জ্বলদর্চি

মেদিনীপুরের কৃষিবিজ্ঞানী ড. রামচন্দ্র মণ্ডল-এর বর্ণময় জীবনের উত্থান-পতনের রোমহর্ষক কাহিনী/ উপপর্ব — ০৭/পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

বিজ্ঞানের অন্তরালে বিজ্ঞানী — ৭২

এগ্রিকালচারাল রেটুনিং

মেদিনীপুরের কৃষিবিজ্ঞানী ড. রামচন্দ্র মণ্ডল-এর বর্ণময় জীবনের উত্থান-পতনের রোমহর্ষক কাহিনী

উপপর্ব — ০৭

পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

ঝড়-জলের রাত। একটানা বৃষ্টি পড়ছে অঝোরে। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। আকাশে ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকায়। সময় সময় চোখ ধাঁধানো ক্ষণিকের আলো আর বাজ-পড়ার কান ফাটানো শব্দে হৃৎপিণ্ডটা চমকে ওঠে। শালগাছের ঘন সারিতে ঢেকে রয়েছে এলাকা। বেশ লম্বা ও মোটা তার গুড়ি। অন্ধকারে সেগুলো একেকটা ভৌতিক অবয়ব ভেবে হৃদয় সংকুচিত হয়। বৃষ্টিতে ভিজে মোটা গুড়িগুলোর সপসপে চেহারা। বৃষ্টির জল পড়ে আবছা আলোয় বেশ চকচক করছে সেগুলি। বিক্ষিপ্ত ছড়ানো ছিটানো গাছের ভাঙা ডাল আর গাঢ় সবুজ পাতায় লণ্ডভণ্ড স্টেশন চত্বর। ঝাড়গ্রাম রেলওয়ে স্টেশন। স্টেশন তো নয়! যেন জনমানবশূন্য প্রান্তর। ফাঁকা ফাঁকা। খাঁ খাঁ করছে অন্ধকারে। থমথমে পরিবেশ। কেমন যেন ভুতুড়ে জায়গা মনে হয়! একলপ্তে বিদ্যুতের ঝলকানি আর স্টেশনের স্বল্প আলোয় কেমন মায়াবী হয়ে উঠছে এলাকা। রেলগাড়ি থেকে নামা গুটিকয়েক প্যাসেনজার শুধু সম্বল। অধিকাংশই স্থানীয় দেহাতি মানুষজন। প্রত্যেকে বাড়ি ফেরার জন্য উদগ্রীব। অসময়ের বৃষ্টি আটকেছে তাদের ঘরে ফেরার পথ। তাদের চোখে মুখে চিন্তার স্পষ্ট ছাপ। একটানা বৃষ্টির জলে অল্প বিস্তর কাকভেজা সবাই। 

রেলগাড়ি থেকে নামল রাম। অচেনা অজানা জায়গা। প্ল্যাটফর্মের অস্তিত্ব নেই। ট্রেন থেকে নামলে সোজা নিচে লাল মাটির কার্পেট বিছানো ভূমি! অন্ধকারে কাছেপিঠে কোনও স্টেশন ঘর নজরে পড়ে না। একটি মাত্র টিনের শেড সম্বল। বৃষ্টি থেকে বাঁচতে তার নিচে গাদাগাদি সকল প্যাসেনজারের অপেক্ষা। হুইসেল বাজিয়ে দিনের শেষ ট্রেনটি রওনা হয়ে গেল আরও পশ্চিমে। ট্রেন চলে যেতেই আরও ফাঁকা হয়ে গেল স্টেশন চত্বর। ঝাড়গ্রাম শহরে পূর্বপরিচিত কেউ নেই রামের। সম্বল বলতে একখানা চিঠি। কী করবে, কোনদিকে যাবে – সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে হাতের ছাতাটা পাশে রাখল রাম। স্টেশনের দক্ষিণ দিকে একটা সাইকেল দোকান দেখা যায়। টিমটিম আলো জ্বলে। বেশিরভাগ যাত্রী ওদিকে চলে গেল। উত্তর পাশে দূরে কয়েকটি ঝুপড়ি ঘর দেখা যায়। কুপির সামান্য আলোয় দূর থেকে কুঁড়ে ঘরগুলো রঙীন হয়ে ওঠে। স্টেশনের এদিকটা বাছুরডোবা কলোনি। কলোনিতে একজন বৃদ্ধার বাস। কয়েক মিনিটের হাঁটা রাস্তা। তার কুঁড়ে ঘরে হঠাৎ হাজির এক আগন্তুক। বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে। কারণ সঙ্গের ছাতাখানি অন্ধকারে স্টেশন থেকে কখন যে মিসিং হয়ে গেল, কাক-পক্ষীও টের পায়নি। অগত্যা ছাতা বিনে বৃদ্ধার দরজায় উপস্থিত হয় রাম। বৃষ্টির জলে কাকভেজা অপরিচিত অল্পবয়সী একটা ছেলেকে দেখে অবাক হয় বৃদ্ধা। তাঁর কপালের বলিরেখা চিহ্নিত অংশগুলো ঈষৎ কুঞ্চিত। কুপির আলোকে স্পষ্ট প্রতিভাত হয় বৃদ্ধার দোদুল্যমানতা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই বৃদ্ধার হাতে একখান চিরকুট ধরিয়ে দেয় রাম। চিঠিখানা পড়ে খানিক আশ্বস্ত বৃদ্ধা। দিনের আলোর মতো পরিস্কার চিঠির সারমর্ম। পড়াশুনার জন্য বহুদূর থেকে এসেছে এই কিশোর – চিঠির বয়ান বোধগম্য হয় বৃদ্ধার। চিঠিপ্রেরক অনন্তদার কাকা শ্রী মহাদেব প্রামাণিক বৃদ্ধার পূর্ব পরিচিত। তারপর আতিথেয়তার বাঁধ গেল ভেঙে। সহানুভূতি দেখিয়ে তিনি আশ্রয় দিলেন রামকে। যদিও তাঁর নুন আনতে পান্তা ফুরায়। টেনেটুনে কোনো মতে সংসার চলে।
     
ঝাড়গ্রাম বাজারের বাগালবাড়িতে একটি কৃষি কলেজ রয়েছে — বন্ধু মারফৎ খবর পেয়েছিল রাম। ছেলেবেলা থেকেই কৃষি কাজে তার প্রবল ঝোঁক। বিজ্ঞান সম্মত উপায়ে কৃষি বিদ্যা শিক্ষা লাভের আশায় তার ঝাড়গ্রাম আগমন। হয়তো বা তার সে-আশা পূরণ হওয়ার দোরগোড়ায় অপেক্ষমান। বৃদ্ধার কুঁড়ে ঘরে শুয়ে আকাশ কুসুম চিন্তায় আচ্ছন্ন রামের অস্থির মন। 

(২)
এ যে ঘনঘোর বর্ষাকাল! গতকাল রাত থেকে আকাশের মুখ ভার। মাঝে সাজে মেঘের গুড়গুড় ডাক। একটানা ঝিমঝিম বৃষ্টিপাতে একফোঁটা বিরাম নেই। বাছুরডোবা থেকে কলেজের দূরত্ব হাঁটাপথে তিন - চার কিলোমিটার মত রাস্তা। গতকাল অন্ধকার রাতে স্টেশন চত্বর থেকে ছাতা হারানোর টাটকা স্মৃতি এখনও দগদগে ঘায়ের মতো যন্ত্রণার উদ্রেক করে। আসলে বর্ষাকালে ছাতা আর শীতকালে কাঁথা— দুটোই ভীষণ প্রয়োজন। সঠিক সময়ে না মিললে কিংবা হারিয়ে গেলে বড্ড কষ্ট হয়। তায় সকাল সকাল মাথার উপর টিপির টিপির বৃষ্টির ভ্রূকুটি। আচ্ছা জ্বালাতনে পড়া গেল তো! বৃষ্টি কখন থামবে, তার ঠিকানা নেই। এ বৃষ্টি থামার কোনও লক্ষন নেই! বেশি দেরি করা ঠিক হবে না। কলেজে বের হতে হবে। অগত্যা বৃষ্টির তোয়াক্কা না করে পায়ে হেঁটে কৃষি কলেজে ভর্তি হয়ে এল রাম। তারপর রোজকার একই রুটিন। গতানুগতিক সময় পার হয়। বৃদ্ধা মাসিমার হাতের রান্না খেয়ে সময় মতো কলেজে পৌছনো। খুব যত্ন সহকারে খাওয়ান মাসিমা। এদিকে হয়েছে মহা জ্বালা! কলেজে রোজ রোজ লেট! চার কিলোমিটার রাস্তা পায়ে হেঁটে যেতে যেতে প্রায়শই দেরি হয়ে যায় কলেজ পৌঁছতে। এ কথা বৃদ্ধার কানে গেল একদিন। বৃদ্ধা মাসিমার জামাইয়ের সাইকেল রিপেয়ারিং দোকান রয়েছে স্টেশনের পাশে। রোজ অনেক পুরনো সাইকেল সারাতে আসে দোকানে। শাশুড়ির কথায় রামের কলেজ যাতায়াতের জন্য একটি পুরাতন সাইকেলের ব্যবস্থা করলেন জামাই বাবাজি। তাঁর কাছে সাইকেল সারানোর জন্য যে-সাইকেল আসত, তার মধ্যে থেকে একটা দিয়ে দিতেন। সারাদিন ক্লাস শেষ করে কলেজ ফেরত সাইকেল খানি দোকানে রেখে বাড়ি ফিরে আসত রাম। 

একদিন ঘটে গেল মহা বিপত্তি। মারাত্মক ঘটনা! ঘটনা কী? প্রতিদিনের মতো সাইকেল চড়ে কলেজের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে রাম। কিছু দূর যেতে না যেতেই বিগড়ে গেল দ্বিচক্রযান। হঠাৎ সামনের চাকা ছিটকে বেরিয়ে গেল সাইকেল থেকে। অমনি হুড়মুড়িয়ে রাস্তার উপর পড়ে গেল সে। হাতের কনুই, পায়ে আঘাত লাগল। সামান্য ছড়ে যাওয়া জায়গায় হালকা কনকনে ব্যথা। আঘাত আহামরি কিছু নয়, খুব সামান্য। ভাগ্য জোরে এ যাত্রায় বড় বিপদের হাত থেকে রক্ষা পেল সে। যেভাবে সাইকেল থেকে পড়েছিল, তাতে মুখের থোবড়া আস্ত রয়েছে, এ-ই রক্ষে। কষ্টেসৃষ্টে এভাবেই কেটে গেল ১৯৫২ সাল। ওদিকে বৃদ্ধা মাসিমার অবস্থা বেশ সঙ্গীন। বয়সের ভারে ন্যুব্জ। দিনকে দিন একপ্রকার অথর্ব হতে থাকলেন তিনি। তিনি অক্ষম হলে রামের কী হবে? যাবে কোথায়? খাবে কী? আকাশ কুসুম চিন্তা মাথায়। সত্যি সত্যি একদিন অথর্ব হলেন বৃদ্ধা। বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয় রাম। থাকার জায়গা না পেলে এ বিদেশ বিভুঁইয়ে লেখাপড়া চালানো অসম্ভব। এখন উপায়? কথায় আছে — যার কেউ নেই, তার ভগবান আছেন। কলেজের ভেতর আচমকা দেখা হয়ে গেল এক বাল্যবন্ধুর সঙ্গে। ছোট বেলার সহপাঠী দেবীদাস বিশ্বাস কলেজে ছাত্র নেতা হিসেবে বেশ জনপ্রিয়। তার আশ্বাসে বুকে বল পেল রাম। ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক লক্ষ্মণ ঘোষ তখন কলেজের কোয়ার্টারে থাকেন। কোয়ার্টারের সামনে মস্ত বারান্দা। বারান্দায় ছোট্ট একখান ঘর। সে ঘরে রামের থাকার আর্জি নিয়ে প্রিয়‌ অধ্যাপকের দরজায় কড়া নাড়ল দেবীদাস। থাকতে দিতে স্যারও রাজি। থাকার সমস্যা তো মিটল। থাকার মতো যুতসই ঘর পাওয়া গেল। কিন্তু খাওয়া দাওয়া? একটার পর একটা সমস্যা এসে হাজির। আহারের ব্যবস্থাপনা অসম্ভব ঠেকল। আসলে টাকা পয়সা দিয়ে মেসে মিল খাওয়ার মতো সচ্ছলতা তার নেই। তাহলে উপায় কী? 
 ‌       
এক অভূতপূর্ব উপায় বের হল। আইডিয়াটা বেশ অভিনব। কলেজের কাছে গোটা সাত-আটেক ছাত্র মেস করে থাকে। মেসের ছাত্ররা অধিকাংশই জুনিয়র। দেবীদাসকে 'দেবীদা' সম্বোধনে ডাকে মেসের সকলে। তাকে খানিক মান্যি গন্যি করে সবাই। তার কথা শোনে। একদিন মেসে হঠাৎ হাজির দেবীদাস। ভাতৃপ্রতিম মেসের ব্লগারদের সে সবিশেষ জানাল— 
'তোমরা খেতে বসে প্রত্যেকে এক মুঠো করে ভাত এবং কিঞ্চিৎ সবজি রামের থালায় তুলে দেবে। ওর দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষা না হওয়া পর্যন্ত।'

বিপদে পড়লে প্রকৃত বন্ধুত্বের জাত চেনায়। অসময়ের বন্ধুই আসল বন্ধু। জীবন গড়ার সুলুক সন্ধান। সে-যাত্রায় থাকা খাওয়ার একটা হিল্লে হল।দেবীদাস সকলের চোখে কেন আপন, একটি ঘটনা তার জলজ্যান্ত প্রমাণ। কৈশোর যৌবনের সন্ধিক্ষণ জীবনের এক সোনাঝরা বিকেলের মতো। নূতন নূতন ভাবনার উদ্রেক ঘটায়। আপাত অসম্ভব কাজও চুটকিতে উৎরে যায়। এসময়কার উদ্দীপনা চোখে পড়ার মতো। দেহ-মনে আলাদা শিহরণ খেলে। হেন কোনও কাজ নেই, যা যুবা ছাত্ররা পারে না। ঝাড়গ্রাম এলাকার উত্তর দিকে রুক্ষসুক্ষ লালমাটিতে গড়ে উঠেছিল এক উদ্বাস্তু কলোনি। বাছুরডোবা উদ্বাস্তু কলোনি। অধিকাংশ ভিনদেশী মানুষের বাস। দেশভাগ পরবর্তী সময়ে তাদের এদেশে আগমন। এ হেন কলোনিতে একখান গ্রামীণ লাইব্রেরী গড়ে উঠলে কেমন হয়? পরিকল্পনার উদ্যোক্তা দেবীদাস, রনেন সেন এবং আরও অনেকে। যেমনি ভাবা, তেমনি কাজ। তবে ভাবনার বহিঃপ্রকাশের সঠিক রূপরেখা তৈরি আর তার বাস্তব প্রয়োগের মধ্যে বিস্তর ফারাক। চাই কঠিন পরিশ্রম, সীমাহীন ধৈর্য আর উচ্চাকাঙ্ক্ষী মন। ছক মোটামুটি কষা। শুরু হল পাঠাগারে বই জোগাড়ের অভিনব প্রক্রিয়া। কলোনির প্রতিটি বাড়িতে একটি করে মাটির ছোট্ট পাত্র রাখা হল। গৃহস্থকে বলা হল রোজ দুবেলা এক মুঠো করে চাল, মুঠোর সাউজ মুঠি ভিক্ষার মতো, ওই পাত্রে তুলে রাখতে। পাত্রের আকার এমন ছিল যে মাসের শেষে মাটির পাত্র চালে ভরে যেত। ছাত্র যুব গোষ্ঠী সংগৃহীত সে-চাল বিক্রি করে বই কেনার প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করত। এক বছর পর মিশন সাকসেসফুল। বাছুরডোবা কলোনির প্রতিটি পরিবারের সহৃদয়তায় গড়ে উঠেছিল আকারে ছোট একটি গ্রামীণ লাইব্রেরী।

সেটা ১৯৫২-৫৫ সাল। দুবছরের ইন্টারমিডিয়েট কোর্স আপাতত সমাপ্ত। বিজ্ঞানে (এগ্রিকালচার) আইএসসি (I. Sc. in Agriculture) পাস করল রাম। তার উচ্চাকাঙ্ক্ষী মন আর সন্ধানী দৃষ্টি এবার কৃষিতে গ্র্যাজুয়েশন লক্ষ্যে স্থির। ঝাড়গ্রামে তার সুবন্দোবস্ত আছে। কিন্তু সমস্যা ভিন্ন!

(৩)
ঝাড়গ্রাম কৃষি কলেজের প্রিন্সিপাল তখন ড. পি. কে. সেন। খ্যাত-নামা প্রফেসর। এবং পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন ডা. বিধানচন্দ্র রায়। কৃষি মহাবিদ্যালয় কোথায় তৈরি হবে – এ নিয়ে একপ্রস্থ ঝামেলায় জড়িয়ে গেলেন দুজনে। মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য – কৃষিতে গ্র্যাজুয়েশন করতে হলে কলিকাতা কিংবা তার সন্নিকটবর্তী স্থানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থাকা আশু প্রয়োজন, ঝাড়গ্রামের মতো পিছিয়ে পড়া প্রত্যন্ত অঞ্চলে নয়। এর বিরুদ্ধ মত পোষণ করতেন ড. পি. কে. সেন। তবুও আটকানো গেল না। ড. সেনের শত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও কৃষি মহাবিদ্যালয় স্থানান্তরিত হয়ে গেল কলিকাতার অনতিদূরে নদিয়ায়। নদিয়ার কল্যানীতে তখন সদ্য গড়ে উঠেছে এক শিল্পনগরী। সাধের স্বপ্নপুরী। সেখানে গড়ে উঠবে স্বপ্নের কৃষি মহাবিদ্যালয়। কলেজ নদিয়ায় স্থানান্তরিত হল ঠিকই, কিন্তু সেখানে চরম অব্যবস্থা। পরিকাঠামোর নামগন্ধ নেই। পরিকল্পনা বিশ বাঁও জলে। পরিসেবা তথৈবচ। কলেজের উপযুক্ত পরিকাঠামো রূপায়ণে আরও কিছু সময় দরকার। অগত্যা তড়িঘড়ি কলিকাতার টালিগঞ্জে শুরু হল ক্লাস। ফ্রেস গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্ট সিলেক্ট করে চলল প্রথম বর্ষের পড়াশুনা। 
 ‌         
ওদিকে, কলেজের অধ্যক্ষ ড. পি. কে. সেন ছিলেন নামকরা খয়রা অধ্যাপক। হাত পা গুটিয়ে স্থির বসে থাকার পাত্র তিনি নন। দেশের বিভিন্ন প্রথিতযশা কৃষি কলেজের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করলেন তিনি। আগ্রা, কানপুর, কাশী, জোড়হাট ইত্যাদি কলেজগুলোর তখন খুব নামডাক। এইসব কলেজগুলোতে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করা স্টুডেন্টদের ভর্তির ব্যাপারে বিশেষ তোড়জোড় করেছিলেন ড. সেন। তাঁর প্রচেষ্টায় ফল মিলল হাতেনাতে। আগ্রার বলবন্ত রাজপুত কলেজে বিএসসি এগ্রিকালচারে (B.Sc. (Ag)) ভর্তির সুযোগ পেল রাম। এ হেন সংবাদে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার উপক্রম! দূরদেশে পড়তে যাওয়ার বিস্তর খরচাপাতি। পিতা প্রহ্লাদবাবু প্রায় নিঃস্ব। অথচ, উচ্চশিক্ষার প্রতি পুত্রের ষোলআনা আগ্রহ। তীব্র টানাপোড়েন পিতার হৃদয়ে। শেষমেশ অশান্ত মন স্থির করে ফেললেন তিনি।

কশাড়িয়া গ্রামে এক বর্ধিষ্ণু বৃদ্ধ কৃপণের বাস ছিল। অপুত্রক সেই বৃদ্ধের বাড়ি রামকে সঙ্গে নিয়ে গেলেন প্রহ্লাদবাবু। উদ্দেশ্য ছিল কিছু টাকাপয়সা ধারদেনা করে ছেলের অভীষ্ট লক্ষ্য পূরণ। ছেলের সাফল্যের ইতিহাস আউড়ে মূল উদ্দেশ্যের কথা ব্যক্ত করলেন প্রহ্লাদবাবু। চাইলেন অর্থ সাহায্য। তৎক্ষণাৎ মিলে গেল সম্মতি।‌ তুফান এক্সপ্রেসের টিকিট কাটা-সহ একগুচ্ছ খরচের জন্য পাঁচশত টাকা ধার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেন বৃদ্ধ। এবার খানিকটা আশ্বস্ত পিতা পুত্র। গন্তব্যে রওনা হবার দিন সব জিনিসপত্র গোছগাছ করে প্রহ্লাদবাবু ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে হাজির হলেন মহাজনের বাড়ি, টাকা আনতে। বাইরে দাঁড়িয়ে ডাক পাড়লেন —
'নীলমণিদা, বাড়ি আছো?'
ক্ষণিকের বিরতি। বিষন্ন মনে ঘরের বাইরে পা রাখলেন বৃদ্ধ। কাঁচুমাচু মুখে তিনি বললেন — 
'টাকাটা এখনও জোগাড় করতে পারিনি।'
কান্নায় ভেঙে পড়ল রাম। প্রহ্লাদবাবুর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। তিনি পাথর বনে গেলেন। তারপর শক্ত করলেন নিজের মন। ছেলের চোখ মুছিয়ে দিয়ে বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে। ফিরতে ফিরতে জড়ানো গলায় রাম বাবাকে প্রশ্ন করে —
'আমার সব আশা ও চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গেল।'
'চল, এগিয়ে চলি। কোথাও কিছু করে উঠতে পারি কিনা'— চোয়াল শক্ত করে বাবার প্রত্যুত্তর।
রসুলপুর ঘাট অভিমুখে এগিয়ে চলল দুজনে। মাঝে অজানবাড়ি গ্রাম। গ্রামের শেষ প্রান্তে গৌরহরি পাত্রের বাড়ি। পেশায় চাল ব্যবসায়ী। শ্রমজীবী। অত্যন্ত সৎ ব্যক্তি। তাঁর দুই ছেলে। একজন ডাক্তার। অপরজন ইঞ্জিনিয়ার। চালের ব্যবসা সম্বল করে দুজন ছেলেকে মানুষের মতো মানুষ করে তুলেছেন তিনি। গৌরবাবুর নিকট সব কথা খুলে বললেন প্রহ্লাদবাবু। উদ্বিগ্ন গৌরবাবু সাহায্যের আশ্বাস দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে প্রহ্লাদবাবুর হাতে যথেচ্ছ অর্থ তুলে দিয়ে বলেছিলেন — 'ছেলেকে পড়িয়ে মানুষ কর।' বাবা ছেলের চোখ গড়িয়ে অশ্রু ঝরে। আনন্দাশ্রু।

সময় বেশি নেই। এক্ষুনি রওনা হতে হবে স্টেশনের উদ্দেশ্যে। পা চালিয়ে হাঁটছে পিতা পুত্র; পাছে ট্রেন মিস না করে ফেলে রাম। রসুলপুর ঘাট পেরিয়ে শুরু হল রামের একক যাত্রা। গন্তব্য সূদূর আগ্রা উত্তরপ্রদেশ। বাবাকে প্রণাম করে অচেনা দূর দেশে পাড়ি জমায় সে। ব্যাগপত্তর সমেত রেলস্টেশনে পৌঁছে সে দেখে রেলগাড়ি আসতে তখনও দেরি আছে। স্টেশনে আচমকা দেখা হয়ে গেল কল্যান সেনগুপ্ত এবং আরও অনেকের সঙ্গে। আলাপ হল। সকলে তুফান এক্সপ্রেসের তার সহযাত্রী। স্টেশনে ট্রেন আসার খবর ঘোষণা হল। ট্রেনে উঠে বসল রাম। রিজার্ভেশন নেই। হুইসেল বাজিয়ে খড়গপুর স্টেশন ছাড়ল তুফান এক্সপ্রেস। (ক্রমশ...)

তথ্য সূত্র :
• প্রণম্য বৈজ্ঞানিক ড. রামচন্দ্র মণ্ডল মহাশয়
• শ্রী সুদর্শন সেন বিশিষ্ট শিক্ষক ও আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক
• 'মনীষী ড. রামচন্দ্র মণ্ডল' – সম্পাদনা শ্রী জয়দেব মাইতি ও শ্রী সুব্রতকুমার মাঝি



জ্বলদর্চি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন। 👇


Post a Comment

0 Comments