জ্বলদর্চি

রাধাকান্ত চক্রবর্তী (সমাজসেবী, শিক্ষক, সুতাহাটা, হলদিয়া) /ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ৪৯

রাধাকান্ত চক্রবর্তী (সমাজসেবী, শিক্ষক, সুতাহাটা, হলদিয়া) 

ভাস্করব্রত পতি

সজ্ঞান জীবদ্দশায় পিতৃসত্বা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। কিন্তু তাঁর অন্তর বাহির জুড়ে মাতৃসত্বা বিরাজমান। লবন সত্যাগ্রহে যুক্ত মাসি শতদলবাসিনী দেবী এবং জন্মদায়িনী মা সুভাষিণী দেবীর স্নেহাতুর সাহচর্যে বড় হয়েছেন। অনুপ্রাণিত হয়েছেন। নিজের হাতে সূতা কেটে পোশাক পরতেও এঁদের দেখেছেন। ফলে পরবর্তী জীবনে মা মাসিদের জীবনচর্চার ছাপ নিজের জীবনে অঙ্গীভূত করতে পেরেছিলেন। ফলে আমরা পেয়েছি এক আপাদমস্তক সৎ এবং উন্নত চিন্তাধারার মানুষ। 

মায়ের সাথে ছোটবেলায় যিনি মহাত্মা গান্ধী এবং আচার্য বিনোবা ভাবেকে দেখতে গিয়েছিলেন, তিনিই একসময় সুতাহাটা যুব কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতা হয়েছিলেন। সংস্পর্ষে এসেছিলেন কুমার চন্দ্র জানা, বিরাজ মোহন দাস, বিল্বপদ জানা, আভা মাইতি, বটকৃষ্ণ পালদের সাথে। ১৯৪৭ এর ১৫ ই আগস্ট মায়ের সাথে সুতাহাটার কেন্দ্রীয় মিছিলে অংশগ্রহণ করেন। 

আপাত নিরীহ এবং প্রচারবিমুখ এই মানুষটির সাকিন হলদিয়ার উপকন্ঠে সুতাহাটার জুনাটিয়া গ্রামে। কথায় বলে -- "চোর ছ্যাচ্চড় গলাকাটা, তিন নিয়ে সুতাহাটা"! কিন্তু তিনি অর্থাৎ রাধাকান্ত চক্রবর্তী সুতাহাটার সেই আঞ্চলিক কিংবদন্তী পরিচয়ের ভোলবদল করে দিয়েছিলেন নিজস্ব ঘরানার ঘেরাটোপে। 

মা মাসি ছাড়াও আর একজনকে জীবনের সামনে থেকে পেয়েছিলেনপেয়েছিলেন একান্তভাবে। তিনি তাঁর দাদা সূর্যকান্ত চক্রবর্তী। যিনি একসময় ভারত সেবাশ্রম সংঘের সর্বভারতীয় ভলান্টিয়ার্সদের প্রধান পদে আসীন ছিলেন।  ফলে, এইসব মনিমুক্তোদের সাথে ঘেরাটোপে থেকেই শিশুবেলা থেকে কৈশোরের পথে পাড়ি দিয়েছিলেন যিনি, তিনি পরবর্তীতে যে নিত্যনতুন ভাবনা এবং সেইসব ভাবনাকে বাস্তবায়িত করার জারক রসে রাসায়নিক অনুঘটক এবং বিক্রিয়ক হবেন, তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। 

১৩৪৩ বঙ্গাব্দের ২৬ শে আষাঢ় (১৯৩৬ এর ১০ ই জুন) জন্মগ্রহণ করেন। আজও সচল তাঁর মস্তিষ্ক। তাঁর হাত, তাঁর পা এবং তাঁর মানসিক উৎকর্ষতা। স্কুল লাইফে দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্র থাকাকালীন যে ছেলেটি নয় পয়সা খরচ (১৯৪৪ সাল) করে সার্বজনীন লক্ষ্মীপূজা করেছিলেন, তিনি যে পরিনত বয়সে আরও নতুন কিছু করতে পারেন, তা সেদিন কেউ বোঝেনি। কিন্তু বর্তমান মেদিনীপুরবাসীরা আজ জেনেছে। বুঝেছে। উপলব্ধি করতে পেরেছে। তাঁর কর্মকাণ্ডতে অবাক এবং তাজ্জব বনেছে। গর্বিত হয়েছে মেদিনীপুরের মাটি। আর মানুষের মননে তিনি হয়েছেন 'মেদিনীপুরের মানুষ রতন'।

দীর্ঘ ৩৮ বছর শিক্ষকতা করেছেন। পড়িয়েছেন ভূগোল। অথচ আধুনিক ইতিহাস তাঁর পড়ার (MA, B.T.) বিষয় ছিল। ১৯৫৫ তে সাহিত্যিক মৌমাছি একবার এসেছিলেন। তাঁর কাছে কবিতা পাঠ করেন। কিন্তু রক্তে ছিল হাডুডু এবং ফুটবলের নেশাড়ু উদ্দামতা। খেলাধুলায় তিনি ছিলেন অগ্রনী। পাঁচটি বিভিন্ন খেলায় প্রথম হয়ে পেয়েছিলেন "কলেজ ব্লু" সম্মাননা। এই ফুটবলই তাঁর জীবনের গতিপথ পাল্টে দেয়। তমলুক কলেজে তাঁর ফুটবল জীবন সম্প্রসারিত হয়। ১৯৫৯ সালে চতুর্থ বর্ষে পড়াকালীন একটানা ১৫ দিন শুধু ফুটবল গেছেন। কিন্তু কাঁথিতে খেলতে গিয়ে পা ভেঙে ফুটবলকে আলবিদা জানাতে হয়েছিল একরাশ বেদনা বুকের কোটরে রেখে। একসময় বাঁশ কেটে বানানো হকি স্টিক দিয়ে হকি খেলতেও পিছপা হননি। 

তবে থিয়েটার ছিল তাঁর নেশা। কলকাতার বিভিন্ন থিয়েটার হলে থিয়েটার দেখতেন এবং তা অনুসরণ করে গ্রামের বুকে তা কার্যকরী করতেন। ১৯৬২ তে নিজের স্কুলে চালু করেন রবীন্দ্র ভবন। সেখানে নাটকের আন্দোলন প্রসারিত হয়। শুরু করেন নাটক প্রতিযোগিতা। অন্তত ২০০টি নাটকে নির্দেশনা দিয়েছেন। মেবার পতন, রাজ বিদ্রোহী, ঝাঁসির রাণী লক্ষ্মী বাঈ, ক্ষুধা, কানাগলি, ভানু পেলো লটারি, রামের সুমতি ইত্যাদি তাঁর নির্দেশিত নাটক। 

তবে পড়াশোনা এবং নাটকে অভিনয় করাতে ফাঁকিফক্কড়ি তিনি কখনও দেননি। সেসময় ইকোনমিক্সে ৫৯% এবং ইতিহাসে ৫৬% নম্বর পেলেও বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে ইকোনমিক্স নিয়ে ভর্তি হন। তিনি ছিলেন দোরো কৃষ্ণনগর স্কুলের প্রথম ছাত্র এবং প্রথম শিক্ষক। স্কুল জীবন থেকেই সামাজিক কাজের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন মা মাসিদের থেকে লব্ধ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে। বাড়ি বাড়ি মাটির ভাঁড় দিয়ে আসতেন। তাতে জমা পড়ত চাল। মাসের শেষে সেই চাল বিক্রি করে নানা কাজ করতেন।

তাঁর অভিনবত্ব ছিল নানা কর্মকাণ্ডের মধ্যে। ১৯৯৯ তে একটি গ্রামীণ মেলা শুরু করেন। সেখানে খেজুর পাতা দিয়ে ব্যাজ বানিয়ে অতিথিদের দিয়েছিলেন। নিতান্তই সাধারণ জিনিস কে অসাধারণ করতে জুড়ি মেলা ভার। সেখানে প্রথম চালু করেন তৈলাক্ত কলাগাছে আরোহন প্রতিযোগিতা, জোড়া বলদ দৌড়, পাওয়ার টিলার দৌড়, জল ছেঁচা মেশিন দৌড়, জাল ফেলা প্রতিযোগিতা, হাঁটু মুড়ে দৌড় ইত্যাদি। মাটি বহনকারী ঝুড়ি দিয়ে দোলনার প্রচলন তাঁরই মাথা থেকে আসে। এখানেই প্রথম মেদিনীপুরের বুকে পুরুলিয়ার ছৌ নাচ এনে চমকে দিয়েছিলেন সকলকে। জেলায় প্রথম শুরু করেন গণ ভাইফোঁটা এবং গণবিবাহ। পরবর্তীতে তা অন্যত্র চালু হয়। সুতাহাটা সূবর্ণ জয়ন্তী ভবনে ২৭০ জোড়া হিন্দু এবং ৭০ জোড়া মুসলিম নবদম্পতির গণবিবাহ তাঁরই মস্তিষ্ক প্রসূত। 

হুইসেল বাজিয়ে খাওয়া এবং ওঠার প্রচলনও করেন এই 'পাগল' রাধাকান্ত চক্রবর্তী। এমনকি নিজের মেয়ের বিয়ের সময় এই হুইসেল বাজিয়ে অতিথিদের চমকে দিয়েছিলেন। তিনি পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন 'হুইসেল মাস্টার' নামে। কিন্তু সবাই তাঁকে চেনে 'কাশীবাবু' নামেই। 

জেলা ভাগের পর পূর্ব মেদিনীপুর জেলার প্রথম ডিস্ট্রিক্ট স্পোর্টস সেক্রেটারি তাঁকেই করা হয়। হলদিয়া মহকুমা রেফারিজ অ্যাণ্ড আম্পায়ার্স অ্যাসোসিয়েশন গঠন করেন ১৯৮২ সালে। তিনিই ছিলেন প্রথম সম্পাদক। ১৯৭২ এ সুতাহাটা মাধ্যমিক শিক্ষা ও শিক্ষাকর্মী সমিতি গঠন করেন। এখন তিনি সভাপতি। হাডুডু খেলায় প্রথম রেফারি ছিলেন তিনি। ২০০৫ সালে মেদিনীপুর জেলার প্রথম হ্যাণ্ডবল খেলার শুরু করেন। পরবর্তীতে এই টিম আন্তর্জাতিক স্তরে খেলতে গিয়েছিল আফ্রিকাতে। এই দলের সায়নাজ খাতুন এবং পিয়ালী মহাপাত্র হ্যান্ডবলের ভারতীয় দলের প্রতিনিধিত্ব করেছিল। 

সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও তিনি ছাপ রেখেছেন অন্যভাবে। আলাদা গাজনের আয়োজন করে সেখানে ১৩ টি কালীনাচ করানোর বিরল কৃতিত্ব তাঁরই। চালু করেন নন্দনাচ প্রতিযোগিতা। ১৯৮৫ সালে দোরো কৃষ্ণনগরের মাঠে মেদিনীপুরের বুকে দ্বিতীয় কোনো স্থানে (খড়গপুর রামলীলা ময়দানের পর) ৫২ ফুট রাবণ দহনের শুরু করেন। সেখানে লোক হয়েছিল প্রায় তিরিশ হাজার! এরপর ছোটো ছোটো রাবণ দহন শুরু হয় জেলায়। 
১৯৯২ তে অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার সাংবাদিক সম্মেলনে সভাপতি হয়েছিলেন। সেসময় 'গ্রামের ডাক' পত্রিকার সাংবাদিক ছিলেন। এখনও প্রচুর লেখালেখি করেন। ২০১০ এ বরিষ্ঠ নাগরিক মঞ্চ গঠন করেন বর্ষীয়ানদের নিয়ে সুস্থ থাকার অছিলায়। অবসরপ্রাপ্তদের নিয়ে সান্ধ্য আড্ডা পত্রিকা 'সায়াহ্ণে' প্রকাশ করেছেন নিজের হাতেই। এ ধরনের বহুমুখী ভাবনার মানুষ আজ জেলায় বিরলতমই বলা চলে। 

২০০০ সালে গঠন করেন পুরোহিত পর্ষদ। এবছর পুরোহিত সম্মেলনের আয়োজন করে তাক লাগিয়ে দেন।ব্রাম্ভণদের নির্ভুল এবং সুললিত মন্ত্রোচ্চারণের প্রশিক্ষণ দিতে এই উদ্যোগ। ভারতের মধ্যে প্রথম তিনিই শুরু করেন গীতাপাঠের প্রতিযোগিতা। সেইসাথে শুরু করেন লক্ষ্মীচরিত্র পাঠ, ভাগবত পাঠ প্রতিযোগিতাও। 

২০১৭ তে আরেক অভিনব কর্মসূচি গ্রহণ করেন। যা কিনা এই জেলায় নয়, সারা রাজা তথা দেশের মধ্যে প্রথম। ঘুঁটে উৎসব। সুতাহাটা সূবর্ণ জয়ন্তী ভবনে স্রেফ ঘুঁটে দিয়ে ৭৬ রকম ব্যবহার সামগ্রী বানিয়ে সকলকে অবাক করে দিয়েছিলেন। ঘুঁটে নিয়ে লিখেছেন গান। লিখেছেন বই। ঘুঁটে দিয়ে কুন্দ ফুলের মালা, গোলাপ, পদ্মফুল, বিভিন্ন পাতা, জাতকের গল্প, কৃষক বানিয়েছেন। আসলে মূল লক্ষ্য ছিল জীবাশ্ম জ্বালানির প্রাচুর্যতা কমে আসায় প্রাকৃতিক জ্বালানি ব্যবহারের প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ানো। মানুষকে নিত্য নতুন চিন্তাভাবনায় বিগলিত করতে তিনি ছিলেন একমেবাদ্বিতীয়ম।


জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇



Post a Comment

0 Comments