জ্বলদর্চি

বিস্মৃতপ্রায় কবি সাধনা মুখোপাধ্যায় /নির্মল বর্মন

বিস্মৃতপ্রায় কবি সাধনা মুখোপাধ্যায়

নির্মল বর্মন 

ভূগোল দিদিমণি, সাংবাদিক ও কবি সাধনা মুখোপাধ্যায় আধুনিক বাংলা কবিতায় রোমান্টিক  ভাবনাকে সুচারুভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন। কবি সাধনা মুখোপাধ্যায় আপন  হৃদয়ে রোমান্টিক কবিতার মালা গেঁথেছেন । এই মালা কখনো মৃদু আবার কখনো তীর্যক। এলাহাবাদে ৬ ডিসেম্বর ১৯৩৪ সালে পৃথিবীর আলো দেখেছিলেন সাধনা মুখোপাধ্যায়। এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূগোলে স্নাতকোত্তর ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.টি পাশ   করেছিলেন। কর্মজীবন শুরু হয়েছিল ভূগোল দিদিমণি হিসেবে , বহু বছর  ধরে আনন্দবাজার পত্রিকার সাংবাদিকতা দক্ষতার সঙ্গে সামলেছিলেন। প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর ধরে দেশ পত্রিকা ও নামিদামি পত্রিকায় সাধনা মুখোপাধ্যায়ের কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল। সাধনা মুখোপাধ্যায় স্বামী ছিলেন পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। প্রথম জীবনে বসবাস করতেন রাজধানী শহর দিল্লিতে, পরে পরবর্তীকালে কলকাতাতেই ফিরে এসে সুখে জীবন যাপন করেছিলেন । লেখালেখির জন্য "প্রতিশ্রুতি" পুরস্কারও পেয়েছিলেন , অজস্র সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। রান্নাকে ঘরকন্না থেকে বের করে নিয়ে সাহিত্যের আঙিনায় পৌঁছাতে পেরেছিলেন সাধনা মুখোপাধ্যায়। এ হেন  কবির প্রয়াণ ঘটে ৬ই সেপ্টেম্বর ২০২০।


জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇
৮৬ বছর বয়সে প্রয়াত হন "দিদিমণি" ছদ্মনামে অনেক আধুনিক ভাবনার উপাদেয় তথ্য যিনি পরিবেশন করেছেন,তিনিই সাধনা মুখোপাধ্যায়।। এ প্রসঙ্গে স্মরণযোগ্য "মণি" ছদ্মনামের আড়ালে আধুনিক শাশ্বত ভাবনার উপাদেয় কবি রেবা সরকার মহোদয়ার মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য ---
"আমি কলকাতায় আসার পর ভূগোল দিদিমণি , সাংবাদিক ও কবি সাধনা মুখোপাধ্যায়ের  মুখোমুখি হয়েছি। অসাধারণ তেজস্ক্রিয়া সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব, সুন্দর সুরেলা ও সুললিত বাংলায় উপাদেয় কথাবার্তা। মুখ দিয়ে কবিতার কোলাজ অনব্রত ঝরছে। তাঁর প্রয়াণে শোকাহত। তাঁর পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছিলাম। কবির মৃত্যু হয় না, কবিতায় কবির ছকভাঙ্গা জীবন চলমান থাকে।"
কবি সাধনা মুখোপাধ্যায়ের কবিতায় স্পর্ধাবর্ণের জীবন নিষিক্ত ব্যাজস্তুতি প্রতিফলন, কালচেতনায় পীড়িত সময়ের আয়ুষ তাঁর কবিতার ভাবনা ।  কবি সাধনার  কবিতার ভেতরে স্থানুকে ভেঙে জঙ্গমতার দিকে ছুটে যাওয়ার স্বর । মনোমুগ্ধকর মানসিকতায় ভরপুর কবির কবিতা। কবির কথায়-----
" চিরায়ত  গোলাপের অমরতা আমি তো চাইনি"।
বলা সত্ত্বেও কবি লিখেছেন------
"রোদ্দুর পোহাতে শুধু বেঁচে থাকি বার্ধক্যের শীতে"।
আধুনিক সমালোচক প্রণবেন্দু দাসগুপ্ত ,কবি  সাধনা'র কবিতা প্রসঙ্গে মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য--------
"আমি যতটা পালটেছি, আমার কবিতাও ততটা বদলাবে ।আমি এক জায়গায় দাঁড়িয়ে নেই, আবার সমস্ত ভাঙচুর ,সমস্ত পরিবর্তনের আচ্ছন্ন আছে একটি যুগসূত্রঃ আমার চরিত্রের ভ্রূন"।           (কবিতা প্রসঙ্গ)
কবি সাধনা মুখোপাধ্যায় ভূগোল ম্যাম ছিলেন, সুতরাং ভূগোল প্রীতি থাকা  সত্ত্বেও "বাংলা ভাষা ও সাহিত্য" নিয়ে রীতিমতো চর্চা করে গেছেন , এ প্রসঙ্গে কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সরস মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য----+-
"কবিকে সত্যদ্রষ্টা বলাটা হয়তো বাড়াবাড়ি কবিতা লিখে সমাজ পরিবর্তনের চিন্তাও অবাস্তব। কেউ মানুক বা না মানুক কবিকে এই বিশুদ্ধকরণের কথা বলে যেতেই হবে"
                ( নতুন করে দেখা)
কবি সাধনা মুখোপাধ্যায় উজ্জ্বল কাব্যগ্রন্থ গুলি হল  --+ "আকাশ কন্যা" ১৯৫৯ , "তুমি আর আমি" ১৯৬৫ ; "দোপাটির ইচ্ছে" ১৯৭০; " কুন্দকদলী কৃষ্ণচূড়া" ১৯৭১ ; "একদা রাজধানী" ১৯৭১; " প্রত্যুষের ফুল" ১৯৭৪ ; "রমণী গোলাপ" ১৯৭৫ ; "ছুঁইমুই লজ্জাবতী", "ক্যাপ্টেনের স্ত্রীর রবীন্দ্র সংগীত" ও "চাঁপার সিন্দুক" ১৯৯০ প্রভৃতি।
এছাড়াও রান্নার জগতের প্রিয়ভাজন হয়েছিলেন কয়েকটি রান্নার বইয়ের মাধ্যমে। রান্না যে জনপ্রিয় সাহিত্য হয়ে উঠতে পারে তা তিনি দেখিয়েছেন বিভিন্ন রান্নার পদের মাধ্যমে । তাঁর কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বই হলো----
"রান্না করে দেখুন" ১৯৯৮;  "উত্তরবঙ্গের চলতি রান্নাবান্না "২০০০ ; "৭৫১ রকম রান্না ও জলখাবার" , "সাত রাজ্যের রান্না"১৯৮৮;  "মুরগির মাটন "১৯৮৪; "বাচ্চাদের টিফিন"১৯৮৮, আরও উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ আছে।

কবি সাধনা মুখোপাধ্যায়ের "পরজন্ম" কবিতায় ঘরোয়া জীবনের সুখ, শান্তি, স্বাদ আহ্লাদের মানচিত্র ও প্রেক্ষাপট পরিষ্কারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন , দৃষ্টান্ত স্বরূপ---
"তখন খিড়কি পুকুরের ধারে
রিঠে দিয়ে মাথা ঘষতে ঘষতে
মেয়ে -- ঝি রা স্নান করত
কলকাতায় বাসা ভাড়া নিয়ে থাকা
স্বামীর গল্প করত  বউটি
----------------++------------
তেরো বছরের বিধবা বালিকাটি
সুখ স্বপ্ন দেখত
পরজন্মে আমার যেন অমন একটা
সোয়ামি ভাগ্য হয়
পাই যেন সাবান তেল আলতা পমেটম
সাত জন্মের রুক্ষ চুল যেন একটু
গন্ধ তেলের স্পর্শ পায়"।
এভাবেই সত্য ও শান্তির পথ মাড়াবেন বলেই শ্বাশত দায় মাথার উপর চেপে বসেছিল , তাই তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার সমাধান পাওয়া গেলেও উন্নত দূরত্বের পরিধির সাথে কবির বোঝাপড়ার ঘাটতি থেকে যায়‌। কবি সাধনা মুখোপাধ্যায় যখন লেখেন কবিতা
"স্থির বিশ্বাস ছিল
যা কিছু হয়েছে লেখা
পুরনো যা কিছু শেখা
হাস্যকর আমরাই এক একদিন ভরে দেব সৃষ্টির
বন্ধ্যতার বুক"।
                        (আমার আলোক তীর্থের বন্ধু্রা)
তবে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কথায় বলতে হয়
"বাংলা কবিতায়  বিমূর্ত ধারা বিশেষ প্রয়োজন ছিল আরো প্রয়োজন ছিল তাকে অতিক্রম করার"। কবি সাধনা মুখোপাধ্যায় বলেছেন----
"আবার ইচ্ছা হয়, লাল হয়ে পড়তে আগুনে"
     কবি সাধনার "দেহ- ফুল" কবিতায় কবির সিদ্ধি ও সীমাবদ্ধতায় নান্দনিক বোধ জাগ্রত হয়েছে, উদাহরণ
"কুঁড়ির ঈসৎ কচি গোলাপি গোলাপি ত্বক
বৃদ্ধ হা-মুখ যার উন্মীলনে
শত শত শতদল সারি
এক - একটি দন্তিকা যার
এক-  একটি পাপড়ি আর---
--------------------

কুঞ্চিত রেশম রোমে গোপনীয় যে কামনা
উত্তেজনা
লিখতে লেখনি কাঁপে
অপাঙ্গের বর্ণনায় ভাষা অকুলনা"।
সাংবাদিক ও কবি সাধনা মুখোপাধ্যায়ের কবিতায় স্বাভাবিকতা ও বস্তুধর্মিতা পাঠকের নজর কাড়ে। যা আধুনিক কবিতার ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।।

আরও পড়ুন 
আত্মহত্যার সপক্ষে / ঋত্বিক ত্রিপাঠী 

Post a Comment

0 Comments