জ্বলদর্চি

পৃথিবী ব্রত /ভাস্করব্রত পতি

পশ্চিমবঙ্গের লৌকিক উৎসব, পর্ব -- ৬৭

পৃথিবী ব্রত

ভাস্করব্রত পতি

"বট আছেন, পাকুড় আছেন, 
তুলসী আছেন পাটে।। 
বসুধারা ব্রত করলাম তিন বৃক্ষের মাঝে।
মায়ের কুলে ফুল, বাপের কুলে ফল, 
শ্বশুরের কুলে তারা। 
তিন কুলে পড়বে জলগঙ্গার ধারা।
পৃথিবী জলে ভাসবে, 
অষ্টদিকে ঝাঁপুই খেলবে।"

পশ্চিমবাংলার পশ্চিম সীমান্ত এলাকার হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে পৃথিবী ব্রত হল অন্যতম একটি মেয়েলি ব্রত। গ্রাম গ্রামান্তরের হিন্দু কুমারী মহিলারা চৈত্রসংক্রান্তি থেকে বৈশাখ সংক্রান্তি পর্যন্ত একমাস কাল ধরে এই ব্রত পালন করে অত্যন্ত নিষ্ঠা এবং ভক্তি সহকারে। মোট চার বছর ধরে পরপর পালন করতে হয়। মূলতঃ সাংসারিক অমঙ্গল দূরীকরণের লক্ষ্যে এই ব্রত পালন করেন কুমারীরা। এই লৌকিক উৎসব পালনে কোনো শাস্ত্রীয় মন্ত্রের প্রয়োজন পড়ে না। লাগেনা কোনো পুরোহিতও। ব্রতীনীরা নিজেরাই পূজো করেন। ড. শীলা বসাক মন্তব্য করেছেন "ভাবী সুখীজীবন কামনাই এই ব্রতের উদ্দেশ্য। তবে এই ব্রতের ছড়াগুলি হল আদিম কামনা পূজা ইত্যাদি দ্বারা ঐন্দ্রজালিক উপায়ে বৃষ্টিপাত প্রভৃতির দ্বারা পৃথিবীকে শস্যশ্যামল করা ও প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা করার মন্ত্রস্বরূপ।"

এই লৌকিক উৎসবের মধ্যে একদিকে যেমন আদিমতম সংস্কার ও বিশ্বাস লুকিয়ে আছে, আবার তেমনই এর লোককথার অভিপ্রায়ের মূলসূত্রটি রয়েছে অন্যরকম। ড. শীলা বসাক এ সম্পর্কে বলেছেন, "ব্রতটি ঐন্দ্রজালিক ক্রিয়া দ্বারা বৃষ্টিপাত জনিত ধরিত্রীর শস্যসম্পদ রক্ষা করার প্রবৃত্তিজাত। এই রতের মধ্যে আদিম বিশ্বাসের সঙ্গে যুগে যুগে তৎকালীন সমাজজীবনের কথা সংযোজিত হয়েও এর পরিবর্তন বিশেষ কিছু হয়নি, এর মধ্যে লুকিয়ে আছে আদিমবিশ্বাস ও সংস্কার। এই ব্রতের মন্ত্র থেকেই জানা যায় যে এই ব্রতে ঐন্দ্রজালিক উপায়ে বৃষ্টিপাত করিয়ে পৃথিবীকে শস্যশ্যামলা করা এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা করার কামনা প্রকাশ পেয়েছে। এই ব্রতের কামনা একান্তভাবেই ঐহিক জীবনের সুখ ও সম্পদ লাভের কামনা, রাজরানী হবার কামনা।"

পৃথিবী ব্রত পালনের তিনটি পর্যায় আছে। সেগুলি হল -- আহরণ, ক্রিয়া এবং ছড়া। প্রথম পর্যায়ে প্রয়োজনীয় উপকরণ হিসেবে লাগে আতপচালের পিটুলিগোলা, ছোট শাঁখ, মধু, দুধ এবং গাওয়া ঘি। দ্বিতীয় পর্যায়ে মাটির উপর পরিষ্কার করে পিটুলি বা চাল গুঁড়ি দিয়ে পদ্মপাতা, পৃথিবী ও ধরিত্রীর আল্পনা আঁকা হয়। এই আল্পনা আঁকার ক্ষেত্রে একটু অভিনব উপচার লক্ষ্য করা যায়। পিটুলি দিয়ে মাটিতে আঁকতে হয় পদ্মের একটি ঝাড়। সেই পদ্মের মাঝখানে থাকবে একটি প্রস্ফুটিত পদ্ম। সেই ফোটা শতদল পদ্মের উপরে আঁকা থাকবে পৃথিবী। ঠিক যেন পৃথিবীকেই বসানো হয়েছে শতদলের উপর। এরপর শেষ তথা তৃতীয় পর্যায়ে পূজোর সময় শাঁখের মধ্যে ঘি, দুধ ও মধু ঢেলে আঁকা আল্পনার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে, তিনবার পূজার মন্ত্র পড়ে আল্পনার ওপর ঢেলে দিতে হয়। আল্পনার সন্মুখে পূর্বমুখী অথবা উত্তরমুখী হয়ে হাঁটু মুড়ে বসে মন্ত্র পড়তে হয়। 
"এসো পৃথিবী বসো পদ্মে,
শঙ্খচক্র ধরি হস্তে।
খাওয়াব ক্ষীর মাখন ননী, 
আমি যেন হই রাজার রানি।।"
ড. শীলা বসাক এই মন্ত্রের সামান্য কিছু ভিন্নতর রূপ দিয়েছেন -- 
"এসো পৃথিবী, বসো পদ্মপাতে। 
শঙ্খচক্র ধরি হাতে৷৷
খাওয়াবো ক্ষীর মাখাবো ননী। 
আমি হই যেন রাজার রানী।।"
এবার ঐ আল্পনার উপর ঢেলে দেওয়া হয় সবকিছু। মোট তিনবার মন্ত্র পড়ার পর তিনবার তা ঢালা হয়। কেউ কেউ অবশ্য মধু, দুধ, ঘি'র বদলে ফুল এবং দূর্বা দিয়ে পূজো সারে। এভাবে মোট চার বছর উদযাপন করতে হবে পৃথিবী ব্রত। সবশেষে একটি সোনার পদ্মপাতা তৈরি করতে হবে। আশুতোষ মুখোপাধ্যায় উল্লেখ করেছেন, "পাঁচ বৎসরে আরম্ভ করে নয় বৎসর বয়সে ব্রত উদযাপন করাই প্রশস্ত। তবে এ বিষয়ে খুব বাঁধাবাঁধি নেই। উদযাপনের সময় চাই সোনার পদ্মপাতা। ব্রাক্ষ্মণভোজনের পর দক্ষিণার সঙ্গে ব্রাহ্মণ তা পেয়ে থাকেন। অভাবে দাম ধরে দিতে হয়।"

নিজের পত্নীর প্রতি হিংসা ও নিষ্ঠুরতা হল পৃথিবী ব্রতের ব্রতকথার মূল সুর। পাশবিক নিষ্ঠুরতার এই সুরটিও এখানে লক্ষ্য করা যায়। এখানে পাশবিক নিষ্ঠুরতার প্রকাশ ঘটেছে। আর একটি অভিপ্রায় হল ইন্দ্রজাল। কাহিনীতে ঐন্দ্রজালিক ক্রিয়ার ছবি ভেসে উঠেছে। সেইসাথে মৃতের পুনর্জীবন লাভ হয়েছে। এভাবে ব্রতকথার মাধ্যমে রূপকথার সুর এসেছে সুচারুভাবে। উপরোক্ত বিষয়গুলো সুভাষ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর "পশ্চিম সীমান্তবঙ্গের লোকসাহিত্য (১৯৬৯)" তে ১৭১-১৭৪ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন ব্রত কথার মাধ্যমে। সেটি হলো -- "হরিহরপুরে নরহরি নামে এক বেনে বাস করত। তাঁর দুই স্ত্রী ছিল। বড়র নাম লক্ষ্মী, ছোটর নাম সরস্বতী। সরস্বতীকে বিয়ে করার দু'বছর পরে লক্ষ্মীর একটি ছেলে হলো। সে কারণে নরহরি লক্ষ্মীকে বেশী ভালবাসেন। তাতেই সরস্বতীর রাগ আর হিংসা। কিছুদিন পরে নরহরি সরস্বতীর ব্যবহারে হাড়ে হাড়ে চটে গেল এবং কথা বন্ধ করে দিল। এতে সরস্বতী আরো ক্ষেপে গেল। সে মনে মনে স্থির করলে যেমন করে পারি মা-বেটাকে মেরে ফেলবো। তখন সরস্বতী অন্যপথ ধরলে। লক্ষ্মী আর তার ছেলে গৌরহরিকে খুব যত্ন আত্তি করতে লাগলো। তাই দেখে নরহরি সরস্বতীর সঙ্গে কথাবার্তা আবার কইতে লাগলে। কিছুদিন পরে নরহরি বাণিজ্যে যাবার জন্যে তার সপ্ততরী সাজালো। যাবার সময় তাঁর দুই স্ত্রীকে মিলে মিশে থাকতে বললে আর বিশেষ করে বললে ছেলের যেন অযত্ন না হয়। লক্ষ্মী স্বামীর চরণে প্রণাম করলে। কিন্তু প্রাণটা তাঁর হু হু করে উঠলো। চোখের জলে পৃথিবীর কাছে মানত করে স্বামীকে বাণিজ্যে পাঠালেন।

নরহরি বাণিজ্যে যাবার পর সরস্বতী ছেলেটাকে মেরে ফেলবার সুযোগ খুঁজতে লাগলো। আর ছেলেটার উপর খুব ভালবাসা দেখাতে লাগলো। কাজেই লক্ষ্মী ছেলেকে সরস্বতীর কাছে রেখে, সংসারের কাজকর্ম দেখতো। এইভাবে কিছুদিন যায়। একদিন হঠাৎ ছেলের অসুখ হলো। চিকিৎসা চলতে লাগলো। তবু অসুখ আর সারে না। সরস্বতী নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে ছেলের সেবা করতে লাগলো। পাড়াপড়শী দেখে অবাক। লক্ষ্মী সংসারের কাজ করতে করতে মাঝে মাঝে এসে ছেলেকে দেখে যায়

আর পৃথিবীর কাছে কাতর প্রার্থনা জানায়, 'মা ধরিত্রি, আমার ছেলেকে আরোগ্য করে দাও। আমি আজীবন তোমার পূজা করবো'। দেখতে দেখতে ছেলের জ্বর সেরে গেল। লক্ষ্মী পৃথিবী পূজা করতে বসলো আরও দু'জন মেয়েকে নিয়ে। আর সরস্বতী রইলো ছেলের পথ্য তৈরি করার জন্য। ঠাকুর দালানে পিটুলি গোলা দিয়ে পৃথিবী আঁকলো। পৃথিবীর নীচে পদ্মপাতা আর পদ্মের ঝাড় আঁকলো। পরে একটা শাঁখ নিয়ে তার মধ্যে মধু, গাওয়া ঘি, দুধ ঢেলে পূর্বমুখে পূজায় বসলো। ওদিকে স্বরস্বতী রান্নাঘর থেকে উঁকি মেরে দেখলে লক্ষ্মী পূজায় বসেছে। অমনি পথ্যের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে সরে গিয়ে ছেলেকে খাইয়ে দিলে। ছেলে দু'বার 'মা মা' বলে ঢলে পড়লো। ছেলের কান্না শুনে লক্ষ্মী এসে দেখলো ছেলের দেহ নীল হয়ে গেছে। লক্ষ্মী বুক চাপড়ে কাঁদতে লাগলো। সকলে সান্ত্বনা দিল। অবশেষে সরস্বতী তাঁর এক বিশ্বাসী চাকরকে দিয়ে ছেলেটার মৃতদেহ নদীতে ভাসিয়ে দিতে বলল।
জলে পড়ে মৃতদেহ ডুবলো না। ভাসতে ভাসতে কিছুদূর যেতেই একটা সাধু জল থেকে মড়াটা তুলে আশ্রমে নিয়ে গেল। তারপর একটা গাছের পাতা ছিঁড়ে রস করে সেই মরা ছেলেটার নাকে দিতেই ছেলেটা 'মা মা' বলে কেঁদে উঠলো। সাধু তাঁকে একবাটি গরম দুধ খাইয়ে যত্ন করে আশ্রমে রেখে দিলেন। এদিকে লক্ষ্মী ছেলের শোকে পাগল। আর সরস্বতী সর্বদা চিন্তা করে কি করে তাঁকেও মেরে ফেলবে। একদিন রাত্রে লক্ষ্মী বিছানায় শুয়ে স্বামী পুত্রের কথা ভাবছে। এমন সময় দেখলো তাঁর ঘরের চাল দাউ দাউ করে জ্বলছে। ভয়ে ঘর থেকে সে পালাতে গেল, কিন্তু পারলো না। বাইরে থেকে সরস্বতী পিশাচীর মত হাসতে হাসতে চিৎকার করে উঠলো, 'সতীনের কাঁটা বিদেয় করেছি। এবার সতীনকে পুড়িয়ে মারবো। যাতে না সে স্বামীর ভাগ পেতে পারে।' এমন সময় এক সাধু আবির্ভূত হয়ে সেই আগুনের মধ্যে থেকে লক্ষ্মীকে উদ্ধার করে নিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।

এদিকে সরস্বতী চীৎকার করে পাড়ার লোককে ডাকলো। বললো ঘরে আগুন লেগে গেছে। তখন আগুন নিভিয়ে দেখলো লক্ষ্মী কোথাও নেই। ওদিকে সদাগর নরহরি রাত্রে দুঃস্বপ্ন দেখে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আসতেই সরস্বতী বুক চাপড়ে কেঁদে উঠলো বলল, ‘ছেলে অসুখে মারা গেছে, আর দিদি আগুনে পুড়ে মারা গেছে।' এমন সময় সেই সাধু আবির্ভূত হয়ে বললেন, 'মিথ্যে কথা। তুমি নিজেই ঘরে আগুন দিয়েছ, আর ছেলেকে বিষ খাইয়েছ।' নরহরি বলল, ‘প্রভু আপনি কে?'

সাধু বললেন – 'বৎস, আমি পৃথিবীর পুত্র। তোমার বড় স্ত্রী পুত্র রোগমুক্ত হলে পৃথিবী পূজা করবে বলায় মা পৃথিবী তাঁর উপর সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তাঁরই আজ্ঞায় তোমার স্ত্রী পুত্রকে আমি রক্ষা করেছি।' তখন নরহরি বললে 'প্রভু, কৃপা করে আমার স্ত্রী পুত্রকে ফিরিয়ে দিন। আমি এখনি চণ্ডালীকে পরিত্যাগ করছি।' একথা শুনে সরস্বতী কাঁদতে লাগলো, বললো, 'তুমি আমায় মেরে ফেলো, কিন্তু পরিত্যাগ কোরো না। সাধু বললেন, 'সে কি মা। তোমার মুখে একি কথা, তুমি সতী সাধ্বী। রমণীর শ্রেষ্ঠ ধর্ম স্বামীসেবা। স্বামীই রমণীর পরম গুরু। মন থেকে হিংসা দ্বেষ মুছে পৃথিবীর পূজা কর, তাহলেই মনে বিমল শান্তি ফিরে পাবে।' সাধুর বাক্যে সরস্বতী স্বামীর পায়ে লুটিয়ে পড়লো। এমন সময় লক্ষ্মী ছেলেকে কোলে নিয়ে আবির্ভূত হলো এবং স্বামীকে প্রণাম করলো। আর সাধুও সেই মুহূর্তে কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেলেন। আর সেই দিন থেকে দু’জায়ে পৃথিবী পূজা করে মনের সুখে হিংসা দ্বেষ ভুলে সংসারে বসবাস করতে লাগলো।"


জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇




Post a Comment

0 Comments