জ্বলদর্চি

সবুজ দ্বীপ আন্দামান/প্রথম পর্ব/দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী


সবুজ দ্বীপ আন্দামান                      
প্রথম পর্ব    

দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী


আন্দামান বলতে চোখের সামনে ভেসে উঠে আদিগন্ত নীল সমুদ্রের মাঝে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দ্বীপ, নারকেল গাছের সারি, ছোট ছোট পাহাড়, রক্তিম বর্ণের পত্রে শোভিত পেমা গাছের সারি, গভীর জঙ্গলে আকাশচুম্বী গাছের সারিবদ্ধ অবস্থান এবং জঙ্গলের গভীরে বা উপান্তে হিংস্র, উলঙ্গ, আদিম অধিবাসী জারোয়া, ওঙ্গী ও সেন্টিনেলিজ। বহুদিনের ইচ্ছে ছিল সময় ও সুযোগ পেলে সেই রূপকথার জগৎ আন্দামান দেখে আসার। ইতিপূর্বে সেলুলয়েডের পর্দায় 'সবুজ দ্বীপের রাজা' নামের সিনেমাটি দেখার পরে আন্দামানের আদিম অধিবাসী জারোয়া ও দ্বীপের সৌন্দর্য দেখে আন্দামানের প্রতি আকর্ষণ বেড়ে যায়। অবশেষে ২০১৭ সালের মার্চ মাসের ১৪ তারিখে 'ভিস্তারা এয়ারলাইন্সের' ইকোনমি শ্রেণীর দুটি আসনে আমরা দুজন অর্থাৎ আমি ও আমার ভ্রমণ সঙ্গী সুমিতা (আমার স্ত্রী) নীল সাগরের বুকে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের একমাত্র বিমান বন্দর পোর্ট ব্লেয়ারের বীর সাভারকার বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে কলকাতার নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু বিমানবন্দর থেকে সকাল দশটা পাঁচের বিমানে যাত্রা শুরু হলো। বিমানে বসে চোখ বন্ধ অবস্থায় ভাবছি সৃষ্টিকর্তার সৃষ্ট সবুজদ্বীপ আন্দামানের সৃষ্টি কিভাবে হলো। চোখ বন্ধ অবস্থায় ছবি গুলি পরপর চোখের পর্দায় ভেসে উঠলো আন্দামানের ক্রমবিবর্তনের রূপ।       
                  
ভূপৃষ্ঠের ইন্ডিয়ান প্লেট এবং বার্মা মাইনর প্লেটের (ইউরেশিয়া প্লেটের অংশবিশেষ) ঘর্ষণে দ্বীপপুঞ্জের উদ্ভব হয়েছিল ঠিক যেমনভাবে হিমালয় পর্বতমালার উদ্ভব হয়েছিল। আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ মায়ানমারের আরাকান পর্বতমালার দক্ষিণাংশের একটি শাখা। আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ চারটি অংশে বিভক্ত - উত্তর, মধ্য, দক্ষিণ এবং লিটল আন্দামান। ডানকান প্যাসেজ লিটল আন্দামান ও দক্ষিণ আন্দামানকে বিভক্ত করেছে। নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের গ্রেট নিকোবর সর্ববৃহৎ দ্বীপ এবং গ্রেট নিকোবর দ্বীপ ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপের সন্নিকটে। আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের একমাত্র জীবন্ত আগ্নেয়গিরি ব্যারেন দ্বীপ। বেশিরভাগ দ্বীপ টারশিয়ারি স্যান্ড স্টোন, লাইমস্টোন এবং শেল দ্বারা গঠিত অর্থাৎ বালি পাথর, চুনা পাথর এবং শ্লেট জাতীয় নরম শিলা দ্বারা গঠিত। আদিম অধিবাসী জারোয়া, ওঙ্গি সেন্টিনেলিজ এবং গ্রেট আন্দামানীজদের বাসভূমি। এছাড়াও উপনিবেশ স্থাপনের পরে বাঙালি অধিবাসীর সংখ্যাই বেশী যারা দেশভাগের পরে পূর্ব পাকিস্তান থেকে বিতাড়িত হয়ে এখানে এসেছিলেন। দ্বীপ গুলির মধ্যে উত্তর সেন্টিনেল দ্বীপ সেন্টিনেলিজদের বাসভূমি। এখানে কোন পর্যটককে যেতে দেওয়া হয় না কারণ সেন্টিনেলিজরা বাইরের কোন লোককে দেখলে তীরের ফলার আঘাতে সম্ভাষণ করে। বিশেষজ্ঞদের মতে কোন একসময়ে ব্রম্ভ দেশের আরাকান পর্বতমালা, মালয় উপদ্বীপ ও ইন্দোনেশিয়ার সাথে আন্দামান যুক্ত ছিল। পরে জলোচ্ছ্বাসের ফলে ভূমিখন্ডের অনেকাংশ জলের তলায় চলে যায় এবং যে অংশ জলের উপরে থাকে তা বর্তমানের আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ নামে পরিচিত। সর্বশেষ তুষার যুগের শেষে আজ থেকে ৪০ হাজার বৎসর পূর্বে সমুদ্রের জল স্তর ১০০ থেকে ১২০ ফুট বৃদ্ধি পেয়েছিল। এই জলোচ্ছ্বাসের ফলে মূল ভূখন্ড থেকে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। বিশেষজ্ঞদের মতে গন্ডোয়ানা মহাদেশ ভেঙে টুকরো হয়ে যাওয়ার পরেও বহু যুগ পর্যন্ত বিভিন্ন অংশের মধ্যে যোগাযোগ ছিল। ভূতত্ত্ববিদদের দৃঢ় অভিমত ৪০ হাজার বৎসর পূর্বে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১০০ থেকে ১২০ কম থাকায় আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ মালয় উপদ্বীপ হয়ে ইন্দোনেশিয়া বা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাথে যুক্ত ছিল। ভূপৃষ্ঠের এই পরিবর্তন লক্ষ্য করে অনেক বিশেষজ্ঞদের অভিমত আদিম মানবের দল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে আসার পরে মালয় বা ইন্দোনেশিয়া হয়ে পদব্রজে ৪০ হাজার বৎসর পূর্বে আন্দামান এসেছিল। আবার অনেকের মতে ব্রহ্মদেশ হয়ে তারা আন্দামানে প্রবেশ করে। পরবর্তীকালে সমুদ্রের জলোচ্ছ্বাসের ফলে সেই পথ সমুদ্রগর্ভে নিমজ্জিত হয়ে যায়।       
            
জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করে নিন।👇
স্ত্রীর ডাকে চিন্তা শক্তি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। চোখ মেলে দেখি আমাদের বিমান পোর্টব্লেয়ারের একমাত্র বিমান বন্দর বীর সাভারকরের মাটি স্পর্শ করে দাঁড়িয়ে আছে। বিমান বন্দর থেকে লাগেজ নিয়ে একটি ট্যাক্সি করে আমাদের গন্তব্য স্থল এ্যবারডীন বাজারের কেন্দ্রস্থলে 'Jaimathi in Blair' হোটেলে পৌঁছে আমাদের বুকিংয়ের চিঠি দেখাতে দোতালার একটি ঘরে থাকার ব্যবস্থা হল। এখানে একদিন থেকে পরের দিনে আমরা স্থান পরিবর্তন করে রাজীব গান্ধী নগরে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের সাংবিধানিক প্রশাসকের আবাসস্থলের সন্নিকটে ভারতীয় স্টেট ব্যাংকের অবকাশ গৃহে যাব। আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ ভালোভাবে ধীরেসুস্থে ঘুরে আমাদের ফিরতি যাত্রার তারিখ ২৮ শে মার্চ অর্থাৎ আন্দামানে আমাদের অবস্থিতি দীর্ঘ ১৪ দিন। ভ্রমণ শুরু করার পূর্বে আন্দামানের অতীত ইতিহাস এবং বিস্তৃত বিবরণ উল্লেখ করছি।         
সমুদ্রে ঘেরা মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় থাকা আন্দামানের যোগাযোগ ব্যবস্থার সাথে প্রথমে পরিচয় হওয়া দরকার। আন্দামান যেহেতু মূল ভূখন্ড থেকে সমুদ্রের মধ্যস্থলে অবস্থিত সেজন্য স্থলপথ এর সাথে যোগাযোগের কোন প্রশ্নই নেই। একমাত্র নৌপথে এবং আকাশপথে আন্দামানের সাথে যোগাযোগ। পোর্ট ব্লেয়ারের বীর সাভারকার বিমানবন্দরের সাথে চেন্নাই, ভাইজাগ, কলকাতা, নতুন দিল্লি এবং বেঙ্গালুরুর সাথে প্রত্যহ বিমান পথে যোগাযোগ আছে। ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্স, গো-এয়ার, ইন্ডিগো, ভিস্তারা ও স্পাইস জেট বিমান কোম্পানির নিয়মিত যাতায়াত ব্যবস্থা আছে। এছাড়াও কলকাতার খিদিরপুর জেটি থেকে দু-তিনটি জাহাজ প্রতি মাসে দুবার যাতায়াত করে।  চেন্নাই ও ভাইজাগ থেকে জলপথে পোর্ট ব্লেয়ারের চাত্থাম জেটি পর্যন্ত যোগাযোগ আছে। আন্দামানের উত্তরাংশে দিগলিপুরে বিমানবাহিনীর এক হাজার মিটার লম্বা একটি ছোট বিমানবন্দর আছে যেখানে বিমান বাহিনী বা নৌ বাহিনীর বিমান গুলি প্রতিরক্ষার কাজে ব্যবহৃত হয়। পোর্ট ব্লেয়ারের সাথে স্থলপথে আন্দামান ট্রাঙ্ক রোডের সাহায্যে মায়া বন্দর, রঙ্গত, দিগলিপুরের সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থা আছে।      
   
আন্দামানের ভৌগোলিক অবস্থান - ১৯৪৩ সালের ৩০শে ডিসেম্বর নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু পোর্ট ব্লেয়ারে ভারতের ত্রিবর্ণ রঞ্জিত পতাকা উত্তোলন করে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের নাম পরিবর্তন করে শহীদ ও স্বরাজ দ্বীপ রাখেন। আন্দামানে প্রবেশ করে বাংলা মায়ের সেই দামাল ছেলে মৃত্যুঞ্জয়ী বীরের কথা মনে পড়ে গেল। মূল ভারত ভূখণ্ডের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে বঙ্গোপসাগর ও আন্দামান উপসাগরের কেন্দ্রস্থলে ৫৭২টি ছোট বড় দ্বীপের এক সমাহার। আন্দামান ও নিকোবর দুটি পৃথক দ্বীপপুঞ্জের সমষ্টি ১৫০ কিলোমিটার চওড়া উত্তর-দক্ষিনে বিস্তৃত এবং পূর্ব-পশ্চিমে দশ কিলোমিটার বিস্তৃত 'টেন ডিগ্রী চ্যানেল' দ্বারা বিভক্ত। চ্যানেলের পূর্বদিকে আন্দামান উপসাগর এবং পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর ৫৭২ টি ছোট বড় দ্বীপের মধ্যে মাত্র ৩৮ টি দ্বীপে জনবসতি আছে। আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের মোট আয়তন ৮২৪৯ বর্গ কিলোমিটার। আন্দামানের সর্ব উত্তরে কোকো দ্বীপ এবং প্রিপারিস দ্বীপ মায়ানমারের অধীনে। যে দশ ডিগ্রি চ্যানেল আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জকে বিভক্ত করেছে সেই টেন ডিগ্রি চ্যানেল উত্তর-দক্ষিণে ১৫০ কিলোমিটার এবং পূর্ব-পশ্চিমে ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ। এখানে জলের গভীরতা ৭.৩ মিটার। বিষুবরেখার ১০ ডিগ্রি উত্তর অক্ষাংশে অবস্থানের জন্য দশ ডিগ্রি চ্যানেল বা টেন ডিগ্রি চ্যানেল নামে অভিহিত করা হয়।   
 
  (পরবর্তী অংশ দ্বিতীয় পর্বে)

জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করুন। 👇

Post a Comment

0 Comments