল হস্তগত করিয়েছিলেন, ঘটোৎকচকে জেনেশুনে কর্ণের সঙ্গে যুদ্ধ করতে পাঠিয়েছিলেন যাতে কর্ণ একাঘ্নী অস্ত্র তার উপরে প্রয়োগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। নিরস্ত্র শত্রুকে অর্জুন কখনোই বধ করতেন না কিন্তু বাসুদেব তাকে প্ররোচিত করেছেন কর্ণের বিবিধ কুকীর্তির কথা স্মরণ করিয়ে। কর্ণের অনেক দুষ্কর্ম ছিল সত্য, বিশেষত কপট দ্যূতসভায় তাঁর অমার্জনীয় আচরণ, কিন্তু কর্ণের কি তার থেকে অনেক বেশি গুন ছিলনা?  কর্ণের জন্ম পরিচয় পূর্বেই যদি তিনি প্রকাশ করতেন তাহলে কর্ণ পান্ডবদের সুহৃদ হতেন এবং লোকক্ষয়কারী এই যুদ্ধ হতো না। কিন্তু বাসুদেব কেন শঠতার আশ্রয় নিয়েছিলেন? কারণ তিনি জানতেন কর্ণ বধ না হলে কৌরবেরা চিরকাল অজেয় থাকবে এবং তা তাঁর কল্পিত ধর্মরাজ্য স্থাপনের পথে প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে। কিন্তু সত্যিই কি তিনি ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন? 
আসলে যেসব কারণ আমরা সাধারন মানুষ চর্মচক্ষে দেখতে পেয়েছি মহাভারতের বর্ণনায় সেগুলি সর্বৈব সত্য নয়। এর অন্তর্নিহিত কারণ ছিলেন একজন স্ত্রীলোক এবং তিনি হলেন হোমাগ্নিসম্ভূতা দ্রৌপদী - বিশ্বের অন্যতমা অতুলনীয়া নারী। সেই অসামান্য নারীর দুর্বল স্থান ছিলেন কর্ণ - অঙ্গাধিপতি পাণ্ডব সহোদর -  ধার্মিক, বলবান, অসামান্য বীর, কান্তিমান, বুদ্ধিমান, শৌর্যে-বীর্যে অতুলনীয়। তাহলে তিনি কি পাণ্ডবভ্রাতাদের থেকেও শ্রেষ্ঠ ছিলেন? হয়তো বা না, স্বামী হিসেবে পাণ্ডবভ্রাতারা অবশ্যই আদর্শ। কিন্তু সবসময় আদর্শ স্বামীতে বুঝি কোন মেয়েরই মন ভরেনা, দ্রৌপদীও বুঝি সেরকম চাননি। তিনি চেয়েছিলেন রক্তমাংসের এমন একজন পুরুষকে যিনি আবেগে উদ্বেল, উদারতায় বিশাল, বীর্যে অনন্যসাধারণ, শৌর্যে দেবকল্প, একটি পরিপূর্ণ মানুষ,জীবদ্দশাতেই যিনি কিংবদন্তী হয়ে উঠেছিলেন, যাঁকে ঘিরে মানুষের জল্পনা-কল্পনা কৌতুহলের শেষ ছিল না, যিনি সামান্য অবস্থা থেকে অসংখ্য জনশ্রুতির নায়ক, রূপকথার রাজা হয়ে উঠেছিলেন। যাঁর দানের খ্যাতি ত্রিভুবনে অতুলনীয়, সহ্যে যিনি অদ্বিতীয়, যিনি বহু আত্মত্যাগে তপস্যার মত ক্লেশ সহ্য করে পরশুরামের কাছে অস্ত্র শিক্ষা লাভ করে বিবিধ আয়ুধ সংগ্রহ করেছিলেন, যিনি জেনে শুনে তাঁর দানের গরিমাকে কলঙ্কিত না করে শত্রুর হাতে তাঁর জীবন রক্ষার বর্ম তুলে দিয়েছিলেন। আবার তিনিই কামনায় অস্থির, অসূয়ায় দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে তার গোপন স্বপ্নের মানসীকে প্রকাশ্যে অপমানে লাঞ্ছনায় ক্ষত বিক্ষত করেছিলেন। এরকম এক সাধারণের মধ্যে অসাধারণের সংমিশ্রণে গঠিত মানুষ যাঁকে লজ্জা, ঘৃণা, ভয় করে ভালবাসাও যায়। যাকে প্রভাতের প্রণামের সঙ্গে রাত্রিশেষের এক চুম্বন উপহার দেওয়া যায়, যাঁকে অনুরোধ নয় নিঃসঙ্কোচে আদেশ করা যায়।                               
স্বয়ম্বর সভায় দ্রৌপদী যে আঘাত দিয়েছিলেন সেই আঘাতের ব্যথাটুকু মুছে নেওয়ার একটা ইচ্ছে দ্রৌপদীর ছিল। কোন এক নিভৃত স্থানে, একখণ্ড অবসরে ক্ষমা প্রার্থনা করার, একটু বুঝি সান্তনা দেবার। ইচ্ছে ছিল জানিয়ে দেবার যে তিনি তাঁকে অনুপযুক্ত মনে করেননি, তাঁর আচরণের অভিব্যক্তি আর কেউ জানুক বা না জানুক তিনি বুঝতে পেরেছিলেন পান্ডবদের পৌরুষকে জাগ্রত করার, উদ্বুদ্ধ করার জন্য, কৃষ্ণার অপমান বুকে বিঁধে ছিল বলেই তিনি ক্ষিপ্ত, হিংস্র, বর্বরের মতো আচরণ করেছিলেন। কর্ণ আজ বেঁচে থাকলে বাসুদেব যেমন তাঁর দুটি হাত ধরে অশ্রু-জলে সমস্ত কলুষতা ধুয়ে দিতেন, ক্ষমা প্রার্থনা করে তাঁর কৃতকর্মের প্রায়শ্চিত্ত করতেন। দ্রৌপদীও হয়তো তাঁর দেখা প্রথম সত্তিকারের একজন বীরের প্রতি তিনি যে প্রকাশ্যে অপমানিত করে হাস্যাস্পদ করেছিলেন তাঁর পদপ্রান্তে চুম্বন করে, অশ্রুজলে তাঁর চরণ ধৌত করে জীবনের সর্বাপেক্ষা ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতেন এবং ক্ষমা প্রার্থনা করতেন                   
সবশেষে পাঠককে জানিয়ে রাখি কর্ণকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি মত কর্ণের মৃতদেহ দাহ করার পরে শ্রীকৃষ্ণ তাঁর অস্থি নিয়ে যেয়ে হিমালয়ের গহনে অলকানন্দা ও পিন্ডার নদীর সঙ্গমস্থলে এক নির্জন স্থানে লোকচক্ষুর অন্তরালেই বিসর্জন দিয়েছিলেন,  যে সঙ্গমস্থলে তাঁর অস্থি বিসর্জনের পরে কর্ণপ্রয়াগ নামে খ্যাত এবং বর্তমানে হিমালয় প্রেমীদের কাছে পঞ্চপ্রয়াগের অন্যতম প্রয়াগ বলে পরিচিত।।         


তথ্যসূত্র 
মহাভারত -মহাকবি ভাস 
মহাভারত - কাশীরাম দাস 
পাঞ্চজন্য - গজেন্দ্রনাথ মিত্র।


Post a Comment

0 Comments